ভিনদেশি_তারা পর্ব-২২
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৬৫.
গল্পটা এরকম। দাদুকে যখন সোশ্যাল সাইটে আইডি খুলে দেওয়া হয়, দাদু মাঝেমাঝেই আমাদের ছবি তুলতো। আপলোডও করতো। একদিন দাদুকে কে যেন ম্যাসেঞ্জারে নক করলো, দাদু ম্যাসেঞ্জারে অতোটা একটিভ না বলে ম্যাসেজ চোখে পড়লো সাতদিন পরে। ম্যাসেজ করেছিলো ক্লেভ! বলা বাহুল্য আমার দাদু ইংরেজি খুব ভালোই জানে। কথাবার্তায় প্রায়ই কড়া কড়া ইংরেজি শব্দের ব্যবহার থাকে। যাইহোক, ক্লেভ দাদুকে আমার ছবি দেখিয়ে দাদুর কাছ থেকে সব জেনে নিলো। আমি যে না বলে চলে এসেছি এটাও বলে দিলো। এভাবেই দাদুর সাথে ওর সম্পর্ক। কিন্তু ও খ্রিস্টান শুনে দাদু আপসেট ছিলো এবং সমস্যাটা কোথায় সেটাও জানালো। ক্লেভ তাঁর দাদীর অনুমতি নিয়ে ধর্ম পাল্টেছে। যদিও ওর বাবা-মায়ের আপত্তি ছিলো। কিন্তু ও কেয়ার করেনি।
দাদুর ভরসা পেয়ে ক্লেভ বাংলাদেশে আসার বন্দোবস্ত করলো। দুজনের কূটনৈতিক বুদ্ধির কিছুই আমি জানতাম না। দাদু একপ্রকার ব্ল্যাকমেইল করে আব্বু, চাচ্চুদের রাজি করিয়েছে। আর আমি অফিস থাকার বদৌলতে কিছুই জানতে পারিনি। মিশু আপু আমাকে এসব জানানোর পরে আমি হতভম্ব। সবারই ওকে পছন্দ হয়েছে। যেহেতু আমি বিয়েই করতে চাচ্ছিনা, সেজন্য আব্বুও আমার উপর রাগ।
দুপুরবেলা ডাইনিংয়ে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। বাচ্চা কাজিনরা একপ্রকার ক্লেভের গলায় ঝুলে আছে, ওর সাথে সহজেই মিশে গিয়েছে। আমার আর জায়গা হলো না টেবিলে, জায়গা দখল করেছে ক্লেভ। আমি ভাত নিয়ে সোফায় বসলাম। ঝাল কিছু খেতে পারেনা ক্লেভ, সেজন্য ওকে সাদা ভাত, ডাল আর অমলেট করে দেওয়া হলো। সে লবণ মেখে মেখে খাচ্ছে, ভাত খাওয়ায় ভীষণ অপটু। কাল রাতের পরে আমার সাথে আর কথাই হয়নি। আমাকে এড়িয়ে চলছে বলা যায়।
৬৬.
বিকেলে ঘুম থেকে ওঠে বুঝলাম মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। আমাদের পাড়ার রাস্তাটা সবসময় চুপচাপ থাকে, নাম হলো নিরিবিলি রোড! একটু দূরে চোখ পড়তেই দেখলাম ঝালমুড়িওয়ালার পাশে বাসার বাচ্চাদের নিয়ে ক্লেভ দাঁড়িয়ে আছে। সে কী হাসি মহাশয়ের। ঝালমুড়িওয়ালা ঘন্টু মিয়ার সাথে বোধহয় কথা বলছে, বাংলা বলতে পারছে কিনা কে জানে! কিছুসময় পর ঘন্টু মিয়া কাগজের প্যাকেটে বাচ্চাদের ঝালমুড়ি দিলো, ক্লেভ আমাকে একনজরে দেখলো। তারপর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজেও ঝালমুড়ি খেতে লাগলো। ও মা! প্রচুর ঝাল না হলেও মোটামুটি ঝাল তো থাকবেই, খাচ্ছে কীভাবে?
চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে দেখলাম গাল, ঠোঁট লাল হয়ে টমেটো হয়ে আছে। কাশছে, ঘন্টু মিয়া দোকান থেকে পানি এনে খাওয়ালো। আমি আর কী করবো, মহাশয় তো কথা বলেন না আমার সাথে। তাই চুপচাপ দেখেই গেলাম।
ঝাল পর্ব শেষ হওয়ার পর ঘন্টু মিয়া কোথা থেকে ব্যাট, বল নিয়ে এলো। সবাই মিলে রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে লাগলো। একসময় ক্লেভ ব্যাটিং করতে নামলো। না দিতে পারে চার, না ছক্কা। হঠাৎ করে উঁচুতে বল উঠাতে গিয়ে বল এসে পড়লো বারান্দায়, আমার মাথায়! মাথা আচমকা ঝিমঝিম করতে লাগলো, দু’চোখে অন্ধকার নেমে এলো।
‘ হেই চিতুপ্পি! কী হয়েছে তোমার?’ সাফি জিজ্ঞেস করলো।
‘ কিছুনা।’
‘ ব্যথা লেগেছে? আমরা আসবো উপরে?’
‘ না সাফু। ব্যথা লাগেনি৷ আসতে হবেনা।’
‘ সত্যি?’
‘ হুম৷ তোমরা খেলা করো।’
সাফি অপরাধী গলায় নিচ থেকে চিৎকার করে বললো, ‘ দা-ভাই তোমাকে স্যরি বলেছে চিতুপ্পি!’
আমি ঝিম ধরা মাথা নিয়ে পিটপিট করে তাকালাম। ওই লাল শয়তানটা ব্যাট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেলো। আমার হাসি পাচ্ছে, উঠে চলে এলাম ভেতরে।
সন্ধ্যাবেলা বুঝতে পারলাম কাহিনী কী! কপাল ফুলে গেছে, মাথা ব্যথায় অস্থির। চিল্লানিতে পুরো বাসা অস্থির। মিশু আপু, মিতু আপু, ছোটচাচী সবাই সেবা করছে। কিন্তু ব্যথা কমার নাম নেই। এমনিতে ফোলা জায়গাটা ব্যথা, তার উপর ফ্রি মাথাব্যথা। গড়গড় করে বমি করে বিছানা ভাসিয়ে দিলাম। আম্মু সব পরিষ্কার করে ঠিকঠাক ঔষধ খাইয়ে দিলো। ব্যথা কমতেই গভীর ঘুম গ্রাস করলো আমাকে।
৬৭.
এর পরের তিনদিনও আমার সাথে ক্লেভ কোনো কথা বললোনা, আমি কথা বলতে গেলে কিছুই বললোনা। এর মাঝেই একদিন অফিস থেকে এসে আমি চমকে গেলাম। হুট করে ড্রয়িংরুমের সোফায় মারোলা, নিঝুম, জেনিফার, প্যাটিসন, রবার্ট, আলিয়া আর ক্লেভের দাদীকে দেখতে পেয়ে চমকে গেলাম।
আমাকে দেখেই সবাই এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার উপর। মারোলা কান্নাকাটি শুরু করলো। কী আজব! আমার মাথার উপর দিয়ে সব যাচ্ছে।
‘ হানি, তুমি এভাবে আমাদের না জানিয়ে চলে এলে? একবার বলে আসলে কী হতো?’ মারোলা বললো।
জেনিফার বললো, ‘ তুমি আমাদের বন্ধু ছিলে চিট! তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম আমরা।’
রবার্ট রাগী গলায় বললো, ‘ তুমি এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে আসবে জানলে কখনোই বন্ধুত্ব করতাম না। তুমি খুব নিষ্ঠুর।’
আমি নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে গিয়েছি। আটলান্টিকের ওপারে, একটা নতুন অজানা-অচেনা শহরে যে মানুষগুলো আমায় আগলে রেখেছিলো, যারা আমায় আপন ভাবতো, যাঁদের সাথে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ চার-চারটে বছর কাটিয়ে এসেছি তাঁদের সাথেই আমি বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নই সত্যিই! মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ক্লেভ জুসের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ফোড়ন কাটলো। ‘ব্যাঙলাদেসি গার্ল খুবই নিশঠুর থাকে।’
আলিয়া হেসে বললো, ‘নিষটুর গার্লের কাছে তুমি এসেছো কেন?’
