ভিনদেশি_তারা পর্ব-২

0
3202

ভিনদেশি_তারা
পর্ব-২
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

২.
‘ আমি তোকে আজ রাতে চাই-ই। আর আমাকে কি খাইয়েছিস তুই? কি.. কি ক খাইয়ে!’

বলতে বলতে ঘুমে ঢলে পড়লো নিঝুম। আমি আর দেরি করলাম না। হ্যান্ডব্যাগে ঘুমের ঔষধটা ঢুকিয়ে নিলাম। ব্যাগে সবসময় আমার মাথাব্যথা বা পেটব্যথার ট্যাবলেট থাকে, সেটাই আজ কাজে দিলো। আমি নিঝুমের বুক পকেটে রাখা দরজার চাবিটা সাবধানে নিলাম। আস্তে আস্তে, খুব সাবধানে বেড়িয়ে এলাম বাড়িটা থেকে। কাউকে চোখে পড়লো না আশেপাশে। রাস্তাঘাট নির্জন, সম্ভবত মিরপুরের দিকে এটা। হাঁটতে হাঁটতে আমি রাস্তায় উঠে এলাম একসময়। বুক ধুকপুক করছে। ব্যাগ চেক করে দেখলাম মোবাইলটা নেই। আমার হাতে ছিলো ফোনটা, নিশ্চিত নিঝুমের সাথে ধস্তাধস্তি করার সময় হাত থেকে পড়ে গিয়েছে। কি এক মহাবিপদে পড়লাম।

রাস্তায় একটা ট্রাফিক পুলিশকে দেখতে পেয়ে সেখানে গেলাম। ওনার থেকে চেয়ে মোবাইলটা নিয়ে কল করলাম বাসায়। আব্বু ফোন রিসিভ করলে আমি সবটা ঘটনা খুলে বলি! এতে আব্বু বেশ রেগে যায়। তারপর আমাকে ওখানেই থাকতে বলে, একসময় আব্বু আর চাচ্চু এসে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যায়। বাসায় গিয়ে দেখি সবার কি কান্নাকাটি! কারণ নিঝুম ফোন করে হুমকি দিয়েছে, আমাকে মেরেও ফেলতে পারে। আমার উপর নজর রাখবে ও। আমি বুঝলাম না কিভাবে কি হলো! কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিলাম, তাও ঘন্টা চারেকের মধ্যে ঘুম ভাঙলো কিভাবে?

যাইহোক, বাসার সবাই বেশ চিন্তিত! এই মুহূর্তে আমাকে কোথায় লুকিয়ে রাখবে এই মাফিয়ার থেকে সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। আর আমি কান্না করছি, কারণ তেইশ বছরের জীবনে নিজেকে কখনো এতোটা অসহায় লাগেনি। নিঝুম নামের একটা অভিশাপ যেন গায়ে জোঁকের মতো লেগে আছে। খালার বাসা, মামার বাড়ি কোথাও রেখে নিশ্চিত হওয়া যাবেনা। নিঝুমের মতো মাস্তানরা খুব সহজেই খুঁজে নিতে পারবে আমায়। সবাই চুপ, ঘরে পিনপতন নীরবতা! আব্বু হালকা কেশে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মা চিত্রা, স্কলারশিপে তোমার তো ইউভার্সিটি অব রিচমন্ড সিটি’তে এডমিশন হয়েছিলো!’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘ হুম! তো?’

‘ তোমার সবকিছু তো রেডি?’

‘ হুম, সব ফর্মালিটি পূরণ হয়ে গিয়েছে। আমাকে এক থেকে দেড়মাসের মধ্যে যেতে বলেছিলো। কিন্তু বিয়ের ঝামেলায় আমি ভেবেছি ডেটটা কিছুদিন পিছিয়ে দিলেই ভালো।’

‘ ডেট পিছিয়ে দিয়েছো?’

‘ না তো!’

‘ কয় তারিখ ছিলো?’

‘ দশ তারিখ!’

‘ আজ তো সাত তারিখ তাইনা? তো আমি বলি কি তুমি দশ তারিখেই চলে যাও।’

বিস্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে গেলো। সবাই-ই অবাক আব্বুর কথা শুনে। আব্বুর কাছে এর চেয়ে ভালো আর কোনো সলিউশন নেই। নিঝুমের হাত থেকে বাঁচার জন্য এটাই ভালো পদ্ধতি। যদিও নিঝুম এই ব্যাপারটা জানে যে, বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই আমি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো এক ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করবো। সে শুধু শুনেছিলো, উত্তর দেয়নি। আমাদের প্রথম সাক্ষাৎে এই বিষয়টা সহ দুজনের পছন্দ-অপছন্দ সমন্ধে কথা বলেছিলাম। তখন ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাইনি লোকটা সন্ত্রাসবাজ। ওর সাথে আমার শুধু এতটুকুই সম্পর্ক!

