ভুলবশত_প্রেম,২০,২১

0
895

#ভুলবশত_প্রেম,২০,২১
#লেখনীতেঃসারা মেহেক
২০

আদ্রিশের মুখে রোহান ভাইয়ার পুরো নাম শুনে আমি ভীষণ অবাক হলাম। বিস্ময়ের সহিত জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি রোহান ভাইয়ার পুরো নাম জানলেন কি করে?”

আদ্রিশ আমার দিকে ফিরে জবাব দিলেন,
” ইমাদ যখন বললো, রোহান নামের কেউ নাফিসা ভাবীর পিছনে পড়ে আছে তখনই নামটা শুনে কিছুটা সন্দেহ করেছিলাম। আবার ওর আচার আচরণও কিছুটা সন্দেহজনক মনে হয়েছিলো। এজন্যই পুরো নাম জিজ্ঞেস করলাম। তো এই রোহানের নাম রোহান আহমেদ না?”

ইমাদ ভাইয়া অবিশ্বাস্যভরা চাহনিতে চেয়ে বিস্মিত কণ্ঠে আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করলেন,
” এর মানে এটা সেই রোহান আহমেদ?”

আদ্রিশ যেনো আরেকদফা নিশ্চিত হতে চাইছেন। এ কারণে উনিও পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” তোর খোঁজখবর নেওয়া মতে, এই রোহানের বাবা ওদের এলাকার এমপি৷ রাইট?”

ইমাদ ভাইয়া মাথা নাড়িয়ে বললেন,
” রাইট। ”

ইমাদ ভাইয়া আর আদ্রিশের কথাবার্তার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে আমি এবং আপু প্রায় একত্রেই বলে উঠলাম,
” আপনারা রোহানকে চিনেন কি করে?”

আদ্রিশ এবং ইমাদ ভাইয়া নিরবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমাদের দিকে। অতঃপর ক্ষণিক বাদে আদ্রিশ আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,
” যেদিন আমি হসপিটালে ব্যান্ডেজ করাতে এসেছিলাম সেদিন তোমায় বলেছিলাম, আমায় যে মেরেছে সে আমার পার্সোনাল এবং প্রফেশনাল লাইফ, দু জায়গারই শত্রু৷ মনে আছে?”

আমি সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
” হ্যাঁ, মনে আছে। ”

” সেই ছেলের নামই হলো রোহান আহমেদ। দ্যাট মিনস, নাফিসা ভাবীর পিছে যে পড়ে আছে সে আর আমার শত্রু একই মানুষ। রোহান আহমেদ। ”

আদ্রিশের কথা শুনে আমরা দুজনে থম মেরে বসে রইলাম। রোহান ভাইয়া কাউকে মারার মতো কাজ করে বসবে তা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। রোহান ভাইয়া আপুকে পছন্দ করতো তা মেনে নেয়া যায়। কারণ সে এখনও আপুর সাথে খারাপ কিছু করেনি। কিন্তু উনি যে কাউকে এভাবে মারতে পারে তা আমি আশাও করিনি। ছোট বেলা থেকে রোহান ভাইয়াকে দেখে আসছিলাম। উনি কখনও কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি। সবসময় সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলেছেন। আর আজ সেই মানুষেরই নতুন এক রূপ সম্পর্কে জানলাম। সবটাই অবিশ্বাস্য লাগছে। আপুও যেনো এমন কিছু আশা করেনি। আপু আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করলো,
” রোহানের সাথে তোমার পরিচয় কবে থেকে?”