আলিয়ার আধো বাংলায় কথাটা খুবই মজার শোনালো। কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। লাল ভূতটা আমাকে কিছুতেই ক্ষমা করছেনা, তাকায়ও না চোখে চোখ রেখে। এতো ইগো? এতো রাগ! আমিতো ভাবতেই পারিনা। আমার মন-মস্তিষ্ক থামিয়ে দেওয়ার জন্যই বোধহয় আমার তারাটা অদ্ভুত মাদক মাদক গলায় আলিয়ার প্রশ্নের উত্তরে বললো,
‘ বালোবাসি তাই!’
তারপর যেনো কিছুই হয়নি এরকম একটা ভান করে উঠে দাদুর ঘরে চলে এলো। সোফার এককোনায় নিঝুমকে ফোন ঘাটতে দেখে অস্বস্তিবোধ করছিলাম। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো আছেন আপনি?’
নিঝুম তাকালো। হাসলো। বললো, ‘বেশ ভালোই আছি।’
কথার মাঝেই ছোট্টবাচ্চার কান্না শুনতে পেলাম। মিশু আপুর কোলে একটা বাচ্চা। মারোলা এগিয়ে গিয়ে তুলে নিলো। কান্না থামানোর জন্য বলতে লাগলো, ‘মাই প্রিন্স! কান্না থামাও প্লিজ!’
আমি একবার মারোলা আবার নিঝুমের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকালাম। ওহ মাই গড! এটাও সম্ভব? নিঝুমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রিন্স মিন? আপনার আর মারোলা’র?’
‘ জি। মিসেস মোহাম্মদ!’
‘ কীভাবে কী হলো?’
নিঝুম কেমন অদ্ভুতস্বরে বললো, ‘ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখতে যেকোনো স্টেপ নিতে রাজি ছিলাম, তাই কথাটা আর ফেলতে পারিনি। পরদিনই বিয়ে করে নিয়েছিলাম।’
আমি বললাম, ‘ধন্যবাদ!’
মারোলা বাচ্চাটাকে আমার কোলে দিলো। মনে হচ্ছে এতো সুন্দর বাচ্চা আমি কখনো দেখিনি, জান্নাতের সুবাস ভেসে আসছে যেন গা থেকে। ক্যাটস আই, ধবধবে ফর্সা, কালো চুল, হঠাৎ দেখলে গা শিহরিয়ে ওঠে। এমন অদ্ভুত লাগছে কেন আমার? বাচ্চাটার ছোঁয়ায় নিজেকে নিজের কাছে আমার খুব পরিচিত লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো অশরীরীর নজর আছে ওর উপর। আমি নিঝুমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নাম কী ওর?’
নিঝুম হাসলো। আমার মনে হলো বাচ্চাটা নিঝুমের কার্বন কপি। দুজনকেই রহস্যময় মনে হচ্ছে। ওর নাম, ‘ইতিতাজ আর্ফ!’
‘ নামের অর্থ?’
‘ ইতিতাজ মানে শক্তিশালী, সম্মানিত। আর্ফ মানে সুগন্ধ!’
‘ ওহহ! ছেলে আপনার মতোই শক্তিশালী হবে, যাতে করে ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে পারেন। হা হা! আপনার পুরো নাম কী? শুধুই নিঝুম?’
