ভুলবশত_প্রেম,১৪,১৫

0
997

#ভুলবশত_প্রেম,১৪,১৫
#লেখনীতে:সারা মেহেক
১৪

ইমাদ ভাইয়ার অবিশ্বাস্য ভরা চাহনিতে আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম। বিড়বিড় করে স্বগোতক্তি করে বললাম,
” ইমাদ ভাইয়া!”

আমার কথা শোনামাত্র আপু আমাকে ঝট করে ছেড়ে দিয়ে পিছে ফিরলো৷ আমার মতো আপুও ইমাদ ভাইয়াকে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়লো। আমরা দুজনে এ মুহূর্তে ইমাদ ভাইয়াকে এখানে আশা করেছিলাম না।
আপু নিমিষের জন্য ইমাদ ভাইয়ার দিকে বাকহারা হয়ে চেয়ে রইলো। অতঃপর ভীত কণ্ঠে বললো,
” বিশ্বাস করুন ইমাদ। আপনি যা ভাবছেন এমন কিছুই নেই আমাদের মধ্যে। আমি রোহানের সাথে কোনো কোনোরকমের যোগাযোগ রাখিনি। ”

আপুর কথা শোনামাত্র ইমাদ ভাইয়া নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
” হুঁশশ। ধীরে বলো।”

এই বলে ইমাদ ভাইয়া রুমে প্রবেশ করে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন৷ ধীর পায়ে আপুর কাছে এসে দাঁড়ালেন উনি। আপুর দু চোখ বেয়ে তখনও টপটপ করে জল পড়ছে। এদিকে আমি নির্বাক চাহনিতে দুজনকে বিশেষ করে ইমাদ ভাইয়াকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি। ইমাদ ভাইয়া এক পলক আমার দিকে চাইলেন। অতঃপর আপুর দিকে রিক্ত চাহনিতে চেয়ে বললো,
” আমার কাছে লুকালে কেনো নাফিসা?”

আপু নতমস্তকে নীরস গলায় বললো,
” আমি লুকাতে চায়নি এটা। কিন্তু আবার আপনাকে বলার সাহসও জোটাতে পারিনি। ”

ইমাদ ভাইয়া কিয়ৎক্ষণের জন্য আপুর দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন৷ অতঃপর আপুর দু বাহু ধরে আপুকে বিছানায় বসিয়ে দিলেন এবং নিজে ড্রেসিং টেবিলের সামনে হতে চেয়ারটা নিয়ে আপুর সম্মুখে বসে পড়লেন। আমিও সেই চেয়ারটা নিয়ে ইমাদ ভাইয়ার পাশে বসে পড়লাম। আপু এখনও নতমস্তকে চোখের জল ফেলে চলছে। ইমাদ ভাইয়া মলিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” নাফিসা? আমি কি এতোটাই খারাপ যে আমার উপর বিশ্বাস রেখে তুমি রোহানের কথা বলতে পারবে না?”

আপু তড়িৎগতিতে মাথা তুলে বললো,
” না না এমন কিছুই না৷ আপনি মোটেও খারাপ নন। আসলে আমার সাহসের অভাব ছিলো।”

” তুমি তো ভুল কিছু করোনি। তাহলে এতো ভয়ের কি আছে?”

আপু নিশ্চুপ বসে রইলো। ইমাদ ভাইয়া আপুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমাকে সম্পূর্ণ ঘটনা ডিটেইলস এ বলো। ”

আপু কিয়ৎক্ষণ থেমে দু হাত দিয়ে চোখেরজল মুছে নিলো। অতঃপর আমাকে রোহান ভাইয়া সম্পর্কে যা যা বললো তা ইমাদ ভাইয়ার কাছে পুনরাবৃত্তি করলো। পুরো ঘটনা শোনার পর ইমাদ ভাইয়া বললেন,
” রোহান এখনও তোমার কোনো ক্ষতি করেনি তাই তো?”

