#ভুলবশত_প্রেম,পর্ব-০৪,০৫
#লেখিকা:সারা মেহেক
০৪
অজ্ঞাত লোকটির কথা আমার কর্ণধারে তীক্ষ্ণ কিছুর ন্যায় বাড়ি খেলো। লোকটির সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই আমি লাইন কেটে দিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভয়ে হাত এবং পা যেনো জমতে শুরু করে দিলো। এমন আকস্মিক ঘটনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷ লোকটির সমস্ত কথা এখনো আমার কানে তরঙ্গের ন্যায় প্রতিফলিত হচ্ছে। সে যা যা বললো তার সবটাই কি সত্য? না কি আপুর সাথে কোনো কারণে পূর্ব শত্রুতার রেশ ধরে মিথ্যে কথা বলে আপুর বিয়ে ভাঙতে চাইছে সে? না কি আসলেই আপুর সাথে অজ্ঞাত লোকটির কোনো সম্পর্ক আছে? মস্তিষ্কে হাজারো প্রশ্নের আনাগোনায় ক্ষণিকের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়লাম আমি। এতো প্রশ্নের বেড়াজালে পড়ে এহেন পরিস্থিতিতে ঠিক কি করা উচিত স্থির করতে পারলাম না আমি।
আপু কি সত্যিই এমনটা করেছে? ভুল করেও আব্বু আম্মু যদি জানতে পারে আপুর অন্য কোথাও সম্পর্ক ছিলো তাহলে দুজনে সহ্য করতে পারবে। কিন্তু আমি আমার আপুকে ভালোভাবে চিনি। আপু কখনও এমনটা করবে না৷ আব্বু আম্মুকে সে খুব ভালোবাসে। দুজনের মান সম্মান নিয়ে সে নিশ্চয়ই খেলবে না। তাহলে লোকটি কে এবং আপুর নাম্বারই বা পেলো কোথায়?
অতিরিক্ত ভয় এবং চিন্তা করার দরুন আমার হৃদপিণ্ড দ্রিম দ্রিম করে বাজছে। চোখের সামনে বারংবার আব্বু আম্মুর চেহারা ভেসে উঠছে। এতো বড় একটা ধাক্কার সম্মুখীন হওয়ার পর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। এজনঢ় পাশ ফিরে একটা চেয়ার দেখতে পেয়ে ফোন নিয়ে বসে পড়লাম সেখানে। অত্যধিক চিন্তিতপ্রবণ হওয়ার কারণে নানা ধরনের চিন্তা আমার মস্তিষ্ক চেপে বসলো।
” এক্সকিউজ মি, আমি কি এক গ্লাস পানি পেতে পারি?”
আচমকা একটি পুরুষালি কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই আমি আঁতকে উঠলাম৷ ফলস্বরূপ হাত হতে অসাবধানতাবশত আপুর ফোনটি পড়ে গেলো। আমি চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে আপুর খালাতো দেবর সাদিককে দেখতে পেলাম।চেহারায় মৃদু অসন্তোষের ছাপ তবে ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির রেখা বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আমি সে মুহূর্তে খানিকটা অন্যমনস্ক থাকায় ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কিছু বললেন আপনি?”
সাদিক আমার প্রতিক্রিয়া দেখে মৃদু হেসে দিলেন। অতঃপর বিনা বাক্য ব্যয়ে তিনি আমার হাত হতে পড়ে যাওয়া আপুর ফোনটি তুলে আমায় বললেন,
” আপনি এতো ঘাবড়ে গিয়েছেন কেনো? এনি প্রবলেম?”
