ভুলবশত_প্রেম,২৬,২৭

0
817

#ভুলবশত_প্রেম,২৬,২৭
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২৬

গতকাল রাতের ঘটনার পর হতে আমি আদ্রিশের ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই উনি আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু আমি? সত্যি বলতে আমি উনার অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হলেও নিজের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হতে পারলাম না। আমি নিজেও উপলব্ধি করতে পারলাম না উনায় নিয়ে আমার মাঝে আদৌ কোনো অনুভূতির উদ্রেক ঘটেছে কি না। অদ্ভুত এ ব্যাপারটার কারণও ঠিক উপলব্ধি করতে পারলাম না। যেনো, আমি নিজের বেলায় সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছি।
তবে উনি যে আমায় পছন্দ করেন তা আমি মেনে নিয়েছি এবং এ ঘটনাটাকে এখানেই শেষ করে দিতে চাইছি। কারণ উনার সাথে আমার ভবিষ্যত কল্পনা করা সত্যি বলতে অসম্ভব। এর অবশ্য কারণও আছে। প্রথমত, উনাদের ক্লাস আর আমাদের ক্লাসের পার্থক্য। উনারা যেখানে হাই সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত, সেখানে আমরা মিডেল ক্লাস সোসাইটির মধ্যে পড়ি। আপুকে এমন পরিবারে বিয়ে দিয়ে আব্বু আম্মু শিক্ষা নিয়ে নিয়েছে। ফলে আমার ব্যাপারে কিছুতেই এ বিয়েতে তারা রাজি হবে না৷ আমি নিজ চোখে দেখেছি, আপুর বিয়ের সময় আব্বু আম্মুর উপর দিয়ে কি পরিমাণ মানসিক অত্যাচার গিয়েছে! যদিও ইমাদ ভাইয়াদের পরিবার অত্যন্ত ভালো। তবুও মেয়েপক্ষ বলে কথা! অন্তত সমাজের সামনে যেনো ছোট হতে না হয় সেজন্যই কত আয়োজন! উপরন্তু, আপুকে শোনানো আনোয়ারা দাদির সেই খোঁটাসম্পন্ন কথাগুলো! আবার হলুদের দিনের সে ঘটনার পর হতে আনোয়ারা দাদি আদ্রিশকে ভালো চিনেন না৷ হয়তো এমন আরো অনেকেই আছে। সব দিক বিবেচনায় আদ্রিশের সাথে আমার ভবিষ্যত জীবন কল্পনা করাও অসম্ভব। অতএব, এখন হতে আদ্রিশের নিকট হতে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে উনাকে উপেক্ষা করার চিন্তাভাবনা করে মনস্থির করলাম।
এ নিয়ে চিন্তা করার কারণে আজ ক্লাসগুলোতেও ঠিকমতো মনোযোগী হতে পারিনি৷ ফলস্বরূপ মেজাজ প্রচণ্ড খিটখিটে হয়ে আছে আমার।

এই খিটখিটে মেজাজ নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে বাসায় যাবার জন্য রিকশা ডাকতেই কোথা হতে যেনো রিতু এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো। আচমকা রিতুকে দেখে রোহান ভাইয়ার কথা মনে পড়লো৷ এদিকে রিতু হাস্যজ্জ্বল চেহারায় আমায় জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছিস দোস্ত?”

বহুদিন পর রিতুকে দেখে খানিক অবাক হলাম। তবুও স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললাম,
” আলহামদুলিল্লাহ আপু আছি। তুই কেমন আছিস?”

” আমিও ভালো আছি। ভেবেছিলাম নাফিসা আপুর বিয়েতে তোর সাথে দেখা হবে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে যেতে দিলো না। ”

রিতুর কথায় চট করে আমার মনে সন্দেহের বাতি জ্বলে উঠলো। ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কেনো? রোহান ভাইয়া তোকে আসতে দিলো না কেনো?”

