#ভুলবশত_প্রেম,২২,২৩
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২২
সার্টিফিকেটকে নিজের জায়গায় রেখে আদ্রিশ পুনরায় দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। উনি আমার থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখেই দাঁড়িয়ে আছেন। তবুও উনাকে এভাবে সামনে দেখে আমার ভেতরে তীব্র অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি হলো। ফলস্বরূপ আমি চোখজোড়া কুঞ্চিত করে দু হাতের মুঠো শক্ত করে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম। অজানা কারণে পা দুটো বরফের ন্যায় জমে রইলো। দু কদম পাশ ফিরে যে এখান থেকে সরে দাঁড়াবো সে শক্তিটুকুও যেনো আমি হারিয়ে ফেললো। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়ে আমার সমস্ত স্নায়ু যেনো তার কর্মযজ্ঞ হতে বিরতি নিলো। আমি অনুভব করলাম, আমার হাত দুটো ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সহসা কুহু এবং নদীর কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি। মুহূর্তেই চোখ মেলে সামনে চাইলাম এবং বেশ বিস্মিত হলাম বটে। কারণ এ মুহূর্তে আমার সামনে কেউ নেই। কিছুক্ষণ আগেও যে আদ্রিশ এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অথচ এ মুহূর্তে উনি আমার সামনে নেই৷ বরং উনি এ রুমেই নেই। কুহুর কণ্ঠস্বর শুনে এতো দ্রুত উনি কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন এ ভাবতে ভাবতে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। তন্মধ্যেই কুহু ও নদী নাস্তাসহ রুমে প্রবেশ করলো। আমায় দেখে নদী জিজ্ঞেস করলো,
” ভাইয়া এসেছে?”
নদীর প্রশ্নের কি জবাব দিবো এ ভাবতে ভাবতেই আদ্রিশ ওয়াশরুমের দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলেন। তোয়ালে দিয়ে মুখমণ্ডল মুছে নিতে নিতে নদীকে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমাকে খুঁজছিস কেনো চুন্নি?”
আদ্রিশের মুখে ‘চুন্নি’ সম্বোধন শুনে নদী বোধহয় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। ফলস্বরূপ মুখশ্রীতে অদ্ভুত কায়দা ফুটিয়ে তুলে প্রচণ্ড খিটখিটে গলায় আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললো,
” বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ভাইয়া। আমি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি এ নামে ডাকো কেনো আমাকে?”
আদ্রিশ দাঁত বের করে তৃপ্তির সহিত বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললেন,
” তুই যতবার নিষেধ করবি ততবারই আমি তোকে এ নামে ডাকবো।”
এই বলে উনি নদীর মাথায় গাট্টি মেরে তোয়ালে নিয়ে ব্যালকনিতে গেলেন। আদ্রিশের এরূপ কাজে নদীর রাগ যেনো তুঙ্গে উঠলো। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলো,
” আজ বাবা আসুক। তারপর দেখো, তোমার নামে কি কি কমপ্লেইন করি আমি। ”
আদ্রিশ ভেজা তোয়ালে ব্যালকনিতে রেখে রুমে এসে ডাবল সিটেড সোফায় বসে পড়লেন। একটু ঝুঁকে হাঁটুর উপর দু হাতের কনুই ভর করে দাপট গলায় বললেন,
” এই সন্ধ্যায় আমার কাছে কি চাই তোর?”
আদ্রিশের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নদী গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ফলে নদীর পক্ষ হতে কুহু আদ্রিশকে বললো,
” আদ্রিশ ভাইয়া? আমাদের এখন ফুচকা খেতে মন চাচ্ছে। বাজার থেকে একটু এনে দাও না…..”
