ভীন_দেশের_গল্প #পর্ব_১১ (শেষ পর্ব – ১ম অংশ)

0
1622

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_১১ (শেষ পর্ব – ১ম অংশ)
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

(অতীত)
কুক কুক করে কু পাখি ডেকে গেল তারস্বরে। গোমেজ বাড়িতে বিষাদের ছায়া। মালোকো গোমেজ চিৎকার করে ডাকলেন,
-‘ড্যাড!’
বুকে হাত চেপে দোরগোড়ায় পড়ে রয়েছেন ফুজিন গোমেজ। তার চোখজোড়া বন্ধ। বুকটা হাপড়ের মতো উঠানামা করছে। র’ক্তে বুকের কাছের জামাটা লাল হয়ে আছে। মালোকো এবং তার স্ত্রী আলিজা দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামলেন। ছেলে হয়েও পিতার এমন অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন মালোকো। পিতার বুকে অস্থির ভঙ্গিতে হাত রেখে থেমে থেমে বলে চলেন,
-‘ড্যাড! ড্যাড, প্লিজ চোখ খোলেন। আমাকে…আমাদের একা করে দিয়ে চলে যাইয়েন না আপনি। চোখ খোলেন ড্যাড। প্লিজ।’

ফুজিন চোখ খুলে চাইলেন। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া হাতখানা কোনোরকমে নাড়িয়ে পকেটের ভেতর থেকে একটা পাথর বের করে আনলেন। পাথরটি কোনো সাধারণ পাথর নয়। মালোকো অবাক চোখে তাকিয়ে বলেন,
-‘ব্লাড স্টোন! আপনি ব্লাড স্টোন উদ্ধার করতে পেরেছেন?’
ফুজিন মাথা নাড়ান। ছেলের হাতে দ্রুততার সঙ্গে অতি দামী ‘ব্লাড স্টোন’ হস্তান্তর করে দুর্বল গলায় বলেন,
-‘মাই সান, আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। এখন যাওয়ার পালা। তবে যাওয়ার আগে এইটুকু বলে যেতে চাই, আমার আব্বা ‘ব্লাড স্টোন’ রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন, আজ আমিও দিয়েছি। আর তোমার… তোমার মা-ও।’
-‘মম?’
মালোকোর গলা কেঁপে উঠে। চোখের ইশারায় আলিজার দিকে তাকালে আলিজা দ্রুত উঠে বাহিরে দৌড়ে গেল। উদ্দেশ্য শ্বাশুড়ি হেলেন কে খুঁজে বের করা। ফুজিনের দম ঘন হয়ে আসে। বুক ভরে বাতাস টেনে তিনি পুনরায় দুর্বল কণ্ঠটি নাড়ালেন,
-‘মালোকো, কথা দাও, তুমি আর তোমার পরবর্তী বংশধর কখনো একে হারাতে দেবে না। কখনো এর গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচ আসতে দেবে না। কথা দাও মালোকো। কথা দাও আমাকে।’
চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে মালোকোর। ভেজা কণ্ঠে সে উত্তর করল,
-‘কথা দিলাম ড্যাড, কথা দিলাম।’
ফুজিন চোখ বন্ধ করে বড় একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হারিয়ে গেলেন। বিদায় জানালেন যুদ্ধ করতে করতে বেঁচে থাকা এই সুন্দর পৃথিবীকে। মালোকো পিতার নিথর দেহ বুকের সঙ্গে মিলিয়ে ডুকরে উঠে।। সেই সঙ্গে হাতে ধরে রাখা পাথরটিকে চেপে ধরে আরও শক্ত ভাবে। কিছুক্ষণ পর পিতার নিস্তেজ দেহ মাটিতে শুইয়ে রেখে সে উঠে দাঁড়াল জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে।

