ভিনদেশি_তারা পর্ব-৯

0
1863

ভিনদেশি_তারা
পর্ব-৯
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

২৪.
‘ তুমি কাঁদছো চিটটরা?’ ক্লেভের প্রশ্ন।

‘ কই না তো।’

‘ আমি স্পষ্ট দেখছি, মিথ্যা বলছো তুমি।’

‘ আসলে বাড়ির কথা মনে পড়ছে, তাই আরকি।’

‘ কোনোকিছু হয়েছে নাকি বাড়িতে?’

‘ নাহ। আজ ইদ ছিলো তো, তাই।’

‘ তোমাদের আজ ইদ? মারোলা তো বললো না।’

‘ বোধহয় ভুলে গিয়েছে। বাই দ্যা ওয়ে,, মারোলা কোথায়?’

‘ ঘুমিয়ে পড়েছে!’

‘ কোথায়?’ আমি অবাক হয়ে বললাম।

‘ লিভিংরুমের কাউচে। বেচারি ক্লান্ত ছিলো।’

আমি চিন্তিত হয়ে বললাম, ‘ বাড়ি যাবো কিভাবে?’

‘ যেতে হবেনা। থেকে যাও।’

‘ নাহ।’

‘ কেন?’

এই “কেন” এর উত্তর আমার জানা নেই। ঠিকই তো, আমি এখানে থাকবোনা কেন? বন্ধুর বাড়িই তো, থেকে গেলেই পারি। এর আগেও তো থেকেছি, তখন তো ক্লেভকে ভালো করে চিনতামই না। আমি ক্লেভের হাতটা আমার কাঁধ থেকে সরিয়ে দিলাম। ক্লেভ সরে উঠে দাঁড়ালো, আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ওর দিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটা ধরলাম লিভিংরুমে। পেছন থেকে ক্লেভ গম্ভীর গলায় বললো, ‘ভালো আছো, চিটটরা?’

আমি দাঁড়ালাম। বললাম, ‘এতক্ষণে জিজ্ঞেস করলে?’

ক্লেভ ইতস্তত করে বললো, ‘না মানে.!’

‘ ভালো আছি!’ বলেই এক টুকরো অভিমান নিয়ে চলে এলাম। কেন অভিমান করলাম জানিনা। ইচ্ছা হচ্ছিলো ওর সাথে অভিমান করার, করতেই হলো। লিভিংরুমের কাউচে মারোলাকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখে আমি আস্তে করে ওকে ডাকলাম। ও চোখ খুলে তাকালে বললাম, ‘বাড়ি যাবেনা?’

ঘুমঘুম গলায় ও বললো, ‘থেকে যাই।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘ তাহলে ঘরে চলো।’

২৫.
ক্লেভ পেছনে দাঁড়ানো ছিলো। ও আমাদের উপরের ঘরটা দেখিয়ে দিলো। মারোলা ক্লান্ত শরীর নিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে যেতে লাগলো। আমিও ওর পেছন পেছন কয়েকটা সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই শাড়ির আঁচলে কারো টেনে ধরা অনুভব করলাম। হতভম্ব হয়ে তাকাতেই এলক্লেভের গম্ভীর মুখটা দেখলাম। আশ্চর্য! ও অভদ্রের মতো আমার শাড়ি টেনে ধরলো কেন? মতলব কি ওর? খারাপ কিছু নয়তো? আমি চিৎকার করে বললাম, ‘আমার কাপড় ছাড়ো।’

ও হকচকিয়ে উঠলো। শাড়ির আঁচলটা না ছেড়ে মুঠো করে ধরলো। আমি অবাক হয়ে ওর কান্ড দেখছি। বললো, ‘নিচে নেমে আসো।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘নামবো না। আমার কাপড় ছাড়ো, তুমি অতোটা অভদ্র বিহেভ করছো ভাবিনি আমি।’

ক্লেভ মুচকি হেসে বললো, ‘না নামলে কাপড় ছাড়বোনা।’

‘ মানে? তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো?’

‘ ভাবতে পারো তাই। তুমি যতক্ষণ না নিচে নামবে ততক্ষণ আমি তোমার কাপড় ধরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো।’

‘ মানেটা কি ক্লেভ? এরকম করছো কেন? প্লিজ ছাড়ো, আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে!’

‘ আগে নিচে নামো।’

আমি বুঝতে পারলাম ক্লেভ ওর কথায় অটল থাকবে। আমার কাকুতিমিনতি শোনার মুডে নেই এখন ও। আমি ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ক্লেভ শাড়ির আঁচলটা সুন্দর করে ছেড়ে দিলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি কি আমাকে ইগনোর করছো?’

আমি হকচকিয়ে বললাম, ‘এমন মনে হলো কেন তোমার?’

‘ তোমার আচরণে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আচ্ছা আমি কি তোমার সাথে খারাপ বিহেভ করেছি? তুমি আমার সাথে কথা বলতেই চাচ্ছোনা অথচ আমাদের অতদিন পরে দেখা।’

আমি অসহায় চোখে ওর দিকে তাকালাম। বললাম, ‘কতদিন ক্লেভ? কতদিন?’