আদ্রিশ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলেন,
” ভার্সিটি লাইফ থেকে ওকে চিনি। আমরা ক্লাসমেট ছিলাম। ওর সাথে আমার তেমন পরিচিতি ছিলো না। বন্ধুত্বও ছিলো না। তবে দুটো ঘটনার পর থেকে ওর সাথে আমার শত্রুতার শুরু হয়। প্রথমত একটা জুনিয়রকে খুব খারাপ ভাবে র‍্যাগ দেয়া নিয়ে ওর সাথে বড় রকমের ঝামেলা হয়। দ্বিতীয়ত সেমিস্টার পরীক্ষায় নকল করার সময় আমার কারণে ও হাতেনাতে ধরা পড়ে। এরপর থেকে ওর সাথে কমবেশি ঝামেলা হয়েই থাকে আমার। আর প্রফেশনাল লাইফে এন্ট্রি করার পরপরই আমাদের শত্রুতা যেনো নতুন রূপে চলে আসে। আমি আমার বাবার ফার্মাসিউট্যাকল কোম্পানিতে রিসার্চ ফার্মাসিস্ট হিসেবে ঢুকি। আর রোহান ঢুকে আমাদের রাইভাল ফার্মাসিউট্যাকল কোম্পানিতে। ব্যস আমাদের পাস্ট লাইফের শত্রুতা তখন থেকেই এক নতুন রূপ নেয়। ”

আদ্রিশের কথা শেষ হওয়া মাত্রই আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” রোহান ভাইয়া আপনাকে মেরেছিলো কেনো?”

আদ্রিশ আমার প্রশ্নে যেনো খানিকরা চুপসে গেলেন। কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ব্যস্ততা দেখিয়ে বললেন,
” কিছু প্রফেশনাল কারনে। আচ্ছা, এসব বাদ দাও আপাতত।”

এই বলে উনি ইমাদ ভাইয়ার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কাল কখন বের হচ্ছিস?”

ইমাদ ভাইয়া খানিক চিন্তাযুক্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন,
” সকাল সাতটার দিকে বের হবো। সকালে বোধহয় দেখা হবে না তোর সাথে। কারণ তখনও তুই ঘুমাস।”
এই বলে ইমাদ ভাইয়া পরনের হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন,
” চল উঠা যাক। অনেক রাত হয়েছে। কালকে সকালেও তো উঠতে হবে আবার।”

আদ্রিশ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলেন,
” হ্যাঁ,চল উঠি। ”
এই বলে উনি উঠে দাঁড়ালেন। উনার দেখাদেখি আমরা তিনজনও উঠে দাঁড়ালাম। আপু এবং ইমাদ ভাইয়া আগে আগে চলে গেলেন। আমিও উনাদের পিছু পিছু যেতে লাগলাম। আমার পিছন হতে হঠাৎ এসে আদ্রিশ আমার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলেন। ছাদ হতে দু সিঁড়ি নামার পর আদ্রিশ পকেটে দু হাত গুঁজে আনমনে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” তাহলে এক সপ্তাহ এখানে থাকা হচ্ছে তোমার। গুড থিং।”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমি এক সপ্তাহ এখানে থাকবো তা আপনি জানলেন কি করে?”

আমরা ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এসেছি। সিঁড়ির সাথে গেস্টরুম লাগোয়া থাকায় আমি গেস্টরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কারণ আপাতত গেস্টরুমেই থাকা হচ্ছে আমার।
আদ্রিশ এসে দাঁড়ালেন আমার সম্মুখপানে। ঠোঁটের কোনে এক প্রকার রহস্যময় হাসি এঁটে বললেন,
” সব ঘটনা এবং ঘটনার কারণ জানতে নেই মিশমিশ। জানলে এই ইউনিভার্সের কিছুই তো অজানা থাকতো না। মনে রেখো মিশমিশ, ইউনিভার্স তার অতল গহ্বরে অনেক কিছু লুকিয়ে রাখে। যা সে সবাইকে জানতে দিতে চায় না।”

আদ্রিশের এমন রহস্যভরা কথার অর্থ আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো। আদ্রিশ হয়তো আমার চেহারা হাবভাব দেখে ব্যাপারটা চট করে ধরে ফেললেন। এজন্যই পূর্বের ন্যায় হাসি দিয়ে বললেন,
” এত ভাবতে হবে না তোমায় মিশমিশ। আপাতত যাকে নিয়ে বা যা নিয়ে ভাবলে তুমি টেনশন ফ্রি থাকবে তা নিয়ে ভাবো। ”
এই বলে উনি মনোমুগ্ধকর এক হাসি দিয়ে নিচে যাবার সিঁড়িতে পা রাখলেন। কিন্তু কি যেনো ভেবে দু পা পিছিয়ে এসে আমায় বললেন,
” হ্যাভ এ গুড ড্রিমস মিশমিশ। কালকে দেখা হচ্ছে আবারো। ততক্ষণের জন্য বাই বাই।”
এই বলে উনি প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে চলে গেলেন। উনি যেতেই আমি দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলাম এবং না চাইতেও উনার কথা ভাবতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম কি কারণে রোহান ভাইয়া উনাকে ওভাবে মেরেছিলেন।