কুহুর কথায় তীব্র আকুতির দেখা মিললো। কিন্তু আদ্রিশের চেহারাখানার ভাব এমন যে, এসব আকুতি মিনতি করে লাভ নেই। এ কথার সত্যতা প্রমাণ করতেই যেনো আদ্রিশ কুহুর এ আকুতি হাওয়ায় উড়িয়ে বক্র কণ্ঠে বললেন,
” এ্যাহ, মামা বাড়ির আবদার পেয়েছিস না কি? ল্যাব থেকে কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরলাম। একটু বসতে না বসতেই আমাকে বাজারে পাঠাবি! কত্ত বড় বেয়াদ্দব! ”
কুহু তার চেহারা ভাব পরিবর্তন করে কাঁদোকাঁদো ভাব তুলে ধরে বললো,
” আদ্রিশ ভাইয়া প্লিজ। খুব খেতে মন চাইছে তো।”
” তো নিজেরা গিয়ে খেয়ে আয়।”
” আমরা যেতে পারলে কি আর তোমায় বলতাম না কি? প্লিজ আদ্রিশ ভাইয়া……”
কুহুর কথা শুনে আদ্রিশ ভ্রু উঁচিয়ে নদীর দিকে তাকালেন। নিমিষের পর্যবেক্ষণ শেষে সদর্পে বললেন,
” তোর ঐ লাড্ডু ফ্রেন্ডটাকে বল আমাকে রিকুয়েষ্ট করতে। তাহলে আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে।”
আদ্রিশ, নদী আর কুহুর এহেন কাণ্ডকারখানা দেখে আমি এক কোনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলাম। আদ্রিশ যে এতো দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ তা উনার বহিঃরূপ দেখে বোঝা মুশকিল।
এদিকে আদ্রিশের মুখে ‘লাড্ডু’ সম্বোধন শুনে নদী পুনরায় তার গাল দুটো ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নদীর এরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে শুধু যে আমিই মিটিমিটি হাসলাম তা নয়। বরং আদ্রিশও হাসলেন। তবে আড়ালে।
কুহু নদীর বাহুতে নিজের বাহু দিয়ে ঈষৎ ধাক্কা মেরে বললো,
” আর কতো রিকুয়েষ্ট করবো আমি? এবার তুইই বল। ”
নদী ঝট করে আদ্রিশের দিকে চেয়ে তেজস্বরে বলে উঠলো,
” আমাদের তেলের গোডাউন নেই যে কাউকে তেল দিয়ে দিয়ে তালগাছে উঠাবো। লাগবে না ফুচকা। আমি বাবাকেই আনতে বলবো।”
আদ্রিশ এবার কৌতুক শোনার মতো হেসে উঠলেন৷ সোফায় গা এলিয়ে বসে বললেন,
” তাহলে আজকে ফুচকা খাওয়ার শখ মিটিয়ে দে। কারণ বাবার বাসায় আসতে আসতে রাত এগারোটা পার হয়ে যাবে। ”
এবার নদী যেনো অকূলপাথারে পড়লো। তবে তা আদ্রিশকে উপলব্ধি করতে দিলো না। বরং পূর্বের ন্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো৷ এদিকে কুহু শেষ আশ্রয়স্থল ভেবে আমার কাছে এসে বললো,
” মিম আপু, চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে আদ্রিশকে ভাইয়াকে একটু বলো।”
আমি খানিক থতমত খেয়ে বললাম,
” আমি! তোমরাই আরেকটু বলো। তাহলেই এনে দিবে। ”
” প্লিজ আপু। তুমি বললে হয়তোবা কাজ হবে। আমাদের জন্য বলে দেখো না…..”
