ভীন_দেশের_গল্প #পর্ব_৯,১০

0
1249

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৯,১০
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

‘S.Sherlock’- ওর পুরো নামটা ছিল শারু শার্লক। প্রায় ছ বছর আগের কথা। সেবার জুলিয়ার জন্মদিনে নতুন প্রতিবেশী হিসেবে শারুও দাওয়াত পেয়েছিল। একটা ডেনিম নেভি ব্লু স্যুট-কোটে সে এটেন্ড করেছিল গোমেজ পরিবারের আয়োজিত অনুষ্ঠানে। বার স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক ছিপ নিতে ব্যস্ত ছিল যখন, তখন ফুলের গালিচা মাড়িয়ে লম্বা সাদা ফ্রক পরনে জুলিয়া আগুন জৌলুশ রূপ নিয়ে নিচে নামলো একের পর এক সিড়ি বেয়ে। একপলক দেখতেই শারুর চোখজোড়া থেমে গিয়েছিল জুলিয়াতে। খুব বেশিদিন হয়নি নতুন বাড়িতে এসে উঠার। চেনা পরিচিত লোক নেই বললেই চলে- তাই সারাদিন একা নিজের মতো সময় পার করতো শারু। বাহিরে সময় কাটানো খুব একটা পছন্দ নয় বলে এর আগে জুলিয়াকে দেখা হয়নি তার। এই দাওয়াতটা পেয়েও আসার ইচ্ছে ছিল না মোটেও। তবুও কী ভেবে যেন চলেই এলো শেষমেশ। ভাগ্যিস এসেছিল, নইলে এত সুন্দরী রমণীর দেখা পেত কেমন করে?
ভালোলাগাটা মূলত সেখান থেকেই শুরু। তার পরদিনই জুলিয়াকে সরাসরি নিজের পছন্দের কথাটুকু জানিয়ে দেয় শারু। উঁচা-লম্বা, সুদর্শন, পুরুষালী শরীরের অধিকারী শারুকে ভালো লেগে যায় জুলিয়ারও। দু’জনের মধ্যকার সম্পর্ক গাঢ় হয় ধীরে ধীরে। তারপর একটা দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনার পর থেকেই শারুর সঙ্গে জুলিয়ার পারিবারিক সম্পর্কটা বন্ধু থেকে পাল্টে শত্রুতে রূপ নিয়েছিল। শারু চলে গিয়েছিল এক বুক কষ্ট এবং আঘাত নিয়ে। বলে গিয়েছিল, আর কোনোদিন জুলিয়া বা তার পরিবারের কারো মুখ সে দেখতে চায় না। তবে আবার কেন ফিরে এলো? এই ফিরে আসার পেছনের আসল কারণ কী?
ভাবতে ভাবতে মাথা পাগল হওয়ার অবস্থা ম্যাক্স। সে কী করবে,কোথায় যাবে,কোথায় গেলে উপায় মিলবে জুলিয়া এবং লাবণীকে মুক্ত করার- তা ভাবতে ভাবতেই মিঃ ড্যামের কথা পুনরায় মনে পড়ে ম্যাক্সের। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বেগে সে ছুটলো চার্চের উদ্দেশ্যে।

-‘আমি সত্যি সত্যি দুঃখীত মিঃ ড্যাম। আপনাকে এরকম সময়ে বিরক্ত করার জন্য!’

ধ্যানে বসেছিলেন মিঃ ড্যাম। এমন সময়ে ম্যাক্স এসে তাকে ডাকাডাকি শুরু করলে অগত্যা ধ্যান রেখে উঠে আসতে হয় তাকে। যা দেখে ম্যাক্সের ভেতরটা গ্লানিতে ভরে গেল। সে অপরাধী কণ্ঠস্বরে উপরিউক্ত কথাটুকু বলে ঘাড়টা যথাসম্ভব নিচু করে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মিঃ ড্যাম স্মিত হেসে এগিয়ে গেলেন। ম্যাক্সের কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললেন,
-‘রাজকুমার, আপনি কেন এত নরম মনের, বলুন তো? আপনাকে এ-সাজে মানায় না। আমি আপনার দাস। আপনি আমাকে হুকুম করবেন, আমি তা পালন করব।’
ম্যাক্স সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করে,
-‘মিঃ ড্যাম, আপনার সাহস হয় কী করে এই ধরনের কথা বলার? আপনাকে আমি কতবার বলব, আপনি আমাদের পরিবারের একজন। আপনাকে আমার দাদা-দাদী অথবা বাবা-মা কখনোই দাস হিসেবে ভাবেনি। তাহলে আমি কেমন করে ভাববো?’
কথার মাঝে একটু বিরতি দিয়ে ম্যাক্স গলায় কাঠিন্য যোগ করে বলল,
-‘ফের যেন না শুনি এইধরনের কোনো কিছু না বলতে।’
মিঃ ড্যাম মেকী কুর্নিশের ভঙ্গি করে ম্যাক্সের কথায় সম্মত হলো। ম্যাক্স ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে। মিঃ ড্যাম বললেন,
-‘কী ব্যাপার রাজকুমার? আপনাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে।’
-‘চিন্তারই বিষয় ড্যাম। আপনি যদি শোনেন,তবে আপনিও চিন্তায় পড়বেন।’
-‘আমাকে বলুন রাজকুমার। আমি আমার সর্বাত্মক সাহায্য করবো আপনাকে।’
ম্যাক্স স্বস্তির সহিত বলল,
-‘এইজন্যেই তো আপনার কাছে ছুটে আসা। আমি জানি, আপনিই পারবেন আমাকে যেকোনো একটা পথ বাতলে দিতে।’

