#ভুলবশত_প্রেম,২৮,২৯
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২৮
আমার কথা শোনার পরমুহূর্তে আদ্রিশ প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে ভ্রুজোড়া উঁচু করলেন। নিস্তরঙ্গ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” তাহলে সবটা বুঝেও অবুঝ হবার ভান করছিলে তুমি?”
আদ্রিশের এরূপ কণ্ঠস্বরে আমি খানিকটা নড়েচড়ে বসলাম। কারণ এখন হতে যা যা বলার প্রয়োজন, সবটাই দৃঢ়চিত্তে বলতে হবে। আমি খানিক গলা পরিষ্কার করে বললাম,
” আমি বুঝতে চাইছিলাম না। ”
আদ্রিশ কিছুক্ষণ আমার পানে নিশ্চুপ দৃষ্টিপাত করলেন। অতঃপর তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
” সোজা কথায় বলো, ভান করছিলে তুমি। ”
আমি দৃঢ়চিত্তে বললাম,
” ভান করা বা না বুঝার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার উপর নির্ভর করে। আমার ফিলিংস, আমার লাইফ। আপনি তো বলার কেউ না এখানে। ”
আদ্রিশ পুনরায় নিভৃতে আমার পানে চেয়ে রইলেন। আহত স্বরে বললেন,
” কত সহজেই বলে দিলে তুমি! আসলেই কি এসব এতো সহজ?”
” অবশ্যই সহজ। সহজ হিসেবে মেনে নিলেই সহজ। বরং আপনি ব্যাপারটা জটিল করছেন।”
আদ্রিশ আমার কথার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মুখ ফিরিয়ে হাসলেন। অতঃপর আমার দৃষ্টি বরাবর চেয়ে বিষাদমাখা কণ্ঠে বললেন,
” অনুভূতি নামক শব্দের সাথে সম্পৃক্ত সকল বিষয়বস্তুই জটিল হয়। একে কখনো সরল নামক দাঁড়িপাল্লায় মাপা সম্ভব নয়।
কিন্তু তুমি কত সহজেই একে সরলসোজা বলে দিলে! অদ্ভুত! ”
আদ্রিশে এরূপ কথাবার্তায় আমি নিজেকে সংযত রাখতে ক্রমেই ব্যর্থ হয়ে পড়ছি। তা সত্ত্বেও আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সম্পূর্ণ চেষ্টা করে দৃঢ়তার সহিত বললাম,
” আপনার জন্য এটা অদ্ভুত হলে অদ্ভুতই। কিন্তু আমি যা বলছি একদম সঠিক বলছি। ”
আমার কথা শোনামাত্র উনার দৃষ্টি আচমকা শক্ত হয়ে এলো। উনি টেবিলের উপর পূর্বের তুলনায় কিঞ্চিৎ এগিয়ে এসে ধারালোভাবে বললেন,
” তুমি এতোটাও কঠোর না যতোটা দেখাতে চেষ্টা করছো। এ কঠোরতার কারণ কি? বয়ফ্রেন্ড আছে?”
কি মনে করে আমিও আদ্রিশের ন্যায় টেবিলের উপর এগিয়ে এসে পূর্বের দৃঢ়তা বজায় রেখে বললাম,
” আমি এতোটাই কঠোর যতোটা দেখাচ্ছি। আর রইলো বয়ফ্রেন্ড নামক মানুষটার কথা। সে আছে কি নেই তা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।”
আদ্রিশ এ পর্যায়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন।
মুঠো শক্ত করে দৃঢ়তার সহিত বললেন,
” বাহ! কি সহজেই বলে দিলে এ নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হবে না! কিন্তু তুমি মানো আর নাই বা মানো, তোমার প্রতিটি ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করবোই। এতে তুমি কখনোই আমাকে বাঁধা দিতে পারবে না। মাইন্ড ইট, কখনোই না৷ ”
আদ্রিশের এরূপ বাচনে আমি হতভম্ব হয়ে এলাম। নিজের চোখকে এ দৃশ্য কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না আমি। অনুভব করলাম, আমার হৃদপিণ্ডের স্পন্দনগতি স্বাভাবিকের তুলনায় ক্রমেই বেড়ে চলছে। আমি নিমিষের জন্য আদ্রিশের শক্ত দৃষ্টি বরাবর চাইলাম৷ অতঃপর শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম,
” আপনি আমাকে এসব বলার জন্য ডেকেছিলেন?”
