ভুলবশত_প্রেম,২৪,২৫

0
817

#ভুলবশত_প্রেম,২৪,২৫
#লেখনীতেঃসারা মেহেক
২৪

আমি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ দৃষ্টিতে চিঠির পানে চেয়ে রইলাম। চিঠিতে লেখা প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য আমাকে ভাবনার অতল সাগরে ডুবিয়ে দিলো। সাথে অনুভব করছি, আমার হৃদপিণ্ড পুনরায় তার স্পন্দন গতি বাড়িয়ে তুলছে। আমার কানজোড়া লজ্জায় গরম হয়ে আসছে।
হঠাৎ আপুর ডাক শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে চিঠিটা ভাঁজ করে ফুলসমেত ব্যাগের মধ্যে ডুকিয়ে গেস্টরুম হতে বেরিয়ে এলাম। রুম হতে বেরুতেই আপুর মুখোমুখি পড়ে গেলাম। আপু আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলো,
” গেস্টরুমে কি করছিস তুই? আমি কখন থেকে তোর জন্য ওয়েট করছি!”

আপুর প্রশ্নে আমি শুকনো ঢোক গিলো বললাম,
” না মানে ঐ আর কি আমার একটা জিনিস রয়ে গিয়েছিলো। সেটাই নিতে এসেছিলাম। তুমি ডাইনিং এ যাও আপু। আমি ফ্রেশ হয়ে চলে আসছি।”
এই বলে আপুকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আপুর রুমে গেলাম।

——

বিকেলের দিকে আমার ফোনে হঠাৎ ইমাদ ভাইয়ার কল দেখে খানিক ঘাবড়ে গেলাম। মনের দূর প্রান্তে এক অশনিসংকেতের দেখা মিললো। ফলে কিছুটা ভীতি নিয়ে ইমাদ ভাইয়ার কল রিসিভ করেই সালাম দিলাম। ওপাশে ইমাদ ভাইয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে সালামের জবাব দিয়ে বললো,
” কেমন আছো মিম?”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া? ”

” আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ”
ওপাশে ইমাদ ভাইয়ার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। অতঃপর জিজ্ঞেস করলাম,
” কোনো সমস্যা ইমাদ ভাইয়া? হঠাৎ আমার ফোনে কল করলেন যে?”

ওপাশে এবার ইমাদ ভাইয়ার কণ্ঠস্বর কিছুটা বদলে গেলো। পূর্বের তুলনায় খানিক চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
” তোমার আপু কোথায়?”

” আপু তো ঘুমাচ্ছে ভাইয়া। আপুকে ফোন দিবো?”

” না না। ওকে ফোন দেবার দরকার নেই। তোমার সাথেই কথা বলার জন্য কল করেছিলাম আমি। ”

” হ্যাঁ বলুন ভাইয়া। কি বলবেন।”

” আচ্ছা? নাফিসার ফোনে বা তোমার ফোনে কোনো আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে এ পর্যন্ত? সোজা কথা বললে, রোহান কি আবারো কল করেছে নাফিসাকে?”

এতো দিনে রোহান ভাইয়ার কথা, তার কর্মকাণ্ডের কথা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম আমি। আচমকা ইমাদ ভাইয়ার মুখে উনার নাম শুনে পুনরায় ভয় জেঁকে ধরলো আমায়। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ইমাদ ভাইয়াকে বললাম,
” না ভাইয়া। রোহান ভাইয়ার কোনো কল আসেনি। আপু তো আমাকে এ বিষয়ে কিছু বললো না। তাহলে হয়তো আসেনি। ”

” নাফিসা এ ব্যাপারটা লুকাতেও পারে মিম।”

” না ইমাদ ভাইয়া। এমন কিছুই হয়নি আমি নিশ্চিত। আপুর ফোনো রোহান ভাইয়ার কল আসলেও আপুর চেহারা সুরত দেখে একদম ধরে ফেলতাম আমি। কিন্তু আপু এখনও স্বাভাবিক আছে।”

” তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে ওকে নিয়ে ভয় হয়। যদি হঠাৎ একদিন রোহান কিছু করে বসে?”