মিঃ ড্যামকে সবকিছু খুলে বলল ম্যাক্স। শারুকে আগে থেকে মিঃ ড্যাম ও চিনতেন। তাই তিনিও যারপরনাই বিস্মিত হলেন। এতগুলো বছর পর এসে জুলিয়া এবং লাবণীকে এভাবে কিডন্যাপ করার কারণ কী হতে পারে তা সঠিক ভাবে বুঝতে পারলেন না তিনিও। কিন্তু তাই বলে ম্যাক্সকে খালি হাতে ফিরিয়েও দিলেন না। ম্যাক্সের থেকে সময় চেয়ে তিনি পুনরায় ধ্যানে বসলেন। নিজের মনশ্চক্ষু খুলে খুঁজতে লাগলেন একটি পথ। অন্তত ওদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই জায়গার খোঁজটুকু পেলেও চলবে।

পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে অন্ধকারের মাঝে আবিষ্কার করে লাবণী। ঘামে ভেজা মুখখানা। মাথার ভেতর একধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে। কোথায় আছে,কী হয়েছিল,তা মনে করতে চাইলে যন্ত্রণারা চাপ দিয়ে বসল। মুখ ফুঁটে অস্ফুটে উহঃ জাতীয় শব্দ বেরিয়ে আসে তার। ঠিক তখনই একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায় লাবণী।

-‘ল্যাবণী? তুমি ঠিক আছো?’

জুলিয়া? কণ্ঠটা জুলিয়ার। তবে কী সেও রয়েছে লাবণীর সঙ্গে? কোথায়? কোথায় জুলিয়া? লাবণী আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্ধকারের মাঝেই জুলিয়ার অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করল। ব্যর্থ হলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোনো কিছু দেখা দায়। তবুও অজানার উদ্দেশ্যে প্রত্যুত্তর ছুঁড়ে দিলো সে,
-‘জুলিয়া? আপনি কোথায়? আপনি ঠিক আছেন? আ.। আমি ঠিক আছি।’
-‘আমি তোমার আশেপাশেই আছি লাবণী। আমাকে তুমি যেমন দেখতে পাচ্ছো না, কিন্তু আমি তোমাকে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি।’
-‘দেখতে পাচ্ছেন? এই অন্ধকারের ভেতরও আমাকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন? কীভাবে?’
-‘তা তোমার জানার বিষয় নয় ল্যাবণী। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার হলো, তুমি আমাদের শত্রু নও।’
-‘আমি আপনার শত্রু হতে যাবো কেন! আমি আপনার কথার আগামাথা কোনোকিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ, আপনি লাইটটা জ্বালান। অন্ধকারে আমার ভয় করছে।’

জুলিয়ার কথাগুলো আহত করে লাবণীকে। একই সঙ্গে করে তোলে বিস্ময়। অন্ধকার একেবারেই অপছন্দ লাবণীর নিকট। সেই সঙ্গে এরকম অদ্ভুত কথাবার্তা তার অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুললো। লাবণী পুনরায় আকুতির স্বরে বলল,
-‘প্লিজ আপনি লাইট জ্বালান। আমার ভালো লাগছে না।’
প্রত্যুত্তরে ধমকে কথা বলে উঠে জুলিয়া,
-‘আমার হাত-পা বাঁধা। আমি যদি পারতাম তবে কী অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখতাম তোমাকে? তাছাড়া আমার তো বেশ ভালোই লাগছে। বহুদিন পর এত অন্ধকার উপভোগ করতে পারছি।’
এহেন কথা শুনে লাবণীর ভ্রু-যুগল আপনা আপনি কুঁচকে এলো।
-‘আ…আপনি এইভাবে কথা বলছেন কেন আপু? অন্ধকার কার ভালো লাগে? কোনো মানুষেরই অন্ধকার ভালো লাগে না। এই ঘুটঘুটে অন্ধকার তো একদম না।’
-‘এত কথা বোঝানোর মতো সময় এখন নেই। আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।’
অধৈর্য্য কণ্ঠ জুলিয়ার। পরক্ষণেই আদেশের সুরে বলল,
-‘তোমার বাম পায়ের পাশেই একটা চা’কু পড়ে আছে। ওটা পা দিয়ে ঠেলে আমার দিকে দিতে পারবে ল্যাবণী?’
লাবণী অবাক গলায় বলল,
-‘আপনি কী করে দেখলেন?আমি তো..আমি তো..’
-‘উফফো! এত কথা কেন বলো মেয়ে?যে কাজ দিয়েছি তা করো না। চা’কুটা দাও।’
পুনরায় ধমকে উঠে জুলিয়া। লাবণী এবার কেঁদেই ফেলল। একটার পর একটা এসব ঘটনা নেওয়া যাচ্ছে না। তাও যদি স্বাভাবিক হতো! সবগুলো ঘটনাই অস্বাভাবিক। লাবণী মনে মনে বলল, ‘আমার ঘাট হয়েছে!! আমি অনেক বড় ভুল করেছি এই দেশে এসে। আমি বাংলাদেশেই ভালো ছিলাম। সতীন নিয়েই থাকতাম নাহয়। অন্তত এসব অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা সহ্য করতে হতো না।’

নিশ্চুপ লাবণীর ফ্যাঁচফ্যাঁচ কান্নার শব্দ জুলিয়াকে ভয়ংকর ভাবে রাগিয়ে তুলল। সে রীতিমতো হুংকার ছেড়ে বলল,
-‘ঘা’ড় ফুটো করে মে’রে ফেলবো একদম। এটা কান্নার সময়? এই মেয়ে,কথার জবাব দাও। এটা কান্নার সময়?’
-‘আ..আপনি কে? সত্যি করে বলুন আপনি কেন আমাকে এখানে ধরে এনেছেন? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করি নাই। আপনি জুলিয়া আপু নন। উনি আমার সাথে এইভাবে কথা বলতে পারে না।’
ঠিক তখনই লাবণীর বিদ্যুতের মতো একটা কথা মাথার ভেতর চিলিক মেরে উঠে। জুলিয়া ইংরেজী ব্যতীত অন্যকোনো ভাষায় কথা বলেনি। সে এত স্পষ্ট বাংলা কী করে বলছে? এতক্ষণ ঘটনার মারপ্যাঁচে পড়ে বিষয়টা নজরে না এলেও এখন হুশ ফিরেছে। সঙ্গে সঙ্গে কান্নার বেগ বেড়ে দ্বিগুণ হয়। রীতিমতো হেঁচকি উঠে গেল লাবণীর। সে আকুতির স্বরে বলে চলল,
-‘কে আপনি? জুলিয়া আপু তো বাংলা-ই জানে না। আপনি আমাকে কেন ধরে এনেছেন? আপনি আমার সর্বনাশ করতে চান? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি? আমাকে ছেড়ে দেন। আমি দেশে চলে যাবো। আর আসবো না,কক্ষনো না।’