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

২১

দুপুর তিনটার সময় আপুর শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছেই গেস্টরুমে চলে এলাম আমি। সারাদিনের ক্লাস, ওয়ার্ড, আইটেমের প্যারায় আমার অবস্থা নাজেহাল। সকালে ইমাদ ভাইয়া বেরিয়ে যাবার আধ ঘণ্টা পর পরই আমি কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সারাদিনের ব্যস্ততায় আপুর সাথে ফোনে কথা বলাও হয়ে উঠেনি। ফলে রুমে এসে হাতমুখ ধুয়েই আপুর রুমে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।

হাতমুখ ধুয়ে মিনিট দশেক রেস্ট নিয়েই আমি আপুর রুমে চলে এলাম। রুমের দরজা খোলাই ছিলো। ফলে চুপচাপ আমি রুমে ঢুকে পড়লাম। রুমে ঢুকেই আমার দৃষ্টি চলে গেলো ইমাদ ভাইয়ার ছোট্ট রিডিং কর্ণারে। আপু সে জায়গার বরাদ্দকৃত সোফায় বসে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। আপুর ঘুমুন্ত অবস্থা দেখে আমি মৃদু হাসলাম। অতঃপর ধীর পায়ে আপুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মন চাইছে না আপুকে ঘুম হতে জাগ্রত করতে। কিন্তু এ মুহূর্তে আপুকে ডেকে একসাথে দুপুরের খাবার না খেলে পরে আর খাওয়া হয়ে উঠবে না। এজন্য আপুর কাঁধে হাত রেখে ধীরলয়ে আপুকে ডাকতে লাগলাম। আমার ডাকে আপু প্রায় সাথে সাথেই ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লো। দ্রুত সোফা ছেড়ে উঠে ভীতসন্ত্রস্ত চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে বিচলিত হয়ে বললো,
” কি, কি, কি হয়েছে! সব ঠিক আছে তো? ”

হঠাৎ ঘুম হতে জাগ্রত করার চেষ্টায় যে আপু খানিক ভয় পেয়েছে তা বুঝতে সময় লাগলো না আমার। আমি আশ্বস্ত চাহনিতে আপুর দিকে চেয়ে বললাম,
” কিছু হয়নি আপু। তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলি বলে ডাকলাম। চল দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। ”

আপু ক্ষণিকের জন্য আমার দিকে হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইলো। অতঃপর চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা করতে পেরে ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো আপু। জিহ্বা দ্বারা শুকনো ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে আমায় বললো,
” হঠাৎ ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিস বলে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তো, বাড়িতে কখন পৌঁছালি তুই?”

” এই তো পনেরো বিশ মিনিট আগে।
তুই এখনো খাসনি আপু, ঠিক না?”

আমার প্রশ্নে আপু মুচকি হেসে আমার দিকে চাইলো। অতঃপর ফ্লোরে পড়ে থাকা বইটি সেল্ফের নির্দিষ্ট জায়গায় তুলে রাখতে রাখতে বললো,
” তোকে ছাড়া কি করে খাই, বল তো? এই এক সপ্তাহ তুই আমার দায়িত্বে আছিস। তোর খাওয়াদাওয়ার খেয়াল রাখতে হবে না বল?”

এই বলে আপু ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। অতঃপর আমরা দুজনে একত্রে রুম হতে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম। হঠাৎ কৌতূহলবশত আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপু? তোদের বাড়ির সবাই কি প্রতিদিনই দুইটার সময় খেতে বসে?”

