ভুলবশত_প্রেম,০৬,০৭

0
1500

#ভুলবশত_প্রেম,০৬,০৭
#লেখনীতে:সারা মেহেক
০৬

আপু দ্রুত আভার হাত হতে ফোনটি নিয়ে নিলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে কিয়ৎক্ষণ প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। অতঃপর নিজের আতঙ্কিত মুখখানা আড়ালে নেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে আপু জোরপূর্বক হেসে বললো,
” মাঝে মাঝেই এসব আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। ফোন রিসিভ করলেই বিপদ। এটাও ওমন বোধহয়।”
এই বলেই আপু চট করে কল কেটে দিলো। আপুর এ প্রতিক্রিয়া দেখে আমার সন্দেহ কিঞ্চিৎ গাঢ় হলো। তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি একান্তে কিছু সময় নিয়ে আপুকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো।

কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই আপুর ফোনে পুনরায় সেই নাম্বার হতে কল এলো। এবার আপুকে বললাম,
” রিসিভ করে দেখো, কে কল করেছে। লাউড স্পিকারে দিয়ে রেখো। আননোন নাম্বার থেকে কল করে কিছু বললে আমরা চারজন তো আছিই। তুমি রিসিভ করো। ”

আমার কথায় আপু অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল রিসিভ করে সালাম দিলো। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো,
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। ”

ওপাশে ইমাদ ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে আপুর চেহারায় স্বস্তির ছাপের দেখা মিললো। আমিও খানিকটা স্বস্তি পেলাম এতে।
সালামের উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে ইমাদ ভাইয়া স্বস্তির সহিত বললেন,
” যাক বাবা, ফোন তো রিসিভ করলে! আমি তো ভেবেছিলাম আননোন নাম্বার দেখে আজ বোধহয় ফোনই রিসিভ করবে না তুমি।”

আপু এ মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
” প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম বলে রিসিভ করিনি। আপনার ফোন কোথায়? কার ফোন দিয়ে কল করেছেন আপনি?”

” আমার ফোনের ব্যাটারি একদম ডাউন৷ দশ মিনিট আগে চার্জে দিয়েছি। এটা আদ্রিশের নাম্বার। ওর ফোন থেকেই কল করেছি তোমাকে। তুমি এ নাম্বারটা সেভ করে রেখো। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।”

” আচ্ছা, আমি সেভ করে রাখবো। ”

এরপর খানিক সময়ের নীরবতা বিরাজ করলো দুজনের মাঝে। এদিকে ফোন লাউড স্পিকারে থাকায় আমার, আভার, তাসনিম এবং লামিয়ার চোখেমুখে দুষ্টু হাসির রেখার দেখা মিললো। স্বভাবতই আমরা চারজনে নিজেদের মনেই স্বতন্ত্রভাবে কিছু দুষ্টু বুদ্ধি নিয়ে পর্যালোচনা করলাম। এ সবকিছু আমরা আপুর সামনে বসেই চোখের ইশারায় করলাম। এদিকে আপু কথা বলার জন্য বসা থেকে উঠতে নিলেই আমরা চোখ গরম করে তাকে বসিয়ে দিলাম। ফলস্বরুপ আপুও আমাদের দিকে গরম চোখে তাকালো। কিন্তু আমাদের দল ভারী হওয়ায় আপু এ যাত্রায় জিতে উঠতে পারলো না। আমি আপুকে বসিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
” এখানেই কথা বল আপু। আমরাও দেখতে চাই, প্রতি রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোরা কি কথা বলিস। ”

আমার কথা শুনে আপু পুনরায় উঠতে নিলে আমরা পুনরায় তাকে বসিয়ে দিলাম। আপুর সাথে এমন দুষ্টুমি করার সুযোগ আমরা কেউই হাতছাড়া করতে চাইলাম না।
বেশ কিছুক্ষণ পর ইমাদ ভাইয়া মিহি সুরে বললেন,
” কথা বলছো না কেনো নাফিসা? কিছু কি বলার নেই আমাকে?”