কুহুর মিনতি শুনে আমি আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আদ্রিশ যে এতক্ষণ আমাদের দিকেই চেয়ে ছিলেন তা উনার চাহনি দেখামাত্রই উপলব্ধি করলাম। ফলে আমি খানিকটা সংকুচিত হয়ে এলাম। তবুও কুহুর পক্ষ থেকে এক প্রকার বিরস কণ্ঠে উনাকে বললাম,
” এতো করে যখন রিকুয়েষ্ট করছে, ওদের রিকুয়েষ্ট রাখলেই তো হয়।”
আদ্রিশ আমার কথায় কিয়ৎক্ষণের জন্য আমার দিকে চেয়ে রইলেন। অতঃপর চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর হতে মানিব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু বেরিয়ে যাবার পূর্বে নদীর মাথায় পুনরায় গাট্টা মেরে বললেন,
” সবার জন্য দুই প্লেট। কিন্তু তোর এ ঢঙের জন্য তুই এক প্লেট ফুচকা পাবি। ”
এই বলেই উনি বেরিয়ে পড়লেন এবং সাথে সাথেই নদী স্বাভাবিক হয়ে বললো,
” ভাইটা যে এমন এক নমুনা হয়েছে! এর ডাবল পিছ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। ”
এই বলে সে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। কুহুও তার পাশে সোফায় বসতে বসতে বললো,
” তোর ক্ষেত্রেও তাই৷ প্রতিবার আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে গ্যাঞ্জাম পাকাবি। আর বলি বানাবি আমাকে। আজ তো মিম আপু ছিলো বলে আদ্রিশ ভাইয়া রাজি হলো। তা না হলে কতক্ষণ যে রিকুয়েষ্ট করতে হতো আল্লাহ জানে। ”
নদী আর কুহুর কথাবার্তা শুনে আমি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” সবসময় এমন হয়?”
কুহু জবাব দিলো,
” প্রায় সময়ই। এই দুই ভাইবোনের ঝগড়া যেনো কমতেই চায় না। ”
কুহুর কথা শুনে প্রত্যুত্তরহীন বসে রইলাম আমি৷ বিশ মিনিটের মাঝেই আদ্রিশ রুমে প্রবেশ করলেন। উনার পিছু পিছু ফুচকা নিয়ে প্রবেশ করলেন একজন সার্ভেন্ট। আদ্রিশ প্যান্টের দু পকেটে হাত গুঁজে ব্যালকনিতে যেতে যেতে বললেন,
” নে, খাওয়া শুরু কর।”
আদ্রিশ যেতেই স্বস্তি এবং তৃপ্তি সহকারে ফুচকা খেলাম। আমাদের খাওয়া শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই আদ্রিশ রুমে প্রবেশ করলেন। অঘোষিতভাবেই পুনরায় উনার এবং নদীর মাঝে খুনসুটিময় ঝগড়া চলতে লাগলো। আমার মন চাইলো তাদের এ ঝগড়ার সাক্ষী না হয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখি, গাছ দেখি। শেষমেশ কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই আমি উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। ব্যালকনিতে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। সে হাওয়ার তালে মাধবীলতা ফুলগুলো দুলে বেড়াচ্ছে। মাথার উপরে অবস্থিত উইন্ড কাইমটি মিষ্টি টুংটাং শব্দ তুলে বেড়াচ্ছে। এ যেনো এক ঐন্দ্রজালিক ক্ষণ। আমি ক্ষণেই প্রগাঢ়ভাবে এ মুহূর্তে আবদ্ধ হলাম। মাধবীলতার নৃত্য দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একটু এগিয়ে গিয়ে গাছটির কাছে দাঁড়ালাম। দুলতে থাকা ফুলগুলো আলতো করে হাতের মুঠোয় নিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে রইলাম।
অকস্মাৎ পাশে নদীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে খানিক তটস্থ হলাম৷ দ্রুত হাত হতে ফুলগুলো ছেড়ে দিয়ে নদীর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলাম। নদী বিস্তৃত হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” লাগবে?”
আমি ওর প্রশ্নের অর্থোদ্ধার করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি লাগবে? ”
নদী ভ্রুসহ চোখজোড়া উঁচিয়ে মাধবীলতা গাছের দিকে ইশারা করে বললো,
” ফুল লাগবে?”