উঁচু গলায় ডাকলেন,
-‘ম্যাক্স, ম্যাক্স!’
চপল পায়ে সিড়ি মাড়ালো ম্যাক্স। বয়স তার চৌদ্দ’র কোঠায়। মাত্রই কিশোর থেকে যুবকে পা দিচ্ছে সে। চারিপাশে যা-ই দেখে তাই সুন্দর লাগে। হাসিখুশি ম্যাক্সের চেহারাটা মলিন হয়ে গেল দাদার নিশ্চুপ দেহ দেখে। বাবাকে ডিঙিয়ে দাদার বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ার সাহস তার হলো না। সেই সঙ্গে এক ঝাঁক প্রশ্ন মগজে ভীড় জমালো। বাবার সামনে প্রশ্নবিদ্ধ চোখ নিয়ে এসে দাঁড়াল। নির্বাক রইলো।
মালোকো একমাত্র ছেলের দু’কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
-‘তোমার দাদা আর নেই।’
-‘কে,কে করল এসব?’
প্রশ্নটি বেরিয়ে এলো তাৎক্ষণিক। মালোকো দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললেন,
-‘আমাদের শত্রুর অভাব নেই ম্যাক্স। কে করেছে কেমন করে বলি! তবে ড্যাড চলে যাওয়ার আগে একে ঠিক রক্ষা করতে পেরেছেন।’
বলেই নিজের হাতের মুঠো বাড়িয়ে ধরেন। এর আগে শুধু একবার ‘ব্লাড স্টোন’ কে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ম্যাক্সের। তাই এবার দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারল। ম্যাক্স অবাক গলায় বলল,
-‘এর জন্য? এর জন্য খু’ন হলো দাদা?’
মালোকো ঘাড় নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে। ম্যাক্স ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। মালোকোর হাত থেকে প্রায় ছো মেরে ‘ব্লাড স্টোন’ কেড়ে নিলো। রাগী স্বরে বলল,
-‘তবে একে ভেঙে ফেলছো না কেন ড্যাড? কেন এর জন্য আমাদের স্বজনরা একে একে হারিয়ে যাবে? কেন এর জন্য আমাদের এত শত্রু হবে ড্যাড? আমরা তো কারো ক্ষতি করিনি। তবুও আমাদের এত শত্রু, এত সমস্যা, সব এর জন্য!তাহলে একেই নষ্ট করে দাও। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি।’

ম্যাক্স হাতটা উঁচু করে। ভাবখানা এমন, এক্ষুনি ছুঁড়ে মারবে পাথরটি। মালোকো সঙ্গে সঙ্গে ম্যাক্সের গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিলো। হুংকার ছেড়ে বলল,
-‘ম্যাক্স!! তোমার সাহস হয় কী করে এমন কথা বলো?’
ম্যাক্সের হাত থেকে দ্রুততার সঙ্গে ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে নেয় মালোকো। অগ্নিচোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রয়৷ অপরদিকে ম্যাক্সও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। একটা পাথরের জন্য কেন এতকিছু! সে বুঝতে পারে না। মালোকো ছেলের চোখের ভাষা পড়তে পারে। হতাশামিশ্রিত শ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিঁড়ে। ম্যাক্সের কাঁধে হাত রেখে এবার খানিকটা নরম সুরে সে বলল,
-‘তুমি অনেক কিছু জানো না ম্যাক্স। তাই এই কথা বললে। যদি জানতে আজ বুঝতে পারতে, তোমার দাদা খু’ন হয়নি, শহীদ হয়েছে।’
ম্যাক্স অভিমানী গলায় জবাব ছোঁড়ে,
-‘আমাকে কখনো কিছু জানিয়েছো তোমরা? তুমি বা মা, কেউই আমাকে বলোনি কী এটা। কেন এটার জন্য এতকিছু। কেন এত সুরক্ষিত রাখার পরও এটা চুরি হয়ে যায়। আর তারপর ওকে রক্ষা করতে গিয়ে কেউ না কেউ জীবন যুদ্ধেই পরাজিত হয়ে আসে। আর না, আজ আমি জানতে চাই। আমাকে বলতেই হবে। নইলে আমি সত্যি বলছি, এবার ভেঙে ফেলবো এটাকে। আমাকে কেউ থামাতে পারবে না।’

ম্যাক্সের কণ্ঠে আক্রোশ স্পষ্ট। মালোকো বুঝলেন তার ছেলে বড় হয়ে গেছে। ‘ব্লাড স্টোন’ এবং তাদের উপর আরোপিত দায়িত্বের কথা তাকে জানানোর সময় এসে গেছে। মালোকো ‘ব্লাড স্টোন’ এর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলতে লাগলেন,
-‘আমি তখন তোমার চেয়ে একটু বড় হবো। তোমার দাদা আমাকে একদিন ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে বের হলেন। আমি তো মহাখুশি। অনেকদিন বাদে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছি! ভেবেছিলাম,কত সুন্দর জায়গাতেই না যাবো। অথচ কীসের কী। তোমার দাদা আমাকে নিয়ে গেলেন একটা জঙ্গলে। এমন গভীর জঙ্গল আমার জীবনেও আমি দেখিনি। মাটিতে পা রাখা দায়। মাথা তুলে আকাশ দেখা দায়। দিন দুপুরেও যেন কোনো ভয়ানক রাত নেমে এসেছে! প্রচুর ঘাবড়ে গেলাম, অপ্রস্তুত হলাম কিন্তু মনে সাহস হারালাম না। ড্যাডের হাত ধরে সামলে পথ চলতে লাগলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা থামলাম। ড্যাড আশেপাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়লেন। তারপর মাটির একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে ফুঁ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাটি ফাঁক হয়ে সিড়ির দেখা পেলাম। বিশ্বাস করো,জীবনে ওই প্রথম আমি এতোটা হতবাক হয়েছিলাম, যা বলার মতো না! ড্যাড আমাকে একটুও কাছ ছাড়া করলেন না। আঙুল ধরে নিচে নামালেন। পুনরায় ফুঁ দিলে মাটির গহ্বর বন্ধ হয়ে গেল। উপর থেকে দেখলে কেউ বুঝবেই না আমরা নিচে আছি! আমি অবাক চোখে শুধু চেয়ে রইলাম। এরপর প্রায় ৩২ টা দরজা পেরিয়ে আমরা ঢুকলাম কাঙ্ক্ষিত রুমে। যেখানে ছয়টা ছায়া মূর্তির মধ্যিখানে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছিল এই পাথরটি, ‘ব্লাড স্টোন’। এছাড়াও সেখানে পাহারার জন্য ছিল ২০০ টি বাঁদুর। আমি এতোটাই অবাক হয়েছিলাম, যা তোমাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তোমার মতো আমার মনেও একই প্রশ্ন জেগেছিল, একটা সামান্য পাথরকে এত কড়া পাহারার ভেতর রাখার কী প্রয়োজন! ড্যাডকে প্রশ্ন করতে হয়নি। তার আগেই তিনি আমাকে সব খুলে বলেছিলেন।