‘ এগারো মাস ষোলো দিন।’

আমি হাসলাম, শ্লেষের হাসি। সোফায় গা এলিয়ে বসলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো, শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। বললাম, ‘গুণে রেখেছো দেখি, কেন রেখেছো?’

‘ কারণ তুমি আমার স্পেশাল একজন বন্ধু।’

‘ কেমন স্পেশাল?’

‘ একটু বেশি।’

‘ কেমন বেশি? স্পেশাল বন্ধু বলেই অতোদিন যোগাযোগ রাখলে না?’

‘ রাখতে চেয়েছিলাম, পারিনি।’

‘ কেন?’

‘ জানিনা। খুব ইচ্ছে করতো তোমার সাথে কথা বলার, কিন্তু কোথাও গিয়ে আটকে যেতাম। এরকম কখনো হয়নি।’

‘ ওহহ!’

‘ আচ্ছা কফি করে আনি?’

আমি অদ্ভুতভাবে হাসলাম। ‘হুম, খাওয়া যায়।’

‘ তোমার মনে আছে সেবার যখন তুমি আমার বানানো কফি খেয়েছিলে তখন সবটা আমার জামায় ফেলে দিয়েছিলে?’

‘ খুব মনে আছে। ভুলিনি।’

২৬.
দু’জনে নীরবে হাসলাম। ক্লেভ উঠে রান্নাঘরে চলে গেলো। সেখান থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। ইলেকট্রিক চুলায় বসানো হয়েছে পানি। ক্লেভ এদিকওদিক থেকে কফির সরঞ্জামগুলো একত্র করছে। ওদিকে একমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ভাবনার জগৎে পাড়ি দিলাম। কেন এমন অদ্ভুত বিহেভ করছি আমি নিজেও জানিনা। হুটহাট মনটা খারাপ হচ্ছে, অভিমান হচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে ক্লেভের নীল চোখজোড়া চুরি করি। এমন সময় নিঝুমের কথা মনে হতেই ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।

তাড়াতাড়ি ফোনটা বের করে আব্বুর নাম্বারে ডায়াল করলাম। অবশ্য দু’দেশের সময়ে কয়েক ঘন্টার ব্যবধান রয়েছে। তাও ফোন করলাম। দু’বার রিং হবার পরই ফোন ধরলো আব্বু। সালাম দিয়ে, কুশল বিনিময় করে নিঝুমের সবটা ঘটনা আমি খুলে বললাম। আব্বু শুনে অবাক হয়ে গেলো। এই ছেলে এখনো আমার পিছু ছাড়েনি ভেবে আব্বু ভয় পেয়ে গেলো। আমি আব্বুকে চিন্তা না করতে আর সাবধানে থাকতে বললাম। কিছুক্ষণ এ বিষয়ে কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। মাথার উপর একনাগাড়ে ফ্যানটা ঘড়ঘড় শব্দ তুলে ঘুরছে। ওদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। এলক্লেভের পরণে কিচেন এপ্রোন, হাতে ট্রে। ট্রে’তে দু’মগ কফি রাখা। টি-টেবিলের ওপর এগুলো রেখে এপ্রোনটা খুলে চেয়ারের উপর রাখলো। ওর কপাল কুঞ্চিত, গাল লাল হয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। আমি কফির মগে চুমুক দিলাম, মনে হলো পায়েস খাচ্ছি। আড়চোখে ওর দিকে তাকাতেই আবারও হাসলো। ওর সুন্দর হাসিটার দিকে তাকানোর অপরাধে কফি বাবাজি রেগে ছলকে আমার হাতের উপর পরলো। আউচ..শব্দটা মুখ থেকে বেরুতেই ক্লেভ ছুটে এলো। ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমার হাত আঁকড়ে ধরে বললো, ‘তুমি কি বাচ্চা নাকি? এভাবে বেখেয়ালি হয়ে কেউ খায় নাকি?’

‘ স্যরি!’

‘ স্যরি বললেই হবে নাকি? তোমাকে আমার থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। রাবিশ!’

‘ দিয়ে ফেলো।’

‘ শাট আপ।” ধমকে বললো ক্লেভ। আমি ভয়ে চুপ করে গেলাম। লোকটার রাগগুলোকে আমি ভয় পাই কোভিড ভাইরাসের মতো।

একটা বোলে করে বরফ দেওয়া পানি নিয়ে এলো ক্লেভ। আমার হাতটা পানিতে ডুবিয়ে ধরে রাখলো। পোড়া জায়গাটা প্রচুর জ্বলছে, জায়গাটা লালচে আভা অনেকখানি জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে।

