ভিনদেশি_তারা
পর্ব-৫
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
১২.
ধুপ ধুপ করে জোরে কোথাও শব্দ হচ্ছে। আমার ঘুম ভেঙে গেলো। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি, কেমন আবছা অন্ধকার। কিন্তু শব্দটা একনাগাড়ে হয়েই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ কোনোকিছুতে লাঠি দিয়ে আঘাত করছে। আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম। মারোলা ঘুমুচ্ছে। আমি বিছানা থেকে নেমে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘরের ভেতর কোনো উৎস খুঁজে পেলাম না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল বেঁধে, গায়ে চাদর জড়িয়ে কাঠের দরজা খুলে বেরুলাম। ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে পেছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। ওদিকে ক্লেভের ঘর, কিন্তু শব্দটা সেখান থেকেও আসছেনা।
আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। লিভিংরুম হালকা অন্ধকার। একপাশে নীলচে বাতি জ্বলছে। সেই আলোতে ঘরটা একটা স্বপ্নজগৎের মতো দেখাচ্ছে। যাইহোক, আমি বাড়ির মেইন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি মাথায় স্কার্ফ বেঁধে এক কুঁজো বুড়ি লাঠি দিয়ে একটা শক্ত জিনিসে আঘাত করছেন আর ধুপ ধুপ আওয়াজ তুলছেন। কি ভয়ংকর!
আমি ভয় পেয়ে একটা চিৎকার দিতেই কে যেন আমার মুখ চেপে ধরলো। আমার আত্মা উড়ে গেলো। নিশ্চয়ই এই কুঁজো মহিলার প্রেতাত্মা!
আমাকে টেনে লিভিংরুমে নিয়ে এলো কেউ। ফিসফিস গলায় বললাম, ‘কে ক কে?’
‘ আমি। এডওয়ার্ড!’ ক্লেভের গলা।
আমি হাফ ছাড়লাম। ক্লেভ আমাকে ছেড়ে দিলো।
‘ চিৎকার করছিলে কেন?’
‘ বাইরে একটা মহিলার আত্মা দেখেছি!’
‘ ওটা আত্মা নয়, আমার দাদী।’ ক্লেভ হাসলো।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘ওনি এতো সকালে এরকম ধুপধাপ শব্দ করছেন কেন?’
‘ খোঁয়াড় থেকে মুরগী বের করছেন।’
‘ এতো ভোরে? আরেকটু পরে করলে কি হয়।’
‘ দাদীর অভ্যাস! ভয় পেয়েছিলে নাকি তুমি?’
‘ তো পাবোনা? আমি তো আরেকটু হলে মারাই যাচ্ছিলাম!’
‘ সিরিয়াসলি? তুমি আমার দাদীকে দেখে মরে যাচ্ছিলে?’ হা হা করে হেসে উঠলো ক্লেভ।
‘ ওনাকে প্রথম দেখে কি ভেবেছিলাম জানো?’
ক্লেভ তার সুন্দর চোখজোড়া বড়বড় করে বললো, ‘কি?’
‘ ভেবেছিলাম ওনি বুঝি ডাইনি!’
‘ তো এখন কি ভাবছো? ডাইনিই?’
‘ নাহ। এখন ওনাকে মিষ্টি বুড়ি মনে হচ্ছে। কারণ ডাইনিদের উল্টো পা থাকে কিন্তু তোমার দাদীর পা সোজা।’
‘ তাইতো, তাইতো।’ ক্লেভ হাসতে হাসতে বললো।
আমিও হাসলাম। ‘তোমার বাবা-মা এখানে থাকেনা?’
‘ নাহ। ওরা সেপারেট হয়ে গিয়েছে। ড্যাড তাঁর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়াতে আছেন। মাদার একাই থাকে। আমি দাদীর বাড়িই থাকি।’
এতো সহজভাবে বললো ক্লেভ যেন এটা কিছুই নয়। ক্লেভ জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি স্টাডি করতে এসেছো চিটট.রা?’