শুধু আমরাই না, পুরো ভ্যাম্পায়ার জাতির জীবনের মূল উৎস এই পাথরটি। যাকে তুমি তুচ্ছ নজরে দেখছো। এই পাথরটির গায়ে যদি সামান্য তম আঁচ এসে লাগে তবে আমাদের জাতির এক তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এটাকে তুমি ভেঙে দিতে চাইছো ম্যাক্স? বলতে পারো, আমাদের জীবন, আমাদের শক্তি, এই একটি পাথরের ভেতর নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে। বিধাতা আমাদের সবদিক থেকে শক্তিশালী করলেও এদিক থেকে দুর্বল বানিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই পাথরটি এমন এমন কাজ করতে পারে যা তুমি কল্পনাও করতে পারো না ম্যাক্স। যখন ঘোর সংকট,কোনোদিকে কোনো পথ খোলা পাবে না, তখন একমাত্র এইটিই পারবে তোমার বিপদ উদ্ধার করতে। আর তুমি এটাকেই হেলাফেলা করলে! আমাদের চৌদ্দ পুরুষ একে রক্ষা করে এসেছে। আমাদের জোশ দেখে বিধাতা খুশি হয়েছেন। তাই আগামী চৌদ্দ পুরুষ ও এটি আমাদের দখলেই থাকবে। শুধু আর্নিশ বংশের দখলে। এটি আমাদের জন্য কতবড় পাওয়া, তুমি ভাবতে পারো ম্যাক্স? আর এ কারণেই আমাদের শত্রু নেহাতই কম নয়। ‘ব্লাড স্টোন’ যার কাছেই থাকবে,তার চেয়ে শক্তিশালী আর কারো হবার উপায় নেই। তাই আমাদের শত্রুরা সর্বক্ষণ ওঁৎ পেতে থাকে এটিকে চুরির উদ্দেশ্যে। এর আগে বহুবার এটি চুরি হয়েছে। ফিরিয়েও এনেছি আমরা যুদ্ধ করে। হয়তো ভবিষ্যতেও এরকম বহু যুদ্ধ আমাদের করে যেতে হবে টিকে থাকার জন্য, ‘ব্লাড স্টোন’ কে রক্ষা করার জন্য। আজকে তোমার দাদা শহীদ হলেন, একদিন আমিও হয়তো চলে যাবো এমন করেই। আমার পরে তুমি এই বংশের রাজা হবে ম্যাক্স। তাই তোমার একমাত্র দায়িত্ব একে রক্ষা করা। তাতে যদি জীবন যায়, যাবে। তবুও এর গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচ আসতে দেবে না ম্যাক্স, কথা দাও।’

ম্যাক্স হতভম্ব হয়ে চেয়ে ছিল, মালোকোর কথা শেষ হতে তার ধ্যান ভাঙলো। সে অবিশ্বাস্য চোখে ‘ব্লাড স্টোন’ এর দিকে তাকাল। এতক্ষণ যাকে সামান্য একটা পাথর দেখাচ্ছিল, এখন তাকে দেখতে ভয় লাগছে ম্যাক্সের। এই পাথরের এত ক্ষমতা! এর জন্যই টিকে আছে ওদের পুরো জগত,জাতিটা! কী অবিশ্বাস্য ঘটনা!