আপু নির্বাক বসে রইলো৷ আমাদের সামনে যে সে কথা বলতে পারছে না তা যথার্থই বুঝতে পেলাম আমরা। আপুর এহেন অবস্থা দেখে এবং ইমাদ ভাইয়ার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন দেখে আমরা চারজনে মিটিমিটি হাসতে লাগলাম।
ইমাদ ভাইয়া পুনরায় বললেন,
” কি ব্যাপার নাফিসা? তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?”

আপু তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
” আরে না না। আমি আপনার উপর রেগে থাকবো কেনো?”

” তাহলে কথা বলছো না কেনো?”

আপু পুনরায় মৌনতা পালন করলো। ইমাদ ভাইয়া খানিক বাদে কণ্ঠে পূর্বের সুর বজায় রেখে বললেন,
” মিস করছো না আমাকে? আমি কিন্তু তোমাকে খুব মিস করছি৷ আজ সাদিকের কাছে তোমার হলুদের ছবিগুলো দেখলাম। বিশ্বাস করো নাফিসা, হলুদ শাড়ীতে তোমায় অপরূপ সুন্দরী দেখাচ্ছিলো। তোমার এ ছবি দেখে আমি আরেকদফায় তোমার প্রেমে মজে গেলাম৷ আমি…..”

ইমাদ ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই আমার চারজনে নিজেদের উপস্থিতি টের পাওয়াতে একত্রে ‘ওহহো’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমাদের এহেন কাজে হয়তো ইমাদ ভাইয়া হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই কারণেই তিনি বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
” তোমরা আমাদের কথা শুনছিলে এতক্ষণ! ”

আমি উচ্ছল গলায় বললাম,
” বাহ, আমাদের কণ্ঠস্বর এই এক টোনেই এতো দ্রুত চিনে ফেললেন আপনি! নট ব্যড।”

ওপাশে ইমাদ ভাইয়া সশব্দে হেসে উঠলেন। বললেন,
” বউয়ের খোঁজ রাখি, তারমানে এই না যে শ্যালিকাগণের খোঁজ রাখবো না। তোমাদের সাথে যে পাঁচ ছয়বার কথা হয়েছে তাতে তোমাদের কণ্ঠ চেনা কোনো দুঃসাধ্য ব্যাপার নয় আমার পক্ষে। ”

” এজন্যই তো আপনি বেস্ট। আমার আপুর জন্য আপনার চেয়ে ভালো লাইফ পার্টনার হয়তো পাওয়া যেতো না।”

” উঁহু, ভুল বললে। আমার জন্য তোমার আপুর মতো লাইফ পার্টনার হয়তো শত চেষ্টার খোঁজাখুঁজিতেও পাওয়া যেতো না। এক্ষেত্রে আমি…..”

ইমাদ ভাইয়াকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে কে যেনো বলে উঠলো,
” আজকে আমার ফোনে এক হাজার টাকা ফ্লেক্সিলড দিবি তুই। ব্যাটা আধ ঘণ্টা যাবত এতো কি কথা বলছিস তুই? একটা দিনেরও তর সইছে না তোর?”

ইমাদ ভাইয়া সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” শালা কিপ্টা। কেটে দিচ্ছি এখন৷ আমার ফোন দিয়েই কথা বলবো এখন। এতোক্ষণে যথেষ্ট চার্জ হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই। ”
এই বলে ইমাদ ভাইয়া পুনরায় আপুর উদ্দেশ্য বললেন,
” নেট কানেকশন অন রেখো। আমি ভিডিও কল দিচ্ছি। ”
আপু ছোট্ট করে জবাব দিলো,
” আচ্ছা।”
এপাশ হতে আপুর জবাব শোনামাত্রই ইমাদ ভাইয়া কল কেটে দিলেন এবং প্রায় এক মিনিটের মাঝেই আপুর ফোনে ইমাদ ভাইয়া ভিডিও কল দিলেন। আপু কল রিসিভ করে ফোনটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে বসে পরলো এবং তাকে ঘিরে আমরা চারজনে বসে পড়লাম।