ইমাদ ভাইয়ার এ প্রশ্ন আমার মনেও জাগ্রত হলো। তবে নিজেকে এবং ইমাদ ভাইয়াকে সান্ত্বনা দিতে বললাম,
” কিচ্ছু করবে না রোহান ভাইয়া। এতোদিনে এমনকি বিয়ের দিনেও যেহেতু এমন কিছু করেনি সেহেতু আর ভয় নেই। ”

” এতোদিনে কিছু করেনি এর মানে এ নয় যে, সামনেও সে কিছু করবে না। মনে রেখো, ঝড় আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও কিন্তু সবকিছু শান্ত স্বাভাবিক থাকে। ”

ইমাদ ভাইয়ার কথা আমার মাঝে আরো ভীতির সৃষ্টি করলো। আমি শুকনো একটা ঢোক বললাম,
” আপনি চিন্তা করবেন না ভাইয়া। কিছুই হবে না আপুর। আর বাসার সিকিউরিটি তো বাড়িয়ে রেখেছেন তো চিন্তা কিসে?”

” জানি না মিম। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। ভয় হয়, হঠাৎ বড় কিছু না হয়ে যায়। ”

” আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন ভাইয়া। রিল্যাক্স হওয়ার চেষ্টা করুন।”

ওপাশে ইমাদ ভাইয়া প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” আচ্ছা রাখছি মিম। পরে কথা হবে। ”

” আচ্ছা ভাইয়া। ”
ওপাশে ইমাদ ভাইয়ার কল কাটার শব্দ শুনে আমি ফোন রেখে দিলাম। যদিও আমি ইমাদ ভাইয়াকে চিন্তা না করার কথা বলে সান্ত্বনা দিলাম কিন্তু আমি নিজেকে শান্ত করতে পারলাম না। সত্যিই তো, রোহান ভাইয়া হুট করে এতো নিশ্চুপ হয়ে যাবেন তা ভাবিনি আমি। বিয়ের দিন উনি যেভাবে আপুকে অনুরোধ করেছিলো তাতে উনাকে নির্ঘাত পাগলা প্রেমিক বলে মনে হয়েছিলো। আর শেষ কথায় যে হুমকি দিয়েছিলেন তাতে বেশ জোর ছিলো। মনে হয়েছিলো হয়তো সত্যিই উনি কিছু করে বসবেন৷ কিন্তু উনি সেদিন কিছু করেননি। এমনকি এখনো পর্যন্ত কিছু করেননি। আর আপুকেও কল করেননি৷ তাহলে ইমাদ ভাইয়ার কথামতো, এটি কি ঝড় আসার পূর্বের সতর্ক সংকেত? না কি আমরাই অতিরিক্ত ভাবছি?

—-

ঘড়িতে এখন সময় রাত বারোটা। আজ রাতের মেঘমুক্ত আকাশে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির চাঁদ মামার উদয় হয়েছে। পূর্ণিমার মতো পুরো পৃথিবীতে এতো আলো না ছড়ালেও আজ তার আলো বিলিয়ে দেওয়ার মাত্রা কিছু কম নয়৷ আগামীকালের অর্ধেক পড়া শেষ করে রুমের লাইট নিভিয়ে আপুর রুমের ব্যালকনিতে একা বসে আছি আমি। আপু ঘুমের ওষুধ খেয়ে আজ গভীর ঘুমে মগ্ন। রাতের খাবারের কিছু পরেই হঠাৎ আপুর প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা হওয়ায় আপু আজ তুলনামূলক জলদিই ঘুমিয়ে পড়ে। এজন্য এ সময়ে আজ একা একা সময় কাটাচ্ছি।

গ্রিলবিহীন ব্যালকনিতে বসে আজ রাতের পরিবেশটা পুরোপুরি উপভোগ করতেই রুমের লাইট বন্ধ করেছিলাম আমি। কিন্তু ইমাদ ভাইয়াদের গার্ডেনের আলোয় চারপাশ পুরোপুরি অন্ধকার হতে পারেনি। এ নিয়ে আজকে বিদ্যুতের উপর ভীষণ রাগ হলো। একে তো আজকাল প্রয়োজনে সে গায়েব হয় না। উপরন্তু কালেভদ্রে যখন সে গায়েব হয় তখন নিজের পরিবর্তে জেনারেটরকে তার দায়িত্ব দিয়ে যায়। ফলে ভীষণ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আজকাল চাঁদের আলোয় আলোকিত শহরটা উপভোগ করতে পারি না। উফ, কি ঝামেলা!

