#ভুলবশত_প্রেম,০৮,০৯
#লেখনীতে:সারা মেহেক
০৮
প্রত্যূষের হিম অনলের শীতল ছোঁয়ায় আধো আধো চোখ মেলে তাকালাম আমি৷ ঘুম ভাঙার পরও চারপাশের হৈচৈ পূর্ণ মহলে আমি ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। ক্ষণিকের জন্য মনে এ চিন্তা জাগ্রত হলো যে, আমাদের শান্তশিষ্ট বাসায় এমন মাছের হাট বসলো কি করে। পরক্ষণেই মনে পড়লো, আজ আপুর বিয়ে। এজন্য সকাল হতেই এতো হৈচৈ পূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে।
শীতের সকালের আলসেমি কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি এবং একে একে রুমে যারা ঘুমিয়েছিলো তাদেরকে ডাকলাম। আপু কিছুক্ষণ পূর্বেই উঠে পড়েছে। সে আপাতত রুমে নেই। আমি বাকিদের ডেকে রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কারণ ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘর পার হয়ে গিয়েছে বহুক্ষণ পূর্বে। আর আধ ঘণ্টার পর পার্লারের জন্য বেরিয়ে না পরলে যে বরযাত্রী আপুর পূর্বেই কমিউনিটি হলে পৌঁছে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সকালের খাওয়াদাওয়া শেষে আপু, আমি, আভা, তাসনিম এবং লামিয়া পার্লারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলাম। ইমাদ ভাইয়া এখানকার সুপরিচিত এক পার্লারে আমাদের এপোয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন। সেই পার্লারে যাচ্ছি আমরা। আমাদের বাসা হতে সেই পার্লারে যেতে প্রায় বিশ মিনিটের মতো সময়ের প্রয়োজন হয়। আমরা একটা অটো নিয়ে পাঁচজনে বসে পার্লারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
পার্লারে ঢুকতেই সেখানকার এক কর্মচারী আমাদের পাঁচজনকে একত্রে দেখে খানিকটা ভড়কে গেলেন হয়তো। তিনি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনাদের মধ্যে ব্রাইড কে?”
কর্মচারীটির কথায় হাসি পেলেও আমরা চারজনে আপুর দিকে আঙুল তাক করে বললাম,
” এই যে আমাদের ব্রাইড।”
আপুকে দেখে কর্মচারীটি মৃদু হাসবার চেষ্টা করে বললেন,
” সরি ম্যাম। আসলে এতোজনকে দেখে একটু কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক, আসুন এদিকে। আপনার জন্য তো বুকিং দেওয়া আছে।”
এই বলে তিনি আপুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। আপু যেতেই আমরা চারজনে মুখ চেপে খানিক সময় হেসে নিলাম। আপাতত এতোজন মানুষের সামনে উচ্চস্বরে হাসাহাসি করা অর্থ নিজেদের অপর মানুষগুলোর সামনে হাসির পাত্র বানানো। সর্বপ্রথম আমাদের প্ল্যান ছিলো, আপুর সাথে যেকোনো একজন যাবে। কিন্তু সেই ‘যেকোনো একজন’ যে আসলে কে তা নির্বাচন করতেই আমাদের দুটো দিন শেষ। অতঃপর ইমাদ ভাইয়ার কানে কোনোভাবে এই সংবাদটা পৌঁছালে তিনি আমাদের চারজনের এপোয়েন্টমেন্টও নিয়ে রাখেন।
আমরা চারজনে একে একে গিয়ে একেকটা চেয়ারে বসে পড়লাম। পার্লার মোটামুটি ফাঁকাই আছে। মাত্র ২ জন ক্লায়েন্ট বাদে এখনও অব্দি কোনো ক্লায়েন্ট নেই সেখানে। ফলে আমরা চারজনে আরামে বসে পড়লাম।
আমি বসে পড়তেই হুট করে আমার ফোনে কল এলো। ব্যাগ হতে ফোন বের করে দেখলাম তিন্নি কল করেছে। ভেতরে বেশ চেঁচামেঁচি থাকায় আমি দ্রুত পার্লারের বাহিরে এসে ওর ফোন রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলাম,
” তিন্নি? আপুর বিয়েতে আসবি না তুই?”