‘ রুয়াইস রাবী।’
‘ মানে?’
‘ বিজয়ী নেতা!’
আমি হুট করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা নিঝুম আপনি কী কোনো অশরীরী?’
নিঝুমের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। বললো, ‘আমি ভালোবাসায় জয়ী হয়েছি। তোমাকে না পেলেও, এটাই তো আমার জয়, তাইনা? একটা কথা রাখবে?’
ইতস্তত করে বললাম, ‘বলুন?’
‘ তোমার যদি কখনো মেয়ে হয়, তাহলে সেই মেয়ের সুরক্ষার দায়িত্ব আমার। মানে আমি বিয়ের কথা বলছিনা, চাইছি আমাদের সন্তানদের মধ্যে সম্পর্ক থাকুক, বন্ধুত্বের! রাখবে প্লিজ?’
আশ্চর্য! নিঝুমের মাঝে যে এতো রহস্য লুকিয়ে আছে আমার এতোদিন খেয়াল হলো না কেন? হয়তো আমিই খেয়াল করিনি। ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অতীব ধারালো। যেন ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারছে। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। উত্তর দিলাম না। একমাস বয়সী আর্ফ’কে মারোলার কোলে দিয়ে আমি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
৬৮.
ক্লেভের দাদী আমার ঘরে ঘুমাচ্ছে। বুড়ির সাথে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখা। অথচ বুড়ির কী শখ! আমার সাথে নাতির বিয়ে না দিয়ে ভার্জিনিয়ায় ওই খুপরিতে না নিলে বেচারি মরে গিয়েও নাকি শান্তি পাবেনা। আমার নামে নাকি ওই ভুতুড়ে বাড়িটা লিখে দিয়েছেন। সাথে করে অনেককিছু নিয়েও এসেছেন। থুথুড়ে বুড়ির এসব শখ শুনে ও দেখে আমি রীতিমতো কোমায়। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি বুড়িকে নামাজ পড়তে দেখে। দাদী, নাতি দুজনেই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। বাসায় একেবারে উৎসব উৎসব পরিবেশ।
রাতে ছাদে গেলাম। গিয়ে দেখি ক্লেভ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে। আমি উঁকিঝুঁকি দিতেই দেখে ফেললো। সরে যেতে নিলেই হুট করে আমি ওর হাত ধরে ফেললাম।
মিঁইয়ে যাওয়া গলায় বললাম, ‘এখনো রেগে আছো?’
‘ আমার রেগে থাকা, না থাকায় কিছু হবে?’
‘ ক্ষমা করা যায়না?’
‘ নাহ! মোহাম্মদ আহনাফ বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করেনা, যেটা ক্লেভও করতোনা।’
‘ ভালোবাসার মানুষকেও ক্ষমা করা যায়না?’
‘ যদি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য হতে, অবশ্যই পেতে। তোমার সেই যোগ্যতা নেই। তুমি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, তাই পেতে হবে।’
‘ ক্লেভ!’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘ক্লেভ নয়। মোহাম্মদ আহনাফ।’
‘ এরকম করে কী লাভ?’
‘ একবছর আমি যে কষ্ট সহ্য করেছি, সেটা তো তোমাকেও পেতে হবে। এটাই আমার লাভ।’
‘ তুমি কী আমায় আর ভালোবাসো না?’
‘ বাসি। প্রচন্ড ভালোবাসি। যে ভালোবাসা আমাকে এতোদিন কষ্ট দিয়েছে, তিলে তিলে পুড়িয়েছে সেই ভালোবাসাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। এটাই ভালোবাসা, যা তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকরা জানেনা!’
বলে গটগট করে নিচে নেমে গেলো। ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে লাফ মরে যাই। কেন আবালের মতো, চোরের মতো পালিয়ে এসেছিলাম!
চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। নিজেও জানিনা কী লিখেছি, রি-চেইকও হয়নি।