নদীর কথায় যেনো হাতের মুঠোয় এক ঝাঁক সুখ পেয়ে বসলাম। আমি সাথে সাথে উৎফুল্লতার সহিত ওর প্রশ্নের জবাবে বলে বসলাম,
” হ্যাঁ হ্যাঁ৷ লাগবে। ”
নদী আমার জবাবে স্মিত হাসলো। আমার সামনে দাঁড়িয়েই আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললো,
” ভাইয়া, ঐ মাধবীলতা ফুল লাগবে। ”
আদ্রিশ কিয়ৎ তেজস্বরে বললেন,
” আমার ফুলগুলোয় হাত লাগালে খবর আছে।”
” ইশ! আমার না। মিম আপুর লাগবে। ”
নদীর কথায় আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আদ্রিশের দিকে চাইলাম৷ আদ্রিশও নদীর উপর হতে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে চাইলেন। নিমিষের জন্য আমায় পর্যবেক্ষণ শেষে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
” আচ্ছা। নিক ও।”
আদ্রিশের সম্মতি পাওয়া মাত্র আমি এক মুহূর্তও দেরি করলাম না। পা এগিয়ে গাছের কাছে এসে দু গুচ্ছ মাধবীলতা ফুল তুলে নিলাম। ফুলের গুচ্ছ দুটো হাতের মুঠোয় পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমি বোধহয় সব সুখ পেয়ে বসেছি৷ এক ফুলের গুচ্ছকে ঘিরে কি অদ্ভুত এক অনুভূতি! মন চাইছে এ মুহূর্তে চুলের বাঁধন খুলে এক গুচ্ছ মাধবীলতা কানে গুঁজে নেই। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় সে ইচ্ছে বিসর্জন দিতে হলো আমায়।
আমি ফুল নিয়ে আদ্রিশের রুমে চলে এলাম৷ আদ্রিশ সোফায় বসে মনোযোগ সহকারে ফোন চালাচ্ছেন। অনেকক্ষণ যাবত এ রুমে থাকায় খানিক অস্বস্তি বোধ করলাম আমি৷ ফলে নদীর রুমে যাওয়ার জন্য ওর অনুমতি চাইলাম। কুহুর সাথে গল্পে মশগুল থাকতে থাকতে সে ভদ্রতাসূচক কণ্ঠে আমায় অনুমতি দিলো। অতঃপর নদীর রুমে এসে দরজা কিঞ্চিৎ ভিড়িয়ে ওর রুমে অবস্থিত ডাবল সিটেড সোফায় বসে পড়লাম। একদৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ মাধবীলতা গুচ্ছ দুটির দিকে চেয়ে রইলাম৷ সহসা কানের পিছে ফুল গুঁজে রাখার চিন্তা আসতেই আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো। দরজা ভিড়িয়ে রাখায় আমি সোফা ছেড়ে উঠে মাথা হতে ওড়না কাঁধে নিলাম। মুহূর্তেই চুলের বাঁধন খুলে মাধবীলতার এক গুচ্ছ কানের পিছনে গুঁজে নিলাম। অতঃপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখলাম।
আচমকা দরজার ওপাশে কারোর পদশব্দে খানিক ভীত হলাম। দ্রুত কান হতে ফুল সরিয়ে খোঁপা বেঁধে মাথায় ওড়না নিলাম। অতঃপর চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো সোফায় বসে পড়লাম।
#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২৩
কিছুক্ষণের মাঝেই রাতের খাবারের জন্য নদী রুমে এসে আমাকে নিচে নিয়ে এলো। মাঝের একটি চেয়ারে আমাকে বসিয়ে সেও আমার পাশে বসে পড়লো। আমার পাশে এবং সামনে কুহু, দাদি ও আন্টী বসে আছেন এবং আমার একদম সামনাসামনি বসে আছেন আদ্রিশ। উনাকে দেখে পুনরায় আমার মাঝে অস্বস্তিকর অনুভূতির উদয় হলো। কেনো যেনো, আজ উনার বাড়িতে এসে উনার প্রতি এ জড়তা ভাবটা তীব্রভাবে জন্ম নিয়েছে। যদিও এতোদিনেও এ জড়তা ভাবটা ছিলো। তবে তীব্র নয়।
আমি সুক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করছি আদ্রিশ আমার দিকে চেয়ে আছেন। তবে একনাগারে নয়। সালাদ চিবুতে চিবুতে এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে আছেন যে হুট করে এই বিষয়টা কেউ ধরে উঠতে পারবে না। উনার এ লুকোচুরি চাহনি দেখে আমার মন বলছে সালাদের মতোই উনাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। কিন্তু এ ইচ্ছেটা অপূরণীয় বলে শীঘ্রই এ ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিতে হলো। অতঃপর আমি স্বগোতক্তি করে বললাম,
” আজ আমার রাতের খাবার গেলো।”
কিছুক্ষণ পর সার্ভেন্ট এসে সবাইকে খাবার সার্ভ করে চলে গেলো। সবাই খাওয়া শুরু করলেও আমি শুরু করতে পারলাম না৷ কারণ আদ্রিশ সামনে থাকায় খাবার খেতে বেশ অস্বস্তি লাগছে। ফলস্বরূপ লোক দেখানোর জন্য এক গাল ভাত মুখে তুলে ধীরেসুস্থে চিবুতে লাগলাম। এদিকে সবাই তৃপ্তি সহকারে আরামে খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কণ্ঠনালী দিয়ে খাবার নামছে না। এরই মাঝে হঠাৎ আন্টী আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার মিম? খাবার কি ভালো হয়নি? খাচ্ছো না কেনো?”
