ভুলবশত_প্রেম,১৬,১৭

0
900

#ভুলবশত_প্রেম,১৬,১৭
#লেখনীতে:সারা মেহেক
১৬

আদ্রিশের কাঁটাছেড়া স্থানগুলো ততক্ষণে পরিষ্কার করা হয়ে গিয়েছে। আমি তাতে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করলাম,
” নাম কি তার?”

আদ্রিশ আমার দিকে এক পলক চেয়ে হাঁটুতে হাতের তালু ঘষতে ঘষতে বললেন,
” পায়েও বেশ ব্যাথা পেয়েছি আমি। যদিও এখন ব্যাথা করছে না। তবে নিশ্চিত রাতে পুরো শরীর ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে যাবে।”

আমার প্রশ্নের জবাবের বদলে আদ্রিশের কথা ঘুরিয়ে ফেলা দেখে আমি উনাকে এ বিষয়ে আর প্রশ্ন করলাম না। স্বভাবতই উনি আমার সাথে এ ব্যাপারে বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। ফলে উনার কথার প্রবাহ বজায় রাখতে আমি বললাম,
” আচ্ছা, আপনি বসুন। আমি ডক্টরকে ডেকে আনছি। ”
এই বলে আমি দরজা খুলে কেবিনের বাহিরে চলে এলাম। কিন্তু ডক্টর ডাকতে গিয়ে আমি ডক্টরকে কি বলবো তা ভেবে পুনরায় কেবিনে চলে এলাম। আড়ষ্টভাব নিয়ে আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললাম,
” আমি ডক্টরকে ডাকতে পারবো না। দরকার হলে আপনি ডেকে নিন। ”

আদ্রিশ তাজ্জব বনে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেনো? ডক্টরকে ডাকতে কি প্রবলেম তোমার?”

আমি খানিক আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললাম,
” আশ্চর্য তো! আমি ডক্টরকে আপনার সম্পর্কে কি বলবো? এখানকার অনেক ডক্টরই আমার কাছে পরিচিত মুখ। ক্লাস করতে এলে তাদের সাথে দেখা হয়। তো তাদেরকে এখানে কি বলে আনবো আমি?”

আদ্রিশ ব্যাপারটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নিয়ে বললেন,
” বলবে, একজন পেশেন্ট এসেছে। তাকে ওষুধ লিখে দিতে হবে। ব্যস, কাজ শেষ। ”

” হ্যাঁ। তারপর যখন কেবিনে আসার পর ডক্টর আমাকে জিজ্ঞেস করবে যে, আপনি আমার কি হোন, আপনাকে কিভাবে চিনলাম। তখন আমি কি জবাব দিবো?”

এ পর্যায়ে আদ্রিশ চুপটি করে রইলেন। নীরবে কিছু ভাবতে লাগলেন৷ উনার ভাবনার গাড়িকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আমি অনেকটাই সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
” ঐ নার্সটিকে আপনি কি বলেছিলেন যে উনি আপনাকে আমার হাসবেন্ড বললো?”