ওপাশে তিন্নির উদাসীন কণ্ঠ শুনতে পেলাম। সে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
” না রে। আব্বু কোনোভাবেই রাজি হলো না। ”
তিন্নির কথায় আমার ঠোঁটের কোনে বজায় থাকা হাসিটা মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেলো। ওর ফোন আসার আগ পর্যন্তও আমি এই আশায় ছিলাম যে, আংকেল ওকে বিয়েতে আসতে কোনোপ্রকার বাঁধা দিবে না। তবে এখন ওর কথায় সে আশার আলো দপ করে নিভে গেলো। আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
” ওহ।”
ওপাশ হতে তিন্নি নিশ্চয়ই মেকি খুশির অভিনয় করে বললো,
” আমি যাচ্ছি না তো গিয়েছে? নিশাত তো যাচ্ছে।”
আমি উদাসীন কণ্ঠে বললাম,
” একজন কখনোই দুজনের শূন্যস্থা পূরণ করতে পারে না। তুই আসলে অন্যরকম মজা হতো। ”
আমার হাবভাব দেখে তিন্নি কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো,
” আচ্ছা, শোন। কালকে কিন্তু ফরেনসিকের আইটেম আছে।”
তিন্নির কথা কর্ণপাত হতেই আমার খারাপ মেজাজ আরো খারাপ পর্যায়ে চলে গেলো। আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললাম,
” আচ্ছা? দেওয়ান স্যারের কি আমার সাথে কোনো শত্রুতা আছে? আমি উনাকে বলে আসলাম, আমার আপুর বিয়ে বলে আমি তিনদিন কলেজে আসতে পারবো না। এরপরও স্যার কোন আক্কেলে আইটেম দিলো? যে চ্যাপ্টার আমাদের আরো চারদিন আগে শেষ, সে চ্যাপ্টারের আইটেম আরো কিছুদিন পরেই নিতে পারতো। নাহ, তা তো উনি করবেন না। এবার গিয়ে স্যারকে বলবো, স্যার আমার পেন্ডিং আইটেমটা আপনি দিয়ে দিয়েন। ”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই ওপাশে তিন্নির উচ্চ শব্দের হাসি শুনতে পেলাম। এদিকে আমার মেজাজ ধীরেধীরে গগনচুম্বী হওয়ায় আমি চুপচাপ গাল ফুলিয়ে এবং ভ্রু কুঁচকে ওর হাসির শব্দ শুনতে লাগলাম। এদিকে ওর হাসির শব্দ অনবরত শুনতে শুনতে দেখতে পেলাম, ইমাদ ভাইয়ার ছোট বোন থেকে শুরু করে উনার কাজিন এবং মধ্য বয়স্ক দুজন মহিলা পার্লারে ঢুকছে। ইমাদ ভাইয়ার ছোট বোন, ইমা আমাকে দেখে মুচকি হেসে ইশারায় ‘হাই’ বলে চলে গেলো। ইমাদ ভাইয়ার পরিবার হতে এই পাঁচজনের পার্লারে আগমন দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না, কি কারণে আজকের দিনে এতো সুপরিচিত পার্লারে ক্লায়েন্টের অভাব দেখা যাচ্ছিলো।
ওপাশ হতে হঠাৎ তিন্নির কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম। ও জিজ্ঞেস করলো,
” কি ব্যাপার মিম? কথা বলছিস না কেনো?”
আমি তৎক্ষনাৎ বলে উঠলাম,
” এই তো কথা বলছি তো। আচ্ছা, বল। গতকাল কি ওয়ার্ড হয়েছিলো?”
” অবভিয়েসলি হয়েছে। ওয়ার্ড না হয়ে থাকতে পারে না কি!”