আন্টীর কথার প্রত্যুত্তরস্বরূপ আমি তৎক্ষনাৎ জোরপূর্বক হেসে বললাম,
” না না আন্টী। খাবার খুব ভালো হয়েছে। আমি খাচ্ছি তো। ”
এই বলে পুনরায় আরেক গাল ভাত মুখে তুলে নিয়ে চিবুতে লাগলাম আমি। পাশাপাশি আদ্রিশকে সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণ কারণটা সঠিক জানা নেই। হয়তো আমার দিকে ফের উনি তাকাচ্ছেন কি না তা জানার জন্য দেখছি উনাকে!
হঠাৎ খাবার মাঝেই আদ্রিশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। খাবার প্লেট হাতে নিয়ে ড্রইং রুমের সোফার দিকে যেতে যেতে বললেন,
” তোমরা এখানে খাও। আমি সোফায় বসে খাচ্ছি।”
আদ্রিশের এ কাজে আমি ভীষণ অবাক হলাম। কিন্তু অন্যান্যদের চেহারা দেখে মনে হলো, তারা বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। আন্টী খেতে খেতে আদ্রিশকে বললেন,
” কিছু লাগলে বলিস। নদীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবো।”
আদ্রিশ প্রত্যুত্তর করলেন না। বরং সোফায় বসে আমাদের বিপরীত দিকে মুখ করে খাবার খেতে লাগলেন। এদিকে আমার সামনে থেকে আদ্রিশ চলে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি৷ ফলে স্বাভাবিকভাবে তৃপ্তিসহকারে খাবার খাওয়া শুরু করলাম আমি।
রাতের খাবার শেষ হওয়ার আধঘণ্টার মাঝেই আদ্রিশ আমাকে ও কুহুকে ইমাদ ভাইয়াদের বাসায় রেখে এলেন। পথিমধ্যে আমার এবং আদ্রিশের মাঝে কোনোরূপ কথাবার্তা হয়নি। হয়তো কুহু আছে বলে। তবে আমি নিশ্চিত, আজ কুহু না থাকলে আদ্রিশ নিশ্চয়ই আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন। এ যেনো উনার এক চিরাচরিত স্বভাব, যা এ কয়দিনেই আমি বুঝতে পেরেছি। আর এও লক্ষ্য করেছি যে, উনি সবার সামনে আমার সাথে খুব একটা কথা বলেন না। কিন্তু আমাদের মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত না থাকলে উনার মুখ দিয়ে কথার ফুলঝুরি বেরুতে থাকে। আসলেই উনি অদ্ভুত নামের কিম্ভূতকিমাকার একটা মানুষ।
——–
গত পরশু আদ্রিশদের বাসা থেকে ডিনার করে এসে যে ঘুম দিয়েছিলাম, সে ঘুম আমার ভাঙে পরেরদিন সকাল সাড়ে নয়টায়। ফলে সকালের ক্লাসটাও মিস যায়। অবশ্য পরে জানতে পারি কলেজে একটা পরীক্ষার জন্য ক্লাস সাসপেন্ড রাখা হয়েছে। ব্যস আমার খুশি আর দেখে কে! ক্লাস বন্ধ থাকার ফায়দা লুটে গতকাল প্রায় সারাটাদিন ঘুমু ঘুমু ভাবেই কাটিয়েছি আমি। তবে ইমাদ ভাইয়া না থাকায় গতকাল আমি আপুর রুমে শিফট হয়েছি এবং আপুর রুমেই আমি সারা বিকেল সন্ধ্যা শুইয়ে কাটিয়েছি। অতঃপর গতকালের আরামময় আরামের খেসারত আজ কলেজে রেগুলার আইটেম ও পেন্ডিং আইটেম দিয়ে চুকাতে হয়েছে। ক্লাস, আইটেম, ওয়ার্ড, সব মিলে আমার অবস্থা আজ বেগতিক। ক্লান্তিতে দু চোখ ভেঙে এরূপ ঘুম আসছে যে মনে হচ্ছে এখনই রাস্তায় ঘুমে ঢলে পড়বো আমি। অথচ আমি গতকাল ঘুমিয়েই কাটিয়েছি!