মালোকো ছেলের তরফ থেকে কোনোপ্রকার জবাব না পেয়ে ফের প্রশ্ন করল,
-‘কী হলো ম্যাক্স? জবাব দিচ্ছো না কেন? নাকি তুমি তৈরি না এই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য?’
ম্যাক্স সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত মাথা ঝাঁকালো। মালোকোর হাত থেকে ভয়ে ভয়ে ‘ব্লাড স্টোন’ নিজের হাতে নিয়ে বলল,
-‘আ…আমি তৈরি। আমি সত্যিই তৈরি।’
মালোকোর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসে ফুঁটে উঠে। সে জানে,তার ছেলে তাদেরই র’ক্তের ধারা বহমান রাখবে। তাদের মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় সম্মান কখনো অক্ষুণ্ণ হতে দেবে না। ম্যাক্স যোগ্য। তার পরে আর্নিশ বংশের হাল ধরার জন্য।

(বর্তমান)

একটা নদী। অন্যান্য আর দশটা স্বাভাবিক নদীর চাইতে এর বৈশিষ্ট্য সামান্য আলাদা। এই নদীর পানির স্থিরতা হয় না কখনো। সারাদিন কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলে তীব্র স্রোত নিয়ে। ভ্যাম্পায়ার অথবা সামুদ্রিক জীব ছাড়া আর কারো এই নদী ডিঙিয়ে ওপারের জগতে প্রবেশ করা শুধু কঠিনই না, দুঃসাধ্য বলা চলে। তাই তো যুগ যুগ ধরে শত্রুদের প্রত্যক্ষ আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে চলেছে আর্নিশ বংশের সকলেই। তবুও মাঝে মাঝে ‘ব্লাড স্টোন’ চুরির পরোক্ষ আক্রমণ টা ভাবিয়ে তোলে সবাইকে।

ম্যাক্স প্রায় বাতাসের গতিতে ছুটে এসেছে। মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে এবার খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিলো। মূল ফটকে দু’জন দেহরক্ষী দাঁড়িয়ে। তারা ম্যাক্সকে দেখামাত্র কপালে হাত উঠিয়ে সালাম ঠুকলো। এটাকে ঠিক সালামও বলা চলে না। সম্মান প্রদর্শনের খাতিরে কুর্নিশ করা আর কী। ম্যাক্স ঘাড় নাড়িয়ে কিছু না বলেই ভেতরেই পা রাখে। অনেকক্ষণ ধরে বুকের ভেতরে যে ঝড়টা লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছিলো সবকিছু, তা যেন নিমিষেই থেমে গেল। একটু স্বস্তি এবং অনেকখানি আশা সূর্যের রশ্মির ন্যায় জেগে উঠল মন আকাশে। কথা আছে, নিজ বাড়িই নিরাপদ এবং আরামদায়ক হয় সবচেয়ে বেশি। তাই নিজের ঘরে ফিরে এলে যত কষ্টই থাকুক,কিছুটা হলেও লাঘব হয় তা।

দূর পাহাড়ের খাঁজে বিশাল প্যালেসটাই ম্যাক্সদের বাড়ি। ওখানে বাবা-মা সহ ৮ জন দাস-দাসী থাকে। ম্যাক্স বাড়িতে প্রবেশ করে। মালোকো উপরে, হল ঘরে আলিজা বসে কিছু একটা করছিলেন। ছেলেকে দেখতে পেয়ে কিছুটা খুশি এবং অনেকখানি বিস্ময় নিয়ে হাতের কাজ ফেলে দ্রুত এগিয়ে এলেন।

-‘ম্যাক্স, তুই?’

ম্যাক্স মলিন মুখে অল্প একটু হাসল।
-‘আমাকে দেখে এত অবাক হওয়ার কী আছে মম?’
ম্যাক্স প্রশ্ন করে। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল। পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-‘ড্যাড কই?’
-‘আছে ঘরেই। আমি ডেকে দিচ্ছি। তুই বস না। কী খাবি, বল? ছাগলের গরম গরম র’ক্ত আনা হয়েছে। খাবি, দেবো?’
জিভে জল চলে এলেও নিজেকে সংবরণ করল ম্যাক্স। প্রতিজ্ঞা নিয়েছে, জুলিয়াকে বিপদ থেকে উদ্ধার না করা অবধি এক ফোঁটা র’ক্ত সে মুখে তুলবে না। তাই আলিজাকে বলল,
-‘নো মম। ড্যাডকে ডাকো।’
আলিজার চোখেমুখে বিস্ময়তার পাশাপাশি একটা চাপা উদ্বেগ ও দেখা দিলো।
-‘কী হয়েছে? কোনো বিপদ..’
-‘ড্যাডকে ডাকো প্লিজ!’
আলিজার কথার মাঝেই নিজের কথাখানা ছুঁড়ে দিয়ে ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে ম্যাক্স। সোফার উপর ধপ করে বসে পড়ে হাত-পা ছড়িয়ে। আলিজা দ্রুত পায়ে মালোকোকে ডাকতে ছুটলেন। ম্যাক্সের চোখমুখ বলছে,বড় কোনো সমস্যা হয়েছে।

আলিজা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। মালোকো পিঠ টান টান করে বসে রয়েছেন। আর ম্যাক্স একটু দূরে মাথা নিচু করে রেখেছে। বাবা-মা নিজের অপারগতার কথা বলতে গিয়ে লজ্জায়, হতাশায়, মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। বড় ভাই হয়েও বোনের জন্য কিছু করতে না পেরে ছুটে এসেছে সে এখানে! এরচেয়ে অপমান আর কী হতে পারে?