আমার মাঝে পুনরায় বিরক্তির আভাস টের পেলাম। বললাম,
” একটা দিন রোগী কম থাকলে কি হয়। অন্তত এই ছুটি নেওয়াতে ওয়ার্ড তো মিস যায় না। মহাযন্ত্রণা। উফ।
আচ্ছা, তিন্নি,তোর সাথে পরে কথা বলছি।”
” আচ্ছা। বিয়েটা ইনজয় কর। কারণ এরপর তোর বিয়ের সানাই বাজবে। তখন আর সিঙ্গেল অবস্থায় কোনো বিয়ের দাওয়াত খেতে পারবে না সোনা। তখন সব হবে মিঙ্গেল মিঙ্গেল। ”
” আরে রাখ তো তোর সিঙ্গেল মিঙ্গেল। আমি রাখি এখন। বাই।”
এই বলে আমি কল কেটে দিলাম। ফোন হাতে প্রচণ্ড বিরক্তি এবং ক্রোধ নিয়ে ঘুরতেই সাদিককে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। উনাকে এ মুহূর্তে এখানে কল্পনাও করতে পারিনি আমি। ফলস্বরূপ উনাকে দেখে খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। সাদিক আমাকে দেখে মুচকি হেসে দিলেন। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” ভয় পেয়ে গেলেন না কি?”
উনাকে দেখে ভয় পাওয়া সত্ত্বেও নিজের সম্মান বাঁচিয়ে রাখতে জোরপূর্বক হেসে বললাম,
” না না। এমন কিছু না। তো আপনি এখানে যে?”
সাদিক সপ্রতিভ হেসে বললেন,
” ঐ যে দেখলেন না পার্লার বাহিনীকে? দুই গাড়ি ভর্তি করে ওদের রাখতে এসেছিলাম। একদল এলো আমার সাথে। আরেকদল এলো ড্রাইভারের সাথে।”
সাদিকের এ হাসিতে আমার মাঝে মৃদু ভালোলাগা বিরাজ করলেও তা লুকিয়ে রেখে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
” ওহ।”
সাদিক এবার জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনি কিসে পড়েন?”
হুটহাট এমন প্রশ্নে আমি চমকায়িত হলেও চেহারায় স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললাম,
” জি, এমবিবিএস থার্ড ইয়ারে। ”
উনার চেহারা যেনো উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। উনি পুনরায় উৎসুকতার সহিত জিজ্ঞেস করলেন,
” কোন মেডিকেলে?”
আমি উনাকে মেডিকেলের নাম বলতেই উনি চমকপ্রদ গলায় বললেন,
” ওয়াও। কোইন্সিডেন্সটা দেখো। আমি ঐ কলেজেই ফার্মাসিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি। ”
সাদিকের কথা কর্ণপাত হতেই আমার মাঝে ক্ষুদ্র এক ভালোলাগার শিহরণ বয়ে গেলো। আমি উনার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে বললাম,
” বাহ। এখন তো তাহলে রোজ রোজই আমাদেরই দেখা হবে। ”
” তা আর বলতে। ”
সাদিকের কথা শেষ হতেই হঠাৎ পিছন হতে আদ্রিশ উনার কাঁধে হাত রেখে পাশে দাঁড়ালেন। আমার দিকে নিমিষের জন্য তাকিয়ে সাদিকের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুই যুবক যুবতীর মাঝে এতো হাসাহাসি হচ্ছে কি কারণে?”
সাদিক খানিক চমকিত গলায় বললেন,
” আরে আদ্রিশ ভাই যে? তুমি এখানে কেনো?”
আদ্রিশ আমার দিকে বাঁকা চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” নদী বাসা থেকে আসবার সময় ভুলে ড্রেস এনেছিলো না। সো, মহারাণীকে ড্রেস দেবার জন্য ছুটে চলে আসতে হলো। তা এখানে দাঁড়িয়ে এতো হাসাহাসি করছিলি কি নিয়ে?”