স্ক্রিনে ইমাদ ভাইয়ার দেখা মিলতেই আমরা একে একে চারজনে সালাম দিলাম তাকে। তিনিও সালামের জবাব দিয়ে আমাদের সাথে টুকটাক কথা বলতে শুরু করলেন। কথার এক পর্যায়ে আমি রসিয়ে রসিয়ে উনাকে বললাম,
” তা আপনি যে আমাদের আপুর প্রেমে আরেকদফা পা পিছলে পরলেন তাতে আপনার অনুভূতি কেমন? ”

ইমাদ ভাইয়া মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন,
” পা পিছলে পড়ার পর যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমনটাই অনুভূত হচ্ছে আমার৷ অর্থাৎ ব্যাথা করছে বুকটায়। প্রচণ্ড ব্যাথা।”

ইমাদ ভাইয়ার এহেন কথায় আপু লজ্জায় মিইয়ে গেলো। তবে আমরা সমস্বরে হেসে উঠলাম। আমি বললাম,
” তাই না কি? প্রেমে পড়লে যে এতো ব্যাথা হয় তা তো জানতামই না আমি।”

(লেখনীতে:সারা মেহেক)

ইমাদ ভাইয়া জবাব দিলেন,
” প্রেমে পড়োনি তো কখনো। এজন্য এমন অনুভূতি হয়নি তোমার। একবার কারোর প্রেমে পড়েই দেখো। ব্যাথার সাথে সাথে আরো অনেক অনুভূতির সাথে পরিচিত হবে তুমি। ”

আমি বেশ গর্বের সহিত বললাম,
” ওসব প্রেম টেমের ফাঁদে আমি পা রাখছি না কখনো।”

আমার কথার প্রত্যুত্তর স্বরূপ এবার আপু বলে উঠলো,
” এসব থেকে এতো দূরত্ব বজায় রেখে চলিস তো…..দেখিস অতি শীঘ্রই তুই এ ফাঁদে পা রেখে মারাত্মকভাবে ফেঁসে যাবি। তখন আমরা সবাই বলবো, ‘ ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’।”
আপুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই ইমাদ ভাইয়াসহ সকলে সমস্বরে হেসে উঠলো। এদিকে আমি কপট রাগ দেখিয়ে চোখমুখ কুঁচকে আপুর দিকে তাকিয়ে আছি। ইমাদ ভাইয়া এবার বললেন,
” বি প্রিপেয়ার্ড মিম।”

আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। বরং সরু চোখে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ ফোনের ওপাশ হতে কে যেনো বলে উঠলো,
” কাকে কি নিয়ে প্রিপেয়ার্ড হতে বলছিস তুই?”

ইমাদ ভাইয়া জবাবে কিছু বললেন না। বরং ফোনটা নিজের সামনে হতে সরিয়ে নিয়ে পাশে ধরে বসলো। তথায় উদোম শরীরে আধশোয়া অবস্থায় ফোন নিয়ে বসে থাকা কারোর সামনে ধরে বললেন,
” এই যে, মিমকে বলছিলাম। ”