আমি উত্তেজিত হয়ে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললাম,
” জি জি না৷ কোনো সমস্যা নেই। ”
সাদিক মৃদু হাসলেন। আন্তরিকতার সহিত বললেন,
” একটু সাবধানে চলবেন। এভাবে হুট করে ঘাবড়ে যাওয়া মানুষকে সকলে কিন্তু আরো ঘাবড়ে দিতে চায়। আর যদি ঘাবড়েও যান সেটা বাহিরে প্রকাশ করবেন না। ”
এই বলে উনি পুনরায় মৃদু হাসলেন। উনার এরূপ আন্তরিক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ চাহনিতে ক্ষণিকের জন্য উনার দিকে চেয়ে রইলাম। কিন্তু উনার কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আমি দ্রুততার সহিত নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কিছু চাইছিলেন আপনি?”
সাদিক পুনরায় স্মিত হেসে বললেন,
” জি, এক গ্লাস পানি পেতে পারি কি? ছাদে পানি খাওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই বিধায় জিজ্ঞেস করলাম।”
ছাদে পানি খাওয়ার মতো ব্যবস্থা না থাকায় উনার কথায় আমি খানিক বিব্রত বোধ করলাম। তবুও ঠোঁটের কোনে ভদ্রতাসূচক হাসি এনে বললাম,
” জি জি অবশ্যই। আপনি দাঁড়ান। আমি নিয়ে আসছি।”
এই বলে আমি পা বাড়ালাম। কিন্তু সাদিক আমার পথ রোধ করে বললেন,
” আপনার যদি কোনো প্রবলেম না থাকে তাহলে কি আমি আপনার সাথে নিচে যেতে পারি?”
আমি কোনো চিন্তাভাবনা ব্যতিতই বললাম,
” জি জি অবশ্যই। ”
কথা শেষ হতে না হতেই আমরা দুজনে স্টেজের পিছন হতে এসে রেলিঙের ধার ঘেঁষে হাঁটতে লাগলাম। আচমকা পিছন হতে কে যেনো বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
” কি রে সাদিক! তুই তো সেই চালু চিজ রে! এতো তাড়াতাড়ি বেয়াইনরে পটায় ফেললি!”
অজ্ঞাত কণ্ঠের অনুসন্ধানে আমি এবং সাদিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখলাম আপুসহ প্রত্যেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছে। ব্যতিক্রম, শুধুমাত্র আদ্রিশের চেহারায় কোনো হাসি দেখলাম না।
জেবা ভাবী আমাদের দেখে ফোড়ন কেটে বললেন,
” তলে তলে টেম্পু চালাও তাই না? এত্তো ফাস্ট হলি কবে থেকে? এসেই মিমকে পটিয়ে ফেললি!”
জেবা ভাবীর কথার সুরে আমি লজ্জায় মিইয়ে গেলাম। কিন্তু সাদিক তৎক্ষণাৎ জেবা ভাবীকে শুধরে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” ভাবী, আমি পানি খেতে যাচ্ছিলাম নিচে। শুধু শুধু ছোট্ট একটা বিষয়কে নিয়ে তোমরা মেয়েটার মজা নিচ্ছো। আমি পানি খেয়েই চলে আসছি৷ তোমরা রেডি থেকো। আমি আসলেই বেড়িয়ে পড়বো। ”
সাদিকের কথা শুনে আপুর খালাতো ননদ কুহু টিপ্পমী কেটে বলে উঠলো,
” যাও যাও সাদিক ভাই। পানি খেয়েই চলে আসতে হবে না। সময় নাও তুমি। যতোটা সময় লাগে নাও। আমরা ওয়েট করবো। ”
এই বলে কুহুসহ সকলে মিলিত সুরে হেসে উঠলো।
আমি এবং সাদিক আর এক মুহূর্তও সে স্থানে দাঁড়িয়ে না থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে এলাম। ডাইনিং এ আসতেই ছোটখাট মাছের বাজার এর ন্যায় চেঁচামেচির শব্দ কানে এসে বাড়ি খেলো। তবে আমার এবং সাদিকের উপস্থিতিতে মুহূর্তেই সকলে চুপচাপ হয়ে গেলো। আম্মু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
” কি ব্যাপার? এখানে কেনো তুই?”