দাঁতে দাঁত কামড়ে নিজের রাগটা সংবরণ করে জুলিয়া। লম্বা লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে ধীর স্বরে বলল,
-‘আমি জুলিয়াই। তোমাকে আমি কেন ধরে নিয়ে আসবো? আমি নিজেও এখানে ফেঁসে আছি, দেখছো না? আর আমি কীভাবে বাংলা কথা বললাম, তা যথাসময়ে জানতে পারবে। এখন কান্না থামাও। প্লিজ লাবণী, কান্না থামাও!’
লাবণীর কান্নার দমক খানিকটা কমলো এইবার। তবে ফোঁপানি রয়ে গেল।
জুলিয়া বলল,
-‘লাবণী, আমরা এখানে ফেঁসে গেছি। আমার জন্য তুমিও ফেঁসে গেছো। তোমার উচিত ছিল আরও পরে ঘুম থেকে জেগে ওঠার। তাহলে ফাঁসতে না। যাইহোক, এখন আমাদেরকেই একটা পথ বের করতে হবে এখান থেকে বের হওয়ার। আমি অন্ধকারে সবকিছু দেখতে পারি,সবকিছু স্পষ্ট টের পাই। তাই ভয় নেই। শুধু আমি যেমনটা বলে যাই, তেমনটা করো। কেমন?’
লাবণী অন্ধকারে নিরবে ঘাড় নাড়ে। মুখ দিয়ে হা হুঁ কিছু করল না। জুলিয়া এত কঠিন সময়েও মৃদু হাসল। এরকম ভীতু এবং ছিচকাঁদুনে মেয়ে সে এই প্রথমবার দেখল।

অধির আগ্রহ নিয়ে বসে রয়েছে ম্যাক্স। প্রতিটা সেকেন্ড যেন ঘন্টার সমান! একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে একটু দূরে ধ্যানে বসা মিঃ ড্যামের দিকে। বুকের ভেতরটা হাপড়ের মতো উঠছে নামছে। তার বোনের সঙ্গে কীরকম আচরণ করা হচ্ছে, তা ভেবেই কলিজা শুকিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে লাবণীর চিন্তা যে তার মাথায় উঁকি দিচ্ছে না,তা অবশ্য না। তবে লাবণীর চেয়েও অধিক চিন্তা জুলিয়ার। লাবণী তার কেউ না। যদি প্রা’ন যায় তার,তবে যাক। কিন্তু জুলিয়া..জুলিয়ার কিচ্ছু হওয়া যাবে না। জুলিয়ার কিচ্ছু হলে সে পুরো পৃথিবী নড়িয়ে তুলবে।

সাত-পাঁচ ভাবনায় মাথার ভেতরটা যখন জ্যাম পাঁকিয়েছে, ঠিক তখনই মিঃ ড্যাম গর্বিত ভঙ্গিতে চেঁচালেন,
-‘রাজকুমার, আমি পেয়েছি।’
চোখের পলকে মিঃ ড্যামের সামনে গিয়ে বসে ম্যাক্স। দ্রুততার সঙ্গে বলল,
-‘কী? কী পেয়েছেন? আমাকে জলদি বলুন। কোথায় আছে ওরা? কোথায় রেখেছে শার্লক ওদের? রাস্তা দেখান।’
এ কথা শুনে মিঃ ড্যামের চোখেমুখে হালকা মেদুর রঙের ছায়া নেমে এলো। তিনি গলায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বললেন,
-‘রাস্তা পাইনি রাজকুমার। তবে সেই রাস্তা পাওয়ার জন্য কী উপায় অবলম্বন করতে হবে,তা পেয়েছি।’
নিমিষেই এক ছটাক হতাশা ঘিরে ধরল ম্যাক্সকে। তবে মনের জোর হারালো না। আপাতত এইটুকুই ভরসা। সে তড়িৎ গতিতে বলল,
-‘বলুন।’
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে মিঃ ড্যাম বললেন,
-‘তবে এখানে আপনার জীবনসঙ্গিনীর ও ভূমিকা রয়েছে রাজকুমার। আপনার জীবনসঙ্গিনীর যেকোনো কিছু আপনি স্পর্শ করার সাথে সাথে আপনার কাছে একটি সুযোগ আসবে। আপনি চোখ বন্ধ করে জুলিয়ার নাম ধরে উচ্চারণ করলে সে কোথায় আছে,সেখানে যাওয়ার রাস্তা- সবটা আপনি মনের আয়নায় দেখতে পারবেন।’
-‘অ্যাহ!’
ম্যাক্সের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠে। আক্রোশপূর্ণ গলায় সে বলে উঠল,
-‘আমার জীবনসঙ্গিনী? তাকে কোথায় পাবো আমি? আমার তো কেউ নেই!’
-‘জানি। জানি বলেই তো আমিও হতাশ হয়ে পড়েছি রাজকুমার।’
অস্বস্তির নিরবতায় ডুবে যায় দু’জনেই। ম্যাক্সের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বোনকে ফিরে পাওয়ার আশাটুকু নিরাশা ঢেকে নিচ্ছে। তার কোনো গার্লফ্রেন্ডই নেই, সেখানে জীবনসঙ্গিনী আসার প্রশ্নই উঠে না!
মুখ ঘুরিয়ে নিজের অসহায়ত্ব লুকোতে চেষ্টা করে ম্যাক্স। মিঃ ড্যাম ম্যাক্সের পিঠের উপর হাত রেখে বললেন,
-‘রাজকুমার, হতাশ হবেন না। আমরা খুঁজবো চলুন। আপনার জীবনসঙ্গিনী অবশ্যই আছে।’
-‘হুম, আছে তো, আমার মাথায় আছে! মানে এতোই সোজা? আমরা খুঁজতে বের হয়ে গেলাম, আর পেয়ে গেলাম? এই জার্মানিতে কত কোটি মেয়ে আছে, কোনো আইডিয়া আছে আপনার? তাদের ভেতর কে আমার জীবনসঙ্গিনী,সেটা কেমন করে বুঝবো আমি?’
-‘আদৌও এই দেশের কীনা, তাও বা কে জানে!’
বলে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় মিঃ ড্যাম। তার কথার মর্মার্থ ধরতে পেরে ম্যাক্সের বুক চিঁড়ে হাহাকার বেরিয়ে আসে। শব্দরা হারিয়ে যায়। সে ব্যর্থ চিত্তে বাসার পথে রওনা হলো।