ইমাদ ভাইয়ার কথা শোনামাত্রই সে ব্যক্তিটি মাথা তুলে ফোনের দিকে চাইলো। অচিরেই উদোম ব্যক্তিটির চেহারা ঠাহর করতে পেরে আমরা সকলেই স্তব্ধ চাহনিতে চেয়ে রইলাম। উদোম শরীরের ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং স্বয়ং আদ্রিশ। এদিকে পুরো ঘটনাটি ঠাহর করতে কিয়ৎক্ষণ সময় নিলেন আদ্রিশ। অতঃপর উনি ঝড়ের গতিতে ফোন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের দু হাত দিয়ে শরীর ঢাকার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালেন। আদ্রিশের এহেন কাণ্ডে ইমাদ ভাইয়াসহ আমরা পাঁচজনে ফিক করে হেসে ফেললাম। মুহূর্তটির কথা চিন্তা করতেই আমাদের সকলের হাসির গতি পূর্বের চেয়ে বহুগুণে বেড়ে গেলো। ইমাদ ভাইয়া তখনও আদ্রিশের দিকে ফোনের ক্যামেরা তাক করে আছেন। এদিকে আদ্রিশ নিজের উদোম শরীর ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তড়িঘড়ি করে সোফা হতে একটি গেঞ্জি নিয়ে পরতে পরতে ইমাদ ভাইয়া ভাইয়ার উদ্দেশ্যে রাগত স্বরে বললেন,
” শালা ইমাদের বাচ্চা ইমাদ, তোকে নিয়ে এখন আমি ফুটবল খেলবো। শালা, মেয়েদের সামনে আমার ইজ্জত সম্মান রাখলি না৷ ভাবীর সামনে তো রাখলিই না বরং ভাবীর বোনদের সামনেও রাখলি না৷ সাহস কত বড় তোর! আমার ইজ্জত নিলামে দিয়ে এখন দাঁত কেলিয়ে হাসছিস! এর রিভেঞ্জ আমি নিয়েই ছাড়বো। দেখে নিস।”

আদ্রিশের এহেন কাণ্ডে হাসতে হাসতে আমাদের সকলের পেটে খিল ধরে যাওয়ার উপক্রম হলো।

#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

ইমাদ ভাইয়াকে কিছুক্ষণ মনমতো শখানেক কথা শুনিয়ে আদ্রিশ উনার পাশে এসে বসলেন। আপুর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেমন আছেন ভাবী?”

আপু মুচকি হেসে বললো,
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি?

” জ্বি, আমিও ভালো আছি। আপনি কিছু মনে করবেন না আবার। একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম রুমে। কিন্তু ইমাদ আমার রেস্টের বারোটা বাজিয়ে ছাড়লো। ”

আমাদের মাঝে পুনরায় হাসির রোল পড়ে গেলো। আপু এবার জিজ্ঞেস করলো,
” এতো শীতে ওভাবে বসে ছিলেন যে?”

আদ্রিশ মৃদু হেসে জবাব দিলেন,
” রুম হিটার অন করে রেখেছিলাম। হালকা গরম গরম ফিল হওয়ায় গেঞ্জিটা খুলে রেখেছিলাম। কে জানতো, আমার এ গেঞ্জি খোলাটাই আমার ইজ্জত নিলামে তুলে দিবে। ”

ইমাদ ভাইয়া দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন,
” তুই দেখেছিস না যে আমি ফোনে কথা বলছিলাম? তাহলে গেঞ্জিটা তখন পরে নিলেই তো পারতি। ”

আদ্রিশ বিস্মিত চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” আজব যুক্তি দিস কেন? তুই কথা বলছিস, তো বল। এখানে আমার গেঞ্জি পরার সাথে এই কথা বলার কি সম্পর্ক ছিলো!”

” ওসব তুই বুঝবি না৷ আচ্ছা, তুই যা তো রুম থেকে। তুই ওদের সাথে কথা বলতে দিচ্ছিস না আমাকে। ”

আদ্রিশ নাছোড়বান্দা হয়ে বললেন,
” আমি তো এখানেই থাকবো। তোর কথা বলতে সমস্যা হলে তুই অন্য রুমে যেতে পারিস। ”

ইমাদ ভাইয়া এবং আদ্রিশের এহেন অবস্থা দেখে আমরা মিটিমিটি হেসে চলছি। আপু দুজনের উদ্দেশ্যে বললেন,
” আচ্ছা, আজ রাখছি। অনেক কথা হয়েছে। পরে আবার কথা হবে।”

ভিডিও কলে দেখতে পেলাম, ইমাদ ভাইয়া আপুর এ কথায় বেশ মনঃক্ষুণ্ন হলেন। কিন্তু আর উপায় না পেয়ে মনে যেনো ভীষণ কষ্ট নিয়ে তিনি কল কেটে দিলেন। উনি যে রাতে আবারো আপুকে কল করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইমাদ ভাইয়া কল কাটতেই আমরা পাঁচজনে একে অপরের সাথে কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলাম।

.

