ভিনদেশি_তারা
পর্ব-৬
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
১৪.
আমি থেমে গেলাম। কি ভয়ংকর চিন্তাভাবনায় নিজের মনটাকে দুর্বল করে দিচ্ছিলাম। যাইহোক, আমরা সবাই ক্যান্টিনে গেলাম। জেনিফার, প্যাটিসন ওরা সবাই ক্লেভকে ঝেঁকে ধরলো ট্রিট দিতে। খাওয়ার অর্ডার দিয়ে আমরা বসে বসে গল্প করলাম। ম্যাক্সিকান ওয়েটার কাচের টেবিলের উপর ডেজার্ট, ব্রেড পুডিং, চকলেট মুস, ক্রিম ব্রুলি চীজ কেক,বাদামের কেক আর চাউমিন সাজিয়ে দিলো। আমি কি খাবো বুঝে উঠতে পারলাম না। সবাই এমন আহ্লাদীপনা করে খাচ্ছে দেখে আমার রীতিমতো আফসোস হতে লাগলো যে কেন আমি এমন চটপট করে খেতে পারছিনা।
ক্লেভ আমাকে একপলক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘খাচ্ছো না যে?’
‘ কই খাচ্ছি তো।’
‘ তোমার বোধহয় এসব খেয়ে অভ্যাস নেই, তাইনা?’
‘ হুম। এসব আমাকে টানেনা অতোটা।’
‘ তাহলে অন্যকিছু অর্ডার করি?’
আমি মাথা নাড়িয়ে না করে দিলাম। ক্লেভ জোর করলো। কিন্তু আমি ওর জোরাজুরি থেকে বাঁচার জন্য বাদামের কেক গিলতে লাগলাম। ক্লেভ আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘তোমরা বাঙ্যালিরা এতো মুখচোরা হও কেন?’
‘ তোমার আমাকে চোর মনে হচ্ছে?’
‘ না তো। তবে তুমি কথা লুকিয়ে রাখো সেটা বুঝতে পেরেছি।’
‘ ভালো করেছো।’
‘ রাগ করলে নাকি চিট..রা?’
‘ হুম করেছি, তাতে তোমার কি?’
‘ আমার অনেক কিছু।’
‘ যেমন?’
‘ তুমি আমার দেশের অতিথি। এদেশে একা-একা থাকবে। আমাদের উচিৎ তোমার খেয়াল রাখা। কিন্তু তুমি কিছু বুঝতেই দাওনা। তারপরে দোষ হবে আমাদের, কেন আমরা তোমার খেয়াল রাখিনি!’
আমি মুখ টিপে হাসলাম। কাঠ কাঠ গলায় বললাম, ‘ তোমার অতো খেয়াল রেখে কাজ নেই।’
‘ আছে। দেশে গিয়ে আমাদের নাম খারাপ করবে সেটা একজন সচেতন নাগরিক হয়ে আমি মেনে নেবো কেন?’
আমি হেসে দিলাম। হাসলো ক্লেভও। আলিয়া আমাদের দুজনকে লক্ষ্য করে গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা হাসছো কেন? কি হয়েছে?’
ক্লেভের সোজাসুজি উত্তর, ‘কিছুনা।’
তারপর আলিয়ার প্লেটের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় ধমকে বললো, ‘এখনো অনেকটা খাবার আছে, খাচ্ছোনা কেন? আমি কিন্তু অপচয় করা পছন্দ করিনা। সো ফিনিশ ইট!’
সবাই একটু ভড়কে গেলো। আলিয়া ছুরি, কাঁটাচামচ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেতে লাগলো। আমি আড়চোখে মারোলা’র দিকে তাকাতেই ও গলার স্বর নিচু করে বললো, ‘ ক্লেভ কিন্তু বড্ড রেগে যাবে, যদি কেউ খাবার শেষ না করে উঠে। এ বিষয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করেনা ও।’
আমি অদ্ভুতচোখে ক্লেভের দিকে তাকালাম। ও খাওয়ায় ব্যস্ত। ক্যান্টিনে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। লাল-নীল-হলুদ আলোর সাথে সাথে একটা ইংরেজি গান চলছে মিউজিক বক্সে। সবাই যার যার খাওয়ায় মনোযোগী। কিন্তু আমি ভাবছি অন্যকথা। যেখানে ক্লেভ ওদেরকে খাবার ফেলে রাখার জন্য রেগে ধমক দিলো সেখানে আমাকে কিছু বললো না কেন? আমি কি স্পেশাল নাকি? ওর তো উচিৎ ছিলো আমাকে থাপড়িয়ে খাওয়ানো কিন্তু ও সেটা না করে আমাকে কিছু বললোই না। ভাববার বিষয়। এটা নিছকই আমার উড়ো ভাবনা বলে বিষয়টাকে আর পাত্তা দিলাম না।
১৫.