কানে ইয়ারফোন গুঁজে ব্যালকনিতে বসে মৃদু তরঙ্গের গান শুনছি আমি। এদিকে মানুষের গানের পাশাপাশি নিশুতি রাতের পরিবেশের ঝিঁঝি পোকার গানও শুনছি আমি। দুটো মিলে রাতের গানের পূর্ণাঙ্গ একটি সংমিশ্রণ তৈরী হয়েছে। এ নিশুতি রাতের পরিবেশটা আরো উপভোগ্য করে তুলতে ঘাটতি আছে শুধু বিদ্যুৎ মহাশয়ের গায়েব হওয়ার। অবশ্য সে গায়েব হয়েই বা কি লাভ। নিজের জায়গায় তো তখন জেনারেটর কে বসিয়ে রেখে যায়।
নিজের সাথে নিজেই কথা বলতে বলতে আচমকা ধুপ করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো। তাহলে আমরা মন মোতাবেক অবশেষে বিদ্যুৎ মহাশয় গেলো! ইশ! কিন্তু খুশি হয়ে কি লাভ? এখনই তো ঘটর ঘটর শব্দ করতে করতে জেনারেটর জ্বলে উঠবে।
কিন্তু পাঁচ মিনিট পার হওয়ার পরেও জেনারটের জ্বলে উঠলো না৷ তাহলে কি আজ জেনারেটর নষ্ট হয়ে গেলো! বাহ, আজ দেখি সব আমার মন মতো হচ্ছে! সব নিজের ভাবনা অনুযায়ী চলতে দেখে ভীষণ খুশি খুশি লাগলো মনের মাঝে। ফলে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে চোখজোড়া বন্ধ করে গানের তালে তালে মৃদু গতিতে ব্যালকনির এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে হাঁটতে লাগলাম। আহ, এ পরিবেশ উপভোগ করার যেনো আলাদা এক মজাই আছে।

ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে ব্যালকনির এক কোনে এসে আচমকা কারোর সাথে ধাক্কা লাগতেই আমি চোখ খুললাম। ভাবলাম হয়তো আপু জেগে গিয়েছে। কিন্তু ব্যালকনির সাথে লাগোয়া সুউচ্চ ঝাউ গাছের আঁধারে সামনের ব্যক্তিটির অবয়ব এবং পুরুষালি পারফিউমের ঘ্রাণে চট করে বুঝে ফেললাম সামনের ব্যক্তিটি আপু নয়। বরং অন্য কেউ। ব্যালকনির এ প্রান্তে হঠাৎ উদয় হওয়া আগন্তুক পুরুষ মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ভয়ে আমার ভেতরটা একদম শুকিয়ে এলো। শুকনো ঢোক গিলতেও গলার মাঝে ব্যাথা অনুভব করলাম। আচমকা উদিত এ ব্যক্তিটি কে তা ভাববার পূর্বেই ভয়ে আমার গলা দিয়ে চিৎকার স্বরূপ আওয়াজ বেরুতে চাইলো। কিন্তু এর পূর্বেই আচমকা সেই আগন্তুক আমার কাছে এসে আমার মুখ চেপে ধরলো। ফলে কয়েক কদম পিছিয়ে এলাম আমি। এতে সেই আগন্তুকও আমার সাথে পিছিয়ে এলো। ব্যালকনির এ অংশের আঁধো আলোকিত পরিবেশে আগন্তুকের চেহারা দেখে বিস্ময় এবং ভয়ে আমার চোখজোড়া কোটর হতে বেরিয়ে যাবার উপক্রম হলো।

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

২৫

এভাবে আদ্রিশকে দেখে আমার চোখজোড়া কপালে উঠে যাবার উপক্রম হলো। আমি বড় বড় চোখে উনার দিকে নিমিষের জন্য চাইলাম৷ অতঃপর আমার মুখের উপর থেকে উনার বলিষ্ঠ হাতের তালু সরিয়ে নেবার চেষ্টায় উনার বাহুতে বার কয়েক চাপড় দিলাম। সাথে সাথে উনি ফিসফিস করে বলে উঠলেন,
” ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু চিৎকার তো দূরের কথা জোরে কথা বললেই আবারো এভাবে মুখ চেপে ধরবো কিন্তু। ”