আজ বাসার সবারই নানারকম ব্যস্ততায় সময় কেটেছে। কাল বিয়ে বলে আপুর জিনিসপত্রের গোছগাছ, ভেন্যু সাজানো নিয়ে ছোটখাট একটা গোলামালও বেঁধেছিলো। তবে খুব দ্রুতই তার সমাধান হয়ে গিয়েছিলো।
আমাদের বোনদের দিনের আজ পুরোটা সময় কেটেছে আপুকে ঘিরে। আপুর টুকটাক রূপচর্চা, টুকটাক জিনিসপত্রের গোছগাছ করা নিয়ে পুরো দিন চলে গিয়েছে।

গতকালের ঘটনার পর আমরা কেউই আনোয়ারা দাদির সামনে পড়িনি এবং উনিও আমাদের সামনে পড়েননি। তবে দূর্ভাগ্যবশত উনার সাথে একটু আধটু দেখা হলেও আমরা এমন ভাবে তাকে এড়িয়ে চলছি যেনো আমরা তাকে চিনি না। অবশ্য এ নিয়ে আনোয়ারা দাদি আপাতত কিছু বলেননি আমাদের। তবে সময় সুযোগ পেলে হয়তো কিছু নয়, বরং অনেক কিছুই বলে বসবেন তিনি।

মাগরিবের পর পরই দুজন মেহেদি আর্টিস্ট এলো আপুকে মেহেদি দিয়ে দিতে। এই দুজন মেহেদি আর্টিস্ট এর জোগাড় করেছেন স্বয়ং ইমাদ ভাইয়া। তার কথা, ‘আমি শহরের বেস্ট এবং নামীদামী মেহেদি আর্টিস্টকে আনবো। কিন্তু এর বিনিময়ে আমার বউকে বেস্ট এণ্ড বেস্ট মেহেদি দিয়ে দিতে হবে।’ ইমাদ ভাইয়ার কথামতোই হয়তো তিনি মানুষ পাঠিয়েছেন। কারন আপুকে মেহেদি দিতে আসা মেহেদি আর্টিস্টদের সাজপোশাক দেখে মনে হচ্ছে তারা কোনো সাধারণ পার্লারের কাজ করে না। বরং শহরের নামীদামী পার্লারের একটিতে কাজ করে।

মেহেদি আর্টিস্ট দুজনে আপুকে আপুর রুমেই মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে। আপু বিছানায় বসে দু পাশে দু হাত ছাড়িয়ে মেহেদি দিয়ে নেওয়াচ্ছে। যেহেতু মেহেদি পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে সেহেতু আমরা কাজিনরাও মেহেদি নেওয়া শুরু করলাম। তবে এী পূর্বে বাসার ছোট বাহিনীর সদস্যগুলোকে মেহেদি দিয়ে দিলাম। পিচ্চিদের মেহেদি দেওয়া শেষ হতে হতে আপুর ফোনে ইমাদ ভাইয়ার ভিডিও কল এলো। আপুর ফোন আমার কাছে থাকায় আমি চট করে ইমাদ ভাইয়ার কল রিসিভ করে ঝলমলে গলায় বললাম,
” সারপ্রাইজ ইমাদ ভাইয়া। কলটা আপনার বউয়ের রিসিভ করার কথা থাকলেও দূর্ভাগ্যবশত আমি রিসিভ করলাম। ইশ, খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”

ইমাদ ভাইয়া আমার কথায় হেসে দিলেন। স্বাভাবিক সুরেই বললেন,
” আমি জেনেশুনেই ফোন দিয়েছি মিম। আমি জানি, এখন আমার বউটা ফোন রিসিভ করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। কারণ সে এখন আমার জন্য সাজতে ব্যস্ত।”

ইমাদ ভাইয়ার এহেন কথায় মেহেদি আর্টিস্ট দুজনে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। এদিকে আপু লজ্জায় নতমুখে বসে রইলো। উনার কথার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এবার আভা আমার পাশ হতে বলে উঠলো,
” আপনি তো ভীষণ দুষ্টু কোয়ালিটির লোক ইমাদ ভাইয়া। আমার আপুকে তো আপনি লজ্জায় ফেলেই মেরে ফেলবেন। ”