” হ্যাঁ, প্রতিদিনই। তবে বাড়িতে অনুষ্ঠান থাকলে এর হেরফের হয়৷
তোকে ছাড়াই সবাই খেয়ে নিয়েছে বলে কিছু মনে করিস না আবার। বাবা আবার এসব নিয়ম কানুনে খুব স্ট্রিক্ট। তোকে বাদ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছে বলে অনেকবার আমার কাছে বলেছে, তোকে যেনো বুঝিয়ে বলি। তুই যেনো কিছু মনে না করিস৷ ”

আমি আপুকে আশ্বস্ত করে বললাম,
” আমি কিছুই মনে করিনি৷ আচ্ছা, আমাকে আগে বল, কুহু কি বাড়িতে এসেছে?”

” হ্যাঁ। একটার দিকে বাড়িতে পৌঁছেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার না কি এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। আসরের পর তুই ওকে ডেকে কথাবার্তা বলিস। ”

” আচ্ছা, চল খেয়ে নেই আপু।”

এই বলে আমি ও আপু চেয়ারে বসে পড়লাম। আমাদের দেখে প্রায় সাথে সাথেই রান্নাঘর হতে দুজন সার্ভেন্ট এসে প্লেটে আমাদের খাবার পরিবেশন করে চলে গেলো। খাবার দেখে আপুর কেমন অনুভূতি হলো জানি না। তবে এতো মজাদার খাবার দেখে আমার ক্ষুধা পূর্বের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ফলে আর অপেক্ষা না করে খাওয়া শুরু করলাম।

.

আসর নামাজের খানিক বাদে কুহুর রুমে এসে দেখলাম সে ইতিমধ্যে ঘুম হতে জেগে গিয়েছে। আমি রুমে ঢুকতেই সে আমায় দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো,
” কত্তদিন পর তোমার সাথে দেখা মিম আপু! কেমন আছো?”

আমিও কুহুর মতো চেহারায় উৎফুল্ল ভাব আনার চেষ্টা করে বললাম,
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

” আমিও খুব ভালো আছি। কিন্তু তোমাকে দেখে এখন আমি ডাবল ভালো হয়ে গিয়েছি। তাহলে এক সপ্তাহের জন্য নতুন একটা মানুষ পেলাম গল্প করার জন্য। উফ কি শান্তি…..”

কুহুর এ অকৃত্রিম খুশি দেখে আমার ভালোলাগার মাত্রা বেড়ে গেলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতেই সে আমাকে নিজের সামনে বসিয়ে রাজ্যের গল্প শুরু করে দিলো৷ গল্পের একপর্যায়ে কুহু আমাকে আদ্রিশদের বাড়িতে যাবার প্রস্তাব দিয়ে বসলো। প্রথমে এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেও সে আমার নিষেধ মানলো না। বরং এক প্রকার জোর করেই আমাকে আদ্রিশদের বাড়িতে নিয়ে এলো। অবশ্য তার এখানে আসার উদ্দেশ্য আছে। আদ্রিশের বোন নদী আর কুহু একই কলেজে একসাথে পড়াশোনা করে। দুই ভাইদের মতো তাদের মাঝেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে সেই ছোট থেকেই৷ তবে কুহুর মতে, তাদের মধ্যে কিছুদিন পরপরই ঝগড়া লেগে যায়। অবশ্য কয়েক ঘণ্টার মাঝে সে ঝগড়াও মিটমাট হয়ে যায়। এই হলো তাদের বন্ধুত্ব।

কুহুর সাথে আদ্রিশদের বাড়িতে পৌঁছিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বয়স্ক একজন মহিলাকে বসে থাকতে দেখলাম৷ উনি কে, এ নিয়ে কুহুকে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই সেই বয়স্ক মহিলা কুহুকে উদ্দেশ্য করে প্রফুল্লচিত্তে বলে উঠলেন,
” ওরে আমার কুহুরে! কতদিন পর তোকে দেখলাম! কেমন আছিস রে তুই?”

বয়স্ক মহিলার কথা শেষ হওয়া মাত্রই কুহু আমাকে ছেড়ে উনার কাছে গিয়ে বসলো। বয়স্ক মহিলাটির গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
” আমি একদম ফিট আছি গো দাদু। তুমি কেমন আছো?”

