ভুলবশত_প্রেমপর্ব-০২,০৩

0
1370

#ভুলবশত_প্রেমপর্ব-০২,০৩
#লেখনীতে:সারা মেহেক
০২

আমি খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে আপুর এক পাশে বসলাম। ওপাশ থেকে আভা এসে আপুর অপর পাশে বসলো। আমাদের দুজনের বসে পড়ার পরপরই অনেকেই আমাদের ছবি তুলতে লাগলো । যার মধ্যে পরিচিত মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম এবং অপরিচিত মানুষের সংখ্যা অগণিত। এতো মানুষের ভিড়ে অস্বস্তিতে কাঁদা হয়ে গেলাম আমি। এদিকে কনের বোন হওয়ার খাতিরে এ মূহুর্তে স্টেজ ছেড়ে উঠেও যেতে পারছি না আবার ভদ্রতার খাতিরে ঐ মানুষদের ছবি তুলতে নিষেধও করতে পারছি না। এ যেনো উভয় সংকট! উপায় না পেয়ে চেহারায় বিরক্তি এবং অস্বস্তিকর ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি আমার চেষ্টায় সফল হতে পারলাম না বোধহয়। কারন এখনো ক্যামেরাম্যানসহ দু চারজন ছেলে নানা এঙ্গেল থেকে ছবি তুলে যাচ্ছে। যেনো আমরা সাক্ষাৎ বলিউড এর কোনো নায়িকা!

” কারোর পারমিশন না নিয়ে ছবি তোলা উচিত না, এটা একটা কমন ম্যানার্স। এখানে কি কারোর সে বিষয়ে জানা নেই?”
আকস্মিকভাবে একটি পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে আমার ডান দিকে তাকালাম আমি। সেদিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম। কারণ উক্ত বচনের মালিক আর কেউ নন বরং সেই অভদ্র যুবকটি! আমি নগন্য সময়ের জন্য বিস্মিত চাহনিতে যুবকটির দিকে চেয়ে রইলাম এবং লক্ষ্য করলাম, শুধু আমি নয় বরং ছাদের মোটামুটি অর্ধেক জনগোষ্ঠী অভদ্র সেই যুবকটির পানে তাকিয়ে আছে। যুবকটি এ মুহূর্তে ফোন চালাতে ব্যস্ত। অর্থাৎ সে হয়তো ফোন চালাতে চালাতেই কথাগুলো বলেছে।

যুবকটি এবার অতি সন্তর্পণে পাঞ্জাবির পকেটে ফোন রেখে মাথা তুলে তাকালো এবং আমাকে আরেক দফা বিস্মিত করে সে এতো মানুষের প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখেও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অতি স্বাভাবিকভাবেই বললো,
” ভুল কিছু বলেছি বলে মনে হয় না আমার। হ্যাঁ, বিয়ে বাড়ি এটা, ছবি তোলা স্বাভাবিক। তবে চিনি না জানি না এমন মানুষের ছবি তোলার ক্ষেত্রে অবশ্যই তার পারমিশন নিয়ে ছবি তোলা উচিত। এই যে, যেমন ঐ ছেলেগুলো যতদূর সম্ভব কনের এবং কনের বোনগুলোর পরিচিত কেউ না। তা তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে তাদের ছবি নিজেদের পার্সোনাল ফোনে তোলার আগে এটলিস্ট পারমিশন নেওয়া উচিত। এই মিনিমাম ভদ্রতাটুকু থাকা দরকার, অন্তত আমার মনে হয় এমনটা।”
এই বলে সে ঐ ছেলেদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মিষ্টিভাবে আদেশ দিয়ে পুনরায় বললো,
” আপনারা ভদ্র ঘরের ছেলে বলে মনে হচ্ছে। সো এ পর্যন্ত উনাদের যা যা ছবি তুলেছেন তা ডিলিট করে দিলে ভালো হয়। ”
যুবকটির হেন কথায় ছেলেগুলো একদম থ বনে গেলো। তারা হয়তো আশা করতে পারেনি যে ছবি তোলার জন্য এভাবে তাদের অপমান হতে হবে!