আভার কথা শুনে ইমাদ ভাইয়া তৎক্ষনাৎ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
” কই কই, দেখি তো আমার বউয়ের লজ্জায় রাঙানো মুখখানা।”

ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে আমি এবং আভা সশব্দে হেসে ফেললাম। এদিকে উনার কথাবার্তার ধরণ শুনে মেহেদি আর্টিস্ট দুজনে উঠে পড়ে বললেন,
” আমরা একটু পড়ে আসছি৷ আপনারা কথা বলুন।”
এই বলে তারা মেহেদি রেখে রুম হতে বের হয়ে গেলেন। তাদের পিছু পিছু আভাও রুমে ছেড়ে বের হয়ে গেলো। কারণ আম্মুর ডাক এসেছে তার জন্য। আভা বেরিয়ে গেলেই তৎক্ষনাৎ আমি ইমাদ ভাইয়াকে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
” আপনার কথাবার্তা শুনে মেহেদি আর্টিস্ট দুজন উঠে চলে গেলো। ইশ, আপনার মতো দুষ্টু লোক এ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই বোধহয়। ”

ইমাদ ভাইয়া যেনো এ কথা শুনে খুব গর্বিত হলেন। বললেন,
” আমি তো লিমিটে থাকি। আদ্রিশের দুষ্টুমির কথা শুনলে তুমি মনে হয় লজ্জায় কান চেপে ধরবে। ”
(লেখনীতে:সারা মেহেক)
ইমাদ ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই চট করে আদ্রিশ ক্যামেরার সামনে এলেন। আমাদের কিছু বুঝে উঠবার পূর্বেই উনি ইমাদ ভাইয়ার হাত হতে ফোনটি নিয়ে নিজের দিকে তাক করে বললেন,
” আমার এতো এতো তারিফ কার কাছে করিস?”

এই বলে আদ্রিশ ফোনের ক্যামেরা দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আদ্রিশের এ কাণ্ডে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ফলে মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও বের হলো না। কিন্তু আদ্রিশ আমাকে দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। বরং কিয়ৎক্ষণের জন্য একধরনের অনির্ণেয় চাহনিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। উনার এ চাহনিতে আমার মাঝে অদ্ভুত এক অনুভূতির উদ্রেক হলো। আমার দু হাত ক্ষণিকের জন্য যেনো হিমায়িত হয়ে গেলো। আমার এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো তখন যখন ইমাদ ভাইয়া আদ্রিশের কাছ হতে ফোন নিজের হাতে নিলেন। উনার এ উদ্যোগে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ইমাদ ভাইয়া ফোন হাতে নিয়ে আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললেন,
” হুদাই ফোন হাতে দাঁড়িয়ে ছিলি কেনো? আজব মানুষ তো তুই! মিম, তোমার আপুকে ফোন দাও।”

আমি এ মুহূর্তে আর মজা করার মতো পরিস্থিতিতে রইলাম না। ফলে কোনোরূপ কথাবার্তা না বাড়িয়ে আপুর দিকে ফোন তাক করলাম। ইমাদ ভাইয়া ও আপু বেশ কিছুক্ষণ যাবত কথা বললো। এদিকে ফোন লাউড স্পিকারে থাকার সত্ত্বেও উনাদের একটি কথাও আমার কান অব্দি এসে পৌঁছুলো না। শুধু শুনতে পেলাম কথার শব্দ আসছে। কিন্তু কি কথা হচ্ছে তা বোঝার সাধ্য রইলো না আমার। কারণ এ মুহূর্তে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্রিশের সেই চাহনি নিয়ে এপার ওপার ভাবনা ভাবতে লাগলাম। যদিও এ ভাবনার কোনো কূলকিনারা এবং উপযুক্ত কারণ খুঁজে পেলাম না আমি। তবুও এ নিয়ে ভাবলাম। কারণ অতিরিক্ত চিন্তাশীল মেয়ে হওয়ার দরুন এ ছোট্ট ঘটনা নিয়ে না ভাবলে যেনো আমার নিজের দেওয়া এ নামের সার্থকতা হতো না। যেনো এ নামের সার্থকতা সিদ্ধির জন্যই আমি এ ভাবনায় ডুবে ছিলাম এতোক্ষণ যাবত।

.