” আল্লাহ এ বুড়ো শরীরটা এখনও রহম করে বাঁচিয়ে রেখেছে। তা তোর সাথে এই মেয়েটা কে রে?”

” দাদু, এই আপুর নাম মিম। ছোট ভাবীর আপন বোন। ”
এই বলে কুহু আমাকে উদ্দেশ্য করে হাসিমুখে বললো,
” আর এই সুন্দরী হলো আদ্রিশ ভাইয়া আর নদীর দাদু। তবে হ্যাঁ, শুধু যে ওদের দাদু তা নয়। আমার, বড় ভাইয়ার, ছোট ভাইয়ারও দাদু হয় কিন্তু। একদম জাতির দাদু।”
এই বলে কুহু ফিক করে হেসে ফেললো। ওর কথা শুনে আমি নিজেও হেসে ফেললাম। দাদু আমাকে দেখে কোমল স্বরে বললেন,
” আমার পাশে এসে বসো দাদুমনি। তোমার সাথে পরিচয় হই এসো। ”

দাদুর মিষ্টি আচরণে আপ্লুত হয়ে আমি হাসিমুখে উনার পাশে বসলাম। দাদু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমার সম্পর্কে টুকটাক বিষয় জেনে নিলেন। আমাদের কথার মাঝেই সিঁড়ি বেয়ে মধ্যবয়স্ক একজন মহিলাকে নামতে দেখে আমি ভেবেই নিলাম, উনি আদ্রিশের মা। উনার পাশাপাশি দ্রুত বেগে হেঁটে এলো কম বয়সী একটি মেয়ে। হয়তো তার নাম নদী।

সেই কম বয়সী মেয়েটাকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে কুহু দৌড়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। মেয়েটির কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কুহু বললো,
” নদী! দোস্ত! ইশ কত্তদিন পর দেখা! তোকে কত্ত মিস করেছি তা বলার বাইরে। আমি জানি, তুই আমাকে একটুও মিস করিসনি। ”
এই বলে কুহু তাকে ছেড়ে দিলো। ওর সম্বোধনেই আমি এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম, এই মেয়েটিই নদী।
নদী এ পর্যায়ে কুহুর বাহুতে চাপড় মেরে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
” ঢং করিস না। তুই আমাকে না বরং আমি তোকে মিস করেছি। জানিস? তোর জন্য আমি শপিং করতেও যাইনি৷ ওয়েট করছিলাম, কবে তুই আসবি। ”

এদের দুজনের কথার মাঝে সেই মধ্য বয়স্ক মহিলাটি হাসিমুখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মিষ্টি হেসে বললেন,
” আমি আদ্রিশ আর নদীর মা। তুমি মিম, তাই না?”

আমার অনুমান সঠিক হতে দেখে যতটা না খুশি হলাম এর চেয়ে ঢের অবাক হলাম আন্টীর মুখে নিজের নাম শুনে। আমার যতদূর মনে আছে, আমার নাম বলার সময় আন্টী এখানে এমনকি আশেপাশেও ছিলেন না। তাহলে উনি আমার নাম জানলেন কি করে? এ নিয়ে আন্টীকে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই আন্টী আমায় বললেন,
” তুমি বসো, তোমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করছি। ”

ভদ্রতা দেখিয়ে আন্টীকে নাস্তার জন্য নিষেধ করার পূর্বেই কুহু অবলীলায় বলে ফেললো,
” হ্যাঁ গো আন্টী, খুব ক্ষুধা লেগেছে। নাস্তার ক্ষুধা। কতদিন তোমার হাতের খাবার খাই না গো। ভাবছি, আজকের ডিনার এখানেই করে যাবো। ”

কুহুর কথা শুনে আন্টী ভীষণ খুশি হলেন। চমকপ্রদ গলায় বললেন,
” বাহ কুহু, এতো ভালো আইডিয়া তোর মাথায় এলো কি করে? একদম ঠিক আইডিয়া দিয়েছিস। আজকে তোরা আমাদের সাথেই ডিনার করবি। ”