আমি সাদিককে দেখিয়ে বললাম,
” আম্মু, উনি আপুর মামাতো দেবর হয়। ছাদে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় নিচে এসেছেন। ”
আমার কথা শোনামাত্রই আম্মু বিলম্ব না করে ডাইনিং হতে একটি গ্লাস বেসিনে নিয়ে ভালোমতো ঘষেমেজে পরিষ্কার করলো। অতঃপর জগ হতে তাতে পানি ঢেলে সাদিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” কিছু মনে করো না বাবা। ছাদে পানির একটা জগ ছিলো। তবে তা অপরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় রুমে নিয়ে আসি। পরে যে আবারো জগ রেখে আসবো তা আর মনে ছিলো। কিছু মনে করো না কেমন?”
আম্মুর কথায় সাদিক চেয়ারে বসতে বসতে আন্তরিকতার সহিত হেসে বললেন,
” আরে আন্টী, এতো প্যানিক হওয়ার কিছু নেই৷ ইটস ওকে। বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততা বুঝতে পেরেছি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। ”
সাদিকের আশ্বাসে আম্মু এবার গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এদিকে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপভাবে আড়চোখে রুমে উপস্থিত প্রত্যেকের চাহনি দেখছি। উপস্থিত সকলের চাহনি স্বাভাবিক মনে হলেও আনোয়ারা দাদির বাঁকা চাহনিতে আমি খানিক ঘাবড়ে গেলাম৷ শুকনো একটা ঢোক গিলে সামনে তাকিয়ে দেখলাম সাদিক চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়েছেন৷ আমি কোনো প্রকার কথাবার্তা ছাড়াই উনার পিছু পিছু চলে এলাম ছাদে।
সাদিক চলে আসায় ধীরেধীরে আপুর শ্বশুরবাড়ী হতে আগত সকলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। একে একে সকলে বেড়িয়ে যাবার পর আমি, আভা, তাসনিম মিলে আপুকে নিচে নিয়ে এলাম।
.
রাতে আপু এবং আভাসহ আমরা সকল কাজিনেরা মিলে গল্পগুজবে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ আব্বুর রুম থেকে শীতল এবং গাম্ভীর্যপূ্র্ণ কণ্ঠে আব্বুর ডাক শুনতে পেলাম। আব্বুর এহেন সুরের ডাক শুনে আমি এবং আভা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। দুজনেই আন্দাজ করে নিলাম, ঘূর্ণিঝড় আসার পূর্বের নীরবতা এটি। আমি, আভা, আপুসহ একে একে সকলে আব্বুর রুমে উপস্থিত হলাম। রুমে পৌঁছে ছোটখাটো একটি পঞ্চায়েত দেখে ভয়ে আমার হাত পা অসার হবার জোগাড় হয়ে এলো। চাচি-চাচু, মামি, খালামনি,আম্মু, দাদি এবং আনোয়ারা দাদি পুরো রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আসে। তাদের দেখে আমি শুকনো একটি ঢোক গিলে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমাদের ডেকে পাঠালে যে আব্বু?”
আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য আব্বু মুখ খোলার পূর্বেই আনোয়ারা দাদি প্রচণ্ড রাগত স্বরে বললেন,
” শোন তোর মাইয়াদের কাছ থেক, ছাদে কি হইছিলো। সবকয়টা তহন ওহানে ছিলো। জিজ্ঞাস কইরে দেখ, ঐ পোলা নাফিসারে ছুঁইছে না কি। কর জিজ্ঞাস।”
আনোয়ারা দাদির কথা শেষ হতে না হতেই আব্বুর শীতল চাহনি আমাদের উপর পড়লো। তৎক্ষনাৎ আমরা একযোগে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম। আনোয়ারা দাদি পুনরায় নিজের সমস্ত রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,
” কইছিলাম, ওমন বংশে মাইয়ার বিয়া না দিতে। কিন্তু কেডা শোনে কার কথা। তোরা আমার কথাখান আমলেই নিলি না। ওর শ্বশুরবাড়ীর লোকজন কত্ত বড়লোক দেখছিস? ওতো বড়লোক ঘরে আমাগো মাইয়া গেলে কি ঠিক থাকবো? ওমন মরডার্ন পরিবারে বিয়া দিতে না করছিলাম৷ দেখ অবস্থা এহন। ছিঃ ছিঃ! ”
এই বলে তিনি ক্ষণিকের জন্য থেমে পুনরায় বললেন,
” ওগোর মামি চাচিরাও তো তহন ওহানে ছিলো। ওরা কিছু কয়নি ক্যান? হ্যাঁ? শায়লা আর রেনু কও তো দেহি, তোমরা তো তহন ওহানে ছিলা। তোমরা ঐ পোলারে কিছু কওনি ক্যান?”