ম্যাক্স মাথা তুলে জোরালো কণ্ঠে বলল,
-‘আমি যোগ্য নই ড্যাড। তোমার ধারণা ভুল ছিল আমাকে নিয়ে। আমার কোনো যোগ্যতাই নেই এই বংশের রাজা হওয়ার। আমি…আমি আমার বোনকেই সুরক্ষা দিতে পারলাম না। তাহলে ‘ব্লাড স্টোন’ কে কী করে সুরক্ষিত রাখবো?’
প্রতিটি শব্দে হতাশা মেশানো। মালোকো ছেলের কথার পিঠে বললেন,
-‘আমি জানি, যদি কেউ যোগ্য হয়ে থাকে তবে সেটা তুমিই। তাই তো বোনকে বিপদে একা ফেলে হারিয়ে যেতে পারোনি। বরং যখন সব পথ বন্ধ পেয়েছো তখন চলে এসেছো শেষ উপায় অবলম্বন করতে। যদিও তুমি জানো, এরচেয়ে রিস্কি আর কিছু হতে পারে না।’
-‘আমি কী করব ড্যাড? ওই লাইটগুলো… ওগুলো না থাকলে আমি ঠিক ছাড়িয়ে নিয়ে আসতাম জুলিয়াকে। আর ওই হা’রাম’জাদাকে পিষে রেখে আসতাম মাটিতে.. ওর ওই অন্ধকার কুঠুরিতে ওকে পু’তে রেখে আসতাম।’

শেষের বাক্যগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে ম্যাক্সের গলার স্বর কেঁপে উঠে। দাঁত কিড়মিড় করে সে। তার চোখে আগুন ক্রোধ স্পষ্ট। মালোকো বললেন,
-‘সামলাও নিজেকে। রাগ ভালো তবে অতিরিক্ত নয়। তোমার পরিকল্পনা এক মুহূর্তে বানচাল করার জন্য এই রাগই যথেষ্ট।’
ম্যাক্স দীর্ঘশ্বাস চাপিয়ে চুপ করে গেল।
মালোকো বললেন,
-‘এখন বলো, কী চাচ্ছো তুমি? ‘ব্লাড স্টোন’ নিতে? তাই তো?’
-‘এছাড়া..’ ম্যাক্স মাথা তুলে তাকায়, কথাটুকু শেষ করে, ‘আর কী কোনো উপায় আছে ড্যাড?’
মালোকো এক মুহুর্ত নিরব থেকে বলল,
-‘কিন্তু আমি তোমাকে ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিতে পারবো না ম্যাক্স।’

ম্যাক্স,আলিজা দু’জনেই অবাক হয়ে বড় চোখ করে তাকায়। মালোকো ঢোক চেপে বুকে পাথর চাপা দিয়ে বললেন,
-‘জুলিয়া আমার মেয়ে। আমি ওর বাবা। কিন্তু তার আগে আমি এই বংশের রাজা। আর রাজা হয়ে আমি পুরো বংশের সবার জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারব না। আমি কোনো ভরসাতেই ‘ব্লাড স্টোন’ কে ঝুঁকিতে ফেলতে পারব না।’
-‘তুমি এসব কী বলছো মালোকো?’ এতক্ষণ পর আলিজা কথা বললেন, তার চোখেমুখে একই সঙ্গে ক্রোধ, বিস্ময়, ‘তোমার মাথা ঠিক আছে তো?’
মালোকো নরম সুরে জবাব দেন,
-‘আমার মাথা ঠিক আছে বলেই আমি ভেবেচিন্তে আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি।’
-‘ড্যাড,জুলিয়াকে বাঁচানোর আর কোনো পথ খোলা নেই। একমাত্র ‘ব্লাড স্টোন’ ই পারবে ওই আলো গুলোকে ফিঁকে করে তুলতে। ড্যাড প্লিজ..’
-‘আর যদি ওখানে গিয়ে কোনোভাবে ‘ব্লাড স্টোন’ হারিয়ে ফেলো তুমি, তখন? কী হবে ম্যাক্স? ভাবছো একবারও?’
ম্যাক্স কথা বলতে পারল না। তার মাথাটা পুনরায় নিচু হয়ে গেল। নিজের প্রতি নিজের রাগ, ক্রোধ, হতাশা- সব একত্রেই অনুভব করল সে।

আলিজা তেজ পূর্ণ স্বরে বলে উঠলেন,
-‘এর মানে তুমি তোমার মেয়েকে ম’রতে দেখতে চাও? তাই তো মালোকো? তাই তো?’
-‘আমি..আমার কথাটা একবার বোঝো আলিজা। আমি কেমন করে সবার জীবন… ‘
-‘রাখো আর সবার কথা। তোমার মেয়ে একজন সাইকোর হাতে বন্দী! ওই আলো গুলো আমাদের জন্য কতটা ভয়ানক তা কী তুমি জানো না? সেই আলোর মাঝে আমার মেয়েটা যন্ত্রণায় ছটফট করে কাতরাচ্ছে। আর তুমি আছো বংশের অন্য সবার জীবন নিয়ে? তুমি কী সত্যিই ওর পিতা মালোকো?’