আন্টীর কথা শোনামাত্র আমার ভেতরটা অস্বস্তিতে কাঁদা হয়ে এলো। এখানে রাত অব্দি থেকে ডিনার করার মতো একটুও ইচ্ছে নেই আমার। এজন্য আমি দ্রুত সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
” আজকে না আন্টী। অন্য একদিন। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। এখন না গেলে আপু খুব টেনশন করবে৷ ”
এই বলে আমি আকুল চাহনিতে কুহুর দিকে চাইলাম। কিন্তু আমার এ চাহনি সে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো এবং সেসহ উপস্থিত সকলে এমনভাবে হেসে উঠলো যেনো তারা কোনো কৌতুক শুনে ফেলেছে। আন্টী হাসতে হাসতে আমায় বললেন,
” পাগল মেয়ে। এখান থেকে এক দৌড়ে ইমাদদের বাড়িতে যাওয়া যায়। আর তুমি আমায় সন্ধ্যা হওয়ার অজুহাত দিচ্ছো! আর যাই বলো, তোমাকে আর কুহুকে ডিনার না করে যেতে দিচ্ছি না। আজকে তোমরা দুজন ডিনার করবে। আর ইমাদ বাড়িতে এলে তোমাকেসহ ওদের সবাইকে রাজকীয় স্টাইলে রান্না করে খাওয়াবো। বিয়ের পর একদিন ইমাদ আর নাফিসাকে রান্না করে দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছিলাম। সেদিন নাফিসা আরো একদিন খাওয়ার কথা বলেছিলো। আচ্ছা, যাই হোক, তোমরা বসো। আমি নাস্তা নিয়ে আসি।”

এক অজুহাত নাকচ করার বিনিময়ে আন্টীর এতো কথা শুনে আমি ফের কিছু বলার সাহস পেলাম না। বরং চুপচাপ বসে রইলাম। এদিকে আন্টী রান্নাঘরে যাবার পূর্বে নদীকে আদেশ দিয়ে গেলো, আমায় যেনো পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখায় সে। মায়ের নির্দেশে নদী সে মুহূর্তেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমার কাছে এসে আমায় হাত ধরে দাঁড় করালো নদী। এভাবেই আমার হাত ধরে সিঁড়ির কাছে এসে হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,
” চলো আপু, তোমায় ছোট্ট এই রাজমহলটা ঘুরিয়ে দেখাই।”
এই বলে সে পিছে ফিরে কুহুকে বললো,
” আমাদের সাথে আসার জন্য তোকে আলাদা করে ইনভিটেশন দিতে হবে বুঝি?”

কুহু দাঁত কেলিয়ে সোফা ছেড়ে আসতে আসতে বললো,
” আসছি দোস্ত, আসছি আমি।”

মুহূর্তেই কুহু আমাদের সাথে যোগ দিলো। অতঃপর আমরা তিনজনে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। নদী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললো,
” আসলে এ বাড়িটা দেখতে রাজমহলের মতো না। কিন্তু আমাদের সবার কাছে এ বাড়িটা ভালোবাসায় পূ্র্ণ রাজমহলের চেয়ে কিছু কম নয়। আমি ছোট থাকতেই এ বাড়ি বানিয়েছিলো বাবা। এজন্য এ বাড়ির সাথে আমার স্মৃতিও বেশি, মায়াও বেশি।”

এদিকে নদী কথা বলছে, ওদিকে আমি বিস্মিত চাহনিতে বাড়িটি দেখছি। বাড়িটির সাজসজ্জা যেমন সাধারণ তেমনি মার্জিত। এক নজরে পছন্দ হয়ে যাবার মতো একটি বাড়ি।
দোতালায় আসার পর কোনার একটি রুমের সামনে আমাদের আনলো নদী। অতঃপর সে রুমের লকে হাত রেখে নিজের কণ্ঠে হঠাৎ কৃত্রিম রহস্যময় ভাব এনে বললো,
” আপু, তোমাকে শুরুতেই দেখাতে চলেছি রহস্যময় এক ঘর। যার কোনায় কোনায় লুকিয়ে আছে সাসপেন্স, থ্রিল। যা তোমার গায়ের লোম পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে দিবে।”
নদীর এহেন কথায় আমি ভাবনার অতল সাগরে পাড়ি দিলাম। ভাবতে লাগলাম, প্রকৃতপক্ষে রুমটায় কি আছে। আমার এ ভাবনার মাঝেই নদী চট করে লক ঘুরিয়ে রুমটা খুলে দিলো। তৎক্ষণাৎ আমার দৃষ্টি সীমানায় ধরা পড়লো কয়েকটি কাঠের টেবিল এবং রাসায়নিক বিভিন্ন সরঞ্জামাদি। সে মুহূর্তে নদী ফিক করে হেসে বললো,
” এই হলো সেই সাসপেন্স এবং থ্রিলিং একটা রুম। বাবা আর ভাইয়ার কাছে এটা নরমাল একটা ল্যাব হলেও আমার কাছে আস্ত এক থ্রিলিং রুম এটা। ”