এবার বড় চাচ্চু কথা বলে উঠলেন। তিনি এই ব্যাপারগুলো জানতেন না। আর্মি ফোর্সে চাকরি করায় বাড়িতে আসা হয়না অনেকদিন। তার উপর কেউ বলেনিও চাচ্চুকে। চাচ্চু বললো, ‘বাহ! তাহলে তো ভালোই হলো। কিন্তু আমাকে তো জানাওনি কেউ, কিভাবে কি হলো বলো তো চিত্রা।’ আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

৩.
আমি শর্টকাটে বললাম, ‘ভার্জিনিয়াতে আমার এক বান্ধবী থাকে, ওর সাথে আমার সোশ্যাল সাইটে সম্পর্ক। ওর বাবা সেখানকার ইউনিভার্সিটির লেকচারার। ও খুব করে চায় আমি যাতে ওখানে গিয়ে পড়াশোনা করি। ওর কথামতোই আমি আমার ভার্সিটি থেকে অ্যাপলিকেশন ম্যাটেরিয়ালস ও অন্যান্য যাবতীয় ইনফরমেশন পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

চাচ্চু বললেন, ‘ ওখানকার ইউনিভার্সিটির টিউশন ফি আর ডরমেটরী চার্জ খুবই হাই। আউট অব স্টেট স্টুডেন্টদের বেলায় খরচ অনেক বেশিই। স্কলারশিপ বা গ্রান্ট ছাড়া ওখানে পড়া খুব টাফ। যাইহোক, তোমার তো স্কলারশিপ হয়েই গিয়েছে। কংগ্রাচুলেশনস আম্মিটা।’

আমি হাসলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। দুটো দিন আর এখানে আছি, ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। সমস্ত কাগজপত্র পূরণ করে মারোলা’র কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, ও সবকিছু জমা দিয়েছিলো ওর বাবার কাছে। ক’দিন পরই এলিজেবিলিটি আর আই টুয়েন্টি এলো। পাসপোর্ট, ভিসা সব মিলিয়ে চার মাসের জার্নি ছিলো। এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে আমি ভাবতেও পারিনি। সবকিছু যেমন তাড়াতাড়ি হলো এখন ভাগ্য আমায় তাড়াতাড়িই বিদায় দিয়ে দিচ্ছে। বিয়ে বাড়ি একদিনেই মারাত্মক একটা ঝড়ের মধ্যে দিয়ে গেলো। বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে হওয়ায় অল্পতেই ওরা চিন্তিত হয়ে যায়। ঝুঁকি নিতে চায়না, যেখানে নিঝুমের মতো একটা খুনি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

দুটো দিন আমাকে বাসায় রাখা হলোনা। কারণ তন্নতন্ন করে নিঝুম আর তার লোকেরা আমায় খুঁজে চলেছে। খবর নিয়ে জানলাম রিতুর যে ফোন থেকে আমার কাছে ম্যাসেজ এসেছিলো, সেটা চুরি হয়ে গিয়েছিলো, নিশ্চয়ই নিঝুমের কাজ। আমি থাকলাম বনানীতে দূরসম্পর্কের এক খালার বাসায়। সব গোছগাছ, শপিং করে আনলো খালাই। অবশেষে যাওয়ার দিন চলে এলো। খুব লুকিয়ে, সাবধানে চাচ্চু-আব্বু নিয়ে এলো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সঙ্গে এলেন আম্মু আর বড় আপু। তিনটায় ফ্লাইট! প্রথমে ঢাকা শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল টু জন এফ কেনেডি নিউ ইয়র্ক |
তারপর ডোমেস্টিক ফ্লাইটে করে রিচমন্ড
ইন্টারন্যাশনালে। সেখান থেকে বাকি যাত্রা। ইমিগ্রেশনের সমস্ত প্রকিয়া শেষ। ঘুরে ঘুরে এয়ারপোর্টে আসা বিভিন্ন মানুষদের দেখছিলাম।হঠাৎ আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম।

পাশে আপু দাঁড়ানো ছিলো। বললো, ‘কি ব্যাপার চিতু? কাঁদছিস কেন?’

‘ কই না তো!’

‘ আরে কান্নাকাটি করিস না। ইউএসে নিঝুম থাকবেনা, তুই নিজের লাইফটাকে সুন্দর করে সাজাতে পারবি বোন। একদিন তো ফিরবিই, মোটে কয়টা বছর। ঘুরাফেরা করবি, মজা করবি দেখবি ভালো লাগবে।’

‘ আমি এভাবে যেতে চাইনি আপু।’

আপু হাসানোর জন্য বললো, ‘কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছিস, ফিরে আসিস হাসতে হাসতে একটা সাদা বান্দর নিয়ে। গলায় গাঁদা ফুলের মালা ঝুলিয়ে সুন্দর করে নিয়ে আসবি। পারলে আমার জন্যও একটা নিয়ে আসিস। ওকে?’