আমি কিঞ্চিৎ মাথা উঁচু করে দেখলাম মামি এবং চাচি আনোয়ারা দাদির আচমকা প্রশ্নের আঘাতে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছেন। আনোয়ারা দাদি পুনরায় তাদের কাছে কৈফিয়ত চাইলে চাচি দাঁড়িয়ে বললেন,
” ফুপু, ঐ ছেলেটা একদম হঠাৎ করে নাফিসার গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছিলো। এভাবে হঠাৎ করে করায় আমরা আর কিছু বলতে পারিনি৷ ”
আনোয়ার দাদি এবার তেতে উঠলেন। প্রচণ্ড আক্রোশে বললেন,
” তহন কইবার পারছিলা না তো পরে তো কইবা? না কি তহনও জবানে তালা লাগানো ছিলো? আর ঐ পোলা মাইয়াগো তোমরা ছাদেই বা উঠবার দিছিলা ক্যান? নাশতা খাওইয়া নিচ থেইক্কা বিদায় কইরা দিতা। ”
চাচি নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি পুনরায় লক্ষ্য করে দেখলাম, আম্মু আমাদের দিকে গরম চোখে তাকিয়ে আছে।
আনোয়ারা দাদির কথা শেষ হতেই আব্বু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” আচ্ছা, ফুপু শান্ত হোন। যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। শুধু শুধু এখন চিৎকার চেঁচামেচি করে কি লাভ? কাল বাদে পরশু মেয়েটা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আজ অন্তত……… ”
আনোয়ারা দাদি পূ্র্বের সুরেই বললেন,
” তো কি হইছে? মাইয়া চলে যাইবো দেইক্কা হের সব খুন মাফ করুম না কি! তোমাগো তো বুদ্ধিশক্তি সব লোপ পাইছে। মাইয়া নাচতে নাচতে কইলো ঐ বড়লোক পোলারে বিয়া করবো, আর তোমরা তা তে রাজি হইয়া গেলা? ক্যারে নাফিসা? তোর ঐ পোলারে এতো পছন্দ হইছে! ঐ পোলার মধ্যে তুই দেখেছোসটা কি? ট্যাহা পয়সা না কি রূপ। হো বুঝছি, দুইডা দেইক্কাই তুই বিয়েতে রাজি হইছিলি। তাই না?