ঘরের দরজা হাট করে খোলা। এক পাশে একটু ঝুলে রয়েছে। সন্ধ্যের সময় দরজা লাথি দিয়ে ভেঙে রেখে যাওয়ার ফল। এভাবেই ঘরবাড়ি উদাম রেখে চলে গিয়েছিল ম্যাক্স। এতক্ষণে ঘরের ভেতরে সব ফাঁকা করে দিয়েছে কীনা চোরেরা,কে জানে! অবশ্য এসব নিয়ে মোটেও ভাবনা নেই ম্যাক্সের মনে। নিয়ে যাক,সব নিয়ে যাক,ঘরবাড়ির দলিলও নিয়ে যাক। শুধু জুলিয়াকে ফিরে পাওয়ার একটা রাস্তা কেউ বলে দিক। কোথায় আছে জুলিয়া? কেমন আছে সে? তাকে এতক্ষণে জীবিত রেখেছে নাকি…
ম্যাক্সের মনটা হু’হু করে কেঁদে উঠে। সে সোফায় বসে পড়ল ধপ করে। মনটাকে নানান ভাবে বুঝিয়ে শক্ত করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বারবার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। ভাগ্যিস সে একা,কেউ নেই তার এই কান্না দেখার। তাহলে কী হাসির পাত্রটাই না হতো!
আঙুল দিয়ে মুছতে গিয়ে নখের কোণা চোখের ভেতর লেগে ভীষণ জ্বালা করে উঠে ম্যাক্সের। আশেপাশে খুঁজে একটা ওড়না পেল সে। কার ওড়না তা খেয়াল না করে দ্রুত চোখের উপর চেপে ধরে। ডলে ডলে চোখ মুছে নেওয়ার সময় হুট করেই সম্মোহনের মতো হলো। বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠল, ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি কক্ষ। তারপর কয়েকটি গাছের পাতা, আকাশে অমাবস্যার আঁধার। এরপর একটি জঙ্গলে দু’জন নারীর দৌড়ের শব্দ। ওইতো, ওইতো জুলিয়া! দৌড়াচ্ছে। তাদের পেছনে কেউ আছে! কে? কে সে?
দেখার আগেই সবকিছু নিমিষেই মিলিয়ে গেল। সেকেন্ডের ব্যবধানে অনেক কিছু দেখে ফেলল ম্যাক্স। সারা শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে তার। সে চোখ মেলতেই হাতে ধরা ওড়নাটা নজরবন্দী হয়। এটা কার যেন?
লাবণীর? মনে পড়ে ম্যাক্সের। সেই সঙ্গে মনে পড়ে আরও একটি কথা, মিঃ ড্যাম বলেছিলেন, তবে এখানে আপনার জীবনসঙ্গিনীর ও ভূমিকা রয়েছে রাজকুমার। আপনার জীবনসঙ্গিনীর যেকোনো কিছু আপনি স্পর্শ করার সাথে সাথে আপনার কাছে একটি সুযোগ আসবে। আপনি চোখ বন্ধ করে জুলিয়ার নাম ধরে উচ্চারণ করলে সে কোথায় আছে,সেখানে যাওয়ার রাস্তা- সবটা আপনি মনের আয়নায় দেখতে পারবেন।”
তবে কী…তবে কী লাবণীই ম্যাক্সের জীবনসঙ্গিনী?
ম্যাক্সের মনে হলো, ছোট খাটো একটা ভূমিকম্প তার পায়ের তলায় অনুভূত হয়েছে।

(চলবে)

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_১০
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

শাঁ শাঁ করে বাতাস বইছে চারিদিক থেকে। গায়ের লোম গুলো উড়িয়ে দিচ্ছে যেন। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে লাবণী। একে তো রাত, তার উপর খোলা জঙ্গল। বাতাসের সঙ্গে হু হু করে আসা শীতের তীব্রতা তার শরীর নিস্তেজ করে দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তাপমাত্রা কত’র ঘরে, কে জানে। লাবণী স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এভাবে আর ক’মিনিট গেলে অজ্ঞান হতে দেড়ি নেই তার। হতে পারে, জীবনের অন্তিম মুহূর্তে চলে এসেছে সে। হতে পারে, এভাবেই দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় মা’রা যাবে। এতসব চিন্তার ভেতরেও পা-দুটো থেমে নেই এক সেকেন্ডের জন্যেও। জুলিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বারবার শ্বাস ঘন হয়ে উঠছে।

লাবণী হাপানো গলায় বলল,
-‘আপু..আপু আমি আর পারছি না। প্লিজ আপু।’
জুলিয়া থামলো। পেছন ঘুরে লাবণীকে দেখল, সে অলরেডি একটা গাছের গুড়ির উপর বসে পড়েছে। বুকটা হাপড়ের মতো উঠছে নামছে। তার চোখে পানি। আবার কাঁদছে মেয়েটা!