অজ্ঞাত পরিচয়ের যুবকটি আবারো পকেট থেকে ফোন বের করলো এবং আপুর হলুদের স্টেজ থেকে যৎসামান্য দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। আপুর উদ্দেশ্যে ভদ্রতাসূচক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” ভাবী? আমি কি আপনার একটি ছবি তুলতে পারি?”

যুবকটির এহেন কাণ্ডে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম এবং খেয়াল করে দেখলাম শুধু আমিই নয় বরং আপুসহ অনেকেই তাঁর এ কাণ্ডে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে।
আপুর হতবুদ্ধি অবস্থা হতে বের হবার পূর্বেই যুবকটি আপুর কাছ থেকে আরেকদফা অনুমতি চাইলো। আপু এহেন পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লো। তবে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জোরপূর্বক মাথা নাড়িয়ে বললো,
” জি অবশ্যই। ”

ব্যস, আপুর অনুমতি পাবার পরপরই যুবকটি আমাদের তিনজনের কয়েকটি ছবি তুলে হেলেদুলে চলে গেলো। আমি এখনও অজ্ঞাত যুবকটির হেন কাজে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায় হতে যেনো নামতে পারছি না।

আমি খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেবার পর আপুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এটা কে? চিনো আপু?”

আপু না সূচক মাথা নাড়িয়ে তার জবাব দিলো। অর্থাৎ আপু যুবকটিকে চিনে না। কিন্তু যুবকটি আসলে কে এবং আপুকে কেনো ভাবী বলে ডেকেছিলো তা সম্পর্কে অবগত না হওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবো না৷ অন্তত এটা জানি যে, যুবকটি ইমাদ ভাইয়ার আপন ভাই নয়। তবে কি কাজিন ব্রাদার?

আমি আপুকে রেখে রুমে যাবার বাহানায় স্টেজ ছেড়ে উঠে এলাম। পিছনে শুনতে পেলাম যুবকটিকে নিয়ে সকলের মাঝেই টুকটাক চাপা গুঞ্জন চলছে।

.

ছেলেদের বাড়ি থেকে তত্ত্ব এসেছে কিছুক্ষণ আগেই। এ তত্ত্ব এনেছে ইমাদ ভাইয়ার বোন, ভাবী এবং কাজিনরা। তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ইমাদ ভাইয়ার আপন বড় ভাবি এবং আপন ছোট বোন বাদে সবাই কাজিন ৷ ফুপাতো ভাইবোন, মামাতো ভাইবোন, খালাতো ভাইবোন আরো কতো! ইমাদ ভাইয়ার কাজিনের সংখ্যা যে এতো হবে তা আমার কল্পনাতীত ছিলো এবং মেয়েপক্ষকে তাদের জনসংখ্যার ভারিক্কি বোঝাতেই হয়তো এতো মানুষ এসেছে। মেয়েরা এসেছে মূলত তত্ত্ব সাথে নিয়ে এবং আপুকে দেখতে। আর ছেলেরা এসেছে শুধুমাত্র আপুকে দেখতে।

ইমাদ ভাইয়ার পরিবার বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উনার দাদার যেমন সম্পদ এবং প্রতাপ ছিলো, বংশ পরম্পরায় উনার বাবাও তা পেয়েছে। ইমাদ ভাইয়ার বাবার নিজস্ব তিনটি ফ্যাক্টরি আছে এবং উনার মা একজন জাজ।