এই বলে উনি আমায় ছেড়ে দিলেন। কয়েক কদম দূরে গিয়ে ব্যালকনির গ্রিলে হেলান দিয়ে বুকের উপর আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ পূর্বে সংঘটিত হওয়া এহেন কাণ্ডে আমি যেমন বিস্মিত হলাম ঠিক তেমনিই রাগান্বিতও হলাম। ফলে মিশ্র কণ্ঠে অনুচ্চ স্বরে বললাম,
” আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে এভাবে স্পর্শ করার?”

আদ্রিশ আমার প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা করলেন না। বরং তরঙ্গায়িত কণ্ঠে বললেন,
” বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সাহস চলে আসে ম্যা-ডা-ম মিশ-মিশ।”

উনার এমন সম্বোধনে আমি সরু চোখে উনার দিকে নিমিষের জন্য চেয়ে রইলাম। পুনরায় বললাম,
” আচ্ছা আপনার সমস্যা কি বলুন তো?”

আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বরং উঠে গিয়ে ধীরেসুস্থে ব্যালকনির থাই গ্লাসটা লাগিয়ে দিলেন। অতঃপর পূর্বের স্থানে ফিরে এসে একইভাবে হেলান দিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ, তো কি যেনো প্রশ্ন করেছিলে?”

আমি খানিকটা রেগে দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁটজোড়া কুঞ্চিত করলাম। অতঃপর উনার মতোই আড়াআড়িভাবে বুকে হাতে রেখে বললাম,
” জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনার সমস্যা কি?”

আদ্রিশ ঠোঁট উল্টে অবুঝ হবার ভান করে বললেন,
” সমস্যা হবে কেনো? কি সমস্যা হবে আমার?”

” সেই প্রশ্নই তো করলাম আমি৷ কি সমস্যা আপনার? ”

” উফ, মিশমিশ! কোথায় এতো কষ্ট করে আসলাম বলে আমার সাথে বসে দুদণ্ড কথা বলবে, তা না করে এতো প্রশ্ন করছো! বড়ই বেদরদি মেয়ে তুমি।”

” এ্যাহ, আমার ঠেকা পড়েছে আপনার সাথে কথা বলার? কোন দুঃখে আমি আপনার সাথে কথা বলবো?”

আদ্রিশ এবার দুঃখে কাতর হবার ভান করে বললেন,
” দেখো এই বেদরদি মেয়ের কথাবার্তা! কোথায় বাড়িতে মেহমান এসেছে, দু চারটা মিষ্টি কথা বলবে তা না করে বাঁকা বাঁকা কথা বলছো!”

আদ্রিশের এহেন কথার ধরণে আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
” মেহমান! সিরিয়াসলি আপনি নিজেকে মেহমান বলছেন! হা হা, আপনি যেভাবে এখানে এলেন তাতে মেহমান নয়, আপনাকে চোরের খেতাব দেওয়া উচিত।”

আদ্রিশ ভীষণ অবাক হবার ভান করে বললেন,
” আমাকে চোর বানিয়ে দিলে তুমি! এতো বেদরদি হলে কি করে!”

উনার মুখে বারংবার “বেদরদি” শব্দটা শুনে ভীষণ বিরক্ত হলাম। ফলস্বরূপ চোখমুখ কুঁচকে বেশ রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম,
” এই আপনার সমস্যাটা কি হ্যাঁ? বারবার এই ‘বেদরদি’ বলছেন কেনো আমাকে? নতুন করে শব্দটা শিখলেন বুঝি?”