” অবভিয়েসলি এগুলো বলার জন্যই ডেকেছিলাম তোমাকে। কিন্তু তোমার ব্যবহারে আমি বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েছি। ”
” আপনি আজ এমনটা করবেন, এটা জানলে কখনোই আপনার সাথে আসতাম না। ”
আদ্রিশ প্রতিক্রিয়াহীন শান্ত চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” না আসলে তুলে নিয়ে আসতাম। সিম্পল। ”
আদ্রিশের এরূপ কথায় আমি বিস্ময়ে হা হয়ে এলাম। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললাম,
” আপনি আমায় কিডন্যাপের হুমকি দিচ্ছেন!”
আদ্রিশ পূর্বের ন্যায় বললেন,
” হ্যাঁ দিচ্ছি। এনি প্রবলেম?”
” আপনার কাছ থেকে এমনটা আশা করেছিলাম না আদ্রিশ।”
” তোমার কাছ থেকেও এমনটা আশা করেছিলাম না আমি মিশমিশ। ”
” তো কি আপনি চাইছেন আমি আপনার প্রস্তাব রাজি হয়ে যাই?”
” অবশ্যই। ”
কি মনে আমি চট করে বলে ফেললাম,
” আমি কখনোই রিলেশনে যেতে চাইনি। ”
আদ্রিশ আচমকা উদগ্রীব হয়ে বললেন,
” আমিও চাই না রিলেশনশিপে যেতে। আর আমি তোমাকে আমার সাথে রিলেশনেও যেতে বলছি না।”
” তাহলে কি বলতে চাইছেন আপনি?”
” আমি সোজা তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমার পরিবারের মতেই বিয়ে করতে চাই তোমাকে।”
আমি উনার এ কথার প্রত্যুত্তর দিলাম না৷ বরং সাহস করে কিছুক্ষণ উনার দৃষ্টি বরাবর চেয়ে রইলাম। অতঃপর দৃষ্টি নত করে বললাম,
” বাস্তবতা মানতে শিখুন আদ্রিশ। বিয়ে করতে চাই বললেই হয়ে যায় না। সবকিছু দেখেশুনে বিয়ে করতে হয়।”
আদ্রিশ উতলা কণ্ঠে বললেন,
” আমার মধ্যে কোনো কমতি আছে মিশমিশ? বলো, আমি নিজেকে শুধরে নিচ্ছি। ”
আমি এ পর্যায়ে হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” আপনার মধ্যে কোনো কমতি নেই আদ্রিশ। বরং আমার মধ্যে কমতি আছে। এসব ছাড়ুন। আজ বরং আমি উঠি। আমার মাথা ধরছে। ”
এই বলে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলাম। কিন্তু এর পূর্বেই আদ্রিশ আমার হাত ধরে আমাকে উঠতে বাঁধা দিলেন। পুনরায় ঈষৎ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
” আমার জীবনটাকে মধ্য সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে তুমি কি করে ভাবলে যে আমার প্রশ্নের জবাব না শোনা অব্দি তোমাকে যেতে দিব?”
আমি এ পর্যায়ে গরম চোখে চেয়ে বললাম,
” এটা পাবলিক প্লেস আদ্রিশ। আর আপনার সাহস কি করে হয় আমার হাত ধরার?”