বাড়ি ফিরে আসার পথে আমাদের সবাইকে ক্লেভের গাড়ি করে আসতে হলো। আর সেখানে রবার্ট বললো, ‘ কয়েকদিন পরে তো ব্রেক আছে ভার্সিটিতে, তাইনা?’
আলিয়া বললো, ‘হুম। প্রায় সাতদিনের ব্রেক পাওয়া যাবে।’
‘ তো আমরা কোথাও ক্যাম্পিং কর্তে পারিনা?’
ক্লেভ বললো, ‘ আমি যাবো তো। চাইলে যেতে পারো আমার সাথে।’
মারোলা জিজ্ঞেস করলো, ‘ অবশ্যই যাবো।’
ক্লেভ আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘তুমি কিছু বলছো না যে?’
‘ কি বলবো?’
‘ আমাদের সাথে যাবে কিনা?’
‘ আমিতো কিছু চিনিনা।’
‘ তোমার চিনতে হবেনা। আমি চিনি সব।’
‘ মারোলা তুমিও কি যাবে?’
মারোলা মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ সে যাবে। আর মারোলা গেলে আমিতো আর একা বাড়িতে সাতদিন থাকতে পারবো না। তাই আমিও কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে হ্যাঁ বলে দিলাম। সবাই বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে হইহই করে উঠলো। ক্লেভ আমাদেরকে আমাদের বাড়িতে ড্রপ করে দিলো।
এই একটা সপ্তাহ ভার্সিটির ক্লাস, আড্ডা নিয়ে কাটিয়ে দিলাম। সারাদিন এসব করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেই বাসার সবার সাথে স্কাইপিতে কথা বলেই ঘুম। মাঝেমধ্যে প্রকান্ড ব্যলকুনিতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। কেমন যেন নিজেকে একলা একলা লাগে এখানে। মারোলা ছাড়া আর কেউ নেই যার সাথে আমি মন খুলে কথা বলতে পারি। তারউপর খাওয়া নিয়ে সমস্যা। এই ক’দিনে আমি দেশের খাবার এতোটাই মিস করেছি যে কোনো কোনোদিন রাতে না খেয়ে কান্না করে কাটিয়েছি। এতগুলো দিনে ক্লেভের সাথে আমার দেখা হয়নি। গ্রোসারি শপে মারোলা’র সাথে নাকি দুদিন দেখা হয়েছিলো আর জেনিফার আলিয়ার সাথে নিয়মিত ওর দেখা হয়। কিন্তু আমার সাথে দেখা করেনি। হয়তো ইচ্ছে করেই!
আমার এতো অভিমান হলো বলার বাইরে। সবার সাথে দেখা হয় আর আমি থাকলেই ওকে দেখিনা। একটু একটু মন খারাপ লাগলেও আমি ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে গেলাম। ওই নীল চোখের ছেলেটাকে দেখার জন্য আমার ছটফটানি মনটা অস্থির হয়ে গেলো। তারপর এলো কাঙ্খিত সেই দিন। কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে জিন্স আর আর টপ পরে রেডি হলো মারোলা আর আমি সাদা রঙের ইয়া বড় একটা ঘেরওয়ালা জামা পরে রওনা দিলাম ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্যে। আমার তখন ঠিক মাথায় নেই ক্যাম্পিংয়ে গেলে কেউ অমন জামা পরিধান করে ‘যায় কিনা।
ক্লেভের বাড়িতে গিয়ে আমরা সবাই ওর গাড়িতে করে রওয়ানা দিলাম। ও আমার দিকে ফিরেও তাকালোনা। ছবির মতো সুন্দর রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওর গাড়িটা। আমি মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছি। অনেকটা হ্যাংলা লাগছে নিজেকে। বিকেলের দিকে পৌঁছলাম আমরা একটা জায়গায়। এটা ভার্জিনিয়ার ঠিক কোন জায়গা বা আদৌ ভার্জিনিয়ার অংশ কিনা ঠিক বুঝলাম না। চারদিকে পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। ক্লেভ ঠিক করলো এখানেই তাবু খাটানো হবে, তবে পাহাড়ের একটু উপরে। সরঞ্জামাদি সবকিছু ও নিয়ে এসেছে। রবার্ট আর ক্লেভ মিলে তাবু খাটালো আর আমরা সবাই পাহাড়ের খানিক নিচে একটা ওক গাছের নিচে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছি। কিন্তু কাজ শেষ করে রবার্ট নিচে নেমে এলেও ক্লেভ আসলোনা। ওর ঠিক হয়েছেটা কি আমি বুঝতে পারলাম না। খুব রাগ হলো।
১৬.