বাড়িতে ল্যাব দেখে খানিক অবাক হয়েই নদীকে জিজ্ঞেস করলাম আমি,
” বাড়িতে ল্যাব করা রিস্কি না? কখনো কোনো রিয়েকশনে কিছু হয়ে গেলে?”

নদী ল্যাবের দরজার লক ঘুরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। পা ঘুরিয়ে বিপরীত দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
” তেমন কোনো ক্যামিকালই এখানে নেই যাতে রিয়েকশন হলে কোনো বিস্ফোরণ বা এমন কিছু হবে। বাবা আর ভাইয়া দক্ষ হাতের ফার্মাসিস্ট। তারা বুঝেশুনেই এখানে সব এনেছে। ”

” ওহ। আংকেলও ফার্মাসিস্ট? ”

” হ্যাঁ। বাবা ফার্মাসিস্ট। তবে অফিশিয়ালি এ নিয়ে আর কাজ করে না বাবা। শুধুমাত্র কোম্পানির যাবতীয় সব কাজের খোঁজখবর রাখে বাবা। আর ভাইয়াই মেইনলি রিসার্চ করে।”

নদীর কথায় আমি ভাবুক স্বরে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
” ওহ। ”

নদী একে একে দাদুর রুম, আংকেল আন্টীর রুম দেখালো। বাকি রইলো আদ্রিশ আর নদীর রুম। তন্মধ্যে নদী আমাকে আর কুহুকে নিয়ে আদ্রিশের রুমে ঢুকলো। আদ্রিশের রুমে ঢুকেই নদী একরাশ ভালোলাগা নিয়ে বললো,
” আর এটা হলো ভাইয়ার রুম। এ বাড়ির সবচেয়ে পছন্দের একটা রুম। আমার রুমও আমার কাছে ততটা প্রিয় না যতোটা ভাইয়ার রুম আমার কাছে প্রিয়। ভাইয়ার গোছানো রুম, বিশেষ করে ভাইয়ার রুমে ব্যালকনিটা আমার সবচেয়ে ফেভারেট। ”
এই বলে আমায় নিয়ে ব্যালকনিতে চলে এলো এবং ব্যালকনিতে পা রাখার সাথে সাথে আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে গেলাম। গ্রিল ছাড়া ব্যালকনিটা কৃত্রিম ঘাসের কার্পেটে ছেয়ে আছে৷ এক কোনায় রাখা আছে ছোট ছোট কয়েকটি গাছ এবং অপর কোনা ছেয়ে আছে অসম্ভব সুন্দর মাধবীলতা গাছে। মাধবীলতা গাছটির নিচে মূল মাটির সাথে জড়িত। কিন্তু গাছটির আসল সৌন্দর্য, শুভ্র লাল ফুলের অনেকাংশই স্থান পেয়েছে আদ্রিশের ব্যালকনিতে। আমি বিস্ময় নিয়ে গাছটির দিকে চেয়ে আছি। মাধবীলতা ফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য দেখে আমার সর্বাঙ্গ মুগ্ধতায় ছেয়ে গেলো। খানিক বাদে কৌতূহলবশত নদীকে জিজ্ঞেস করলাম,
” এটা কি মাধবীলতা ফুলের সময়?”