” হ্যাঁ। তোমার জন্য শিখলাম৷ শব্দটা ভারী করুনাময় টাইপ না?”
এই বলে উনি ভ্রুজোড়া নাচিয়ে উৎসুকতার সহিত আমার দিকে চেয়ে রইলেন। হয়তো উত্তরের অপেক্ষায়। কিন্তু আমি উনার প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছুক নই৷ বরং এ মুহূর্তে উনি কেনো, কিভাবে এখানে এলেন তা জানতে ইচ্ছুক আমি। ফলে আমি উনার প্রশ্নটি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করলাম,
” এই রাত বারোটায় আপনি কোন দুঃখে এখানে এসেছেন? কি মতলবে? হ্যাঁ?”

আমার প্রশ্নে আদ্রিশ মুহূর্তেই মুখ দিয়ে ‘চ’ উচ্চারণ করার মতো আওয়াজ বের করে বললেন,
” এই মিশমিশ? তোমার এতো দুঃখ আসে কোথা থেকে বলো তো। দুঃখের গোডাউন দিয়ে বসে আছো না কি? কথায় কথায় দুঃখের কথা বলো…..”
আমি মুহূর্তেই আদ্রিশের কথার পাল্টা জবাব দিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম,
” হুম বসে আছি গোডাউন দিয়ে। কেনো? দুঃখের গোডাউন থেকে কিছু দুঃখ লাগবে না কি আপনার?”

আমার প্রশ্নে আদ্রিশ ভীষণ আফসোসের সুরে বললেন,
” লাগবে গো লাগবে। কিছু দুঃখ লাগবে আমার আসলে, একটু ট্রাই করে দেখতাম যে কথায় কথায় এতো দুঃখ পেতে কেমন লাগে। দিবে না কি?”

প্রতিটি কথায় আদ্রিশের এরূপ পাল্টা প্রত্যুত্তর শুনে রাগে আমার শরীর জ্বলতে লাগলো। ফলে প্রচণ্ড রাগে হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে উনাকে বললাম,
” এই ছেলে এই, আরেকটা প্রশ্নের এমন ত্যাড়া জবাব পেলে আমি সত্যি সত্যি এখান থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো কিন্তু।”

আমার কথা শোনামাত্র মাত্র আদ্রিশ বিস্ময়ে চোখজোড়া বড় বড় করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মুখে হাত দিয়ে ভীষণ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
” ইয়া আল্লাহ! কি খুনি মেয়েরে বাবা! দিনেদুপুরে মার্ডারের হুমকি দেয়! ”

আমি পূর্বের মতোই বললাম,
” এখন দিনদুপুর না। গভীর রাত। আর আপনি যেমনটা শুরু করেছেন, তাতে হুমকি না দিয়ে বরং ডিরেক্ট একশনে আসা উচিত ছিলো।”

আদ্রিশ এবার বাঁকা হেসে বললেন,
” বারণ করেছে কে? ফেলে দিতে ইচ্ছে হলে ফেলো। আই হ্যাভ নো প্রবলেম। তবে মনে রেখো, আমি পড়লে তোমায় নিয়েই পড়বো। ”
এই বলে উনি বিড়বিড় করে কিছু বললেন। কিন্তু আমার কান অব্দি তা এলো না। আমি বরং পূর্বের ন্যায় বললাম,
” ক্ষতি কিন্তু আপনারই বেশি হবে। ”

আদ্রিশ মুচকি হেসে বললেন,
” কবুল আছে রাণী সাহেবা।”

উনার এ মুচকি হাসিও এ মুহূর্তে সহ্য হলো না আমার। উনার প্রতিটা প্রত্যুত্তর শুনে ধৈর্য সীমা ধীরে ধীরে অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি মনটা বলছে, এক ধাক্কায় ব্যালকনি থেকে উনাকে ফেলে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলি৷ এদিকে ক্ষণে ক্ষণে আপুর জেগে উঠার ভয়ে বুকটা ধুকপুক ধুকপুক শব্দ করে বেড়াচ্ছে। এদিকে আদ্রিশ খামখেয়ালি মেজাজে চারপাশে চেয়ে চেয়ে দেখছেন। আমি উনার এ নিশ্চিন্ত ভাবখানা দেখে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠাণ্ডা স্বরে বললাম,
” আর এক মিনিটের মাঝে যদি আপনি এখান থেকে না যান তাহলে আমি এক ডাকে আপুকে ঘুম থেকে তুলে ফেলবো। সো নিজের ভালো চাইলে চুপচাপ কেটে পড়ুন এখান থেকে। ”