এবার আমি জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। ইমাদ ভাইয়া এবং আপুর উদ্দেশ্যে বললাম,
” কোনো ক্ষতি করেনি ঠিক। তবে আপুকে হলুদের দিন এবং বিয়ের দিন কল করেছিলো। হলুদের দিন রোহান ভাইয়ার কথাগুলো ছিলো অনুরোধের মতো৷ কিন্তু বিয়ের দিন শুরুতে অনুরোধ সুরে কথা বললেও পরমুহূর্তে উনি হুমকি দেওয়ার ঢঙে কথা বলেন। উনার কথা শুনে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম হয়তো উনি সত্যিই আসবেন। কিন্তু সেদিন উনার ছায়াও দেখিনি আমি। ”
এই বলে আমি নিমিষের জন্য বিরত নিলাম। আপু এবং ইমাদ ভাইয়ার দিকে এক পলক চেয়ে পুনরায় বললাম,
” আমার মনে হয় না রোহান ভাইয়া কিছু করবে। হয়তো উনি আপুকে ভয় দেখানোর জন্য এসব বলছেন। ”

ইমাদ ভাইয়ার মুখশ্রীতে এবার উদ্বেগের দেখা মিললো। কণ্ঠে মৃদু উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে তিনি বললেন,
” কিছু করেনি এতোদিন এর মানে এই নয় যে সামনেও সে কিছু করবে না। ”

ইমাদ ভাইয়ার কথায় আমি সহমত প্রকাশ করে বললাম,
” তা আপনি ঠিক বলেছেন। ”

ইমাদ ভাইয়া পুনরায় বললেন,
” তবে কিছু করার সম্ভাবনাও কম দেখছি। কারণ ও যদি সত্যিই কিছু করতো তবে নাফিসার বিয়ের আগে বা বিয়ের দিনই করে ফেলতো। কিন্তু সে এখনও কিছু করেনি৷ আমার মনে হয়, শুধু শুধু রোহানের কাছ থেকে আমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। ”

আপুর কান্নার গতি বেশ খানিকটা কমে এসেছে। আপু ত্রাসজনক গলায় বলে উঠলো,
” কিন্তু হুট করে যদি কিছু করে বসে?”

ইমাদ ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন,
” এখন তুমি একা নও নাফিসা। তোমার সামনে সবসময় ঢাল হয়ে আমি থাকবো। রোহান কিছু করতে চাইলেও পারবে না। কারণ তার আমাকে অতিক্রম করে তোমার ক্ষতি করার সাহস নেই।”

ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে আমি এবং আপু দুজনে আশ্বস্ত হলাম। ইমাদ ভাইয়া এ পর্যায়ে উঠে গিয়ে আপুর পাশে বসলেন। আপুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
” তুমি ভয় পেয়ো না নাফিসা। শুধু শুধু রোহানকে ভয় পেয়ে কেনো নিজের সবকিছু নষ্ট করবে? আর তুমি এখন থেকে নিশ্চিন্তে থাকো। কারণ আগামীকাল বাড়িতে গিয়েই সিকিউরিটির ব্যবস্থা করবো আমি। আর বাড়িতে গিয়ে রোহান সম্পর্কে খোঁজ লাগাবো আমি। সো নো টেনশন। ”

ইমাদ ভাইয়ার বলা প্রতিটা কথায় আমি আশ্বস্ত অনুভব করলাম। আর আপুর ঠোঁটের কোনায় ফুটলো মিষ্টি এক হাসির রেখা। সে মেদুর কণ্ঠে ইমাদ ভাইয়াকে বললেন,
” থ্যাংকইউ সো মাচ আমার লাইফে আসার জন্য। আমার ভরসার স্থল হওয়ার জন্য।”

ইমাদ ভাইয়া মৃদু হেসে আপুর বাহু জাপটে নিজের পাশে টেনে নিলেন। দুজনের এ মিষ্টি মুহূর্ত দেখে আমি আনমনে বলে উঠলাম,
” আপু, তুমি খুব লাকি। ভাগ্যগুণে এমন পার্টনার পেয়েছো। থ্যাংক ইউ ইমাদ ভাইয়া, থ্যাংকইউ।”

.