জুলিয়া বিরক্ত ধরা গলায় বলল,
-‘ম’রতে চাও? ম’রতে না চাইলে উঠো।’
-‘আমি এমনিতেও ম’রে যাবো আপু। এত শীত আমার সহ্য হচ্ছে না। আর..আর আমি দৌড়াতেও পারছি না।’
হতাশ কণ্ঠস্বর লাবণীর। জুলিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘এভাবে দৌড়ানোর পরেও শীত লাগছে তোমার?’
লাবণী উপরনিচ মাথা দোলালো। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটাকে কোনোভাবেই চাপাতে পারল না জুলিয়া। অনেক কষ্টে ওই অন্ধকার কুঠুরি থেকে পালিয়ে এসেছে তারা। এখন যদি অর্ধেক পথে এসে হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে লাভটা কী হলো?
নাহ, হাল ছাড়া যাবে না। জুলিয়া হাল ছাড়ার মেয়ে নয়। সে এগিয়ে গিয়ে লাবণীকে টেনে দাঁড় করালো। লাবণী কুঁকড়ে রয়েছে। ঠিক ভাবে দাঁড়ানোটাও এখন আর সম্ভব নয়। তার মুখ অস্বাভাবিক ফর্সা। হাতখানা বরফ প্রায়। জুলিয়া ডাকলো,
-‘ল্যাবণী? চোখ খোলা রাখো। এই মেয়ে! প্লিজ।’
লাবণী পারছে না। সে আধো আধো শব্দ শুনলো কর্ণকুহরে। তার চোখেমুখে গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো ধীরে ধীরে। তারপর…তারপর আর কিচ্ছুটি মনে নেই!

লাবণী অতল ঘুমে তলিয়ে গেল। সেন্সলেস।
জুলিয়া লাবণীকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে গাছের গুড়িতে রাগ নিয়ে একটা লাথি মেরে বসল। আনমনে বিড়বিড় করে উঠে,
-‘শিট!!’
দ্রুত আশেপাশে চোখ বুলিয়ে তাকায়। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না দেখে একটু স্বস্তি মিললো। কিন্তু এখন কী করবে সে? তার শক্তি এতোটাও না যে লাবণীকে কোলে তুলে দৌড়াতে পারবে! অপরদিকে এতক্ষণ এত শক্তি খাটানোর জন্য অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে এসেছে তার শরীরও! কিন্তু সে শীত এবং অন্ধকার দুটোই সহ্য করতে পারে বলে রক্ষা।
জুলিয়া অস্থির মনে পায়চারী করতে লাগল। একবার আশেপাশে তাকাচ্ছে,আরেকবার মাটিতে অচেতন লাবণীর দিকে। কী করবে কিছুই আসছে না মাথায়। নিজের গায়ে অতিরিক্ত কিছু নেই-ও যে খুলে লাবণীকে পরিয়ে দিবে। ঠোঁট কামড়ে হতাশায় ডুবে যায় সে।

-‘আরও একবার ওয়েলকাম মিস জুলিয়া।’
একটি পরিচিত গমগমে কণ্ঠস্বর। জুলিয়া বিদ্যুৎ বেগে সামনের ঝোপে তাকাল। সেখান থেকে ঠোঁটে ক্রুর হাসি নিয়ে ধীরস্থির ভাবে বেরিয়ে এলো শারু শার্লক। জুলিয়া রুখে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করতেই শারু দু’দিকে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে উঠল,
-‘নো,নো,নো। আর চালাকি না। একবার পার পেয়ে গেছো বিধায় বারবার পার পাবে,তা ভাবলে খুব বড় ভুল ভাবনায় আছো তুমি।’
-‘শারু!!’
জুলিয়ার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। চিৎকারের তীব্রতায় আশেপাশের কিছু বন্য কীট-পতঙ্গও ঝি ঝি আওয়াজ তুলে দিলো। জুলিয়া আগুন রাঙা চোখে চেয়ে বলল,
-‘আমি তোমাকে এক মিনিটেই এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলতে পারি। তুমি কী জানো না সেটা? বলো, জানো না? আমার সাথে লাগতে এসো না শারু। একসময় তোমাকে ভালোবেসেছিলাম দেখে আজ তোমার অন্যায় গুলো মুখ বুঁজে সহ্য করব, তা ভেবে থাকলে তুমিও অনেক বড় ভুল ভাবনায় আছো।’
শারু হাসির দমক বাড়িয়ে দিলো। প্রত্যুত্তরে বলে,
-‘আই নো ডার্লিং। ইউ আর মাই ডেঞ্জারাস লেডি, আই নো!’ বলেই একটা তুড়ি মারলো দু আঙুলের সাহায্যে। সঙ্গে সঙ্গে মাথার উপর থেকে গাছপালা ভেদ করে নেমে এলো একটা লোহার পিঞ্জর। যেখানে বদ্ধ হয়ে গেল জুলিয়া এবং লাবণী। জুলিয়া চকিতে চারপাশে চেয়ে দেখে পুনরায় শারুর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