এলক্লেভ তাবুর বাইরে বসে আছে চুপচাপ। দৃষ্টি সুদূর আকাশে। আকাশে মেঘ নেই। সূর্যের প্রখর রোদ চারিদিকে ঝিকিমিকি ছড়াচ্ছে! আলোয় আলোয় ক্লেভ ওর নীল চোখে হালকা অন্ধকার দেখছিল! ক্লেভ বেশ অস্থিরবোধ করছিলো।এরকম অস্থির ওর অনেকদিন লাগে না। ও আনমনা হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো!’
‘হঠাৎ পাহাড়ি পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে কে যেন বেরিয়ে এলো। পরমূহুর্তেই ক্লেভ দেখলো,একটা মেয়ে। মেয়েটাকে দূর থেকে দেখে সে চিনতে পারলো না। বসে বসে দেখতে লাগলো মেয়েটিকে।’
‘তখন সূর্যের আলোর ঝিকিমিকি কমে গিয়েছে।স্বচ্ছ নীল রঙ ধারণ করেছে ধরণী। আকাশের কিছুটা অংশজুড়ে উড়ছে ধূসর মেঘের কুঞ্জ।বুনোগন্ধী হাওয়া ভেসে ভেসে আসছে পাহাড়ি প্রকৃতিতে।’
‘সাদারঙা জামা পড়া মেয়েটি পাহাড়ি সিঁড়িবেয়ে উঠে আসছে উপরে। মাথায় কাপড় জড়ানো, অনেকটা রাজকন্যাদের টায়রার মতো! মেয়েটির পেছন পেছন আসছে বন-মোরগ। আর মেঘের মতো ভেসে আসা মেঘের কুয়াশারা ঠিক মেয়েটির পেছনেই উড়ছে!
এলক্লেভ তাকিয়ে রইলো সেদিকে! ওর কাছে মনে হচ্ছে এ এক অপার্থিব, অবাস্তব দৃশ্য! ‘
‘মেয়েটি উপরে পৌঁছেই হঠাৎ পা পিছলিয়ে পড়ে গেলো। পেছনে আসা বন-মোরগটা ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটিয়ে পাশের ঝোপে লুকিয়ে পড়লো। এলক্লেভ বেশ অবাক হয়ে দেখলো এটা চিত্রা! ও দ্রুত বেরিয়ে এলো।
চিত্রা’র দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বললো, ‘ উঠো।’
চিত্রা হকচকিয়ে উঠে বললো,’না।’
‘ কেন?’
‘ আমি তোমার হাত ধরবো না।’
‘ আরে কি আশ্চর্য! পড়ে গিয়েছো আসলাম সাহায্য করতে আর তুমি কিনা আমার হাত ধরবে না!’
আমি রাগী গলায় বললাম, ‘আমি কি তোমাকে বলেছি আমাকে সাহায্য করতে?’
‘ না বলোনি। কিন্তু তাই বলে কি সাহায্য করা বারণ?’
আমি গম্ভীর গলায় বললো,’জানি না।’
ক্লেভ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।আমি নিজে নিজেই মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালাম। পোশাকে লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। হঠাৎ করেই মাথায় জড়ানো কাপড়ের অংশটা খসে পড়লো। বেরিয়ে এলো লম্বা, কালো চুলের গোছা।
এলক্লেভ টের পেল, ওর ভেতরের অস্থিরতাটুকু আর নেই। মনটা বেশ ফুরফুরে। গাছে বসে থাকা দু’টো চড়ুই পাখি ডানা মেলে উড়াল দিলো আকাশে!
ক্লেভ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন ঠিক আছো? নাকি কোমর গেছে?’
‘ আমি ইচ্ছুক নই তোমার সাথে কথা বলতে।কথা বলতে চাইলে একা একা বলো!’
ক্লেভ বেশ অবাক হলো। হুট করে আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘ এভাবে কথা বলছো কেন তুমি?’
‘ কারণ আমি রেগে আছি।’
‘ কেনো রেগে আছো?’
‘ তোমার উপর রেগে আছি।’
ক্লেভ মুখটা কাঁচুমাচু করে বললো, ‘ আমি কি করেছি চিট..রা?’
আমি আগুন চোখে একবার ক্লেভকে দেখে নিয়ে বললাম, ‘জানোনা বুঝি?’
?””ভালোবাসা দিবস বর্জন করাও এক প্রকার ভালোবাসা। সেটা আল্লাহ্ এবং রাসূলের প্রতি ভালোবাসা।”
–ড.বিলাল ফিলিপস
চলবে….ইনশাআল্লাহ!