সাদিক উচ্ছ্বাসের সহিত বললেন,
” আরে আদ্রিশ ভাই, জানো না, মিম আর আমি একই কলেজে। আই মিন, ও থার্ড ইয়ারে পড়ে আর আমি ফোর্থ ইয়ারের লেকচারার। বলছিলাম, এখন থেকে তো রোজ রোজই দেখা সাক্ষাৎ হবে।”
আদ্রিশ সাদিকের পিঠে মৃদু শব্দে চাপড় মেরে স্বাভাবিক সুরে বললেন,
” বাহ, ভালো তো। আচ্ছা এখন চল, আমাদের ইমাদ সাহেবকে তো রেডি করতে হবে না কি! দেখা গেলো, ভাবী রেডি হয়ে বিয়ের আসরে উপস্থিত। কিন্তু আমাদের ইমাদ এখনও রেডি হচ্ছে। ”
এই বলতেই উনাদের দুজনের মাঝে অল্পবিস্তর হাসির রোল পরে গেলো। উনাদের এ হাসাহাসির পর্ব শেষ হতেই উনারা উল্টো পথে হাঁটা ধরলেন। সামনের গাছের নিচে সাময়িক পার্কিং করে রাখা কারে প্রথমে সাদিক উঠলেন। অতঃপর আদ্রিশও উঠলেন। তবে গাড়িতে বসবার পূর্বে অজানা কোনো কারণে আমার দিকে আড়চোখে নিমেষের জন্য তাকালেন। যেতে যেতে উনার এ চাহনি উনার পিছে বেশ ক’টা প্রশ্ন ফেলে রেখে গেলেন।
#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৯
কালেভদ্রে আকাশে আজ সূর্যের দেখা মিলছে। তার পরশ আজ তেজহীন এবং উষ্ণ। শীতের হিম পরশে তেজি সূর্যও নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। বাহিরের পরিবেশ কিছুটা শীতল হলেও কমিউনিটি হলে অগণিত মানুষের উপস্থিতিতে পরিবেশটা বেশ তপ্ত হয়ে উঠেছে। ফলে বাহিরের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে বাসা হতে আনা শালটা এখন অতিরিক্ত একটি ঝঞ্জাট বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। কিন্তু এই ঝঞ্জাটকে আপাতত কারোর হাতে তুলে দিতে পারছি না আমি। কারণ আমার বাসার সকলেই এখন টুকটাক কাজে ব্যস্ত৷ কেউ কথা বলতে, কেউ পরস্পরের সাথে পরিচিতি বাড়াতে,কেউ আপুর পাশে থাকতে তো কেউ মেহমানদের খানাপিনার ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। অতঃপর বেশ কিছুক্ষণের খোঁজাখুঁজির পর আমার দাদিকে চুপচাপ এক কোনায় বসে অলস ভঙ্গিতে দুলতে দেখলাম। দাদিকে দেখা মাত্রই আমার চোখজোড়া যেনো আশার আলোয় দপ করে জ্বলে উঠলো। ফলে কোনোরূপ বিলম্ব ছাড়াই আমি দাদির হাতে শালটি ধরিয়ে দিলাম। দাদির নিকট হতে কোনোরূপ প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে উল্টোদিকে ফিরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
” শালটা সামলে রেখো দাদি। পরে প্রয়োজন পড়লে নিয়ে যাবো আমি।”
পিছে দাদি কি বললো তা আমার কান অব্দি পৌঁছালো না৷ আমি বরং শাল দিয়ে পুনরায় আমার গাউনের ভার এবং নতুন হিলের ব্যাথার চাপ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
আপুর বিয়ের জন্য শখ করে আমরা চারজন অর্থাৎ আমি, আভা, তাসনিম এবং লামিয়া যে একই ধরনের গাউন এবং হিজাব বানিয়েছিলাম তা পরে তারা তিনজনে সামাল দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ এদিকে আমি না পারছি তা সামাল দিতে, না পারছি ফেলে দিতে। কারণ আমার গাউনটা ওদের গাউনের তুলনায় উচ্চতায় খানিক বড় এবং পরনের হিলটাও একেবারে নতুন। হিলের উচ্চতা কম এবং গাউনের উচ্চতা বেশি হওয়ায় মাঝেমধ্যে অসাবধানতাবশত গাউনের নিচের অংশ হিলের নিচে পড়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ বেশ ক’বার পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় চলতে শুরু করেছিলাম। এ পড়ে যাওয়া -সামলানোর মাঝে মিনিট দশেক আগে আমার সাথে ভীষণ লজ্জাজনক ঘটনার একটি ঘটেছে এবং এ ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন স্বয়ং আদ্রিশ, সাদিক এবং তামিম।