আমার প্রশ্ন শোনামাত্রই আদ্রিশ নিতান্তই অবুঝ বালকের ন্যায় বললেন,
” বিশ্বাস করো। আমি এমন কিছুই বলিনি নার্সকে। আমার অবস্থা দেখে নার্স তুলো, ব্যান্ডেজ নিয়ে হাজির হতেই আমি বললাম, আমি উনাকে দিয়ে ব্যান্ডেজ করাবো না। এ কাজের জন্য তোমাকে যেনো ডেকে আনে। ব্যস, তুমি আসার পরই নার্স ভাবলো, আমার দুজন হাসবেন্ড ওয়াইফ।”
এই বলে আদ্রিশ শিশুসুলভ চাহনিতে আমার দিকে চাইলেন। উনার এহেন কথার ঢং দেখে আমি কিয়ৎক্ষণ ফ্যালফ্যাল চাহনিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। বিশেষত শেষোক্ত বাক্যটি উনি এমনভাবে বললেন যে, মনে হলো আমাদের দুজনকে হাসবেন্ড ওয়াইফ ভাববার পিছনে উনার কোনো হাত নেই।
আমি কিয়ৎক্ষণ উনার দিকে চেয়ে খেঁকিয়ে উঠে বললাম,
” সে ভালো কথা। আপনি যে পুরো ওয়ার্ডের সামনে, নার্সগুলোর সামনে আমার মান সম্মানের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে এসেছেন সেগুলোর ক্ষতিপূরণ কে দিবে? বলুন?”
আদ্রিশকে জবাব দেবার সুযোগ না দিয়ে আমি পুনরায় বললাম,
” পরিচিত স্যার এবং নার্সরা জানে, আমি এখনও অবিবাহিত এবং মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই৷ কিন্তু আজ ওয়ার্ডে আপনার নাটক দেখে সকলেই এসব ভেবে বসেছে। ফর শিওর নার্সগুলো সময় সুযোগ পেলে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করবে। তারপর তাদের এসব কথা এভাবে ওভাবে স্টুডেন্টদের কানে যাবে, স্যারদের কানে যাবে। এভাবে করতে করতে আমার বাসা অব্দি ব্যাপারটা চলে যাবে। তখন আমাকে কত ধরনের প্রশ্ন ফেস করতে হবে আপনি জানেন? সেসব প্রশ্নের কি জবাব দিবো আমি? বলুন আপনি। আমার কাছে……”

আমাকে মাঝপথে থামিয়ে আদ্রিশ আমায় টেনে এনে নিজের পাশে বসালেন। শান্ত সুরে বললেন,
” এতো হাইপার হও কেনো মিশমিশ? তুমি ব্যাপারটাকে নিজের মতো করে এভয়েড করে চলবে। দেখবে একসময় সবাই ব্যাপারটা ভুলে যাবে৷ পেশেন্টদের নিয়ে চিন্তা করার তো কোনো কারন দেখছি না আমি৷ আর রইলো নার্সদের নিয়ে। আমি তাদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবো।”

” আচ্ছা? কি বলবেন তাদের আপনি? ”

আদ্রিশ আমার প্রশ্নের জবাব দিতে চাইলেন। কিন্তু এর পূর্বেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। কড়া নাড়বার শব্দ শুনে আমি ঘাবড়ে গিয়ে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ালাম। দ্রুত দরজা খুলে পরিচিত এক ডক্টরকে দেখতে পেয়ে আমরা ভয়ের পরিমাণ পূর্বের তুলনায় আরো বেড়ে গেলো। ফলে ডক্টরকে ঢুকতে দিয়েই আমি তাড়াহুড়ো করে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম৷ ভয়ের ফলে ফের পিছনে ফিরে তাকাবার সাহস জুটাতে পারলাম না আমি। দ্রুত পা চালিয়ে ক্যান্টিনে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

.

রাতের খাবার শেষে বই সামনে নিয়ে রীতিমতো ঝিমুতে শুরু করলাম আমি৷ আচমকা ফোনের বাজখাঁই রিংটোনে আমি ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। ফলে নাম্বার না দেখেই কল রিসিভ করে বললাম,
” কে বলছেন?”

ওপাশে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সেকেন্ডেই বুঝতে পারলাম আদ্রিশ কল করেছেন৷ উনি অনেকটাই অভিমানী সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” একজন অসুস্থ মানুষের খোঁজখবর নেয়া কি ডাক্তারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?”

আমার দু চোখ হতে ঘুমুঘুমু ভাবটা নিমিষেই কেটে গেলো। আমি তৎক্ষনাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। কণ্ঠে বিস্ময়ভাব প্রকাশ করে আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথা থেকে?”

” পেয়েছি এক জায়গা থেকে। ওসব শুনে লাভ নেই। কিন্তু কথা হলো, আমি যে কাজটা করলাম সে কাজটা তোমার করা উচিত ছিলো। ”

” কোন কাজ?”

” এই তো, আমার নাম্বার জোগাড় করে আমার খোঁজখবর নেয়ার কাজ।”

” এ্যাহ, আমার ঠেকা পড়েছে না কি! কোন দুঃখে আমি আপনাকে কল করবো!”