ইমাদ ভাইয়া আর আপুর পরিচয় হয় সাধারণভাবেই। তারা দুজন একই ভার্সিটিতে ছিলো। তফাৎ একটাই ছিলো দুজনের মাঝে। তা হলো একজন ভার্সিটির ছাত্রী এবং অপরজন নব্য শিক্ষক। ইমাদ ভাইয়া খুব ভালো ছাত্র ছিলেন বিধায় পড়াশোনা শেষে সেই ভার্সিটিতেই পরে শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। আপুর সাথে তার দেখা সেই সিএসই ক্লাসেই। ইমাদ ভাইয়ার ভাষ্যমতে, আপু যখন সদ্য ভার্সিটিতে পা রাখে তখন ইমাদ ভাইয়া ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিবে। সেসময় ভার্সিটির ক্যান্টিনে আপুকে প্রথম দেখায় তার ভালো লেগে যায়। ব্যস তখন থেকে ধীরেধীরে তিনি আপুকে ভালোবাসতে শুরু করে। আপু অবশ্য এ ব্যাপারে কিছুই জানতো না। সে এ ব্যাপারে সেদিন জানলো যেদিন ইমাদ ভাইয়ার বাবা মা আপুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।

ইমাদ ভাইয়াদের পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে আব্বু আম্মু প্রথমে বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করেছিলো। কারণ তাদের অবস্থা আর আমাদের অবস্থার ঢের পার্থক্য রয়েছে। এমতাবস্থায় এমন ধনী পরিবারের সাথে কোনো সম্পর্কে জড়ানোর অর্থ নিজ দায়িত্বে নানা বিপদ ডেকে আনা।
আপু প্রথমে মনে মনে বিয়ের স্বপ্ন বুনে ফেললেও আব্বু আম্মুর মতামত শোনার পর আপু পিছু হটে যায়। সে ইমাদ ভাইয়াকে সরাসরি না বলে দেয়। কিন্তু ইমাদ ভাইয়া আপুর পিছু ছাড়লো না। একদম নাছোড়বান্দার মতো যেমন আপুর পিছে পড়ে রইলেন তিনি তেমন আব্বু আম্মুকেও এ বিয়েতে রাজি করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। অতঃপর আব্বু আম্মু নানা চিন্তাভাবনা করে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন।

.

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পর ড্রইংরুমে এসে দেখলাম রুমটি লোকে লোকারণ্য হয় উঠেছে এবং রুমের প্রতিটি সদস্যই ইমাদ ভাইয়ার বাড়ি হতে আগত। তারা প্রত্যেকে এখন মুখের ভেতর চা নাস্তা ঠুসে নিতে ব্যস্ত। এদের মাঝে মোটাসোটা গোছের একটি ছেলেকে দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার জোগাড় হয়ে এলো। কম বয়সী ছেলেটি ভীষণ আরামে বসে গোগ্রাসে নিজের সামনে থাকা নাস্তাগুলো গিলছে। ছেলেটির এ ভক্ষক রূপ দেখে আমার মুখ থেকে আপনাআপনি ‘মস্ত বড় খাদক’ শব্দগুলো বেড়িয়ে এলো। ছেলেটির এতো খাবার ঠুসা দেখে বেশ রাগ এবং বিরক্ত লাগলো আমার। বয়সে তো নিশ্চয়ই একেবারে ছোট নয় সে। সুতরাং একজনের বাড়িতে এসেছে আদবের সহিত কিভাবে খেতে হয় এবং কতটুকু খেতে হয় তা জানে না কেনো সে। অদ্ভুত!

মন চাইছে ছেলেটিকে বলি, ‘ এই যে খাদক, আপনি যে এতোগুলা খাবার ঠুসে ঠুসে খাচ্ছেন, এগুলোর টাকা কে জোগাড় করে দিয়েছি শুনি? আমার আব্বু কি বিয়েতে শুধু আপনার এবং আপনার মতো খাদকদের জন্য খাবারে আয়োজন করেছে না কি!’
হঠাৎ আম্মুর ডাক শুনে মনের আশা মনেই কবর দিয়ে ঘাড় ঘুরে তাকালাম। আম্মু আমাকে কিছু না বলেই হুট করে আমার হাতে মিষ্টির বাটির ট্রে ধরিয়ে বললো,
” যা, এটা ওদের সামনে দিয়ে আয়। আরেক ট্রেতেও নিতে হবে তো। এটা দিয়ে তাড়াতাড়ি আয়।”