নদী হয়তো কুহুর সাথে গল্পে মশগুল ছিলো। এ কারণে প্রথম দফায় প্রশ্ন করায় তার থেকে উত্তর না পেয়ে দ্বিতীয় দফায় প্রশ্ন করলাম এবং তখন সে উত্তরস্বরূপ বললো,
” এই গাছ সময়ে অসময়ে ফুল দেয় আপু। এই ফুলের অন্যান্য গাছ হয়তো সময়ে ফুল দেয়। কিন্তু আমাদের এ গাছটা এক্সেপশনাল। মোটামুটি সারাবছরই ও ফুলে ফুলে ভরে থাকে। এজন্যই আমার আর ভাইয়ার, বিশেষ করে ভাইয়ার ফেভারেট ফুলগাছ এটা। আমরা দুজনে……”
নদী তার কথা শেষ করতে পারলো না। এর পূর্বেই নিচ হতে আন্টীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আন্টী নদী ডাকছে, উপরে নাস্তা নিয়ে আসার জন্য।
আন্টীর ডাক শুনে নদী এক মুহূর্তও দেরি না করে চলে গেলো। তার পিছে পিছে গেলো কুহুও।

ওরা দুজন চলে যাবার পর আমি কিছুক্ষণ মাধবীলতা গাছটির দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর সন্ধ্যের হিম হাওয়া শরীরে লাগতেই আমি ব্যালকনি ছেড়ে রুমে চলে এলাম। রুমে ঢুকেই রুমের প্রতিটা জিনিস দেখতে লাগলাম। আদ্রিশের রুম ছিমছাম। তবে সুন্দর। যে যে জিনিস এ রুমে আছে তার প্রত্যেকটাই যেনো এ রুমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রুমের চারপাশ দেখতে দেখতে আমার দৃষ্টি আটকে গেলো দেয়ালে টাঙানো বেশ কয়েকটি সার্টিফিকেট দেখে। আমি কৌতূহলবশত ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম সার্টিফিকেট দিয়ে গড়ে উঠা সেই দেয়ালটির কাছে। এখানকার সবগুলো সার্টিফিকেটগুলো সুন্দর করে ফ্রেম দিয়ে বাঁধাই করা আছে। সর্বপ্রথম সার্টিফিকেটটা সায়েন্স অলিম্পিয়াডের। তারপরেরটা ম্যাথ অলিম্পিয়াডের। তারপরেরটা পুনরায় সায়েন্স অলিম্পিয়াডের। কোনোটাতে তিনি জেলা পর্যায়ে প্রথম। কোনোটাতে জাতীয় পর্যায়ে প্রথম বা দ্বিতীয়। এমনই বেশ কয়েকটা অর্জনের সার্টিফিকেট উনার ঝুলিতে স্থান পেয়েছে। সব সার্টিফিকেট দেখা শেষে আমার দৃষ্টি আটকে গেলো সর্বশেষ সার্টিফিকেটের উপর। যেটা বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের পক্ষ থেকে শুটিং এ প্রথম হওয়ার জন্য আদ্রিশকে দেয়া হয়েছে। আদ্রিশের অর্জিত অন্যান্য সার্টিফিকেট দেখে যতোটা না বিস্মিত হলাম এর চেয়ে ঢের বিস্মিত হলাম উনার এই শুটিং এ প্রথম হওয়া সার্টিফিকেট দেখে।

” আজ দেখি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। ”

পিছন হতে আচমকা আদ্রিশের কণ্ঠস্বর শুনে বিস্ময়ের সুঁতো কেটে ভয়ের সুঁতো পেঁচিয়ে ধরলো আমায়। পিছনে ফিরে কয়েক সে.মি. দূরে আদ্রিশকে দেখে আমি কয়েক কদম পিছিয়ে এলাম। আমার শরীর গিয়ে ঠেকলো দেয়ালের সাথে। ফলস্বরূপ আমার উচ্চতা বরাবর সেই সার্টিফিকেটের ফ্রেমটি আমার স্পর্শে পড়ে যেতে নিলো। কিন্তু এর পূর্বেই আদ্রিশ এগিয়ে এসে দেয়ালের উপর সার্টিফিকেটে হাত ঠেকিয়ে সেটা পড়ে যাওয়া হতে বাঁচিয়ে নিলেন।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here