#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৫
আনোয়ারা দাদির এরূপ কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি আপুর সম্পর্কে এমন বাজে কথা বলে বসবেন তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। আনোয়ারা দাদির কথা শেষ হতে না হতেই আমাদের দাদি একপ্রকার হুংকার তুলে বললেন,
“আনোয়ারা, তোমার সাহস তো কম না! আমার নাতনীরে তুমি এসব কইতেছো কোন মুখে? ”
আনোয়ারা দাদি আমাদের দাদির কথা শুনে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না৷ বরং উল্টো দাপট দেখিয়ে বললেন,
” ঠিক কইছি ভাবী। কম পয়সাওয়ালা বাপের মাইয়া হইয়া অতো বড় বাড়িত যাওনের লাইগা উঠেপড়ে লাগছে, বুঝতাছি তো। এই মাইয়া যে এমন লোভী হে তো আগে জানতাম না। লোভী তো লোভী সাথে বেহায়াও আছে। মাইয়া……”
আনোয়ারা দাদিকে মাঝপথে থামিয়ে তার লাগাম টেনে ধরলো আব্বু। ক্রোধান্বিত স্বরে বললো,
” অনেকে হয়েছে ফুপু। আপনি বড় বলে আপনাকে সম্মান করছি। কিন্তু তাই বলে কি আমার মেয়েকে যাচ্ছেতাই বলে যাবেন! আপনি কি ভেবে ওকে লোভী বলেছেন? ও ইমাদকে পছন্দ করেছে বলে? ইমাদকে ও পছন্দ করে, ইমাদও ওকে পছন্দ করে। এখন যদি ছেলেটা বড়লোক ঘরের হয় তাহলে সেটা কি নাফিসার দোষ? ও…….”
আব্বুর কথা শেষ হতে না হতেই আপু কাঁদতে কাঁদতে রুম হতে চলে যায়। আমি তৎক্ষণাৎ আপুর পিছু গেলাম না৷ কারণ, এ মূহুর্তে আপুর পিছু পিছু গেলে আপু আমাকে ঠিকই পাঠিয়ে দিবে। এজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম, আপু কিছু সময় কান্না করে খানিক হালকা হয়ে নিলে তারপর আমি যাব। আপাতত আনোয়ারা দাদির মুখের উপর কিছু না বললে স্বস্তি পাবো না আমি৷
আপু যেতেই আব্বু পুনরায় আনোয়ারা দাদির উদ্দেশ্যে বললেন,
” মেয়েটাকে শুধু কষ্ট দিলেন ফুপু৷ যেখানে ওর কোনো দোষই ছিলো না সেখানে ওকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দেবার মানে কি! ”
আব্বুর কথার প্রত্যুত্তর স্বরূপ আনোয়ারা দাদি তার জবান খুলতে নিলেই আমি বেশ দুঃসাহসিকতার সহিত দাদির উদ্দেশ্যে বললাম,
” সম্পূর্ণ কথা না জেনে এভাবে হুটহাট পাগলেরা কথা বলে বসে। কিন্তু আপনি তো একদম সুস্থসবল মানুষ তাই না দাদি? তাহলে আপনি কি চিন্তা করে আপুকে ওসব কথা শোনালেন? আপনি কি একবারও চিন্তা করেছেন, কথা কোথায় শুরু করেছিলেন আর শেষ করলেন কোথায়? বিয়ে বাড়িতে এসেছেন মুরুব্বি হিসেবে, মুরুব্বির মতো থাকবেন। আর না জেনেশুনে এভাবে কথা বলার অভ্যাসটা ত্যাগ করলেই ভালো। ”
এই বলে আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম না। আক্রোশে উল্টে পথে পা বাড়িয়ে রুম হতে বেড়িয়ে এলাম৷ ওদিকে রুমে তখন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। আম্মু এবং চাচিরা স্বভাবতই তাদের ফুপু শ্বাশুড়ির সামনে জবান খুলবে না। কারণ মুখ ফসকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বেড়িয়ে গেলেই বাকিটা সময় তাদের নানারূপ কথার সম্মুখীন হতে হবে। তবে তারা নীরব রইলেও আমি এমতাবস্থায় কিছুতেই নিজেকে সামলে উঠতে পারলাম না। ফলে যতটা কথা না বললেই নয় ঠিক ততটাই উনার মুখের উপর বলে এসেছি।