সে মুহূর্তে আমি এক হাতে শাল ও ফোন এবং অপর হাত দিয়ে গাউন সামলে হাঁটছিলাম। হঠাৎ গাউনের বা পাশের অংশ ভুলবশত আমার হিলের নিচে পড়ে যায়। ফলস্বরূপ আমি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। তবে পুরোপুরি ভারসাম্য হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে সবার সামনে মানসম্মান খোয়ানোর ভয়ে আমি গাউন ছেড়ে পাশে অবস্থানরত ব্যক্তিটির পাঞ্জাবির পিঠের খানিক অংশ খামচে ধরি। তখনও জানতাম না সেই ব্যক্তিটি আদ্রিশ হবেন। পরবর্তীতে যখন তিনি ‘আহ’ বলে কুঁকিয়ে উঠে ঘাড় ঘুরে তাকালেন, সে মুহূর্তে আমি জানতে পারলাম, বেয়াইদের সামনে মানসম্মানের ফালুদা বানিয়ে ফেলেছি আমি। তখন ঘটনাস্থলে পড়ে যাওয়া হতে ঠিকই বেঁচে যাই আমি৷ তবে আমার এ কৌতুকপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হতে পেরে আদ্রিশ,সাদিক এবং তামিমসহ আশেপাশের গুটিকয়েক ব্যক্তি আমাকে দেখে মিটিমিটি হেসে ফেলেন। তাদের এ হাসি দেখে আমি ভীষণ বিব্রত বোধ করেছিলাম। ফলে কোনোমতে ‘সরি’ শব্দটুকু উচ্চারণ করে সেখান হতে কেটে পড়ি আমি। এ ঘটনার পরে এ পর্যন্ত আমি ঐ স্থানের ত্রিসীমানাতেও পা রাখিনি আমি।
বর্তমানে আমি দু হাত দিয়ে গাউন উঁচু করে যথাসম্ভব সামলে হাঁটছি। তবে ততটুকুই উঁচু করে হাঁটছি যতটুকু উঁচু করে হাঁটলে সামনের ব্যক্তির সামনে হাসির পাত্র বলে বিবেচিত হবো না আমি। তথাপি দূর্ভাগ্যবশত আমি পুনরায় পূর্বের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে লাগলাম। এহেন পরিস্থিতিতে পড়ে রাগে ক্ষোভে আমার মেজাজ পাহাড়সম উচ্চ স্থানে পৌঁছে গেলো। যার দরুন বিরক্তিতে ভ্রুজোড়া কুঁচকে আমার গাউন এবং হিল নামক জড় বস্তু দুটির উপর মুখের বুলি দিয়ে আক্রোশ মিটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার আক্রোশমূলক বুলির ভাণ্ডার শেষ হতে না হতেই আমার ছোট্ট চাচাতো বোন তিয়াশা আমার হাতে আপুর ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো,
” মিমাপু, নাফিসাপুর ফোনে কে যেনো ফোন দিচ্ছে বারবার। দেখো তো। ”
এই বলে সে আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে ছুট লাগালো। তিয়াশার কথা শুনে সেদিনকার ঐ আননোন নাম্বারের লোকটির কথা মনে পড়ে গেলো। মুহূর্তেই আমার বুকটা ধক করে উঠলো। এরই মাঝে পুনরায় আননোন নাম্বার হতে কল এলো। প্রথম দফায় রিসিভ না করার চিন্তা ভাবনা থাকলেও পরমুহূর্তেই সে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলি। তৎক্ষনাৎ কল রিসিভ করতেই সেই লোকটি আকুল কণ্ঠে বলে উঠলো,
” নাফিসা, তুমি কি সত্যিই বিয়ে করে ফেলেছো? আমাকে ছাড়া কি তুমি সুখী থাকবে বলো? আমি বলি? আমাকে ছাড়া কখনও সুখী হতে পারবে না তুমি। তোমার সুখ দুঃখ সব আমার অধীনে।। ” এই বলে লোকটি নিমিষের জন্য থামলো। পুনরায় উগ্র কণ্ঠে বললো,
” আমি চাইলে তুমি সুখী। আবার আমি চাইলে তুমি দুঃখী। এখন বলো, কোনটা চাও নাফিসা? আমি কি আসবো ওখানে? এসে কি সবার সামনে বলে দিবো আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি? কথা বলো নাফিসা। চুপ করে থেকো না। টেল মি ডেম ইট।”