-‘আমাকে বন্দী করে রাখবে? এই খাঁচায়?’
প্রশ্নে বিদ্রুপের ইঙ্গিত। শারু গায়ে মাখলো না। পুনরায় তুড়ি মারতেই পূর্বের ন্যায় উপর থেকে লতাপাতার মতো কিছু একটা পড়ল। খাঁচাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল লতাগুলো। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় জুলিয়া। চাপা গোঙানির মতো শব্দ ছিটকে আসে ঠোঁট ভেদ করে। খাঁচার একদম মাঝখানে যেখানে লাবণী অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে, সেখানে গিয়ে নিজেও বসে পড়ে সে। লাবণীর শরীর ভেতর গুটিশুটি পাঁকায় ব্যথার তীব্রতায়। বাঘিনী জুলিয়া বিলাইয়ের মতো আচরণ দেখে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হা-হা করে হেসে উঠে শারু। হাসির শব্দ জুলিয়ার কলিজায় শত শত সূচের ন্যায় বিঁধলো। ইচ্ছে করছে,জা’নোয়ারটার কলিজা ছিঁ’ড়ে খেয়ে ফেলতে। কিন্তু এখন নিরুপায়। যতক্ষণ খাঁচার আশেপাশে এই ছোট ছোট চোখ ধাঁধানো আলোর লতা গুলো থাকবে, ততক্ষণে সে কিছুই করতে পারবে না। একমাত্র অতিরিক্ত আলোর কাছেই অসহায় ভ্যাম্পায়ারদল। তাই তো তারা দিনের বেলা নয়, রাতকেই পছন্দ করে সবচেয়ে বেশি। দিনের আলোয় রোদচশমা পড়ে চলাচল করে চোখকে সুরক্ষিত রাখার জন্য। তাদের সমস্ত শক্তি ওই চোখজোড়াতেই লুকিয়ে থাকে। যত অন্ধকার, তত চোখে আরাম, ততই শক্তি।

শারু হাসি থামিয়ে খাঁচার চারপাশ চক্কর দিতে লাগল। পকেটে দু’হাত গুঁজে গুটিশুটি পাকানো জুলিয়াকে পরখ করে নিলো। বলল,
-‘ওহ ডার্লিং! তুমি কী ভেবেছো? আমি এতোই কাঁচা প্লেয়ার? নো সুইটহার্ট। আমি তোমাদের বিষয়ে সব জেনেশুনেই এখানে এসেছি। তোমার সাথে খেলা করতে। কী, খেলবে না? একটু আগে যে তেজ তোমার ভেতর ছিল,বিশ্বাস করো,খুব মজা লাগছিল তা দেখে। তোমার সেই তেজপূর্ণ চেহারা আবার দেখতে চাই। দেখাও! এত শক্তিশালী তুমি! আর্নিশ বংশের একমাত্র রাজকুমারী! অথচ তুমি এই সামান্য কিছু লাইটকে ভয় পাও? ছিঃ রাজকুমারী। এই খবর তোমাদের জগতে পৌঁছে গেলে তুমি আর তোমার বাবা-মা মুখ দেখাবে কেমন করে?’

জুলিয়া কাঁদছে যদিও তা শারুর অগোচরে। লাবণীর কোলের ভেতর মুখ ডুবিয়ে সে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। তার অপারগতা এবং অসহায়তা তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে ভেতর থেকে। মনে মনে ডেকে চলেছে ভাইকে, ‘ভাই, ভাই কোথায় তুমি? আমাকে বাঁচাও ভাই। আমাকে তুমি বাঁচাও!’

-‘কী হলো? কথা বলছো না কেন জুলিয়া? ভাষা হারিয়ে গেছে? জানো, ঠিক এভাবেই আমার ভাষা হারিয়ে গিয়েছিল, যখন তোমার ভাই আমার বোনকে খু’ন করেছিল। তুমি কী ভেবেছো, আমার একমাত্র বোনকে যে খু’ন করবে তাকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেবো? আমি তোমাকে খু’ন করলে তোমার ভাই আমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিতো জুলিয়া? তুমি নও, তোমার ভাই-ই আমার শত্রু। সে আমার বোনকে মে’রেছে,আমি তার বোনকে মা’রবো। হিসাব বরাবর।’

যেন অনেক দারুণ কোনো অংক মিলিয়ে ফেলেছে শারু। গর্বে ভেতরটা ফুলে উঠে তার। পরক্ষণেই চোখ চলে যায় ঘুমিয়ে থাকা লাবণীর দিকে। গলার স্বর পাল্টে উৎসুক ভঙ্গিতে সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় জুলিয়াকে,
-‘বাই দ্য ওয়ে, এই মেয়েটা কে? একে তো আগে দেখিনি। তোমার ভাইয়ের বউ? যাক, ভালো হলো। এখন একসাথে দু’টোকেই মা’রবো। একা বোনকে হারিয়ে যতটা না কষ্ট পাবে ওই কু’ত্তার বাচ্চা, বউকে হারিয়ে দ্বিগুণ হবে কষ্টটা। জুলিয়া, মানতে হবে, তোমাদের চেয়ে আমি বেশি জ্ঞানী। কী বলো?’

জুলিয়া এইবার তাকায়। চোখ ধাঁধানো আলোর মাঝেও চকিতে একবার তাকাতেই যন্ত্রণা অনুভব করে চোখে। তড়িঘড়ি করে আবারও মুখ ডুবিয়ে দেয় লাবণীর কোলের ভেতর। এতক্ষণে হিসেব মিলে গিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, না আসুক তার ভাই। জুলিয়ার কিছু হলে তার পরিবার একসময় সামলে উঠবে ঠিকই। কিন্তু ম্যাক্স? যদি ম্যাক্সের কোনো ক্ষতি করে দেয় শারু, তখন আর্নিশ বংশের সবাই তাদের আগত রাজাকে হারিয়ে শোকে মাতম হয়ে যাবে। দেউলিয়া হয়ে পড়বে গোটা রাজ্য। জুলিয়া মনে মনে প্রার্থনা করল, ‘না আসুক ভাই, না আসুক সে।’

-‘আমার বোনটা! আমার আদরের ইশা। তোমার ভাইকে ভালোবেসেছিল জাস্ট। বিনিময়ে কী পেল? ধোঁকা! আমার একমাত্র খেলার সঙ্গীকে তোর ভাই কেড়ে নিয়েছে আমার থেকে। সেই হিসাব যে এখনো বাকী জুলিয়া। আপাতত চলো, তোমাদের দুটোকে ব’লি দেওয়া যাক। তোমার ভাই আসুক। তার জন্য উপহারস্বরুপ তোমাদের দু’জনের মাথাটা আমি রেখে দেবো। তার যথাযথ আপ্যায়ন করা হবে জুলিয়া। একবার আসতে দাও।’