‘ হুম।’
‘ কোথায়?’
‘ রিচমন্ড সিটিতে।’
‘ ভালো।’
‘ তুমি কোথায় পড়াশোনা করেছো?’
‘ বিভিন্ন জায়গায়। নর্থ ডাকোটা থেকে মাস্টার্স করেছিলাম। এরপর ঘুরাঘুরির ভূত মাথায় চাপলো, তাই করি!’
‘ এতো ঘুরাঘুরি করে কি মজা পাও?’
‘ আফিমের মতোন মজা পাই। নেশা ধরে গিয়েছে।’
আমি হাসলাম। বাইরে তখন একটু একটু ভোর। হালকা বাতাস ঢুকছে জানালা দিয়ে। গা কাটা দিয়ে উঠলো আমার। ক্লেভ দেখলো। বললো, ‘ ঠান্ডা লাগছে তোমার?’
‘ একটু!’
‘ হেল্প লাগবে?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কি হেল্প?’
ক্লেভ হেসে বললো, ‘ শীতের জামাকাপড় আছে? নাকি আমার কাপড় দিবো?’
আমি বললাম, ‘ না না। আমার আছে।’
‘ একটা কথা বলি?’
‘ বলো।’
ক্লেভ আমার চোখে চোখ রাখলো। ক্ষীণ গলায় বললো, ‘তুমি খুব ভালো মেয়ে।’
‘ কি করে বুঝলে?’
‘ জানিনা। এমনিই মনে হলো।’
আমার বুকের ভেতর একটা মিশ্র অনুভূতি টের পেলাম। কমলা রঙের এক টুকরো রোদে ছেয়ে গিয়েছে আশপাশ। আমি ক্লেভের কাছ বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আজ আমাদের ফিরে যেতে হবে নিজ বাড়িতে। আরও নানা কাজ আছে। তবে বিদেশ বিভূঁইয়ে এসেই এমন ভালো একটা দিন কাটাবো ভাবিনি। নিঝুম নামক লোকটার কথা মনেই হলোনা দুদিন। সবচেয়ে বড় কথা, এলক্লেভ তার আচরণ দিয়ে আমাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছে। অত সুন্দর একটা ছেলেকে আমি খুব খারাপ ভাবতে চাইনা।
১৩.
রাস্তার দুপাশে ফোটে আছে ছোট ছোট ঘাসফুল। পরিষ্কার রাস্তা। আমি আর মারোলা হেঁটে হেঁটে ভার্সিটি এসেছি। খুব এক্সাইটেড আমি।
প্রথম দিন ভার্সিটি গিয়েই একগাদা বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে ফেলেছি। হৈ-হুল্লোড় করে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। প্যাটিসন, রবার্ট, জেনিফার, আলিয়া এরা হলো আমার নতুন বন্ধু।
ঠিক তখনই একটা গাড়ি এসে থামলো আমাদের সামনে। গাড়ি থেকে নামলো একটা যুবক। দেখেই চিনলাম এটা হলো ক্লেভ। নামতে দেরি, কিন্তু রবার্ট, জেনিফার ওদের ক্লেভের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরি নেই। সবাই এতো খুশি যেটা বলার বাইরে।
ক্লেভ আমার উদ্দেশ্য বললো, ‘তুমি জড়িয়ে ধরলে না যে?’
‘ আমি কেন ধরবো?’
‘ বন্ধু হই না তোমার? ধরতেই পারো।’
জেনিফার ক্লেভকে বললো, ‘ চিটড়া তোমার ফ্রেন্ড? চেনো একে অপরকে?’
ক্লেভ মাথা নাড়ালো। আমি বললাম, ‘মোটেও না!’
ক্লেভ মুখ কালো করে আমার দিকে তাকালো। বললো, ‘মানে?’
আমি বললাম, ‘ আমি কখন তোমার বন্ধু হলাম?’
ক্লেভ মাথা চুলকে বললো, ‘উমম..মনে আসছেনা। কিন্তু আমরা তো বন্ধুই!’