” ইশ! দেখো তো মেয়েটা কি অকৃতজ্ঞ! সেদিন তোমার পা মচকে যাওয়ায় তোমার কত খেয়াল রাখলাম, এর বিনিময়েই তো আজ আমার খোঁজ নিতে পারতে।”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য বাকহারা হয়ে পড়লাম। ওপাশ হতে আদ্রিশ আমার নির্বাক পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে বললেন,
” আচ্ছা, যাই হোক। অন্তত এখন আমি কেমন আছি এটলিস্ট সেটা তো জিজ্ঞেস করবে?”

আমি তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার অবস্থা কি এখন? শরীর ব্যাথা করছে? ওষুধ নিয়েছেন?”

ওপাশে আদ্রিশের হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। উনি হাসতে হাসতে বললেন,
” ব্যস ব্যস। একসাথে এতো প্রশ্ন করতে বলিনি আমি৷ আচ্ছা, আমি একে একে উত্তর দেই।
এট ফার্স্ট, আমার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। সেকেন্ডলি, আমার সমস্ত শরীর ব্যাথায় একাকার। মনে হচ্ছে, যত সময় যাচ্ছে, ততই আমার ব্যাথা বাড়ছে। থার্ডলি, আমি ওষুধ খেয়েছি। আপাতত ব্যাথায় জর্জরিত শরীর নিয়ে শুয়ে আছি। ”

আদ্রিশের হেন পরিস্থিতির বর্ণনা শুনে আমার ভীষণ মায়া হলো। আমি কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে উনার কথা ভাবতে লাগলাম। অতঃপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার উপর যে, অ্যাটাক হলো এ নিয়ে পুলিশে কমপ্লেন করেছেন?”

আদ্রিশ ক্ষণিকের জন্য নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর বললেন,
” এসব বিষয়ে পুলিশি মামলা হলে সবকিছু আরো বিগড়ে যেতে পারে। এজন্য পুলিশি ব্যাপারে জড়ায়নি।”

আদ্রিশ ঠিক কি বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছেন তা আমায় বেশ ভাবালো। এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কৌতূহল জাগার পরও আমি নিজেকে সংযত রাখলাম৷ কারণ উনার পার্সোনাল বা প্রফেশনাল কোনো ব্যাপারেই আমার হস্তক্ষেপ ঠিক মানায় না। ফলে সে ব্যাপারটা না ঘেঁটে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আংকেল, আন্টী কিছু বলেননি এ ব্যাপারে? তারা জানে না?”

আদ্রিশের মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেলো। উনি বললেন,
” হ্যাঁ, তা তো জানেই। এমনকি তারা এও জানে যে, তাদের ছেলে এসব ঝামেলা ঠিকই সামল নিবে। ”

আমি আর কোনো কথা খুঁজে পেলাম না৷ ফলে অযথা কানে ফোন চেপে না ধরে আমার রুমে আম্মুর প্রবেশের বাহানা বানিয়ে আদ্রিশের কল কেটে দিলাম। আদ্রিশও ফের ফোন করলেন না। ফলে রুমে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।

.

আজ কলেজে সর্বশেষ ক্লাস না হওয়ায় মনে ফূর্তিভাব নিয়ে একা একা লাইব্রেরিতে গেলাম। নিশাত আর তিন্নি ওয়ার্ড শেষ হওয়া মাত্রই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। মূলত আমিই ওদের চলে যেতে বলি। কারণ আজ লাইব্রেরিতে নিজের মতো করে কিছুটা সময় কাটাতে চাইছি। কিন্তু আজ লাইব্রেরি মোটামুটি ভরপুর থাকায় সেখানে সময় কাটাবার ইচ্ছে মাটি চাপা দিতে হলো। ফলে একটি বই বদলিয়েই লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। কলেজ লিফটে উঠতেই অকস্মাৎ সাদিকের সাথে দেখা হলো আমার। আপুর রিসেপশনের পর আমাদের আর দেখা হয়নি৷ বেশ ক’দিন পর আজ দেখা হওয়াতে আমি উনায় জিজ্ঞেস করে বসলাম,
” কেমন আছেন? ”

পুরো লিফটে শুধু আমি এবং সাদিক আছি। উনি আনমনে ফোন গুতাচ্ছিলেন। আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে চকিতে মাথা তুলে অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমায় বলছেন?”