পুনরায় শারুর ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুঁটে উঠে। চারপাশে তাকিয়ে ম্যাক্সের উপস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে সে। নাহ, ম্যাক্স আসেনি। আচ্ছা, সে কী আসবে? সে কী খুঁজে পাবে এই জায়গা? পাবে, অবশ্যই পাবে। সে আসার আগেই এই দুটোর কাম তামাম করতে হবে। শারু ঠোঁটে শিষ দেয়, এগিয়ে চলে। জুলিয়ার কাছে মনে হলো, এরচেয়ে ভয়ংকর সুর আর কোনো শব্দের হয় না।

ধূলোর গতিতে কক্ষে এসে উপস্থিত হয় ম্যাক্স। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে। তবুও ম্যাক্স দেখতে পাচ্ছে, কয়েক গাছি দড়ি পড়ে রয়েছে মাটির উপর। চোখ বন্ধ করে মনের দর্পণে দেখা দৃশ্যগুলো আরেকবার রিভাইস করে সে। তারপর চোখ খুললো। এই দড়ি দিয়েই ওদের বেঁধে রাখা হয়েছিল। চা’কুটাও পড়ে রয়েছে এক পাশে,অবহেলায়,অযত্নে। তার মানে ঠিক জায়গাতেই এসেছে ম্যাক্স। এখানেই আঁটকে রেখেছিল তার বোন ও লাবণীকে ওই জা’নোয়ারটা। কিন্তু এখন কোথায় তারা? ম্যাক্স আবারও চোখ বন্ধ করে মনের আয়নায় দৃশ্যগুলো দেখে। লাবণী এবং জুলিয়া দৌড়াচ্ছিল। একটা জঙ্গলে। তার মানে এখান থেকে বেরিয়েই তারা দৌড়েছে। শারু কোথায়? সেও কী ওদের পিছু নিয়েছে? নিশ্চয়ই নিয়েছে। এখন কোথায় আছে তারা?
ম্যাক্স পুনরায় চোখ বন্ধ করে জুলিয়াকে স্মরণ করে। কিন্তু হায়, এরপর আর কোনো দৃশ্য ফুঁটে উঠল না। হতাশ হলেও আশা ছাড়ে না ম্যাক্স। এই অন্ধকার ঝুপড়ি অবধি যখন আসতে পেরেছে তখন ওদেরকেও ঠিক খুঁজে পাবে। হয়তো এই জঙ্গলেই আছে ওরা। ম্যাক্স সিদ্ধান্ত নিলো, পুরো জঙ্গলটা একবার চষে ফেলার। বাহিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সে থমকে দাঁড়াল। কেউ আসছে। কারো গন্ধ নাকে এসে লেগেছে। গন্ধটা অপরিচিত। শারু?

ম্যাক্স তড়িৎ গতিতে আশেপাশে তাকাল। একটা ভাঙা জীর্ণশীর্ণ টেবিল রয়েছে। সেটার তলায় মুহূর্তে ঢুকে কুঁকড়ে রইলো। এখানে আর কী কী হবে,তা যে দেখতেই হয়! ম্যাক্সের ভাবনাই ঠিক হলো। শারু এসেছে। গম্ভীর পদক্ষেপে ভেতরে ঢুকে একটা বাতি টিপে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে একেবারেই হালকা পাওয়ারের অস্পষ্ট একটা লাইট জ্বলে উঠে। আলোটা সাদাও না, আবার হলুদও না। ঘরের অন্ধকার পুরোপুরি কাটে না সেই আলোতে। লাইটের নিকটে যে দাঁড়াবে তাকে শুধু দেখা যাবে৷ বাকিসব ঘুটঘুটে অন্ধকারেই নিমজ্জিত। ম্যাক্স স্বস্তি বোধ করে। যাক, তাকে অন্তত দেখা যাবে না। নিঃশ্বাসের শব্দও কমিয়ে রুদ্ধশ্বাসের বসে রইলো সে।

শারু লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘খাঁচাটা এখানে নিয়ে আসো।’
যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সেই তৎক্ষনাৎ হুকুম পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সঙ্গে আরও একজন সঙ্গী নিয়ে বাহির থেকে ঠেলতে ঠেলতে একটা বড় খাঁচা লাইটের নিচে এনে রাখল। ম্যাক্স চমকে উঠে। চোখে ব্যথা শুরু হয় যদিও হালকা ভাবে। কেননা সে বেশ খানিকটা দূরে রয়েছে ওই ছোট তীব্র আলো গুলোর থেকে। তবুও চোখ ঝাপসা হয়ে পানি বেরোতে শুরু করল। ওহ, এভাবে দাবিয়ে রেখেছে জুলিয়াকে শারু?
রাগে নিজের দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে দেয় ম্যাক্স। না জানি জুলিয়ার কী অবস্থা ভেতরে! বেশিক্ষণ এই আলোতে থাকলে সে অন্ধ হয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। একবার অন্ধ হলে জুলিয়ার সমস্ত শক্তিও নিঃশেষ হয়ে যাবে। হয়তো সে মৃ’ত্যুর দিকে ধাবিত হবে ধীরে ধীরে। ম্যাক্স বুঝল, তাকে কিছু একটা করতে হবে। অতিদ্রুতই করতে হবে। কিন্তু ওই খাঁচার কাছে যাবেই বা কেমন করে? সেও তো চোখ মেলে তাকাতে পারবে না!

-‘ডার্লিং, তোমার ভাই এখনো আসছে না কেন বলো তো? অবশ্য সে আসতে যত দেড়ি করবে ততই ভালো তোমার। কেননা আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি। তোমাদের দু’জনকে এখনই নয়, তোমার ভাইয়ের সামনে হ’ত্যা করব আমি। সে নিজ চোখে নিজের বোন ও স্ত্রীর মৃ’ত্যু দেখবে। এরচেয়ে সুখকর জিনিস আর কীইবা হতে পারে আমার জন্যে?’