” কি জানি। ভাইয়া আমায় বললে তো! আমি বিয়েতে যাওয়া নিয়ে ভাইয়ার কাছে পারমিশন চাইতেই ভাইয়া এক বাক্যে না করে দিলো। আর তুই তো জানিসই, আব্বু আর ভাইয়াকে আমি কি পরিমাণ ভয় পাই! ভাইয়া যেখানে একবার নিষেধ করে দিয়েছে সেখানে আমার দ্বিতীয় কথা বলার সাহস নেই। ”

রিতুর কথা শুনে আমি আর কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করলাম না। রিতু পুনরায় বললো,
” চল, আমাদের বাসায় চল। অনেকদিন আসিস না।”

রিতুর কথায় আমার মাঝে কেমন যেনো ভয় চেপে বসলো। আমি চট করে বলে উঠলাম,
” আরে না না। এখন যাবো না। অন্য কোনোদিন যাবো। ”

” সে কি! একই এলাকায় বাসা থাকার পরও এ কথা বললে মানা যায় না। ”

” আমি এখন বাসায় নাইরে রিতু। গত ৩/৪ দিন যাবত আপুর শ্বশুরবাড়িতে আছি। ভাইয়া একটু বাইরে গিয়েছে তো তাই আমাকে নিয়ে গিয়েছে। ”

” তো? যাই বলিস না কেনো, আজ আমি তোর কোনো এক্সকিউজ মানবো না। আজ আমার সাথে যেতে হবে মানে যেতেই হবে। আজকের দুপুরের খাবার আমাদের বাসায়েই খেতে হবে। আর কিছু শুনতে চাই না আমি। ”
এই বলে রিতু আমার হাত ধরে রাস্তার ওপারে গিয়ে ওদের প্রাইভেট কারে উঠতে বললো। অগত্যা রিতুর জোরাজোরিতে ওর সাথে না পেরে কারে উঠে বসলাম। কার স্টার্ট দিতেই রিতুর মুখের বুলি ফুটতে শুরু করলো।

.

আমাদের শহরের এমপি হওয়ার দরুন রিতুর বাবার বিলাসিতার অভাব ছিলো না। একই এলাকায় কিন্তু দুটো বিপরীত রাস্তায় আমাদের দুজনের বাসা অবস্থিত। স্কুলে থাকা অবস্থায় প্রায়শই রিতু আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসতো। এ নিয়ে অবশ্য তখন আম্মুর কাছে খুব করে বকা শুনতাম। কিন্তু তখন রিতু আমার বেস্টফ্রেন্ড হওয়ায় এ নিয়ে ওকে কিছু বলতে পারিনি।
আজ বহুদিন রিতুদের বাসায় এসে সব নতুন নতুন লাগলো। বাসায় এসেই রিতু আমাকে তার রুমে বসিয়ে নিচে খাবারের আয়োজন করার কথা বলতে চলে গেলো। এদিকে রুমে একা একা বসে থাকায় বিরক্ত অনুভব করায় ওর রুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। দ্বিতীয় তলায় রিতুর রুমের এক রুম পরেই রোহান ভাইয়ার রুম। হাঁটতে হাঁটতে রোহান ভাইয়ার রুমের কাছে আসতেই রুম হতে উচ্চস্বরে উনার কণ্ঠ এবং অপরিচিত এক ছেলের কণ্ঠ শুনতে পেলাম৷ দুজনেই ফোনে লাউড স্পিকারে কথা বলছেন। উনাদের কথার মাঝেই হঠাৎ আদ্রিশের নাম শুনতেই আমি চমকে উঠলাম। ফলে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করে রোহান ভাইয়ার রুমের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য আদ্রিশকে নিয়ে উনারা কি কথা বলছেন তা সম্পর্কে জানা।
দরজার এপারে আড়ি পাততেই রোহান ভাইয়ার কণ্ঠে শুনতে পেলাম,
” আমি ডিলের কথা ভুলিনি মিস্টার ইকবাল। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ”

রোহান ভাইয়ার মুখে মিস্টার ইকবালের নাম শুনতেই আমার বুকটা ধক করে উঠলো। রোহান ভাইয়ার মুখে মিস্টার ইকবালের নাম শুনে আমার মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হলো। অনেকটাই নিশ্চিতভাবে ধরে নিলাম, আদ্রিশের মুখে যে মিস্টার ইকবালের নাম শুনেছি, ফোনের ওপাশের লোকটিই সেই মিস্টার ইকবাল। তবে রোহান ভাইয়া, আদ্রিশ ও মিস্টার ইকবালের মাঝে কি যোগসূত্র থাকতে পারে তা আন্দাজ করতে পারলাম না। পুরো বিষয়টা জানতে আমি পুনরায় রোহান ভাইয়ার কথোপকথন শুনতে আগ্রহী হলাম। ফোনের ওপাশে মিস্টার ইকবাল কিছুটা তেজস্বরে বললেন,
” আমার মনে হয় না আপনি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনটা করলে এক ফর্মুলা নিতে এতোদিন সময় লাগতো না। আপনি হয়তো ডিলটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। ”