আমায় চিনতে না পারায় খানিক অবাক হলাম বটে। তবে তৎক্ষণাৎ নিজের বহিবারণ পর্যবেক্ষণ শেষে বুঝলাম, আমায় এমন সাজপোশাকে উনি দেখেননি বলে চিনতে পারছেন না৷ ফলে নিজের পরিচয় দিতে বললাম,
” আমায় চিনতে পারেননি? আমি মিম। ”

মুহূর্তেই সাদিক আমায় চিনে ফেললেন। চেহারায় মৃদু অনুশোচনা এনে বললেন,
” আই এম এক্সট্রেমলি সরি৷ আপনাকে একদম চিনতে পারিনি আমি। আপনার চেহারা দেখা যাচ্ছিলো না তো তাই আর কি।”

সাদিকের কথা শেষ হতে না হতেই আমরা নিচতলায় চলে এলাম। অতঃপর লিফট হতে বের হয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে সাদিককে বললাম,
” ইটস ওকে। সমস্যা নেই। ”

সাদিক মৃদু হেসে বললেন,
” আপনার ক্লাস নেই?”

” না। শেষ ক্লাসটা আজ হবে না। ”

কথা বলতে বলতে আমরা কলেজ বিল্ডিং এর সামনে চলে এলাম। আচমকা আমার পাশ হতে একটি মেয়ে এসে সাদিকের বাহু জাপটে ধরে বললো,
” আমায় এতোক্ষণ ওয়েট করানোর সাজা ভোগ করতে হবে কিন্তু তোমায়, মিস্টার সাদিক।”

অপরিচিত মেয়েটির হেন কাণ্ডে আমি বেশ অবাক হলাম। ফলস্বরূপ খানিক বিস্মিত চাহনিতে তাদের দিকে চেয়ে রইলাম আমি। সাদিক হয়তো আমার চাহনি বুঝলেন। এর ফলে উনি মৃদু হেসে মেয়েটির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমায় বললেন,
” মিট মাই ফিয়ন্সে মারিয়া। ”

সাদিকের মুখে হেন কথা শোনবার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷ উনার এ বাক্য আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য ফ্যালফ্যাল চাহনিতে উনাদের দুজনের দিকে চেয়ে রইলাম। সাদিক পুনরায় বললেন,
” আগামী মাসে আমাদের বিয়ে। আপনিও কিন্তু ইনভাইটেড। আগেভাগেই ইনভাইট করে রাখলাম।”
এই বলে সাদিকসহ উনার ফিয়ন্সে মারিয়া একত্রে হেসে উঠলেন। আমি ক্ষণিকের জন্য দুজনের হাসি পর্যবেক্ষণ করলাম। বুঝতে পারছি, আমার কোথায় কিঞ্চিৎ কষ্টের আভাসের দেখা মিলছে। কিন্তু আপাতত তাদের সামনে যেনো এরূপ অনুভূতি কোনোরূপেই প্রকাশ না পায় সেজন্য আমি তাদের অভিনন্দন জানাতে চাইলাম। তবে এর পূর্বেই কোথা হতে যেনো আদ্রিশের আগমন ঘটলো। উনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে সাদিক এবং মারিয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
” কি ব্যাপার সাদিক? হবু বউ নিয়ে কলেজেও হাজির! তর সয় না, না কি?”

আদ্রিশের প্রশ্নে সাদিক এবং মারিয়া উভয়েই লাজুক হাসি দেয়। খানিক বাদে আদ্রিশ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” ওদের কংগ্রাচুলেট করেছো?”