” সাহস, দুঃসাহসের কিছুই দেখোনি তুমি। সো ভদ্র মেয়ের মতো বসে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। ”
উনার এরূপ আচরণে আমি অকারণে এবং অঘোষিতভাবে গোঁ ধরে বসলাম। হাতের মুঠো শক্ত করে বললাম,
” আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য আমি বাধ্য নই। ”
আদ্রিশ হয়তো আমার কথায় চটে গেলেন। বললেন,
” আমাকে বাধ্য করো না মিশমিশ। পাবলিক প্লেসে আমি কোনো সিন ক্রিয়েট করতে চাই না। ”
” আমিও এমনটা চাই না। এজন্য ভালোয় ভালোয় বলছি আমাকে যেতে দিন। ”
” আচ্ছা তাই? আমিও নাছোড়বান্দা। আমার জবাব আজকে না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়ছি না তোমায়। যত দ্রুত এন্সার দিবে, তত দ্রুত ফ্রি হয়ে যাবে।”
অতঃপর আদ্রিশের জিদমূলক কথাবার্তার কাছে আমি হার মানতে বাধ্য হলাম। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে নতমস্তকে দু চোখ বন্ধ করে বললাম,
” আপনাদের ক্লাসের সাথে আমাদের ক্লাস কখনোই মিলবে না। আপনাদের এই হাই ক্লাসের সোসাইটিতে আব্বু কখনোই আমাকে বিয়ে দিবে না। ”
আদ্রিশ আমার কথা শুনে নিমিষের জন্য নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর হাসতে হাসতে বললেন,
” এমন সিলি রিজন দিও না আমাকে।”
উনার কথায় আমি চোখ মেলে তাকিয়ে বললাম,
” আপনার জন্য এটা সিলি রিজন হলেও আমার জন্য এ রিজনটাই যথেষ্ট। আপুর বিয়ের সময় আব্বু আম্মুকে দেখেছি আমি৷ আপনার হলুদে করা কাণ্ডের জন্য আপুকে মিথ্যে অপবাদ দিতে শুনেছি। আত্মীয়দের তীক্ষ্ণ কথা শুনেছি। আপনাকে বিয়ে না করার আর কি কারণ চাই?”
আদ্রিশ পুনরায় আমার দিকে নিরবতার সহিত চেয়ে রইলেন। কিয়ৎক্ষণ বাদে বললেন,
” মানুষের কথায় এতো কান দাও তুমি! সোসাইটিতে এমন লোকের অভাব নেই। তাই বলে তাদের কথায় আমাদের জীবন থেমে থাকবে?”
” আমি তাদের কথায় কান দিতে চাই না। কিন্তু এমনটা না করেও থাকতে পারি না৷ কারণ এ সমাজেই আমাদের বাস করতে হবে। আর আপুর এমন ফ্যামিলিতে বিয়ে হওয়ার পর আমার এমন ফ্যামিলিতে বিয়ে মানে আব্বু আম্মুকে মেন্টাল প্রেশারের মধ্যে রাখা। ”
” আচ্ছা, এই কথা? আমি আংকেল আন্টীর সাথে কথা বলবো। তাদেরকে এ বিয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে বলবো। ”
” কথা বলে লাভ নেই। তারা রাজি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা। আমি রাজি না। কারণ সমাজের কটু কথা শোনার মতো ধৈর্য শক্তি আমার নেই। আমি খুবই দূর্বল। কেউ কিছু বললে আমি মোটেও তা সইতে পারি না। ”
এই বলে আমি নিমিষের মাঝে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়া শেষ। এবার আমি উঠি। প্লিজ আমাকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ”
এই বলেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলাম। আশপাশে না চেয়ে চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে এলাম। পিছে আদ্রিশ আমাকে একটিবারের জন্যও ডাকলেন না। হ্যাঁ, এটাই চাইছিলাম আমি। আমি চাইছিলাম আদ্রিশের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে। অবশেষে আমি হয়তো সে সিদ্ধান্তে সফল হতে চলেছি। তবে এ সফলতা আমার জন্য আনন্দ বয়ে আনলো না। বরং কোথাও একটা সুক্ষ্ম তবে ভোঁতা যন্ত্রণা কাজ করলো। কিন্তু আমি চাইলেই এ যন্ত্রণাকে দূর করতে পারবো না। বরং এ যন্ত্রণাকে তিলে তিলে ভোগ করতে হবে আমাকে। এর কারণও আছে অবশ্য, যা আদ্রিশের অজানা।
#চলবে
#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২৯
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের নিকষিত আঁধারে মজে গিয়েছে সম্পূর্ণ আকাশ। দূর আকাশে বসেছে উজ্জ্বল তারার মেলা। সে তারার দিকে চেয়ে চেয়ে আমি কাটিয়ে দিচ্ছি নিষ্প্রভ মুহূর্তগুলো। বারংবার দৃষ্টির সামনে আদ্রিশের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। আমার বলা প্রতিটা কথায় উনার চেহারার প্রতিক্রিয়া আমায় ক্ষণে ক্ষণে ব্যাকুল করে তুলছে। কিন্তু এ ব্যাকুলতার কোনো শেষ নেই। না আছে কোনো সমাধান। দিনশেষে আমার এ অনুভূতি, এ পরিস্থিতি ধীরেধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়বে। হয়তো ভবিষ্যত পরিস্থিতির শিকার হয়ে আদ্রিশকেও একসময় ভুলে যেতে হবে। স্মৃতির পাতা হতে উনার উপস্থিতি মুছে দিতে হবে। দিনশেষে আমি অন্য কারোর সংসারে নিজের সারাজীবন কাটাবো। হয়তো ইচ্ছের বিরুদ্ধে বা হয়তো জীবনের যাঁতাকলে পড়ে!