লোকটির উচ্চ ধমকে আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। ফলস্বরূপ ভবিষ্যত পরিণতি বিবেচনা না করেই কল কেটে দেই৷ ডিসেম্বরের শীতের মাঝেও অনুভব করছি, আমি দরদর করে ঘামছি। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে আমার। অজ্ঞাত লোকটি যদি সত্যি তার কথা মোতাবেক এখানে উপস্থিত হয় তাহলে আব্বু, আম্মু, আপুর মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। আর এসব যদি সত্যি হয়েও থাকে তাহলে এসব শোনার পর কি ইমাদ ভাইয়া আপুকে স্বীকার করে নিবে! এ ভাবতেই আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। মন চাইছে, এখনই আপুর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে নেই। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয় বিধায় আগামীকাল আপুর রিসেপশনের পর বাসায় এলে সব জিজ্ঞেস করে নিবো, এই সিদ্ধান্ত নিয়েই ক্ষান্ত হলাম আমি৷ মনে মনে দোয়া দরুদও পড়তে লাগলাম। তবুও লোকটির কথাবার্তার ধরণ শোনার পর থেকে আমার মনের ভয় দূর হতে চাইছে না। কিছুতেই না।
নিজেকে খানিকটা শান্ত করার জন্য আমি একটা চেয়ার টেনে আপুদের স্টেজ হতে কিছুদূর গিয়ে বসলাম। এ স্থান হতে স্টেজ একদম স্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছে। আপু এবং ইমাদ ভাইয়ার জুটিটা মানিয়েছে বেশ। আপু লাজুক চাহনিতে ইমাদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এমতাবস্থায় ক্যামেরাম্যান ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলছে। আপুদের ছবি তোলার পর্ব সে মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেলো। এবার পারিবারিক একটি ছবি তোলার পালা। এজন্য আমাদের পরিবার হতে সবাইকে ডাকা হলো। আমাকেও আপু ইশারায় ডাকলো। মাত্রই হিল খুলে আরামে বসে পড়ায় আমার পা জোড়া মৃদু ব্যাথায় টনটন করে উঠেছিলো। এমতাবস্থায় পারিবারিক ছবি তোলার জন্য ডাক পড়ায় প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম আমি। তবুও অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনোমতে হিল পড়ে হেলেদুলে হেঁটে স্টেজে উঠলাম। ব্যস, এই ছবি তোলার জন্য মানুষ জড়ো করা, স্টেজ জুড়ে সকলকে ঠিকঠাক জায়গায় দাঁড় করানো, অতঃপর পরিবারভেদে, বয়সভেদে,ভাইবোনভেদে কয়েকটি পারফেক্ট ছবি তোলার প্রচেষ্টায় আধ ঘণ্টারও বেশি সময় চলে গেলো।
এ ছবি তোলার কার্যক্রমের মাঝে আমার পায়ের তালু হতে শুরু করে কোমড় পর্যন্ত ব্যাথায় টনটন করতে লাগলো। ফলস্বরূপ ছবি তোলা শেষ হতে না হতেই আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে কমিউনিটি হলের দ্বিতীয় তলায় চলে গেলাম। এখানকার দ্বিতীয় তলায় আজ কোনো ফাংশন নেই। তবে গুটি কয়েক চেয়ার অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমি সেখান হতেই একটি চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে বসে পড়লাম। পায়ের হিল দুটোর দিকে তাকিয়ে বেশ আক্রোশের সহিত তা খুলে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এমন অনুষ্ঠানপূর্ণ পরিবেশে কখনও নতুন হিল পড়ে আসবো না৷ অতঃপর চোখের চশমাটা খুলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে টেবিলের উপর মাথা দিয়ে নেতিয়ে পড়লাম আমি।
মিনিট পাঁচেকের মাঝেই আমার ক্লান্ত চোখজোড়া ঘুমে বুজে এলো। আকস্মিকভাবে একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি,
” আজ এতো ধুপধাপ পড়ছো কেনো চাশমিশ? এনি প্রবলেম? না কি আজ তোমার ধুপধাপ পড়ার দিবস?” এই বলে সেই জ্ঞাত কণ্ঠের লোকটি হেসে ফেললো। আমি দ্রুত মাথা তুলে আবিষ্কার করলাম, জ্ঞাত লোকটি আর কেউ নয় বরং আদ্রিশ। উনার ঠোঁটের কোনে এখনও হেয়মূলক হাসি বিরাজ করছে। উনার এ হাসিতে ক্রোধে আমার শরীর রি রি করে উঠলো। আমি তেজস্বরে বলে উঠলাম,
” কি বলতে চাইছেন আপনি?”