রাতের খাবার খেয়ে এসে মাত্রই আপুর পাশে শুয়েছি। এমতাবস্থায় একদম বাজখাঁই আওয়াজে আমার ফোনটা বেজে উঠলো। আপু ঘুমিয়ে পড়ায় আমি তৎক্ষণাৎ ফোনটা হাতে নিয়ে সাউন্ড কমানোর বদলে ভুলবশত রিসিভ করে ফেললাম। যেহেতু ফোন রিসিভ করেই ফেলেছি সেহেতু ফোনটা কানের কাছে নিয়ে নিচু স্বরে ‘ হ্যালো ‘ বললাম। আমার কণ্ঠস্বর শোনামাত্রই ওপাশের লোকটি কোনোরূপ ভূমিকা ছাড়া বলে উঠলেন,
” মিসেস ইকবাল, আই এম সরি টু সে দিস, আমরা আপনার প্রপোজাল একসেপ্ট করতে পারছি না। ঐ ফর্মূলাটা আপনার কাছে দেওয়া সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। আপনার হাজবেন্ডকে ফোনে………”
কথার আগামাথা কিছু বুঝতে না পারায় রং নাম্বার বলে ওপাশের লোকটির দ্রুতগতি সম্পন্ন কথা শেষ হবার পূর্বেই আমি কলটি কেটে দিলাম। লোকটি দ্বিতীয় দফায় আর কল করলেন না। এদিকে কল কেটে আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য অকারণেই তার কথাবার্তা বিচার বিশ্লেষণ করলাম। স্বভাবতই এতে কোনো ফল পেলাম না। তবে লোকটির কণ্ঠস্বর আমাকে খানিক ভাবালো।
লোকটির কণ্ঠস্বর শুনে আমি প্রথম দফায় ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো, কণ্ঠস্বরটি খানিক পরিচিত। তবে মুহূর্তেই নিজের এ ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেললাম আমি। কারণ ফোনে দুজন আলাদা মানুষের কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন খুব কমই আঁচ করতে পারি আমি। বিশেষ করে প্রায় পুরুষ মানুষের কণ্ঠস্বর অর্থাৎ এ পর্যন্ত যত জনের কণ্ঠস্বর আমি ফোনে শুনেছি তাদের কণ্ঠস্বর আমার কাছে অদ্ভুত এক কারণে কাছাকাছি মনে হয়েছে। এই যেমন আমার আব্বু এবং চাচুদের কণ্ঠস্বর চেহারা দেখা ব্যতিত হঠাৎ করে শুনলে আলাদা করতে পারি না আমি। কারণ তাদের কণ্ঠস্বরের উঠানামা অনেকটা কাছাকাছি ধরণের। তেমনই রং নাম্বার হতে কল করা ব্যক্তিটির কণ্ঠস্বরও কিয়ৎক্ষণের জন্য ইমাদ ভাইয়ার কণ্ঠের সাথে মিল সম্পন্ন মনে হয়েছিলো আমার কাছে। কিন্তু এ ভাবনাটি এসেছিলো ক্ষণিকের জন্য।
হঠাৎ পাশ হতে আপুর ঘুমুন্ত কণ্ঠস্বর শুনে আমার ভাবনায় নোঙর পড়লো। আপু আমাকে ঘুমুঘুমু কণ্ঠে বললো,
” এতো রাতে কার সাথে কথা বলিস? ঘুমিয়ে পর। কালকে সকাল সকাল উঠতে হবে তো। ”

আমি আর ভাবনার নোঙর না তুলে ফোনটি রেখে চুপচাপ শুয়ে পরলাম।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here