আমি মলিন চাহনিতে সাদিকের পানে চেয়ে কিয়ৎ উদাস কণ্ঠে বললাম,
” না। এখনও করিনি। ”

আদ্রিশ প্রায় সাথে সাথেই বললেন,
” তো করে ফেলো। ওরা নিশ্চিত তোমার মুখে কংগ্রাচুলেশন শোনার অপেক্ষায় আছে। ”

আদ্রিশের কথা শোনামাত্র আমি বিলম্ব না করে সাদিক এবং মারিয়াকে বললাম,
” কংগ্রেটস বোথ অফ ইউ। ”

মারিয়া মিষ্টি হেসে বললো,
” থ্যাংকস। তবে আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। ”

আমার পক্ষ হতে জবাব আসবার পূর্বেই সাদিকে জবাব দিলেন,
” ইমাদ ভাইয়ের শালিকা উনি। উনার নাম মিম। আমাদের কলেজেরই থার্ড ইয়ারে পড়ে।”

পুনরায় মারিয়া মিষ্টি হেসে বললো,
” দেখা করে ভালো লাগলো খুব। আই হোপ, ফিউচারেও দেখা হবে আমাদের। ”

এই বলে সে সাদিকের বাহু পুনরায় জাপটে ধরে বললো,
” চলো, যাওয়া যাক। তোমার অপেক্ষায় অনেকক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

মারিয়ার ব্যতিব্যস্ততা দেখে সাদিক আমাদের দুজনকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য উনার যাবার পানে চেয়ে রইলাম। আচমকা আদ্রিশ আমার সামনে আসায় আমি ভড়কে গেলাম। উনি আমার এ প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমায় প্রস্তাব দিয়ে বসলেন,
” চলো, সামনের রেস্টুরেন্টে কিছুক্ষণ বসি৷ ”

এ প্রস্তাব শোনামাত্রই আমি বারণ করতে নিলাম। কিন্তু আদ্রিশ বললেন,
” দেখো, আমি ‘না’ শুনতে মোটেও আগ্রহী নই। আমার সাথে যেতে হবে। অর্থাৎ যেতেই হবে। আর তোমার সাথে জরুরি কিছু কথাও আছে। এজন্য তুমি আমার সাথে এখনি আসবে। ”

ভীষণ অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি আদ্রিশের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। অতঃপর দুজনে পায়ে হেঁটে কলেজ হতে এক মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত রেস্টুরেন্টে চলে এলাম। রেস্টুরেন্টের কোনার দিকে অবস্থিত চেয়ারে বসবার কিছুক্ষণের মাঝেই একজন ওয়েটার এসে ওর্ডার নিয়ে চলে গেলো।

আমি নির্বাক চাহনিতে টেবিলে রাখা টিস্যুকেসের দিকে চেয়ে আছি। চোখের সামনে ভাসছে কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি।
আমার আনমনা ভাব দেখেই হয়তো আদ্রিশ আমায় ডাকলেন। উনার ডাকে আমি তৎক্ষনাৎ মাথা তুলে উনার দিকে চেয়ে বললাম,
” জি? কিছু বলবেন?”

আদ্রিশ আমার দিকে নিষ্পলক চাহনিতে চেয়ে আছেন৷ আমিও উনার দিকে প্রশ্নের আশায় চেয়ে আছি। কিয়ৎক্ষণ বাদে উনি আমার দৃষ্টি বরাবর দৃষ্টি রেখে ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” সাদিককে পছন্দ করতে?”

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৭

আদ্রিশের হেন প্রশ্নের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ফলে উনার প্রশ্ন শুনে আমি বেশ ভড়কে গেলাম। মুখ দিয়ে বের হলো না টু শব্দটুকুও। আদ্রিশ আমার হেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে মৃদু হাসলেন। বললেন,
” এর মানে, আমার প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’, হবে? ”

আমি পুনরায় কোনোরূপ জবাব দিতে পারলাম না৷ কেনো যেনো কোনো এক কারণে আমি এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না৷ মনেও সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছি না৷ ফলস্বরূপ বিনাবাক্যে নতমস্তকে নিশ্চুপ বসে রইলাম আমি। আদ্রিশও নিশ্চুপ রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর উনি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” সাদিককে আগে থেকেই চিনতে?”