” এমনটা মোটেও না মিস্টার ইকবাল। আমি আমার দ্বিতীয় লোক লাগিয়ে দিয়েছি আদ্রিশের ল্যাবে। এটা ঠিক যে, আমার কিছু ভুলের জন্য প্রথম ইনফর্মার প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার আমি সেরকম ভুল করিনি। এবার মেপে মেপে পা ফেলছি আমি। ”

” সে তো দেখছিই, কত মেপে মেপে পা ফেলছেন আপনি৷ ”

” এ কাজটা করার জন্য আমাকে একটু সময় তো দিতে হবে মিস্টার ইকবাল। ড্রাগটার ফর্মুলা আদ্রিশ কোথায় কিভাবে রেখেছে তা ওর মাধ্যমেই বের করাতে হবে। এজন্য আমরা একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছি। আমি চাইছি যে, সাপও মারবো কিন্তু লাঠিও ভাঙবে না। ”

” যাই করেন মিস্টার রোহান। আমি দ্রুত রেজাল্ট চাই। আমি আর দু মাসের মধ্যেই সুইজারল্যান্ড ব্যাক করবো। এর মাঝেই সব কাজ হওয়া চাই আমার।”

” জি বুঝেছি আপনার কথা। ফর্মুলাটা যেমন আপনার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট তেমনি আমার জন্যও ইম্পর্ট্যান্ট। যাস্ট আমার লোকের সাহায্য রিসার্চ পেপারটা কোনোমতে বের করাতে হবে। কিন্তু আপনি হয়তো এতোদিনে বুঝেই গিয়েছেন যে আদ্রিশ গভীর জলের মাছ। এতো সহজে সে আমাদের কাছে ধরা দিবে না। ”

” জি তা তো বুঝেই গিয়েছি। আচ্ছা, আপনি কি নিশ্চিত, মিস্টার আদ্রিশ আমাদের দুজনার মধ্যকার ডিল সম্পর্কে কিছু জানে না?”

” জি আমি একদম নিশ্চিত মিস্টার ইকবাল। আপনিও নিশ্চিন্তে থাকুন। তবে কাজের মাঝে হয়তো আপনার কিছু হেল্প লাগতে পারে। ”

” জি জি। এ নিয়ে আপনি টেনশন করবেন না। আপনি শুধু কাজটা শেষ করুন। তাহলে আজ রাখছি।”

” আচ্ছা। তাহলে পরে কথা হবে। ”
এই বলেই রোহান ভাইয়া কল কেটে উনার রুমের অপর মানুষটাকে বললেন,
” তুই আরো খোঁজ খবর কর এ নিয়ে। কাজটা খুব দ্রুতই সারতে হবে আমাদের। ”

রোহান ভাইয়ার কথায় আগন্তুক সায় দিয়ে বললো,
” হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। আপাতত এ নিয়ে টেনশন বাদ দে। চল একটু বাইরে ঘুরে আসি। ”

আগন্তুকের কথা শোনামাত্র আমি ত্রস্ত পায়ে রোহান ভাইয়ার রুমের সামনে থেকে চলে এলাম। দ্রুত রিতুর রুমে গিয়ে বসতেই অনুভব করলাম, আমার হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন গতি। রোহান ভাইয়া ও মিস্টার ইকবালের কথোপকথন শোনার পর এটা বুঝতে বাকি রইলো না যে, আদ্রিশ ও রোহান ভাইয়ার মাঝে প্রফেশনাল শত্রুতা কি নিয়ে তৈরী হয়েছে। তবে আমি এটা জানতে পারলাম না, আদ্রিশ কোন ফর্মুলা তৈরী করেছেন যার জন্য মিস্টার ইকবাল ও রোহান ভাইয়া উনার পিছে পড়ে আছেন। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, উনি কোনো ছোটখাটো ড্রাগ ফর্মুলা তৈরী করেননি। এমনটা হলে মিস্টার ইকবাল দেশের বাইরে থেকে এসে এ নিয়ে লাফালাফি করতেন না। নিশ্চয়ই বড় কিছুর সম্পৃক্ততা আছে সেই ফর্মুলার সাথে । যার পিছনে উনারা পড়ে আছেন।