আদ্রিশ আমার কথা শুনে নিশ্চিন্তভাবে একটা হাসি দিলেন। অতঃপর ভ্রু নাচাতে নাচাতে বাঁকা হেসে বললেন,
” আচ্ছা? তাই বুঝি? ঠিক আছে সাহস থাকলে ডাকো। তবে মনে রেখো,আমার সাথে তুমিও ফাঁসবে। ”

আদ্রিশের কথা শুনে এ মুহূর্তে কপাল চাপড়াতে মন চাইলো আমার। রাগে ক্ষোভে কান্না করার উপক্রম হলো আমার। উনার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে শেষমেশ করুন চাহনিতে উনার দিকে চেয়ে অসহায় গলায় বললাম,
” দয়া করুন আমার উপর। দয়া করুন৷ আর পারছি না আপনার কথার জবাব দিতে৷ এবার এখানে আসার কারণটা বলে চুপচাপ বিদায় হোন। যদি এ বাড়ির লোকেরা কোনোভাবে আপনার উপস্থিতির কথা টের পায় তাহলে আমার মান সম্মান কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না৷ ”

আদ্রিশ আমার কথা শুনে বিস্তৃত হেসে বললেন,
” ওকে ওকে বলছি। একটু আগে রিকুয়েষ্ট করলেই তো হতো!”

আমি উনার কথায় ভীষণ অবাক হয়ে বললাম,
” এর মানে কি আপনি আমাকে রিকুয়েষ্ট করানোর জন্য এতোক্ষণ ঘুরাচ্ছিলেন?”

আদ্রিশ এর জবাব দিলেন না। বরং ঠোঁটের কোনে এমন এক হাসি ঝুলিয়ে রাখলেন যাতে স্পষ্ট বুঝে ফেললাম উনি ইচ্ছে করেই এমনটা করেছেন। এ জানার পরও খুব কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে চুপচাপ উনার জবাবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম৷ উনি আমায় অপেক্ষারত অবস্থায় দেখে গর্বের সহিত হেসে বললেন,
” এডভেঞ্চার মিশমিশ। এডভেঞ্চার। ”

আদ্রিশের এ জবাবের অর্থোদ্ধার করতে না পারায় আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” মানে?”

আদ্রিশ এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। অতঃপর হালকা গলা পরিষ্কার করে বললেন,
” এডভেঞ্চার এর একটা ফিল নিতে এসেছি মিশমিশ। তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না ঠিক কি পরিমাণে এঞ্জয় করেছি এই এডভেঞ্চারে ভরপুর মোমেন্টগুলো।”

আদ্রিশের কথা শুনে আমার হাত কপালে তোলার জোগাড়। বিস্ময়ে আমার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে এলো। আমি হতবাক হয়ে বললাম,
” এই রাত বারোটায় আপনি এডভেঞ্চারের ফিল নিতে এখানে এসেছেন! সিরিয়াসলি! নিশ্চিত আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ল্যাবের জটিল জটিল রিয়েকশন সলভ করতে করতে আপনি নিশ্চিত পাগল হয়ে গিয়েছেন। ”

আদ্রিশ আমার কথা শুনে মন খুলে হাসলেন। অতঃপর বললেন,
” তা তো অনেক আগেই হয়েছি। ”

” কি?”

আদ্রিশ আমার প্রশ্নে মৃদু হেসে বললেন,
” পাগল হয়েছি। এনি ডাউট?”

উনার কথার সম্মতি স্বরূপ আমি দৃঢ়চিত্তে বললাম,
” উঁহু। একটুও ডাউট নেই যে আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন। জরুরি ভিত্তিতে আপনার মাথার স্ক্রুগুলো টাইট করতে হবে। ”

আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই আদ্রিশ ব্যালকনির রেলিঙে হেলান দিয়ে আমার দিকে মাথা ঝুকিয়ে বললেন,
” করে দাও। ডাক্তার সাহেবার স্পর্শে একটু সুস্থ হয়ে উঠি। আর ভালো লাগে না এমন থাকতে। কেমন যেনো অস্থির অস্থির অনুভব হয় সবসময়। মাঝে মাঝে তো চারপাশ শূন্য মনে হয়৷ স্পষ্ট অনুভব করি কারোর শূন্যতা। মনে হয়…. ”

আদ্রিশের এরূপ কথাবার্তায় কিঞ্চিৎ অস্বস্তি অনুভব করায় উনাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলাম,
” আপনি এখানে কিভাবে এসেছেন?”