‘ নিঝুইম্মার বাচ্চা কোনখানের, জীবন তেজপাতা করে দিলো আমার।’

আপু বললো, ‘তোকে খুঁজে না পেয়ে বেচারার অবস্থা হবে, “লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া/ মজনু গো আঁখি খোলো!” মানে উল্টোটা, বুঝে নিস!’

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, ‘আম্মুরা কোথায়?’

‘ লাউঞ্জে বোধহয়!’

‘ চল ওখানে যাই। ক’টা বাজে?’

আপু হাতঘড়ি দেখে বললো, ‘সাড়ে এগারোটা।’

আমি আর জবাব না দিয়ে আপুর পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। লাউঞ্জ থেকে আম্মু এসে বললো, ‘ আমার কাছে বসে থাকনা কিছুক্ষণ।’

আমি আম্মুর কাঁধে মাথা রেখে বেঞ্চে বসে রইলাম। আম্মু অনেক কথা বললো। ওখানে গিয়ে কিভাবে থাকবো, কি খাবো, কি পরবো সবকিছু।

হঠাৎ উপরে লাগানো মনিটরের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার বোর্ডিং আওয়ার শেষ। স্পিকারে যাত্রীদের’কে উদ্দেশ্য করে বলছে। আমি মাথা উঁচিয়ে বললাম, ‘আম্মু টাইম তো শেষ। এখন যেতে হবে।’

আব্বু বললো, ‘ হুম। সময় বেশি বাকি নেই।’

আমি হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চাচ্চু আর আব্বু-আম্মুকে সালাম করে নিলাম। তাঁরা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বিদায়ের ঠিক পূর্বক্ষণে কারো সাথেই কথা বলতে পারলাম না, গলা ধরে আসছে। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। অস্বচ্ছ কাচের দরজার ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। ঝাপসা দৃশ্যটুকুই আমার দু’চোখে আবদ্ধ করে নিলাম। পা বাড়ালাম সামনে, এক নতুন জীবন গড়ার আশায়!

৪.
প্লেনে উঠার পরে আমার খুব বমি বমি পাচ্ছিলো। কোনোমতেই সিটবেল্ট বাঁধতে পারছিলাম না। এক্ষেত্রে বিমানবালা এসে আমায় সাহায্য করলো। প্লেন যখন ঘুরে উপরে উঠছিলো তখন আমার মাথা ঘুরে উঠলো। ভাবলাম, যদি প্লেনটা সমুদ্রের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় ক্র‍্যাশ করে? তাহলে কি পরদিন সকালে খবরের কাগজে বড়বড় করে লেখা থাকবে, “বাংলাদেশ থেকে উড্ডয়নকৃত জন অফ কেনেডি, নিউইয়র্কগামী বিমান ক্র‍্যাশ করেছে। সকল যাত্রী আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছে! ওদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি, আমিন!”

ভাবনার প্রহর কাটতেই সামনের দিকে চোখ গেলো। আমার বিপরীত দিকে বসা একটা লোককে খুব চেনা লাগছে। কালো জ্যাকেট গায়ে, চোখে সানগ্লাস। আঁতকে উঠলাম! এটা কি নিঝুম? ওর মতোই তো লাগছে পেছনটা! কে ও?

?”কেউ গালি দিয়েছে, চুপ থাকো। কেউ কষ্ট দিয়েছে, ধৈর্যধারণ করো। আল্লাহর কসম! এমন শক্তি পরিণত হবে যে,পাহাড় ও রাস্তা ছেড়ে দিবে।”

~ মাওলানা তারিক জামিল

চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ব্যাগে ঔষধ রাখা নিয়ে এতো কনফিউজড হওয়ার কি আছে, বুঝলাম না। যাদের সমস্যা থাকে, তাদের ব্যাগে ঔষধ থাকে সবসময়। আর গল্পে ‘চিত্রা’ তো ফ্রেন্ডের সাথে কফিশপে দেখা কর‍তে গিয়েছে, এই কারণে হ্যান্ডব্যাগ থেকে যে ঔষধ সরিয়ে বাসায় রেখে যেতে হবে এমন তো কারণ নেই, তাইনা। ব্যাগে কাকতালীয়ভাবে ছিলো তা-ই বিপদে কাজে লেগেছে। আমি গল্পে কালকে এতোটা বিস্তারিত লিখিনি, তাই আপনারা বুঝতে পারেননি। আমি দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here