উনার প্রশ্ন শোনার পরও আমি কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলাম। অতঃপর মনে আত্মবিশ্বাস এবং সাহস জুগিয়ে মাথা তুলে চাইলাম উনার দিকে। কাষ্ঠ হেসে বললাম,
” পছন্দ করার জন্য কি আগে থেকেই পরিচিতি থাকতে হয়? পছন্দ তো প্রথম দেখায়ও হয়ে যেতে পারে। ”
এই বলে আমি প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লাম। অতঃপর দৃঢ়চিত্তে স্মিত হেসে বললাম,
” এবং মজার ব্যাপার কি জানেন? এ ধরণের ‘প্রথম দেখায় পছন্দ হওয়া, প্রেম, মনে ধরা’ ব্যাপারগুলো টিকে কম। এগুলো হয় নশ্বর। যেমনটি আমার ক্ষেত্রে হয়েছে।”

এই বলে আমি নিরস দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আদ্রিশও গভীর চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। পেলব গলায় আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কষ্ট পাচ্ছো না?”

আমি উনার প্রশ্নে এক দফা হেসে দিলাম। অতঃপর দৃঢ়চিত্তে বললাম,
” এ অনুভূতি যেমন নশ্বর, এর দ্বারা প্রাপ্ত দুঃখ, কষ্টও তেমন নশ্বর। এই যে, আমি এখন যেমন কষ্ট পাচ্ছি। দুদিন বাদে এ কষ্ট আর থাকবে না। সবকিছু আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কারণ আমি সাদিককে খুব গভীরভাবে পছন্দ করিনি। প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিলো, এই যা। এভাবে হুটহাট একটু পছন্দ করেছিলাম বিধায় হুটহাট করেই একটু কষ্ট পেয়ে বসলাম, ব্যস। এখন এ নিয়ে তো বসে থাকলে চলবে না।”
এই বলে কিয়ৎক্ষণ নিজের ভেতরটা অনুভব করার প্রয়াস করলাম আমি৷ ধীরেধীরে অনুভব করতে পারলাম, পূর্বের ন্যায় সেই কষ্টের অনুভূতিটা এ মুহূর্তে আর নেই। এখন মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছি আমি৷ এদিকে আদ্রিশ যেনো আমার নিকট হতে এমন কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তা উনার কিঞ্চিৎ বিস্মিত অভিব্যক্তি দেখেই টের পেলাম আমি।

আদ্রিশ আমার কথাগুলো বিশ্বাস করে নিতে চোখ কুঁচকে দ্বিধাগ্রস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” যা বলছো তা কি নিজের থেকে বলছো? আই মিন সিরিয়াসলি এসব বলছো তুমি?”

আদ্রিশের কথায় আমি সশব্দে হেসে উঠে বললাম,
” কেনো? অবিশ্বাস্য কেনো মনে হচ্ছে এসব? আমি যা বলছি, সিরিয়াসলি বলছি। আমি উনাকে আহামরি পছন্দ করি না। চোখের দেখায় একটু ভালোলাগা। অতঃপর নিজের এ কাজের জন্য কষ্টমূলক এক ফল পাওয়া। যাই হোক, আপাতত এসব ব্যাপারে কথা বলা বন্ধ করি?”

আদ্রিশ যেনো আমার কথায় বেশ স্বস্তি পেলেন। কিঞ্চিৎ হেসে বললেন,
” ওকে। ঠোঁটে একদম জিপ লক লাগিয়ে দিলাম। খাবার আসার আগ পর্যন্ত আর কোনো কথা নেই। আপাতত কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করি।”

আদ্রিশের বাচনভঙ্গিতে আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। কিছুক্ষণের মাঝেই খাবার চলে এলে আমরা স্বাভাবিক কিছু কথাবার্তা বলতে বলতে খেয়ে নিলাম।

.