মালোকো হঠাৎই গলার স্বর শক্ত করে বললেন,
-‘তুমি আমাকে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারো। কিন্তু আমি ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে যাওয়ার আদেশ কিছুতেই দিতে পারব না। আমরা অন্য কোনো উপায় বের করব আলিজা। তুমি একটু শান্ত হও প্লিজ!’
-‘শান্ত হবো? তুমিও কী ভালো করে জানো না ওসব আলোর সামনে একমাত্র ‘ব্লাড স্টোন’ই কাজে আসবে। এছাড়া আর কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। জানো না তুমি?’

আলিজা হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। ম্যাক্স ছুটে এসে মালোকোর পায়ের কাছটায় বসল। ভেজা কণ্ঠে বলে,
-‘আদেশ দাও ড্যাড, প্লিজ আদেশ দাও। নইলে জুলিয়া..আর বাঁচাতে পারব না ওকে। একবার নিয়ে যেতে দাও আমাকে। কথা দিচ্ছি, নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি ‘ব্লাড স্টোন’ রক্ষা করব। আমাদের জাতির জীবন আমি হুমকির মুখে ফেলব না। আমাকে আদেশ দাও বাবা। প্লিজ, একবার আদেশ দাও।’

আলিজা দৌড়ে গেলেন হুট করে। তিন তলার একটি বন্ধ ঘরে ঢুকে রূপার বাক্স থেকে সোনালী রঙের চা’কু বের করে আনেন। এই চা’কু একবার যার বুকে ঢুকবে,তার জীবন নিশ্চিত শেষ। চা’কুটি নিয়ে এসে তিনি মালোকোর সামনে দাঁড়ালেন। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,
-‘যদি তুমি আদেশ না দাও মালোকো, আমি এই চা’কু দিয়ে নিজেকে আঘাত করতে দুইবার ভাববো না।’
মালোকো একবার ম্যাক্সের দিকে তাকালেন, একবার আলিজার দিকে। বেশ কয়েকবার ছেলে ও স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবশেষে রাজী হলেন ‘ব্লাড স্টোন’ ম্যাক্সের হাতে তুলে দেওয়ার। তবে শর্ত একটাই, ‘ব্লাড স্টোন’ যেভাবে অক্ষত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ঠিক সেভাবেই অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। যদি এর কিছু হয়, তবে এর প্রায়শ্চিত্ত ম্যাক্স নিজের জীবন দিয়েও শোধ করতে পারবে না।
ম্যাক্স রাজী হয়। সে কথা দিলো, জুলিয়া এবং ‘ব্লাড স্টোন’ দুটোকেই ঠিকঠাক ভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে সে। সেই সঙ্গে মনে মনে আরও একটি প্রতিজ্ঞা করল, ‘লাবণী, তোমাকেও আমি ফিরিয়ে নিয়ে আসবো আর এরপর কক্ষনো কোনো বিপদে পড়তে দেবো না। কথা দিচ্ছি।’

-‘মালিক, গ্রাম বাসীরা ফুঁসে উঠেছে। তারা খবর পেয়ে গেছে রাজকুমার ‘ব্লাড স্টোন’ নেওয়ার জন্য এসেছে। সবাই বাহিরে ভীড় জমিয়েছে। রীতিমতো চিল্লাচিল্লি শুরু হয়ে গেছে।’
একজন দাস দৌড়ে এসে কথাগুলো জানালো। মালোকো,আলিজা এবং ম্যাক্স- উপস্থিত তিনজনই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। মালোকো মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছিল, ঠিক সেটাই বাস্তবে রূপ নিলো। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। তাদের ভেতরকার কথা এতদ্রুত কে ছড়ালো গ্রামবাসীদের ভেতরে?
আলিজা ফুঁসে উঠে বললেন,
-‘দেখলে মালোকো, তাদের রাজার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সবাই। কতবার স্বার্থপর এবং ছোটলোক এরা!’
মালোকো হাত উঁচু করে বিরক্তি ভরা স্বরে আলিজাকে থামতে নির্দেশ দিলেন। বললেন,
-‘ওরা একদম ঠিক কাজটাই করছে। আমাদের মেয়ে বলে আমরা জীবনের পরোয়া করছি না। কিন্তু ওরা ওদের জীবনের পরোয়া করে। একটা জুলিয়া গেলে কী আসবে যাবে তাতে। অথচ ‘ব্লাড স্টোন’ এর কিছু হলে লাখ-কোটি র’ক্তচোষাদের জীবন নাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
আলিজা প্রত্যুত্তর করতে নিচ্ছিলো, তার আগে ম্যাক্স বলে উঠল,
-‘ড্যাড, আমি গিয়ে সবাইকে বোঝাচ্ছি। আমার কথা তারা নিশ্চয়ই বুঝবে।’
কথা শেষ করেই ম্যাক্স ছুটে চলল বাহিরে। পেছন থেকে ম্যাক্সের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে মালোকো এবং আলিজাও ছুটলো।