এতোগুলো মানুষের সামনে মোটেও আম্মুর এ আদেশ পালন করতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু এ আদেশ পালন না করেও উপায় খুঁজে পেলাম না। কারন আম্মু আমাকে ট্রে হাতে ধরিয়েই আবারো রান্নাঘরে ছুট দিয়েছে এবং আমার আশেপাশে এমন কেউও নেই যার হাতে ট্রেটি ধরিয়ে দিবো আমি। অগত্যা বলেন বিগড়ে যাওয়া মনমেজাজ নিয়ে ট্রেটি সাথে নিয়ে ড্রইংরুমে গেলাম আমি। মিষ্টির ট্রেটি সেন্টার টেবিলে রাখার সাথে সাথে আমার দৃষ্টি চলে গেলো সেই যুবকটির উপর। সোফায় বসে ভারী ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোন টিপছে সে। আশেপাশের কোনোকিছুর প্রতিই যেনো এখন তার খাতির নেই।
হঠাৎ যুবকটির পাশে বসে থাকা ইমাদ ভাইয়ার এক কাজিন যুবকটির দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
” আদ্রিশ, দোস্ত এই অ্যাপটা দেখ তো। এটা সমস্যা করছে খুব।”
ইমাদ ভাইয়ার সেই কাজিনের সুবাদেই এতোক্ষণ পর অজ্ঞাত পরিচয়ের যুবকটির নাম জানতে পারলাম আমি।

এ মুহুূর্তে সেখানে কোনো কাজ না থাকায় আর এক মুহূর্তও দেরি না করে উল্টো পথে দরজার দিকে পা বাড়ালাম আমি। যেতে যেতে ভ্রুজোড়া প্রসারিত করে স্বগোতক্তি করে বললাম,
” অদ্ভুত নাম! এমন আনকমন নাম এর আগে কোথাও শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। অদ্ভুত নামের কিম্ভূতকিমাকার মানুষ।”

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখিকা:সারা মেহেক

ইমাদ ভাইয়ার সকল কাজিনরা একে একে এসে আপুর সাথে ছবি তুললো। ছবি তোলা শেষে প্রত্যেকেই মজা করে আপুর গালে এবং নাকে হালকা হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে চলে গেলো। সবার শেষে আদ্রিশ, যিনি কি না ইমাদ ভাইয়ার কোনো আত্মীয় হোন হয়তো, তিনি অতি ভদ্রতার সহিত আপুর গালে হালকা একটু হলুদ ছুঁইয়ে দিলেন। সবার হলুদ লাগানো শেষে ইমাদ ভাইয়ার একমাত্র ভাবী অর্থাৎ জেবা ভাবী আপুকে, আমাকে ও আভাকে এবং আমাদের ছোটবড় সব কাজিনদের সাথে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এ পরিচয়ের মাধ্যমেই জানতে পারলাম সেই পেটুক ছেলেটার তন্ময় এবং সে ইমাদ ভাইয়ার সবচেয়ে ছোট মামাতো ভাই। অর্থাৎ ইমাদ ভাইয়ার কাজিনদের মধ্যে সে সবচেয়ে ছোট। তন্ময় এবার ক্লাস সেভেনে উঠলো মাত্র। অথচ হাবভাব এবং শরীর তার এমন যে মনে হবে মাত্রই কলেজে উঠেছে সে।

ইমাদ ভাইয়ার সব কাজিনদের মধ্যে সাদিক নামের ছেলেটির আচার ব্যবহার দেখে খানিকটা বিস্মিত এবং অভিভূত হলাম আমি। স্পষ্টত, শুধু আমি নয় বরং আমার দুটো চাচাতো বোন লামিয়া এবং তাসনিমও তাকে দেখে অভিভূত হলো। যদিও তাদের দুজনের মুখে পছন্দ হওয়ার ব্যাপারটা সরাসরি শুনিনি৷ কিন্তু আমার পেছনে দুজনের কানাকানি ফিসফিস শুনে ব্যাপারটি ঠিকই ধরতে পেলাম আমি।