‘ তুমি তো আমাকে বন্ধু হওয়ার অফার দাওনি!’
ক্লেভ ভাবুক গলায় বললো, ‘আমার বন্ধু হবে, হেই ব্যাঙলাদেসি গার্ল?’
আমার প্রচুর হাসি পেলেও মুখটা কঠিন করে বললাম, ‘ না। হবোনা।’
ক্লেভ আহত চোখে তাকালো। বললো, ‘কেন?’
‘ বিকজ তোমার অফারটা আমার পছন্দ হয়নি।’
‘ কিভাবে করলে পছন্দ হবে?’
‘ যদি আমার নামটা ঠিকঠাক করে বলতে পারো।’
‘ কিন্তু আমি তা পারিনা।’
‘ ট্রাই করে দেখো।’
ক্লেভ চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলোনা। বরাবরের মতোই “চিটরা” বেরুলো। বেচারার করুণ অবস্থা দেখে আমার বেশ মায়া হলো। আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ কিচ্ছু হবেনা তোমার দ্বারা।’
‘ প্লিজ রাগ করোনা!’
‘ ঠিকঠাক অফারও দিতে পারোনা, নামটাও বলতে পারছোনা। আমার রাগ করাটা কি স্বাভাবিক নয়?’
আমি কথাটা এমনিই বললাম। ক্লেভ বোধহয় সিরিয়াসলি নিলো। সে উঠে কোথায় যেন চলে গেলো। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম, কিন্তু অনেকটা সময় পার হয়ে গেলেও ক্লেভ ফিরলোনা। আমরা সবাই যখন ক্যান্টিনে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেবো ঠিক তখনই কে যেন আমার হাত পেছন থেকে টেনে ধরলো। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখি ক্লেভ হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে আছে। হাতে একগুচ্ছ সাদা ম্যাগনোলিয়া ফুল। আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ আমার বন্ধু হবে চিট.রা?’
জেনিফার, মারোলা ওরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। আমি হেসে ফেললাম ক্লেভের চেহারা দেখে। বেচারার মুখটা এতোটুকু হয়ে আছে।
বললাম, ‘ অলরেডি আমি তোমার বন্ধু হয়েই গিয়েছি।’
ক্লেভ হাসলো। ওর নীল গভীর চোখজুড়ে প্রশান্তির আভাস। উঠে দাঁড়ালো আমার সামনে। একগাল হেসে আমার গাল দুটো টেনে ধরে বললো, ইউ আ’র সো কিউট চিট..রা!’
‘ আমি মোটেও কিউট নই।’
ক্লেভ বললো, ‘ অবশ্যই কিউট। নইলে আমার মতো বুড়ো তোমার মতো একটা বাচ্চা মেয়েকে ফ্রেন্ডাশিপের অফার করতোনা। বুঝলে?’
আমি বোকার মতো ওর দিকে তাকালাম। হঠাৎ বাতাসে ক্লেভের চুলগুলো উড়ে এসে ওর চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়লো। আমি মুগ্ধতা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ক্লেভ ওর চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিলো। কুচি করা রোদ ওর চোখেমুখে পড়ছে, কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে ওকে। আমার কয়েকটা হার্টবিট মিস হয়ে গেলো। এতো সুন্দর মানুষ আমি কখনো দেখিনি। শুধু সাদা চামড়া বলে নয়। ওর কথা বলার ধরণ, ব্যক্তিত্ব, ভাবনা সবকিছু মিলিয়েই ওকে আমার হঠাৎ ভালো লাগতে শুরু করলো। কিন্তু ভেতর থেকে কে যেন কড়া নেড়ে বলে উঠলো ‘খবরদার! আর বেশি আগিও না। এখানেই স্টপ করো ভাবনা।’
?”অবশ্যই তুমি পাবে যা তুমি হারিয়েছো তার চাইতেও উত্তম সামগ্রী।”
~ সূরা আনফাল-৭০
চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।