কলেজ হতে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর নিয়ে বাড়ির গেটে ঢুকতেই দারোয়ান চাচা এসে আমার হাতে চিঠিস্বরূপ কিছু ধরিয়ে দিলেন। চুপিসারে বললেন,
” আপা, এটা শুধু আপনাকেই দিতে বলেছে। ”
দারোয়ান চাচার কথা শুনে আমি ভ্রু কুঁচকে খামের দিকে তাকালাম। এপাশ ওপাশ উল্টে প্রেরকের নাম না দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
” কে পাঠিয়েছে এটা?”
দারোয়ান চাচা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
” সে বলা নিষেধ। ”
এই বলে উনি সিকিউরিটি রুম থেকে মাধবীলতা ফুলের এক গুচ্ছ এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
” সে বলেছে, এই ফুল আপনাকে দিলেই আপনি তাকে চিনে যাবেন। ”
দারোয়ান চাচার কথা শোনামাত্রই আমি চট করে উপলব্ধি করলাম, চিঠিটি আর কেউ নয় বরং আদ্রিশ পাঠিয়েছেন। এতে আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম৷ দারোয়ান চাচা যে আদ্রিশের এ কাণ্ডে ভারী মজা পাচ্ছেন তা উনার দাঁত কেলানো হাসি দেখেই টের পেলাম। আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চিঠি নিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে গেস্টরুমে চলে এলাম। কারণ আদ্রিশ হতে প্রাপ্ত এই চিঠি নামক ভয়ংকর কাগজখানা কোনোমতেই আপুর চোখের সামনে আনা যাবে না। এজন্যই নিরাপদ রুম হিসেবে গেস্টরুমে চিঠিটি নিয়ে এলাম।
রুমে এসে দ্রুত কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে চিঠিটা নিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়তেই এই চিঠি নামক বস্তুটি দেখে আমার বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা দ্রিম দ্রিম করে বাজতে শুরু করলো। এক হাতে চিঠির খাম, অপর হাতে মাধবীলতার গুচ্ছ। নির্ভাবনায় আমি চিঠির খামের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। অতঃপর জিহ্বা দ্বারা শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করলাম। ধীরেসুস্থে মাধবীলতার গুচ্ছ পাশে রেখে চিঠির খাম খুলে চিঠিটা বের করলাম। অতঃপর কাগজের ভাঁজ খুলতেই আমার দৃষ্টি গিয়ে আটকালো সম্বোধনে। ‘মাধবীলতা’! নতুন এ সম্বোধনে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। তবে এ বিস্ময়ের মাত্রা কিছু কাটিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম,
” প্রিয় মাধবীলতা,