আদ্রিশের ঠোঁটের কোনে বিদ্যমান হাসি এবার কিছুটা হ্রাস পেলো। উনি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
” রিল্যাক্স, চাশমিশ। এতো হাইপার হওয়ার মতো কিছু বলিনি আমি। ”
উনার মুখে আমার ‘চাশমিশ’ নামটি শুনে আমার রাগ পূ্র্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেলো৷ কণ্ঠে পূ্র্বের ভাব বজায় রেখে বললাম,
” এসব কি নামে ডাকছেন আমাকে? আমার যে একটা নাম আছে, সেটা কি আপনি জানেন না? আমার নাম.…..”
আদ্রিশ আমার মুখের সামনে হাত দেখিয়ে আমার কথার গতিরোধক হয়ে বললেন,
” তোমার নাম তো জানতে চাইনি আমি। তোমার নাম চাশমিশ এটাই জানি আমি। ”
” আমার নাম মোটেও চাশমিশ নয়। এ ধরনের নাম আমার মোটেও পছন্দ নয়। ”
এই বলে আমি সরু চোখে উনার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললাম,
” বিশেষ করে অপরিচিত মানুষদের কাছ থেকে তো একেবারেই নয়৷ ”
আমার কথায় আদ্রিশ মৃদু হাসলেন। অতঃপর হাত এবং পা টান টান করে আড়মোড়া ভেঙে বললেন,
” অপরিচিত আর কতদিন? পরিচিত হতে দুদিন। ”
আমি দৃঢ়চিত্তে বললাম,
” জি না৷ এতো সহজেই সবার সাথে পরিচিত হওয়া যায় না৷ সবাইকে চেনা যায় না৷ এজন্য সময়ের প্রয়োজন হয়।”
আদ্রিশ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বেখেয়ালি কণ্ঠে বললেন,
” নিমিষেই কাউকে চেনা যায়, যদি সে হৃদয়ে রয়।”
আদ্রিশের এ কবি কবি ভাব দেখে আমার ক্রোধ অকারণেই তিরতির করে বেড়ে গেলো। আমি ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বললাম,
” আশ্চর্য! কি শুরু করেছেন আপনি? পেশায় আপনি কবি না কি? এতো কবিতা শোনাচ্ছেন কেনো আমায়? যাই হোক, আপনি এখান থেকে যান তো। একটু একা থাকতে দিন আমাকে। ”
আমার কথা শোনবার পরও উনার মাঝে কোনোপ্রকার হেলদোলের দেখা মিললো না৷ বরং উনি আয়েশি ভঙ্গিতে বললেন,
” পেশায় নয়। মনের দিক থেকে আমি কবি। ছোট্ট একজন কবি৷ বুঝেছো চাশমিশ?”
পুনরায় উনার জবানে ‘চাশমিশ’ নামটি শুনে বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ উচ্চারণ করে বললাম,
” ইশ! আবার আমাকে চাশমিশ বললেন! নিষেধ করলাম, এ নামে আমাকে ডাকবেন না। তবুও!”
আদ্রিশ এবার সোজা হয়ে বসলেন। মৃদু কুঞ্চিত ভ্রুজোড়া প্রসারিত করে সাবলীল কণ্ঠে বললেন,
” ওকে ফাইন৷ চাশমিশ বলে ডাকবো না আমি। তাহলে তোমার নাম হবে…..”
এই বলে উনি কিয়ৎক্ষণের জন্য ভাবনার সাগরে পাড়ি দিলেন। অতঃপর তীরে এসে বললেন,
” মিশমিশ। ইয়েস, তোমার নাম হবে মিশমিশ।”
#চলবে