উঠোন জুড়ে উপস্থিত জনতার ভীড়। একজনের ঘাড় টপকে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে যেন। ম্যাক্স প্রাসাদের সম্মুখে সবচেয়ে বড় বারান্দায় উঠে দাঁড়ায়। তাকে দেখামাত্র সবার মধ্যে হৈচৈ কলরব বেড়ে উঠে। ম্যাক্স হাত উঁচু করে সবাইকে থামতে বললেও কেউ তার কথা পরোয়া করল না। অবস্থা বেগতিক, ম্যাক্স বুঝতে পারছে এখানেও ঝামেলা হতে দেড়ি নেই। সে হাত উঁচু করে হাতজোড় করে। গলার স্বর অসম্ভব রকমের তীব্র করে চিৎকার ছুঁড়ে দিলো।

-‘আপনারা সবাই চুপ করুন৷ প্লিজ চুপ করুন৷ আমার কথাটা একটু শুনুন।’

এবার অনেকেই চুপ করে গেল। তবে কারো চোখেমুখে বিন্দুমাত্র নরমতা নেই। সবাই ক্ষুব্ধ৷ রাগ নিয়ে চেয়ে রয়েছে ম্যাক্সের পানে। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস টাকে কোনোভাবেই লুকোতে পারে না ম্যাক্স। সে আকুতির সুরে বলল,
-‘আমি জানি না কে আপনাদের খবর দিয়েছে যে আমি ‘ব্লাড স্টোন’ নিতে এসেছি। আমি সত্যিই নিতে এসেছি কিন্তু আপনাদের রাজকুমারীর জীবন বাঁচাতে। তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেই আমি আবার জায়গা মতোন জিনিসটা রেখে দেবো। কথা দিচ্ছি, এতটুকু ক্ষতি আমি হতে দেবো না ‘ব্লাড স্টোন’ এর। আমার উপর একটু ভরসা করুন।’

-‘ভরসা? যে নিজের বোনকে বাঁচাতে পারে না, ‘ব্লাড স্টোন’ এর কাছে ছুটে আসে, তাকে আবার কীসের ভরসা করব?’

উপস্থিত জনতাদের ভেতর থেকে কেউ একজন কথাখানা ছুঁড়ে মারলো তীব্র বিদ্রুপ নিয়ে৷ ম্যাক্স গায়ে মাখালো না। পূর্বের ন্যায় অনুরোধ করে বলল,
-‘আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে এমনভাবে আঁটকে রেখেছে যে ‘ব্লাড স্টোন’ ছাড়া আর কোনো গতি নেই।’
-‘রাজকুমার, আপনার বোনের জন্য আমরা আমাদের সবার জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না। শুধু আমরা কেন, আমাদের অন্য বংশ গুলোও এই অন্যায় মেনে নেবে না৷ ‘ব্লাড স্টোন’ রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর আরোপিত বলে আপনারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না। একদিকে রাজকুমারী,অন্যদিকে আমরা সবাই- লাখো-কোটি র’ক্তচোষার দল। এবার আপনিই সিদ্ধান্ত নিন যে কী করবেন। আমরা কোনোভাবেই আমাদের জীবন বাজি রাখতে চাচ্ছি না।’

রুক্ষ স্বরে কথার বাণ ছুটে এসে বিদ্ধ করল ম্যাক্সের বুক। এই এদের জন্য তার দাদা,পরদাদা সহ গোষ্ঠীর আরও অনেকেই জীবন দিয়েছেন। শহীদ হয়েছেন৷ তার বাবা এবং সেও একই লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে। অথচ এদের তার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই! সবাই শুধু নিজেকে নিয়েই পড়ে আছে!

ম্যাক্স এবার গলায় খানিকটা কাঠিন্য যুক্ত করে বলল,
-‘তাহলে এই যদি হয় তোমাদের শেষ সিদ্ধান্ত, তবে আমার শেষ সিদ্ধান্ত ও শুনে রাখো। আমি আমার বোনকে বাঁচাবোই। ‘ব্লাড স্টোন’ কেও নিয়ে যাবো এবং ঠিকঠাক ভাবে ফেরতও নিয়ে আসবো। সাহস থাকলে আমাকে থামাও। এসো,কে আসবে আমার সামনে, এসো!’