আজ পুরো এক সপ্তাহ বাদে মেডিকেলে এসে মনমেজাজ বেশ ফুরফুরে হয়ে গেলো। এখন আমি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারি। পায়ের ব্যাথাও একদম চলে গিয়েছে। তবে এক সপ্তাহের এন্টিবায়োটিক এখনও চলছে। আর দু তিনদিন পার হলেই এসব ওষুধের প্যারা হতে বাঁচি।

এক সপ্তাহ পর অনেক স্যার ম্যাডামই আমাকে দেখে কয়েকটা টিটকারিমূলক কথা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেসব কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অপর কান দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম। কারণ তাদের এসব কথা ধরে বসে থাকলে আমার আগামী কয়েকদিন মন খারাপের দিন হয়ে রবে। যা আমি চাই না৷ এজন্যই এসব বিষয় হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া উত্তম।

লেকচার ক্লাশ শেষে আমি, তিন্নি, নিশাত মিলে ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছি। হসপিটাল বিল্ডিংয়ের লিফটের কাছে দাঁড়াতেই কোথা থেকে যেনো পলি নামের একজন নার্স আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তার চলার গতি দ্রুত এবং চোখেমুখে মৃদু আতঙ্কের ছাপ। আমাকে দেখতে পেয়েই তিনি শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনার নামই তো মিম তাই না?”

আমি অদ্ভুত চাহনিতে উনার দিকে চেয়ে হ্যা সূচক জবাব দিলাম। উনি আমার জবাব শুনে যেনো প্রাণ ফিরে পেলেন। অতঃপর হড়হড় করে বলতে শুরু করলেন,
” তৃতীয় তলার ওয়ার্ডে আদ্রিশ নামের একজন পেশেন্ট আপনাকেই খুঁজছে। আপনাকে চাই মানে আপনাকেই চাই। উনার জখম জায়গাগুলোতে উনি কিছু করতেই দিচ্ছেন না। আপনাকে আর্জেন্টলি যেতে হবে সেখানে।”

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৫

নার্সের মুখে এমন কিছু শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কিছুক্ষণ হতবিহবল দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম আমি। পলি নার্স আমার বাহু ঝাঁকিয়ে উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন,
” আপনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন! পেশেন্ট আপনাকে ডাকছে। আপনি না গেলে সে ড্রেসিং করাবে না। দ্রুত চলুন।”

আমি এখনও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমার বিস্ময়ভাব কাটাতে নিশাত আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
” হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? তোকে যে একটা পেশেন্ট ইমার্জেন্সি ডাকছে তা কি মাথায় নেই? চল জলদি। পরে পেশেন্টের কিছু হলে সব দোষ তোর উপর পড়বে।”

নিশাতের কথায় আমি ধরাধামে অবতীর্ণ হলাম। এক পলক ওর দিকে চেয়ে লিফটের অপেক্ষায় না থেকে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠতে লাগলাম। আমার পিছে নার্স, নিশাত ও তিন্নি উঠছে। তৃতীয় তলায় আসবার পর ওয়ার্ডে ঢুকে আমার দৃষ্টি জোড়া আদ্রিশকে খুঁজতে লাগলো। প্রথম সারির বেডগুলোয় আদ্রিশকে দেখতে না পেয়ে দ্বিতীয় সারিতে চোখ বুলাতেই শেষের দিক হতে দুই নাম্বার বেডে উনাকে দেখতে পেলাম। আমি দ্রুত পায়ে উনার বেডের কাছে যেতেই দেখলাম একজন নার্স হাতে তুলো নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে চেয়ে আছেন। আদ্রিশ তখন নিশ্চুপ বসে আছেন। উনার কপালে, ঠোঁটের কোনে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। দু হাতের কনুইও ছিলে গিয়েছে। পরনের সাদা শার্টটি ধুলো ময়লায় একাকার হয়ে গিয়েছে। উনার এ জখম অবস্থা দেখে আমি শিউরে উঠলাম। উনার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি বাঁকা নজরে আমার দিকে চেয়ে অভিমানী সুরে বললেন,
” আমি মারা যাবার পরে আসতে। ”

উনার এহেন কথায় আমি কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবো তা ভেবে পেলাম না। এদিকে হাতে তুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সটি আমার দিকে তুলো এগিয়ে দিয়ে বললো,
” এই নিন। আপনিই করুন আপনার হাসবেন্ডের ড্রেসিং। ”

নার্সের মুখে ‘হাসবেন্ড’ শব্দটি শুনে কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত দৃষ্টিতে নার্সের দিকে চেয়ে রইলাম আমি৷ অতঃপর আদ্রিশের দিকে চেয়ে বিস্মিত কণ্ঠে নার্সের উদ্দেশ্যে বললাম,
” কি বলছেন আপনি! উনি আমার….”

আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আদ্রিশ ভীষণ বিরক্ত নিয়ে নার্সকে বললেন,
” আহহা, আপনি এতো কথা বলছেন কেনো? ওর হাতে তুলো আর ব্যান্ডেজ দিয়ে নিজের কাজে লেগে পরুন৷ ”

আদ্রিশের হুকুম পাওয়া মাত্রই নার্সটি আমার হাতে তুলো ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে নিলো। কিন্তু আদ্রিশ উনাকে ডেকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” হসপিটালে কোনো কেবিন খালি আছে?”

নার্সটি তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। তৎক্ষনাৎ আদ্রিশ বললেন,
” তাহলে একটা কেবিনের ব্যবস্থা করুন। আমি সেখানে শিফট হবো।”

নার্সটি মাথা নাড়িয়ে দ্রুততার সহিত ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে আমি লক্ষ্য করলাম, ওয়ার্ডের প্রায় প্রতিটি সজাগ পেশেন্ট এবং পেশেন্টের আত্মীয়স্বজন আমাদের দিকে অদ্ভুত চাহনিতে চেয়ে আছেন। তাদের এ চাহনি স্বাভাবিকভাবেই আমার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালো।
হঠাৎ নিশাত আমার কানের কাছে এসে বিস্ময়ের সহিত ফিসফিস করে বললো,
” মিম! তুই বিয়ে করে ফেললি আর আমাদের জানালিও না! কেমন বান্ধবীরে তুই!”

নিশাতের এহেন কথায় আমি কটমট করে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। আমার চাহনিতে নিশাত মোটেও ঘাবড়ালো না। বরং সরু চোখে আদ্রিশের দিকে চেয়ে পুনরায় ফিসফিস করে বললো,
” উনাকে তো চেনা চেনা লাগছে খুব৷
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। নাফিসা আপুর বিয়েতে ছেলেপক্ষ থেকে এসেছিলো উনি। তাই তো? কিন্তু সেদিনই না তোকে অবিবাহিত দেখলাম। আর আজকের মাঝেই তুই বিবাহিত হয়ে গেলি! হাউ ম্যান হাউ!”

নিশাতের কথাসমূহ আমার শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিলো। আমি অমর্ষ চাহনিতে নিশাতের দিকে চেয়ে তার বাহুতে সজোরে একটা ঘা মারলাম। এতে নিশাত ‘আহ’ শব্দ করে উঠতেই আদ্রিশ যৎসামান্য হেসে উঠলেন। হয়তো ব্যাথার অনুভূতিতে উনি সামান্য কাতর ছিলেন। এমতাবস্থায় হাঁটুতে হাত ঘষতে ঘষতে ভ্রু নাচিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” কি ব্যাপার মিশমিশ? আমাদের বিয়েও হয়ে গেলো অথচ আমিই জানলাম না! সত্যি করে বলো তো, আমাকে অজ্ঞান টজ্ঞান করে কিডন্যাপ করে এই শুভ কাজটা সারোনি তো?”

আদ্রিশের এহেন কথাবার্তায় ক্রোধে আমার কান গরম হয়ে এলো। এদিকে উনার কথা শুনে নিশাত আর তিন্নি যেনো হেসেই কূলকিনারা পায় না৷ আমি ওয়ার্ডের চারপাশের একবার চোখ বুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললাম,
” ওয়ার্ডে এতো মানুষের মাঝে আপনাকে কিছু বললাম না। কিন্তু আপনি এখন যে কথা বললেন তাতে আপনাকে হাজার কথা শুনিয়ে দেওয়া উচিত আমার এবং আমি শুনাবোও। তবে কেবিনে গিয়ে। আগে কেবিনে শিফট হতে দিন। তারপর দেখুন মজা। ”

আমার কথায় আদ্রিশ চাপা হাসি হেসে আমার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি উনার এ চাহনি ইচ্ছাকৃতপূর্বক উপেক্ষা করলাম।
কিছুক্ষণের মাঝেই পলি নার্স এসে আদ্রিশকে বললেন,
” আপনার কেবিন রেডি হয়ে গিয়েছে স্যার। আসুন। আপনার জন্য কি হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা….”