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

২৭

রোহান ভাইয়াদের বাসা হতে বেরিয়েছি বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে। রিতুর জোরাজোরিতে কোনোমতে দুপুরের খাবার খেয়েই বেরিয়েছি। ইচ্ছা ছিলো, বাসায় গিয়ে আব্বু আম্মু আর আভার সাথে দেখা করে আসবো৷ কিন্তু তখন রোহান ভাইয়া ও মিস্টার ইকবালের কথোপকথন শুনে এখনো অব্দি আমার মন কিছুতেই শান্ত হতে চাইছে না৷ এমতাবস্থায় বাসায় গেলে আম্মুর কাছে নির্ঘাত ধরা খেয়ে যেতাম। আমার মুখমণ্ডলে চিন্তার ছাপ দেখেই প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিত আম্মু, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব হতে বাঁচতেই বাসার ত্রিসীমানার মাঝেও যাইনি। এখন আমার গন্তব্য ইমাদ ভাইয়াদের বাড়ি। রোহান ভাইয়াদের বাসায় থাকা অবস্থায় আপু ফোন দিলে আপুকে মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য হই। কারণ আপু এ বাসায় থাকবার কথা শুনতে পেলে নির্ঘাত নানা ধরনের চিন্তায় মাথা ব্যাথা নিয়ে বসে থাকবে।

রোহান ভাইয়াদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথচারী রাস্তা দিয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে চলছি আমি। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রোহান ভাইয়া ও মিস্টার ইকবালের কথোপকথন। এপার ওপার নানা চিন্তাভাবনায় মাঝে মাঝে মাথায় শূন্যতা অনুভব করছি। যখন কিছুতেই এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করতে পারলাম না তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, এ নিয়ে আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করবো৷ কারণ, উনার সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা না করা অব্দি আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারবো না। কিন্তু আজই যে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি উনার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবো, সে সিদ্ধান্তের কি হবে?
এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে অবশেষে মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্ধারিত করলাম, আজ উনার ও রোহান ভাইয়ার এ শত্রুতার কারণ জেনে তবেই বাকি সিদ্ধান্তে অটল হবো। আপাতত বাসায় গিয়ে উনার সাথে দেখা করাই আমার মূখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হলো।

বেশ কিছুদূর আসবার পর হঠাৎ আমার পাশে আচমকা একটি গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ঘাবড়ে গেলাম। তবে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে আদ্রিশকে দেখে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলাম। আমায় দেখে আদ্রিশ দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
” ভয় পেয়েছো না?”

আমি প্রতিক্রিয়াহীন সরু চোখে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর বললাম,
” আপনার উদ্দেশ্যই ছিলো আমায় ভয় দেখানো। ঠিক না?”

আদ্রিশ এবার স্বাভাবিক হয়ে বললেন,
” মোটেও না৷ আমার এ উদ্দেশ্য ছিলো না। আমার উদ্দেশ্য হলো, তোমার সাথে কিছু কথা বলার। তো, ম্যাডামের কি সময় হবে?”

আদ্রিশের কথা শোনার পর মনে হলো, যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি এসে নামলো আমার কাছে। আমি তৎক্ষনাৎ বলে ফেললাম,
” জি হবে। আমারও আপনার সাথে কথা আছে। কোথায় যাবেন? চলুন।”

আমার কথা শোনামাত্র খুশিতে আদ্রিশের চোখ চকচক করতে লাগলো। উনি হাস্যজ্জ্বল চেহারায় বললেন,
” এতো ইজিলি তুমি রাজি হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। যাই হোক, গাড়িতে উঠে বসো এণ্ড অবভিয়েসলি পেছনের সিটে বসবে না৷ আমি তোমার ড্রাইভার রূপে পরিচিত পেতে চাই না। আমার পাশে এসে বসো। ”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি ভীষণ অবাক হলাম৷ কারণ আমি মনে মনে এ উদ্দেশ্য নিয়েই গাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিলাম যে, গাড়ির পিছনের সিটেই বসবো আমি। কিন্তু আদ্রিশের আদেশ পেয়ে কোনো কথা না পেয়ে আমি চুপচাপ উনার পাশে এসে বসে পড়লাম। অতঃপর আদ্রিশ এক নজর আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