আদ্রিশ এবার মাথা তুলে আমার দিকে চাইলেন। লঘু নিঃশ্বাস ছেড়ে সদর্পে বললেন,
” প্রাচীর টপকে এসেছি।”

উনার কথায় পুনরায় মাথায় হাত তোলার জোগাড় হয়ে এলো আমার। আমি আরেকদফা বিস্মিত হয়ে বললাম,
” প্রাচীর টপকে! গেট কি হয়েছিলো? বাসার আশেপাশের সিকিউরিটিরা কোথায় ছিলো? আর দারোয়ান চাচাই বা কোথায় ছিলেন?”

আদ্রিশ পুনরায় সদর্পে বলে উঠলেন,
” আমি কি রোহান না কি যে সিকিউরিটিরা আমায় আটকাবে? রইলো, দারোয়ান চাচা, সে তো ঘোড়া বেচে ঘুমাচ্ছেন৷ আর তুমিই বলো, গেট দিয়ে আসলে কি এই এডভেঞ্চার ফিল পেতাম?”

” উফ, আপনার এডভেঞ্চার! এই অসময়ে কে এডভেঞ্চার করে! আচ্ছা, তারপর কি করে এলেন?”

” প্রাচীর টপকে নিচের খোলা জানালার গ্রিল বেয়ে সানসেটের উপর এসেছি৷ তারপর সেই সানসেট দিয়ে এ রুমের জানালা বেয়ে ব্যালকনিতে এসেছি। কিন্তু আসার সময় এই বজ্জাত ক্রিসমাস ট্রি বেশ কয়েকটা খোঁচা মেরেছে। ”
এই বলে উনি নিজের বাহুতে হাত ঘষতে লাগলেন। আমি এতে বেশ মজা পেয়ে বললাম,
” ঠিক হয়েছে। একদম উচিত শিক্ষা হয়েছে আপনার। কি মানুষ আপনি হ্যাঁ? শুধু এক এডভেঞ্চারের জন্য এখানে এভাবে উঠে এসেছেন!”

আদ্রিশ হাত দুটো পুনরায় বুকের উপর রেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। অতঃপর ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
” তোমায় কে বলেছে শুধুমাত্র এডভেঞ্চারের জন্যই এখানে এসেছি আমি?”
মুহূর্তেই যেনো আদ্রিশের স্বরভঙ্গি পাল্টে গেলো৷ উনার এরূপ স্বরভঙ্গিতে আমি খানিক সংকুচিত হলাম। শুকনো একটা ঢোক গিলে নিজের ভেতরকার অবস্থা লুকানোর চেষ্টায় বললাম,
” না মানে আপনার কথাবার্তা শুনেই বুঝে গিয়েছি।”

আদ্রিশ মৃদু শব্দে হেসে বললেন,
” তাহলে মানুষ যা বলে তাতেই বিশ্বাস করো তুমি?”

উনার এ প্রশ্নের জবাব দিতে ব্যর্থ হলাম আমি৷ ফলে কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে বললাম,
” আচ্ছা, অনেক হয়েছে আপনার এডভেঞ্চার। এবার ভদ্র ছেলের মতো চলে যান। ”

আদ্রিশ আমার কথা শুনে বাঁকা হাসলেন। পা নাচাতে নাচাতে বললেন,
” ভদ্র হওয়ার ইচ্ছে নেই আপাতত। অভদ্র হয়েই চলতে ইচ্ছুক আমি৷ ”

আদ্রিশের বাঁকা ত্যাড়া কথা, প্রতিটা কথার প্রত্যুত্তর দেওয়া, সেই কখন থেকে একভাবে এখানে থাকা, সব দিয়ে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে একাকার হয়ে গিয়েছে। এ মুহূর্তে না পারছি চিৎকার করে রাগ জাহির করতে, আর না পারছি সইতে৷ পরিস্থিতির শিকারে অসহায় হয়ে আমি এ পর্যায়ে চোখজোড়া বন্ধ করে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” শুনুন, অনেক শুনেছি আপনার প্যানর প্যানর। আপনার সাথে এতো কথা বলতে বলতে আমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। ঘুম নষ্ট হয়েছে। মেজাজ খারাপ হয়েছে। মোটকথা, আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে।”