পলি নার্সকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আদ্রিশ আমার দিকে আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে বললেন,
” সাথে জলজ্যান্ত একটা হেল্পিং মানুষ থাকতে হুইলচেয়ারের কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি যান।”

পলি নার্স চলে গেলেন। আদ্রিশ আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” নাও মিশমিশ,আমার হাতটা ধরো। ”

আমি সাথে সাথে হাত দুটো বুকে ভাঁজ করে বললাম,
” কখনও না। আমি আপনার হাত ধরতে যাবো কেনো? আপনাকে হুইলচেয়ার অফার করার পরও আপনি তা রিজেক্ট করলেন। আর এদিকে আমার হেল্প চাইছেন! আপনাকে হাবভাবে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না আপনি ইনজুরি অবস্থা নিয়ে হসপিটালে এসেছেন। মনে হচ্ছে আমার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করার জন্য এখানে এসেছেন।”

এই বলে আমি দৃঢ়তার সহিত সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই আদ্রিশের পাশের বেড হতে একজন বৃদ্ধ মহিলা অনেকটাই ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
” ঐ মাইয়্যা? সোয়ামির সাথে কেউ এমন করে নাহি? যতই রাগমাগ হোক গে। সোয়ামি তো সোয়ামিই। হের সেবা-যতনেই দিন কাটাইতে হয়। ”
এই বলেই উনি বেডে শুয়ে থাকা বৃদ্ধের দিকে চেয়ে বললেন,
” এই দেহো, আমার সোয়ামি কত্ত অসুস্থ ছিলো৷ এহানে ভরতি করবার পর আমি ওর কত্ত সেবা যতন করছি। এহন হে এক্কেবারে সুস্থ। আজকেই চইলা যামু আমরা। এইবার আমার কথা হুনো, তোমার সোয়ামিরে নিয়া যাও। আর তুমিই তো ডাক্তার মাইয়্যা। তুমি তো আমার চাইয়া আরো বেশি ভালা বুঝবা এগুলান। যাও যাও, জলদি যাও। ”

বৃদ্ধ মহিলার লম্বা এ ভাষণে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। বিস্ময়ে আমার মুখখানা হা হয়ে এলো৷ ফলে আমি সেই বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিলাম। কিন্তু আদ্রিশ আমাকে মাঝপথে থামিয়ে ঠোঁটের কোনে চাপা হাসি বজায় রেখে কণ্ঠে কৃত্রিম কাতরতা প্রকাশ করে বললেন,
” আহ, মিশমিশ। আমাকে জলদি কেবিনে নিয়ে চলো। দেখছো না তোমার স্বামীর কি অবস্থা! ”

চারপাশে আমার প্রতিকূলে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনায় আমি একপ্রকার দিশেহারা হয়ে পড়লাম। অগত্যা আদ্রিশের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বেশ বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” চলুন কেবিনে।”

আদ্রিশ আমার দিকে এক পলক চাইলেন৷ অতঃপর আমার সাহায্য ছাড়াই ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ালেন উনি৷ মৃদু হেসে আমায় বললেন,
” আমার পাশাপাশিই থেকো মিশমিশ। প্রয়োজনে হাতটি একটু বাড়িয়ে দিও। ”

এই বলে উনি হাঁটা ধরলেন। আমিও কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়া উনার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। এদিকে নিশাত ও তিন্নিও আমার পিছু পিছু আসছে৷ ওয়ার্ড থেকে বেড়িয়ে যাবার পর তিন্নি পিছন হতেই আমার কানের নিকট ফিসফিস করে বললো,
” তলে তলে এতো কিছু চলে আর আমাদের জানানোর প্রয়োজনও বোধ করলি না তুই। এই তোর ফ্রেন্ডশিপ! ”