সদ্য বিকেলের তেজহীন রোদেলা পরিবেশ ঈষৎ সোনালী আভায় ছেয়ে আছে। গাড়ির জানালা পেরিয়ে শো শো হাওয়া প্রবেশ করছে ভেতরে। এ হাওয়ায় খানিক শীতল অনুভূতি সৃষ্টি হলেও তা যেনো বদ্ধ মনের দুয়ার খুলে দিতে সক্ষম হলো। আমি জানালা পেরিয়ে বাইরের পরিবেশ উপভোগ করতে করতে কল্পনায় আদ্রিশের সাথে সকল কথোপকথন সাজিয়ে ফেললাম। এখন শুধু উনাকে আমার প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া বাকি রইলো।

দশ মিনিটের মাঝেই আমরা একটি রূফটপ রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছে গেলাম৷ পুরো রাস্তায় আদ্রিশ আমার সাথে কোনো কথা বললেননি। আমিও আগ বাড়িয়ে উনার সাথে কথা বলিনি। আমায় গাড়ি হতে নামিয়ে দিয়ে উনি গাড়ি পার্ক করতে গেলেন। দু মিনিটের মাঝেই গ্রাউন্ড ফ্লোরে ফিরে এসে উনি আমায় নিয়ে দোতালায় উঠলেন। খুঁজে খুঁজে কোনার দিককার একটি টেবিলে গিয়ে বসলেন আমায় নিয়ে। আমাদের বসবার কিছুক্ষণের মাঝেই একজন ওয়েটার এসে ওর্ডার নিয়ে চলে গেলেন৷ অতঃপর আদ্রিশ মুচকি হেসে বললেন,
” তো, কি নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলে তুমি? আগে তুমি বলো। এরপর আমার কথা বলবো আমি। ”

সুযোগ সন্ধানী আমি আদ্রিশের কথা শোনামাত্র উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি কি ড্রাগ তৈরী করেছেন যার জন্য রোহান ভাইয়া আর মিস্টার ইকবালের সাথে আপনার শত্রুতা হয়েছে? ”

আমার প্রশ্ন শোনামাত্র আদ্রিশের ওষ্ঠদ্বয় হতে সেই মুচকি হাসি উবে গেলো। মুহূর্তেই উনার চেহারা পাংশুটে বর্ন ধারণ করলো। উনি যে আমার নিকট হতে এ ধরণের প্রশ্ন আশা করেননি তা উনার হাবভাব দেখেই বুঝতে পারলাম আমি। উনি আমার দিকে চেয়ে হতভম্ব হয়ে বললেন,
” তুমি মিস্টার ইকবালের নাম জানলে কি করে?”

আমি উনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম,
” সে ব্যাপারে আপনার না জানলেও চলবে। আপনি শুধু আমার প্রশ্নের জবাব দিন। ”

মুহূর্তেই যেনো আদ্রিশের চাহনি শক্ত হয়ে এলো। উনার এ চাহনিতে আমি মৃদু ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে শক্ত রেখে পুনরায় একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। উনি এবার চোয়াল শক্ত করে বললেন,
” কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আর মিস্টার ইকবালকে কিভাবে চিনলে তা বলো। ”

আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম,
” আজ রোহান ভাইয়াদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ফোনে উনাকে আর মিস্টার ইকবালকে কথা বলতে শুনেছি৷ ”

আদ্রিশ শক্ত চাহনিতে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি বলেছে ওরা?”

” এই যে, আপনার কাছ থেকে সেই ড্রাগের ফর্মূলা নিবেন উনারা। আপনাদের কোম্পানিতে একজন স্পাইও রেখেছেন মেবি।”

আদ্রিশের চেহারা সুক্ষ্ম চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো। উনি ঠোঁট কামড়ে খানিক আতংকিত সুরে বললেন,
” এর মানে রোহান আর মিস্টার ইকবাল একসাথে ডিল করেছে!”

” হ্যাঁ। উনারা আপনার কাছ থেকে সেই ফর্মুলা চায়। এবার আমায় বলুন, এমন কি আছে ঐ ফর্মূলায় যার জন্য মিস্টার ইকবাল সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে এসেছেন?”