ছাদে উপস্থিত সবার মাঝে সেই সাদিক নামের ছেলেটিই সবচেয়ে নম্র ভদ্রভাবে অবস্থান করছেন। অবশ্য উনাকে দেখে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যে উনি এতো হৈচৈ দেখে খানিক বিরক্ত। উনার এ বিরক্তির প্রতিক্রিয়া হিসেবে উনি নিজের চওড়া কপাল এবং লম্বা নাকটা মাঝে মাঝে কুঞ্চিত করছেন। আবার দাড়িবিহীন ফর্সা গালটায় মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে নিচ্ছেন। উনার চেহারার এরূপ প্রতিক্রিয়া যেকোনো মেয়ের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি।

আপু সকলের সাথে আপাতত নাম জানার মাধ্যমেই পরিচিত হলো। ঐ বাড়ি হতে আগত সকলের সাথে পরিচিতি হবার পরও আপুর সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য একজন মানুষ বাকি ছিলেন এবং তিনি হলেন আদ্রিশ। উনি এতোক্ষণ এদের মাঝে ছিলেন না। বরং ছাদের এক কোনায় রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শত চেঁচামেচির মাঝেও ফোনে মনোযোগী হয়ে কিছু দেখছিলেন উনি। জেবা ভাবী আদ্রিশকে দেখতে পেয়ে হাঁক ছেড়ে বললেন,
” আদ্রিশ? তুই ওখানে কি করছিস? এদিকে আয়।”

জেবা ভাবীর ডাক শুনে আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকে আমাদের দিকে তাকালেন। স্বল্প সময়ের জন্য এদিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য কিছু ভাবলেন। অতঃপর ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
” কি হয়েছে ভাবী? ডাকছো কেনো?”

জেবা ভাবী কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
“বিয়েতে এসেছিস, মজা করবি। তা না করে সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকিস কেনো? এদিকে এসে নাফিসাকে নিজের বায়োডাটা শুনিয়ে দিয়ে যা। তুই তো ওকে চিনেছিস। কিন্তু ও তো তোকে চিনেনি। ”

জেবা ভাবীর কথায় আদ্রিশ মুখ ফিরিয়ে মৃদু হেসে দিলেন। অতঃপর পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে স্টেজের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। পথে কেমন এক অদ্ভূত চাহনিতে আমার দিকে এক নজর তাকালেন উনি এবং আমার চোখের পলক ফেলতেই উনি নিজের দৃষ্টি আবারো পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনলেন। উনার এরূপ চাহনিতে আমি খানিক মিইয়ে গেলাম৷

আদ্রিশ স্টেজের নিকট এসে সামনে অবস্থিত হলুদের বাটি থেকে দু হাতে বেশ খানিকটা হলুদ মাখিয়ে নিলেন। অতঃপর আমাদের সবাইকে আশ্চর্যান্বিত করে আচমকা আপুর দু গালের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে হলুদ লাগিয়ে দিলেন। উনার এমন কাণ্ডে আমি বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম এবং আপুসহ বাকি সকলেই একদম থ বনে গেলো। স্পষ্টত, আদ্রিশের এমন কার্যকলাপ কেউই আশা করেনি। এদিকে আপুর অবস্থা দেখে আদ্রিশ ভ্রু নাচিয়ে জেবা ভাবীর উদ্দেশ্যে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন,
” আমার বায়োডাটা দিয়ে নাফিসা ভাবীর কাজ কি? আমায় পছন্দ হয়েছে বুঝি? বিয়েশাদী করার প্ল্যানিং এ আছে না কি?”

এই বলে উনি আপুর দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম একটা গোয়েন্দা ধরণের ভাব নিয়ে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি নাফিসা ভাবী? মনে মনে কি চলছে আপনার? আমার বন্ধুকে ছেড়ে আমাকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবেন না তো আবার?”