ক্লেভ ভীষণ যত্ন করে মলম লাগিয়ে দিলো। কফির মগদুটো বেসিনে রেখে, বোলের পানিটা রেখে এলো। আমি ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শাড়ির সেফটিপিনটা ছুটে গেলো আর আঁচলটা কাঁধ থেকে সরে গেলো খানিকটা। এলক্লেভ সামনে থাকায় আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। ও অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। একহাতে পোড়া জায়গায় মলম অন্য হাতে আঁচল ঠিক কর‍তে নিলেই সেফটিপিনের সূঁচালো অংশটা ফট করে আঙুলের ভেতর ঢুকে গেলো আর কিছুটা রক্ত বেরিয়ে এলো। রক্ত দেখে আমি একটু আহ করে উঠলাম! ক্লেভ তাকালো ঘুরে, আমার আঁচল প্রায় সরেই যাচ্ছিলো। ও টাইফুনের বেগে এসে সামলে নিলো। আমার আঙুল থেকে পিনটা খুলে সযত্নে বসিয়ে দিলো আঁচলে। মুখে একরাশ ক্লান্তি আর ঠোঁটে সতেজতার হাসি। ঢোলাঢালা টি-শার্টের কলারটা এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘাড়ের কাছে পড়ে আছে। আমি আনমনেই রক্তমাখা হাত দিয়ে ওর কলারটা ঠিক করে দিলাম। টের পেলাম ওর চুলগুলো ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত। আশ্চর্য! আমি এতোক্ষণ টেরই পেলামনা যে ক্লেভ ওর চুলগুলো বড় করেছে? আমি কি গাধি নাকি! অতো সময় কথাবার্তা বলে, কফিটফি খেয়ে হতবুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে দিলাম নিজের কাছে নিজেই? ভাবা যায়।

টের পেলাম আমি আর ক্লেভ খুব কাছে। অন্তত একফুট দূরত্বে দুজন দাঁড়িয়ে আছি। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতেই আশ্চর্য, ওর নীলচোখ জোড়ায় আমি মায়ার আভাস দেখলাম। মায়া নাকি ভালোবাসা বুঝতে পারছি না। এই চোখের মায়ায় তো আমি কবেই পরে গিয়েছিলাম, কিন্তু আজ..আজ কেন সেই মায়ার গভীরতায় আমি অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছি? চট করে আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। চিন্তায় চিন্তায় আমি পাগলই হয়ে যাবো। প্রেশাল হাই হয়ে গেলো নাকি আমার? আমি আবারও মনোযোগ দিলাম ক্লেভের চোখেত গভীরে! এবার আরও বেশি মোহনীয় লাগছে ওর চোখ। আমার মস্তিষ্ক তখন সচল হলো। ভেতরটা বলছে পৃথিবীর এক নিদারুণ বাস্তব সত্যগুলো।

‘ চিত্রা? তুই পাগল হয়ে যাবি। চিত্রা? চিত্রারে… তুই এই ছেলের কাছ থেকে দশফুট দূরত্ব বজায় রাখ। তোর মন সেই মুহূর্তের কাছাকাছি এসে গিয়েছে, যেখানে আসলে একটা মানুষের ভেতর-বাহিরটা উলোটপালোট হয়ে যায়। “ভালোবাসা” নামক এক খাঁচায় আটকে থেকে ছটফটিয়ে মরে। তুই এসব সইতে পারবিনা চিত্রা। তুই যে খুব নরম মনের মেয়ে, তোর ভালোবাসার মাঝে ধর্মের দেয়াল বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা। তুই সরে যা। সবচেয়ে বড় কথা এডওয়ার্ড তোকে এখনো ভালোবাসি বলেনি। তুই ওর প্রেমের অতল সাগরে ডুবে যাচ্ছিস। পাড়ে অপেক্ষা করছে তোর এক কঠিন সময়।’

আমার হাত আলগা হয়ে এলো। ওর কলার ছেড়ে দ্রুতগতিতে পা চালালাম। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে এলাম। খুব দ্রুত। বিছানার একপাশে মারোলা ঘুমিয়ে আছে। আমি ঘরের বাতি নিভিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়লাম। বুক ঢিপঢিপ করছে, মাথা ফেটে যাচ্ছে। দু’চোখ বেয়ে উপচে পড়ছে জল। ইশ, ক্লেভের চোখদুটোতে কি অনুভব করলাম আমি? দুজন মানব-মানবী মনের কথা প্রকাশ না করেও চোখ দিয়েই অন্তপুরীর কথা টের পেয়ে যায়! আসলেই, “ভালোবাসার কখনো কখনো ভাষার দরকার হয়না, চোখের দিকে তাকালেই আগ্নেয়গিরির লাভার মতো মন-মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠে! এই উত্তাপের থেকে মুক্তি দেওয়ার সাধ্যি সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারোর নেই!”

?”অতএব তোমরা আমাকে স্মরন কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরন করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।”
[২:১৫২] সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।

চলবে… ইনশাআল্লাহ! ছোট হওয়ার জন্য স্যরি। ভুল-ভ্রান্তি মাফ করবেন। গল্পের আগামাথা আমি সাজাতে পারছিনা। তবে জেনে রাখুন, এডওয়ার্ড এলক্লেভই হচ্ছে আসল হিরো, নিঝুমও হিরো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here