আদ্রিশ খানিক সময় নিয়ে চিন্তিত হয়ে টিস্যু ট্রে হতে একটি টিস্যু নিয়ে মুচড়াতে লাগলেন। উনি বিড়বিড় করে কিছু বললেনও। তবে কি বললেন তা উনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,
” প্লিজ আমায় বলুন, কি চলছে আপনাদের তিনজনের মাঝে। এ নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমার মাথা ধরে গিয়েছে। ”

আমার কথা শোনামাত্র আদ্রিশ চট করে দৃষ্টি তুলে চাইলেন আমার দিকে। আমাকে বিস্মিত করে উনি চেহারায় পূর্বের ভাবখানা ফিরিয়ে আনলেন। এ মুহূর্তে উনায় দেখে কখনোই বলা সম্ভব নয় যে উনি কিছুক্ষণ পূর্বেই ভাবনার অতল সাগরে পাড়ি জমিয়েছিলেন। আমার দিকে চেয়ে আদ্রিশ বিস্তৃত হেসে বললেন,
” তোমায় এ কথা বলেছি মিশমিশ। ইউনিভার্স সবসময় অতল গহ্বরে সব লুকিয়ে রাখতে চায়। সে চায় না, কিছু তথ্য জনসম্মুখে আসুক। ”

আদ্রিশের এরূপ প্রত্যুত্তরে আমি খানিক রাগান্বিত হলাম। মৃদু উত্তাপে বললাম,
” নিজের ব্যাপারটা ইউনিভার্স নামক এই থিওরি দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করবেন না। চুপচাপ বলুন, আপনি কি লুকাচ্ছেন?”

আদ্রিশ ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠে বললেন,
” এতো জানতে চাচ্ছো কেনো?”

” আমার চিন্তা হচ্ছে তাই জানতে চাইছি।”

আদ্রিশ আমার জবাব শুনে স্মিত হাসলেন। ভ্রু নাচিয়ে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” আচ্ছা? আমায় নিয়ে এতো চিন্তা হচ্ছে তোমার! তা কি কারণে এ চিন্তা হচ্ছে জানতে পারি?”

আদ্রিশের এহেন বাচনভঙ্গিতে আমি সংকুচিত হয়ে এলাম। এলোমেলো দৃষ্টিতে চেয়ে বললাম,
” এটা আমার প্রশ্নের জবাব ছিলো না। ”

” আমার প্রশ্নের জবাবও এটা ছিলো না। ”

” আপনার প্রশ্নটা ভিত্তিহীনবলে আমি জবাব দিতে ইচ্ছুক নই। ”

” তোমার জন্য সে প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকা ভালো বলে আমিও এর জবাব দিতে ইচ্ছুক নই। ”

আমি এবার ভীষণ বিরক্ত হলাম। হাত দুটো একত্রে মুঠো করে বললাম,
” আমার ভালো নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। ”

আদ্রিশ মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসলেন। অতঃপর বললেন,
” তুমি নিজের জন্য যথেষ্ট নও বলেই তোমায় নিয়ে ভাবতে হয় আমার।”

আদ্রিশের এরূপ কথাবার্তায় আমি ভীষণ বিরক্ত এবং রাগান্বিত হলাম৷ অতঃপর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে শেষমেশ উনায় প্রশ্ন করেই ফেললাম,
” আমার পিছে এভাবে পড়ে আছেন কেনো? আমায় নিয়ে এতো ভাবছেন কেনো? কে বলেছে আমায় নিয়ে ভাবতে? ”

আমার এহেন প্রতিক্রিয়ায় যে আশেপাশের কিছু উৎসুক দৃষ্টি আমাদের দিকে চেয়ে রইলো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার পরও আমি বিন্দুমাত্র ঘাবড়ালাম না৷ উল্টো চাপা ক্রোধে আদ্রিশের দিকে চেয়ে রইলাম আমি। এদিকে আদ্রিশ পলক ফেলা বিহীন এবং প্রতিক্রিয়াহীন চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো। কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে এভাবে চেয়ে থেকে মৃদু হাসির সহিত শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” এতো অবুঝ কেনো তুমি মিশমিশ? এতোদিনেও কিছু বুঝতে পারোনি তুমি?”

আদ্রিশের এরূপ প্রশ্নে আমি যেনো হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলাম। সকল রাগ উবে গিয়ে ঠাণ্ডা জলস্রোত বয়ে গেলো আমার উপর দিয়ে। আমি উনার চোখের দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
” আমি নয় দশ বছরের কোনো অবুঝ বাচ্চা নই আদ্রিশ। আর না সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোরী মেয়ে যে এসব সচক্ষে দেখা সত্ত্বেও অবুঝ হবে। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here