আমার একটা কথাও উনি গায়ে মাখলেন না এমন ভঙ্গিতে বললেন,
” আচ্ছা? ক্ষতি কি শুধু তোমারই হয়েছে? আমার যে কতো ক্ষতি হয়েছে সেসবের ক্ষতিপূরণ কে দিবে শুনি?”

” আপনার ক্ষতির জন্য আমি দায়ী নই। আপনিই দায়ী। আর আমার যে ক্ষতি হয়েছে সেটার ক্ষতিপূরন আমি চাইছি না। আমি শুধু চাই আপনি দয়া করে এখান থেকে চলে যান৷ হুট করে বিদ্যুৎ চলে আসলে বিপদে পড়ে যাবো আমি।”

” এ এলাকায় বিদ্যুৎ আসতে সময় নেয় অনেক। আর রইলো জেনারেটর এর কথা। সে বেটাকে তো আমি সকালেই নষ্ট করে দিয়েছি।”

পুনরায় আমি উনার কথায় বিস্মিত হলাম৷ আজ বোধহয় উনি আমায় চমকে দিতে দিতে আমার কেল্লা ফতে করে দিবেন। জেনারেটর নষ্ট করার কথা শুনে একদিকে যেমন রাগও হলো এবং তেমনি এ রাগকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারলাম না আমি। ফলস্বরূপ সে রাগ উনার সামনে জাহির করে বললাম,
” এই ছেলে এই, সমস্যাটা কি হ্যাঁ? আর কতো কীর্তিকলাপের কথা শুনবো আমি? প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে কিন্তু আমার….”

আদ্রিশ আমার কথায় চট করে উঠে দাঁড়ালেন। ঠোঁট উল্টে চমকপ্রদ হেসে বললেন,
” সম্বোধনটা পছন্দ হয়েছে। কি মিষ্টি শোনা যায়! আহা!”
এই বলে উনি স্বগতোক্তি করে বললেন,
” এই ছেলে এই, বাহ! আই লাইক ইট।”

ব্যস এটুকুই বলেই উনি হেঁটে ব্যালকনির কোনায় চলে গেলেন। হয়তো এখন উনি চলে যাবেন৷ অবশেষে স্বস্তি এবং শান্তির দেখা পাবো আমি৷
সত্যি সত্যিই উনি আমার এ ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করে রেলিঙের ওপাশে পা রাখলেন। অতঃপর এ রূমের জানালার গ্রিলে পা রাখার পূর্বে আমাকে ডাকলেন। আমি চোখমুখ কুঁচকে ব্যালকনির মাঝখান হতে হেঁটে গিয়ে উনার সামনে দাঁড়ালাম। উনি আমায় অগ্রসর হতে দেখে মুচকি হাসলেন। অতঃপর কথা নেই বার্তা নেই, হুট করে আমার নাক টেনে বললেন,
” থ্যাংক ইউ এংরি বার্ড। আমাকে সময় দেওয়ার জন্য৷ থ্যাংক ইউ ডক্টর আমার রোগের সাময়িক চিকিৎসা করার জন্য। ”
এই বলে উনি আমার নাক ছেড়ে দিয়ে মনোমুগ্ধকর হেসে বললেন,
” আজকের রাতটা কখনো ভুলবো না আমি মিশমিশ। কোনো একদিন হয়তো স্মৃতির পাতা হাতড়ে পাবো, আঁধো আঁধারে মাখা রজনীতে জীবন্ত এক মাধবীলতাকে অতি নিকট থেকে অনুভব করেছি আমি। তার রাগে কুঞ্চিত নাকটা, চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভীষণ বিরক্তিত হওয়া চোখজোড়া বারংবার নতুন করে উপভোগ করেছি আমি৷ সব কষ্ট যেনো সার্থক আমার। সব কষ্ট……. ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here