আমি কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই ড্রইং রুমে এসে সোফায় বসে পরলাম। কিছুক্ষন পূর্বের সকল ঘটনা মস্তিষ্কে পুনরাবৃত্তি হওয়ায় রাগে, ক্ষোভে হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললাম আমি। এ মুহূর্তে আমার মন চাইছে আনোয়ারা দাদির সামনে নিজের জমানো সমস্ত ক্রোধ উগরে ফেলি। আনোয়ারা দাদির চোখে আমরা তিনবোন এবং আমাদের আম্মু কাঁটাস্বরূপ। আমার আম্মু আনোয়ারা দাদির চোখে খারাপ হওয়ার কারণ আম্মু দাদার বংশের বড় এবং প্রথম বউ হওয়া সত্ত্বেও কোনো ছেলে জন্ম দিতে পারেনি৷ আর আমরা তিনবোন খারাপ কারণ আমরা কেউই ছেলে নই। আনোয়ারা দাদির কথা, তিনটি মেয়ে না হয়ে একটি ছেলে হলেই যথেষ্ট ছিলো এবং উনি প্রতিবারের সাক্ষাতে আমাদের এ কথা শুনিয়ে ছাড়েন। আমাদের তিনবোনের মাঝে আনোয়ারা দাদির সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ হলো আমার আপু। কারণ আমার আপু বংশের বড় মেয়ে। আর তার ভাষ্যমতে, বংশের বড় হিসেবে মেয়েদের মানায় না। বরং বংশের বড় হতে হয় ছেলেদের। আমাদের বাসায় এলে উনি এই চিন্তায় বেহুঁশ হোন যে আমার বাবার বংশ কে এগিয়ে নিয়ে যাবে? কারণ তার কোনো ছেলে নেই। আনোয়ারা দাদির এরূপ কথা শুনে প্রতিবার ক্রোধে আমার সমস্ত শরীর রি রি করে। মন চায়, বেশ কথা শুনিয়ে ছাড়ি উনাকে। কিন্তু আব্বু আম্মুর কথা ভেবে নিশ্চুপ হয়ে থাকি আমরা।
কিছুক্ষণ পর আভা এসে আমার পাশে বসলো। চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” ছোট আপু, তুই বড় আপুর কাছে গিয়েছিলি?”
” এখনো যাইনি। যাব। আপু কি রুমে আছে?”
” আপু কি এমন অবস্থায় কখনো রুমে থাকে না কি! আমি সারাবাড়ি খুঁজে বেড়িয়েছি। আপু এখানে নেই। অর্থাৎ আপু ছাদে গিয়েছে। ”
আভার কথায় আমি আঁতকে উঠে বললাম,
” রাতের এই কনকনে শীতে আপু ছাদে গিয়েছে! উফ, আজ বাদে কাল বিয়ে আর এখন সে ঠাণ্ডা লাগানোর ধান্ধায় আছে। তুই তাসনিমদের সাথে থাক আপাতত। আমি আপুর কাছে যাচ্ছি। বেশিজনের যাওয়ার দরকার নেই। ”
আভা আমার কথার যথাযথ আজ্ঞা করে সোফায় বসে রইলো। এদিকে আমি রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার পরপরই সেখানে তাসনিম এসে উপস্থিত হলো।
আপু এ কনকনে শীতে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই শীতে আমার শরীর শিউরে উঠলো। আমি দ্রুত আমার রুম থেকে একটা শাল নিয়ে শরীরে জড়িয়ে আপুর রুমে গেলাম। আপুর চেয়ারে অগোছালোভাবে থাকা শালটা নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম। তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে পা রাখতেই আপুর ফুঁপানোর শব্দ কানে ভেসে এলো আমার। আমি শব্দহীন পা ফেলে আপুর দিকে ধীরেধীরে এগিয়ে গেলাম। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সমস্ত ছাদ আলোকিত হয়ে আছে। সেই সাথে হিম অনলের প্রবাহে সমস্ত ছাদ যেনো ছোটখাট একটা বরফপুরীতে পরিণত হয়েছে। গা হিম করা শীতে সোয়েটার, চাদর দিয়েও শীতকে কাবু করতে না পারায় আমি শিউরে উঠলাম। এতে আপু আমার উপস্থিতি টের পেয়ে খানিক চমকে উঠলো। অভিমানী সুরে জিজ্ঞেস করলো,