ম্যাক্সের হুংকার শুনে গুটিকয়েক ভ্যাম্পায়ার ভয়ে পিছিয়ে গেলেও হৈহৈ করে একদল ভ্যাম্পায়ার আগুন চোখ নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো। ম্যাক্স নিজের চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। মনে মনে আওড়ে যায় শেখানো মন্ত্র। তারপর চোখ খুলতেই দেখা যায়, টকটকে লাল বর্ণের একজোড়া মণি, যেন সবকিছু ভস্ম করে দেওয়া আগুন খেলা করছে ওর ভেতরে। ঠিক তখনই ম্যাক্সের ঘাড়ে একটা হাত পড়ল। তাকে ঝাঁকি দিয়ে রীতিমতো ধমকের সুরে বলল,
-‘কী করছ ম্যাক্স? এরা তোমার স্বজাতি,তোমার ভাই। ভুলে গেছো?’
ম্যাক্স হুশ ফিরে পায়। পেছন ফিরে মালোকোকে দেখতে পেয়ে মাথাটা নিচু করে ফেলল। হতাশ গলায় বলল,
-‘আমি কী করব ড্যাড? এরা যে আমাকে কোনোভাবেই ভরসা করছে না। আমি যে এদের বোঝাতে পারছি না। এরা যুদ্ধ চায়, তাহলে হোক যুদ্ধ।’
-‘পাগল হয়ো না। আমি এখনো জীবিত আছি।’

ছেলেকে শান্ত করে মালোকো এগিয়ে গেলেন। উপস্থিত জনতাদের বোঝানোর শেষ চেষ্টাটুকু করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরলেন। কেউ তো বুঝলোই না উল্টো রাজা এবং রাজ বংশের সকলকে বন্দী করার কথা বলল সকলেই এক যোগে। মালোকো বুঝতে পারলেন, জীবন নাশের শংকার জন্যেই সবাই এতোটা ক্ষেপে উঠেছে। এদের বোঝানো যাবে না। ঠান্ডা ও করা যাবে না। একদিকে নিজের র’ক্তের সন্তান, অপরদিকে আর্নিশ জগত বাসী। কোথায় যাবেন মালোকো! কোন পক্ষকে সমর্থন জানাবেন? দু’পক্ষই যে যার যার তরফ থেকে সঠিক!

ম্যাক্স জোরালো কণ্ঠে বলল,
-‘ড্যাড, এরা বুঝবে না। সব কয়টা স্বার্থপর। দেখছো না নিজেদের চিন্তায় বিভোর সবাই। আমার বোনের জীবন নিয়ে কেউ ভাবছে না।’
-‘এটাই কী স্বাভাবিক নয় ম্যাক্স?’
বললেন মালোকো।
ম্যাক্স তেজী গলায় বলল,
-‘আমি এত কিছু জানি না ড্যাড। আমি আমার বোনকে মৃ’ত্যুর মুখে ফেলে চলে আসতে পারবো না। আমার বোনের মৃ’ত্যু অবধারিত যদি সে ওখানে থাকে। এখানে এদের বুঝাতে গিয়ে সময় নষ্ট করারও মানে হয় না। তুমি এদিকটা সামলাও, আমি চললাম।’
-‘ম্যাক্স!’
-‘আমার কসম লাগে ড্যাড, তোমাকে আমার এই উপকার টুকু করতেই হবে।’

মালোকো ম্যাক্সের এহেন কথা শুনে থমকে দাঁড়ালেন। ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কোনোটাই প্রত্যুত্তরে বলতে পারলেন না। তার আগেই ম্যাক্স ছুটে চলল পেছনের রাস্তার দিকে। এই দিকের পথ দিয়ে সে সোজা চলে যাবে সেখানে যেখানে লুকিয়ে আছে ‘ব্লাড স্টোন’ আর তারপর জুলিয়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবে সে।

মালোকো উপস্থিত জনতাদের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন। তিনি জানেন, খুব বেশি হলে তিরিশ মিনিট, এরপরই সবাই জেনে যাবে ম্যাক্স পালিয়েছে ‘ব্লাড স্টোন’ নিয়ে। আর তারপর কেউ তো তার কোনো কথা শুনবেই না বরং তাকে এবং তার স্ত্রীকে রাজবন্দী করা হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না ম্যাক্স তাদের হাতে এনে দেবে ‘ব্লাড স্টোন’। সেই সঙ্গে কথার বরখেলাপ ও প্রতারণা করার অপরাধে তাদের উপর আরোপিত দায়িত্ব বদলে লানত ও অভিশাপ বর্ষিত হতে শত শত বছর ধরে। তবুও মালোকো নিরুপায়। আগাম ভবিষ্যৎ জেনেও তিনি সবকিছু মেনে নিলেন একমাত্র ছেলের খাতিরে। ম্যাক্সকে তিনি বড় ভালোবাসেন, ঠিক যেমন ম্যাক্স ভালোবাসে তার ছোট বোন জুলিয়াকে!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here