আদ্রিশের এহেন কথায় আমার গাল ঝুলে পড়ার উপক্রম হলো। আমি বিস্মিত চাহনিতে উনাকে দেখছি। উনি যে এরূপ মজা করে বসবেন তা কল্পনা করতে পারিনি। এদিকে উনার এ কাজে জেবা ভাবীসহ সকলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। কিন্তু আমার আপু আদ্রিশের এমন কাণ্ডে লজ্জায় কাঁদা হয়ে গেলো। সবার হাসাহাসির পর্ব শেষ হতে না হতেই আভা আলতো করে পিছন থেকে আমাকে ডাকলো। আমি ইশারায় ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও ফিসফিস করে বললো,
” ছোট আপু, ওদিকটায় একটু চলো। কথা আছে।”
এই বলে ও আমায় টেনে নিয়ে স্টেজের পিছনে নিয়ে এলো। খানিকটা চিন্তিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,
” ছোট আপু, ছোটখাটো, নাহ, বড়সড় একটা বিপদ আসবে মনে হচ্ছে। ”

আভার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি বলছিস? কিসের বিপদ আসবে?”

আভা পূর্বের ন্যায় বললো,
” আব্বুর যে ফুফু আছে না? ঐ যে, বেশি ক্যাটক্যাট করে যে….

আমি মাঝপথে ওর কথা চট করে ধরে বললাম,
” আনোয়ারা দাদি?”

আনোয়ারা দাদির নাম বলতেই আভা পুনরায় উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
” হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেই আনোয়ারা দাদিই। ঐ যে, আদ্রিশ নামের যে ভাইয়াটা আছে না? উনি যখন আপুর গালে হলুদ লাগিয়ে দিলো তখন আনোয়ারা দাদি ছাদে আসায় তা দেখে ফেলেছিলো। ওসব দেখেই কেমন নাক সিটকাতে সিটকাতে চলে গেলো। আমার তো এখন টেনশন হচ্ছে। উনি এ নিয়ে আবার আজ হাঙ্গামা না করে বসে।”

আভার কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। তবুও ওকে সান্ত্বনা দিতে বললাম,
” এতো চিন্তা করিস না তো। কিছুই হবে না। শুধু শুধু এখন ওসব নিয়ে চিন্তা করে মজা নষ্ট করার দরকার কি? আর এখানে কি শুধু আমরা আছি না কি? আমাদের মামি, চাচিরাও তো আছে। সো নো চিন্তা ডু ফূর্তি। ” এই বলে আমি আভাকে টেনে নিয়ে স্টেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ ততক্ষণে আদ্রিশ নিজের হাত হতে এবং আপু নিজের মুখ হতে অতিরিক্ত হলুদ মুছে ফেলেছে। আপু জেবা ভাবীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” উনি কি ইমাদের কোনো কাজিন হয়?”

জেবা ভাবী স্মিত হেসে উত্তর দিলেন,
” ও ইমাদের ছোট্টবেলার বন্ধু। শুধু ইমাদের বন্ধুই নয়, তামিমেরও বন্ধু ও।” এই বলে জেবা ভাবী আদ্রিশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে ইশারা করলেন। লক্ষ্য করে দেখলাম, এই ছেলেটি সেই ছেলেটি যে ড্রইংরুমে আদ্রিশের পাশে বসেছিলেন৷ উনি সম্পর্কে ইমাদ ভাইয়ার ফুপাতো ভাই হোন, সেই সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো আছেই।