” তুই এখানে এসেছিস কেনো? আমাকে একটু একা থাকতে দে। ”
আমি আপুর পাশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম,
” অনেকক্ষণ একা থেকেছিস। আর না। কি মারাত্মক শীত পড়েছে দেখেছিস আপু? ”
আমার কথা শুনে আপু তার মলিন মুখখানা নিয়ে আমার দিকে তাকালো। জ্যোৎস্নার আলোয় আপুর এই মলিন মুখখানা দেখে আমার বুকটা মোচড়ে উঠলো। বেচারির আজ বাদে কাল বিয়ে অথচ এখনই বিয়ের কান্না করে উজাড় করে দিলো। আমি আপুর দিকে শাল এগিয়ে দিয়ে বললাম,
” এই নে গায়ে শালটা জড়িয়ে নে। না হলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে আপু।”
আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে জেদি সুরে বললো,
” লাগবে না চাদর। নিয়ে যা তুই। ”
আমি তৎক্ষনাৎ আপুর কথার প্রত্যুত্তর দিলাম না৷ কিয়ৎক্ষণ বাদে আমি দুষ্টুমির সুরে আপুকে বললাম,
” আরে নে তো আপু। এতো ঢঙ করিস কেনো? আমি তোর নায়ক না যে তুই জিদ করলে আমি তোর পিছু পরে রইবো। আর ফিল্মি হিরোদের মতো পিছন থেকে একই শাল দিয়ে আমি তোকে জড়িয়ে ধরবো। এসব করার জন্য তো ইমাদ ভাইয়া আছে। ডাকবো না কি ইমাদ ভাইয়াকে? হুম বলো বলো। ”
আমার কথা শুনে তৎক্ষনাৎ আপুর ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা ভেসে উঠলো। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আপুর এই মিষ্টি হাসি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি।
আরেক দফা আপুর দিকে শাল বাড়িয়ে দিতেই আপু তা নিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিলো। আমার দুষ্টুময় কথাগুলোয় আপুর রাগ অভিমান যে গলে গিয়েছে তা ভাবতেই ছোট্ট করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।
রাতের স্তব্ধ কনকনে পরিবেশ উপভোগ করতে দুজনে খানিক সময়ের জন্য ছাদে দাঁড়িয়ে রইলাম। যখন শীতের সাথে দুজনের একেবারেই লড়াই করার সামর্থ্য রইলো না তখন দুজনে রুমে চলে এলাম।
আপুর রুমে আসতেই দেখি আভা, তাসনিম, লামিয়া এবং আমাদের আরো ছোট ছোট দুটো চাচাতো বোন মিলে খেলাধুলা ও গল্পগুজব করছে। রুমে আমার আর আপুর উপস্থিতি টের পেয়েই আভা, তাসনিম এবং লামিয়া আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। আভা চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” বড় আপু? ঠিক আছো তো?”
আপু প্রশ্নের জবাব স্বরূপ শুধু মৃদুভাবে মাথা দুলালো। অতঃপর নিশ্চুপতার সহিত ক্লান্ত শরীরে বিছানায় বসে পড়লো। আমিও পরনের শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে আপুর সামনে একটি চেয়ার এনে বসে পড়লাম। আচমকা আমাদের চমকে দিয়ে আপুর ফোনটা তারস্বরে বেজে উঠলো। আভা আপুর ফোনটা হাতে নিয়েই বললো,
” আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।”
আভার কথা আমার কর্ণাধারে আঘাতপ্রাপ্ত হতেই আমার গলা শুকিয়ে গেলো। আমি ঘাবড়ে গিয়ে আপুর দিকে চেয়ে রইলাম এবং বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, আপুও আমার দিকে ত্রস্ত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো।
#চলবে