এ সম্বোধনে কিছুটা অবাক হলেও এটা জানো যে, এ সম্বোধনটা আমি করেছি এবং এই ‘আমি’টা কে সেটাও জানো। তবে হ্যাঁ, এ সম্বোধনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমার জন্য এ সম্বোধনটা কিন্তু গত পরশুই উদ্ভাবন করেছি আমি। সে যাই হোক, আশা করি, আপনি আমার এ পত্র এবং পত্রের সম্বোধনটা মন দিয়ে কবুল করেছেন। অবশ্য কবুল না করেও উপায় নেই তোমার কাছে। তোমায় কিন্তু এ সম্বোধনে আমি সবসময় ডাকবো না। নির্দিষ্ট কিছু সময়ে, কিছু সুযোগ বুঝে ডাকবো।এবার আসি মূল কথায়।
এই চিঠি লেখালেখি কিন্তু আমার দ্বারা খুব একটা হয় না। ছোট বেলায় সেই বাংলা দ্বিতীয় পত্রের চিঠি লিখতে গিয়ে ভীষণ রাগ লাগতো। মন চাইতো, এই ‘চিঠি লেখা’ উদ্ভাবন করা লোকটির মাথা ফাটাই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সেই লোকটি শতবার ধন্যবাদ বলে আসি। কারণ, এ বয়সে একটি মেয়েকে চিঠি লেখার মতো মজার বিষয় আর দ্বিতীয়টি নেই। এ চিঠি লেখার আইডিয়া কিন্তু হুট করে মাথায় আসেনি। মনে আছে, সেদিন কামাল আংকেলের কথা? ব্যস, সেই সূত্র ধরেই আমার চিঠি লেখা।
জানো মাধবীলতা? তোমায় এ নাম দেয়ার কি কারণ? আমার মনে হয় তুমি জানো না। জানবেই বা কি করে? আচ্ছা আমিই বলি। গত পরশু যখন আমার অনুপস্থিতিতে আমার ব্যালকনিতে এসে মাধবীলতা দেখছিলে তখন আমি নিচেই দাঁড়িয়েছিলাম। সে সময় মাত্রই বাড়িতে পা রেখেছি। অমনি আমার ব্যালকনির দিকে দৃষ্টি চলে গেলো। সেখানে দেখলাম, মাধবীলতা ফুলের প্রেমে পড়ে যাওয়া এক যুবতীকে। যার চোখে সে মুহূর্তে বিরাজ করছিলো, অপার মুগ্ধতা, অপার বিস্ময়তা। সে কি এক চাহনি! যেনো রাজ্যের সৌন্দর্য এবং বিস্ময় সে মুহূর্তেই ঐ মাধবীলতার মাঝেই বিরাজ করছিলো। এরপর বারংবার সেই যুবতীর দৃষ্টি মাধবীলতার কাছে ছুটতে যাওয়া দেখলাম। অতঃপর তার হাতে যখন মাধবীলতার গুচ্ছ এলো তখন তার খুশি চোখে পড়ার মতো ছিলো। এরপর সেই যুবতী কি করলো জানো? সেই যুবতী চুলের বাঁধন খুলে মাধবীলতার গুচ্ছ কানের পিছনে গুঁজে নিলো। তার চেহারায় দেখা মিললো অস্পৃশ্য এক খুশি। সাথে তার মুখশ্রী ভরে উঠলো এক অপরূপ স্নিগ্ধতায়। মন চাইছিলো সে মুহূর্তকে থমকে দেই। মন চাইছিলো সেই যুবতীর অদ্ভুত লালিমায় মাখা চেহারাখানা ক্যামেরায় বন্ধি করে রাখি এবং আমি করলামও তাই। আড়ালে সেই যুবতীর স্নিগ্ধ রূপের একটা স্থির দৃশ্য তুলে রাখলাম। তবে অনুমতিহীন এ কাজের জন্য আমি সেই যুবতীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। শুনছো, মাধবীলতা নামক যুবতীটা? আমায় ক্ষমা করে দিও কিন্তু। ক্ষমা করেছো তো? অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু। ”
#চলবে