জেবা ভাবী আপুর পাশে বসতে বসতে আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললেন,
” তোমার সাথে খাতির জমাতে আর তোমাকে দেখবে বলে আদ্রিশ ইমাদের কাছ থেকে এখানকার ঠিকানা নিয়ে সকাল সকালই চলে আসে। কিন্তু এখানে এসে সে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে আমার। ঠিক তো?”
এই বলে জেবা ভাবী আদ্রিশের দিকে ইশারা করলেন। আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ ভীষণ আফসোসের চাহনিতে তাকিয়ে বললেন,
” আর বলো না জেবা ভাবী। শালা ইমাদ এমন সময়ে বিয়ের ঢোল পিটালো যখন আমার হাতে নতুন প্রজেক্টের কাজ৷ এদিকে কাজের প্রেশার আর ওদিকে ইমাদের বিয়ে। বিশাল ঝামেলার এক সময় পার করছি আমি। এই চারদিনের ছুটি নেওয়ার জন্য বসের কাছে আবেদন করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমি৷ বস তবুও ছুটি দিলেন না। কারন আমাদের এ প্রজেক্টের কাজ আর একদিন করলেই শেষ হয়ে যাবে। বস বললেন, আজ কাজ করে তারপর ছুটি নিতে। কিন্তু আজ ইমাদের হলুদ ফাংশন বলে কথা! আমি ছুটি না নিয়ে থাকি কি করে। অবশেষে বসকে ছুটির জন্য এই বলে রাজি করালাম যে, আজ টুকটাক ফ্রি সময় পেলে রাতের মধ্যেই বাকি কাজটুকু এক্সট্রা ইফোর্ট দিয়ে শেষ করে প্রজেক্ট সাবমিট করে দিবো। তখন ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কাজই করছিলাম আমি। ”

এই বলে আদ্রিশ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আদ্রিশের বাচনভঙ্গি দেখে আপু মুচকি হেসে ফেললো। এদিকে জেবা ভাবী আদ্রিশের মাথায় ছোট্ট একটা চাপড় দিয়ে বললেন,
” ওরে মশাই…..তোর মতো ব্যস্ত মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই বোধহয়। ”
এই বলে উনি আপুর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” আদ্রিশকে দেখে খুব ভদ্র মনে হয় তাই না?”

আপু স্মিত হেসে জবাব দিলেন,
” জি। তা তো অবশ্যই।”

আপুর এ সম্মতিতে সেখানে ছোটখাটো একটা হাসির রোল পড়ে গেলো। জেবা ভাবী হাসিরত অবস্থায় বললেন,
” ও শুধু বাইরে দিয়ে দেখতেই ভদ্র। কিন্তু ভেতরটা দুষ্টুমিতে ভরা। অপরিচিত কারোর সাথে সে বড্ড ফর্মাল একজন মানুষ। কিন্তু কাছের মানুষের সাথে তার ফর্মালিটির বালাইও নেই।
আমাদের বাড়িতে আগে আসো….তারপর দেখতে থাকো এই বিচ্ছুবাহিনীর কাণ্ডকারখানা। আদ্রিশ আর তামিম বাড়িতে আসলে বাড়িটা আর নিজের রূপে থাকে না। পুরোই এই তিন জংলীর দখলে চলে যায়। ”
পুনরায় সেখানে ছোটখাটো হাসির রোল পড়ে গেলো। এদিকে আমি খানিক বিস্মিত হয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
“ভীষণ বিচ্ছু কোয়ালিটির ছেলে মনে হয়। ”

আমার কথা শেষ হতে দেরি তবে আপুর ফোন বাজতে দেরি হলো না। আপুর ফোন আমার হাতে থাকায় রিং হওয়ার সাথে সাথেই আমি টের পেলাম। ফোনের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে দেখলাম একটি অপরিচিত নাম্বার হতে কল এসেছে। আপুর ফোনে নাম্বার সেভ না থাকায় আমি ফোন রিসিভ করলাম না। বরং ওভাবেই রেখে দিলাম। এভাবে পর পর দুবার ফোন বাজলো। তৃতীয়বারে আমি খানিক বিরক্তি এবং সংশয় নিয়ে কল রিসিভ করলাম। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ হতে একটি পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
” নাফিসা? কল রিসিভ করছো না কেনো? আমার সাথে কথা বলতে মন চায় না? এতো এভয়েড করো কেনো আমাকে? তুমি কি জানো না আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি? আমার কাছে ফিরে আসো নাফিসা। এক কাজ করো, ঐ বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসো। কিচ্ছু আনতে হবে না সাথে৷ আমার শুধু তোমাকে চাই। আমরা বিয়ে করে ছোট্ট সুন্দর একটা সংসার করবো। আমি তোমাকে খুব সুখে রাখবো নাফিসা। প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো। তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও…….. ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here