তিন্নির কথা শুনে আমি দাঁত কটমট করে বললাম,
” এখান থেকে বের হতে দে আমাকে। তারপর দেখ কি করি তোদের। ”
এদিকে আমাদের কথা শেষ হতেই দেখলাম, আমরা কেবিনের সামনে চলে এসেছি। তিন্নি আর নিশাত কেবিনে ঢুকবার পূর্বেই আমায় বললো,
” মিম, তুই কেবিনে যা। আমরা ওয়ার্ডে যাচ্ছি৷ আর কিছুক্ষণ পরই হয়তো স্যার চলে আসবে৷ তোর মনে হয় আজ আর ক্লাস করা হবে না৷ আমরা বরং ওয়ার্ডে যা যা হবে তা জানিয়ে দিব তোকে।”

তিন্নির কথা শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। নিশাত ও তিন্নি চলে যেতেই আমি এবং আদ্রিশ কেবিনে প্রবেশ করলাম। আদ্রিশ ধীরেসুস্থে গিয়ে বেডে বসলেন৷ আমি কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রেখে দু হাত গুঁজে আদ্রিশের দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে বললাম,
” রাস্তায় গুণ্ডাদের মতো মারপিট করে এখানে এসেছেন আমাকে জ্বালাতে?”

আদ্রিশ আমার দিকে এক পলক চাইলেন৷ অতঃপর আমার বাহু ধরে আচমকা আমাকে নিজের সামনে টেনে এনে বললেন,
” জখম একজন রোগীকে সেই কখন থেকে জ্বালিয়ে যাচ্ছো তুমি মিশমিশ! তোমার জ্বালায় আমার রক্তও জমাট বেঁধে গিয়েছে দেখো। আর ব্যাথায় সমস্ত শরীর জর্জরিত হয়ে আছে। অথচ আমার এমন অবস্থা দেখে একজন ভবিষ্যত ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও তুমি আমার সাথে ঝগড়া করছো!”

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম৷ অতঃপর নিজেকে উনার স্পর্শ হতে মুক্ত করে পাশের টেবিল হতে তুলো নিলাম। উনার কপালের জখমে তুলো দিয়ে চেপে চেপে পরিষ্কার করতে লাগলাম। আমার স্পর্শে ব্যাথায় আদ্রিশ ‘আহ’ শব্দ করে ককিয়ে উঠলেন। আমি চমকে উঠে তৎক্ষনাৎ পিছিয়ে এলাম। উনি পুনরায় আমার হাত ধরে আমায় নিজের সামনে দাঁড় করালেন। মৃদু হেসে আমায় বললেন,
” হবু ডাক্তারদের এতো দূর্বল হতে নেই। আমার সামান্য গোঙনিতে এভাবে পিছিয়ে পড়লে অপারেশন টেবিলে কি করে টিকবে?”

আমি কোনোরূপ জবাব না দিয়ে আদ্রিশের জখম পরিষ্কার করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম,
” কার সাথে মারপিট করে এসেছেন? ”

আদ্রিশ চোখ তুলে আমার দিকে চেয়ে খানিক রাগত স্বরে বললেন,
” আমি কারোর সাথে মারামারি করিনি। ওরাই আমাকে পিছন হতে আচমকা মারতে শুরু করে। অতর্কিতে হামলা চালানোয় প্রথম দফায় আমি সেল্ফ প্রটেকশনে কিছু করতে পারিনি। কিন্তু এরপরই আমার সাধ্যমত মেরেছি ওদের। ওরাও আমাকে মেরেছে। ”

আমি ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” কাদের সাথে আপনার শত্রুতা আছে? আর কিসের শত্রুতা?”

” কাদের সাথে নয় বরং জিজ্ঞেস করো, কার সাথে আমার শত্রুতা আছে। যারা আমাকে মারতে এসেছিলো, তারা ভাড়াটে মাস্তান ছিলো। আসল মানুষটা হয়তো দূরে বসে এসবের তদারকি করছিলো। ”

আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” সে কে?”

আদ্রিশ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” আছে একজন। যার সাথে আমার পার্সোনাল এণ্ড প্রফেশনাল শত্রুতা আছে।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here