খাঁচার নিকট দাঁড়িয়ে ভেতরে থাকা জুলিয়ার দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলো শারু। তারপর বিকট শব্দ করে হেসে উঠল। এই নিস্তব্ধ গগণের নিচে তার হাসির শব্দ গা হীম করা কোনো পশুর হাসির ন্যায় শোনালো। জুলিয়ার কান্নার মাত্রা বেড়ে গেছে। শেষ বার বাবা-মাকে, ভাইকে দেখার সুযোগ টুকুও বুঝি আর হবে না। খুব বেশি হলে বারো ঘণ্টা! এরপরই সে অন্ধ হয়ে যাবে এবং চব্বিশ ঘণ্টার পর মৃ’ত্যু!

শারু হাসি থামিয়ে উপস্থিত দু’জন চাকরদের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘এবার যদি এরা পালায়, তবে তোমাদের জ’বাই করব আমি মনে রেখো। অবশ্য আমি যে ব্যবস্থা করে রেখেছি, তাতে এরা পালাতে পারার কোনো প্রশ্নই আসে না।’
শারু ঠোঁট গোল করে সিটি দিতে দিতে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। চাকর দুটোও তার পেছন পেছন বের হয়। জুলিয়া এবার তারস্বরে গুঙিয়ে উঠল। চোখে অসম্ভব বেদনা করছে। কিচ্ছু দেখতে পারছে না। মাথার ভেতর ইতিমধ্যেই একধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। জুলিয়া চাপাস্বরে কান্নাভেজা গলায় বলল,
-‘ভাই! কোথায় তুমি ভাই!’
-‘আমি আছি বোন। আমি আছি।’
আচমকা জবাব পেয়ে জুলিয়া চমকে উঠল। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে মাথা তুলে এদিক ওদিক নাড়ায় সে। বলল,
-‘আমি চোখ খুলতে পারছি না ভাই। তুমি কোথায়?’
-‘আমি আছি। এই ঘরেই আছি। একটু সবুর করো বোন। আমি আসতে পারছি না তোমার কাছে। কিন্তু খুব দ্রুতই আসবো।’
-‘কী করে ভাই? এই লাইট। এগুলো না সরানো পর্যন্ত আমি বা তুমি,আমাদের জগতের কেউ-ই এই খাঁচার আশেপাশেও আসতে পারবে না।’
-‘জুলিয়া,ল্যাবণী? ও কোথায়? ও তো মানুষ। ও নিশ্চয়ই এই লাইট গুলো সরাতে পারবে।’
-‘ভাই ও অজ্ঞান হয়ে আছে। ওর শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। এভাবে আর বেশিক্ষণ থাকলে ওর জীবনও শেষ হয়ে যাবে। আমাদের জন্য ও-ও এভাবে মা’রা যাবে ভাই!’
-‘কীহ!’
ম্যাক্স পাগলের মতো হয়ে উঠল কথাটা শোনার পর। লাবণী অজ্ঞান!তার মাথায় এলো, এই শীত সহ্য করার মতো ক্ষমতা কোনো স্বাভাবিক মানুষের নেই। লাবণীর গায়ে নিশ্চয়ই কোনো মোটা কাপড় নেই। ম্যাক্স নিজের কথা ভাবলো না। একবার চোখ খুলেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। সেকেন্ডের ব্যবধানে খাঁচার নির্দিষ্ট অবস্থান দেখে নেয়। নিজের গা থেকে ওভার কোটটা খুলে নিলো সে। গায়ের শার্টটা খুলে নিয়ে চোখের উপর মোটা পট্টির ন্যায় বেঁধে নিলো। বিধাতার নাম স্মরণ করে সে এগোলো খাঁচার দিকে। মোটা পট্টি বাঁধার দরুন আলোগুলো তার চোখের উপর পড়া থেকে অনেকাংশে লাঘব হয়। সে খাঁচার কাছে গিয়ে কোটটা ছুঁড়ে ভেতরে দিয়ে দিলো। তারপর পুনরায় সরে চলে এলো টেবিলের তলায়। বলল,
-‘জুলিয়া, একটা কোট ফেলেছি, পেয়েছো?’
জুলিয়ার মাথার উপরেই পড়ে কোটটা। সে উত্তর দিলো,
-‘পেয়েছি ভাই।’
-‘মেয়েটাকে পেঁচিয়ে দাও জুলিয়া। কোটের পকেটে আমার হাত মোজা আছে। মোটা হাত মোজা। সেটা পট্টির মতো করে নিজের চোখে বাঁধো দ্রুত। একটু হলেও আরাম পাবে।’
বাধ্য মেয়ের মতো ভাইয়ের বলা কথাগুলো পালনে লেগে পড়ে জুলিয়া। লাবণীকে কোটের ভেতর সুন্দর করে পেঁচিয়ে দিয়ে নিজের চোখের উপর মোটা পট্টি বেঁধে নিলো। এতক্ষণ পর গিয়ে একটু রিলিফ লাগে তার। আলোটা অনেকাংশে কম লাগছে চোখে। আরাম লাগছে।
ম্যাক্স বলল,
-‘আমি আসছি জুলিয়া। আমি অনেক দ্রুতই আবার এখানে আসবো। তুমি.. তুমি খেয়াল রেখো নিজের। আর ওকেও দেখে রেখো।’
ম্যাক্স বেরিয়ে পড়ে। বাইরে বেরিয়ে চোখ থেকে শার্ট খুলে নিয়ে গায়ে পরে নিলো। তারপর ছুটে চলল চিতাবাঘের গতিতে। হাতে সময় খুব কম। এর ভেতরই তাকে একবার আর্নিশ জগত থেকে ঘুরে আসতে হবে। জুলিয়াকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে কেবল মাত্র একটি জিনিস, ‘ব্লাড স্টোন’।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here