এক সপ্তাহের জন্য ব্যাগপত্র গুছিয়ে বসে আছি আমি। গন্তব্য আপুর শ্বশুরবাড়ি। আজ বিকেলে হঠাৎ আপুর কল আসে আম্মুর ফোনে। আপু জানায়, ইমাদ ভাইয়া এক সপ্তাহের জন্য ভার্সিটি হতে ট্রেনিং এ শহরের বাহিরে যাবে। আবার কিছুদিন পর আপুর পরীক্ষা। এর মাঝে কিছু পেপার ওয়ার্কও সাবমিট করতে হবে। যার জন্য আমার আপুকে সাহায্য করতে হবে। এজন্যই আমাকে আপু তার শ্বশুরবাড়িতে যেতে বলেছে। এমনকি সেখানে থাকতেও বলেছে। তবে আমাকে ডাকবার প্রধান কারণ এটা না। নতুন জায়গায় আপু একা থাকবে, খুব কাছের কারোর সঙ্গ থাকবে না, এসব কারণেই মূলত আপু আমাকে ডেকেছে।
আপুর এ প্রস্তাব প্রথম দফায় আব্বু আম্মু কিছুতেই রাজি ছিলো না। তবে আপু যখন বললো, আপুর শ্বাশুড়িই আপুকে এ বুদ্ধি দিয়েছে যে আমাকে তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে, তখন আব্বু আম্মু এবং আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমি কিছুতেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না যে নাসরিন আন্টী এমন বুদ্ধি দিবে।
নাসরিন আন্টীর কথা শোনার পরও আব্বু আম্মু রাজি ছিলো না। অতঃপর আপু বাধ্য হয়ে নাসরিন আন্টীকে আম্মুর সাথে কথা বলিয়ে দিলো। ফলস্বরূপ কিছুক্ষণের জোরাজুরিতে আম্মু রাজিও হয়ে গেলো।

মাগরিবের আজানের পর পরই ইমাদ ভাইয়া আমায় নিতে চলে এলেন। প্রথম প্রথম আভাকেও আমাদের সাথে নিতে চাইলেন উনি। কিন্তু এ সপ্তাহে আভার ক্লাসটেস্ট থাকায় ওকে নেওয়া হলো না আমাদের সাথে।
বাসায় সাজো সাজো নাস্তা করে ইমাদ ভাইয়ার অবস্থা রীতিমতো কাহিল। উনার চেহারার হাবভাব দেখার মতো হয়েছে। উনার হেন পরিস্থিতি দেখে আমি ও আভা হেসেই কূলকিনারা পেলাম না৷
ইমাদ ভাইয়া ভরপেটে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

ইমাদ ভাইয়াদের বাড়ি পৌঁছে আমার প্রতি নাসরিন আন্টীর খাতিরযত্ন দেখে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো ছাড়া উপায় রইলো না আমার কাছে। উনার আন্তরিক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ না হয়ে উপায়ন্তর পেলাম না৷ উনি যেমন মিশুক ঠিক তেমনিও যত্নশীল একজন মানুষ। নাসরিন আন্টীর আচরণ দেখে মুহূর্তেই বলে দেওয়া সম্ভব ইমাদ ভাইয়া কার আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

নাসরিন আন্টী, আপু এবং ইমাদ ভাইয়ার সাথে কিছুক্ষণ গল্পগুজব শেষে দোতালায় আপুসহ আপুর রুমে চলে এলাম আমি। ইমাদ ভাইয়া গেলেন বাহিরে। আপু আমাকে রুমে দিয়ে কিছু কাজের জন্য নিচে চলে গেলো। আমি আপুর রুমে গিয়ে ধীরেসুস্থে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে বসে রুমের প্রতিটি জিনিস দেখতে লাগলাম। ইমাদ ভাইয়া যে বেশ শৌখিন ধরণের একজন মানুষ তা রুমের সাজসজ্জা দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পেলাম আমি। রুমের প্রতিটি শোপিস এক এক করে দেখতে দেখতে আমার দৃষ্টি একটি কাঁচের শোপিসের উপর। আমি উঠে গিয়ে সেই কাঁচের শোপিসটি হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম।

আচমকা পিছন হতে সশব্দে ‘নাফিসা ভাবী!’ ডাক শুনে ভীষণ চমকে উঠলাম আমি। ফলস্বরূপ অসাবধানতাবশত হাত হতে শোপিসটি পড়ে গেলো। মুহূর্তেই তা চূর্ণবিচূর্ণ পদার্থে পরিণত হলো। আমি স্তব্ধ হয়ে কিয়ৎক্ষণ ভাঙা শোপিসটির দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর প্রচণ্ড ক্রোধে এ কাজে দায়ী লোকটিকে দেখতে চট করে পিছনে ফিরলাম আমি। পিছনে ফিরে আদ্রিশকে দেখে আমার ক্রোধ এবং বিস্ময়, দুটোর মাত্রাই পূর্বের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here