প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি আপু আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আপুর হাতে ফোন, চাহনি উদ্দীপ্ত। আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে আপু উত্তেজিত হয়ে বললো,
” আম্মু তোর সাথে কথা বলবে। এই নে।”
আমি নিরস চাহনিতে মলিন হেসে আপুর হাত থেকে ফোনটা নিলাম৷ ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে আম্মু উত্তেজিত হয়ে বললো,
” পরশুদিন ইয়াসির আসবে তোকে দেখতে। পরশুদিন যেহেতু কলেজ নেই তাই সকাল সকাল নাফিসার সাথে বাসায় চলে আছিস। আমি বেয়াইনকে বলে রাখবো এ ব্যাপারে। ”
আম্মুর মুখে ইয়াসিরের নাম শুনে আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। হৃদপিণ্ডটা প্রবলতায় একটি ঢিপ শব্দ তুলে ধীরেধীরে মন্থর এবং স্বাভাবিক হয়ে এলো। আমার স্তব্ধতায় পূ্র্ণ অনুভূতি বাস্তবতা মেনে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। কারণ, আমি ইয়াসিরের ব্যাপারে বহু আগে থেকেই অবগত৷ কিন্তু রূপকথার রাজ্যের ভেতরে নিজের পছন্দ, নিজের অনুভূতির বেড়াজালে এ বাস্তবতা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম আমি। এ অদ্ভুতুরে আমাকে মাঝেমাঝে আমি নিজেই চিনে উঠতে পারি না। নিজের আচরণে, নিজের অনুভূতিতে ক্ষণে ক্ষণে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি৷ সঠিক উপলব্ধি করতে পারি না, আসলে আমার এ অগোছালো মনটা কি চায়। আমার এ অগোছালো অনুভূতিগুলো কার সঙ্গ পেতে চায়।
যেমনটা এ মুহূর্তে হচ্ছে।
আপুর অগোচরে আমি চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। অতঃপর আম্মুকে ছোট্ট করে উত্তর দিলাম,
” আচ্ছা আম্মু।” এই বলে আপুকে ফোন দিয়ে দিলাম। আপু ফোনে আম্মুর সাথে কথা বলতে বলতে রুমে চলে গেলো। এদিকে আমি পুনরায় ভাবনার জগতে পাড়ি জমালাম।
গত বছর আব্বুর এক কলিগ আমাদের বাসায় দাওয়াতে আসেন। হুট করে উনি উনার ছেলের জন্য আব্বুর কাছে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। আপু তখন অবিবাহিত ছিলো এবং আপুকে বাদ দিয়ে আমায় পছন্দ করায় ইনিয়েবিনিয়ে সেই আংকেলকে না করে দেয়। কিন্তু উনি অর্থাৎ ইয়াসিরের বাবা সেসময় বললেন, উনি ‘না’ শুনতে চান না। বিয়ে যে এখনই দিতে হবে এমন নয়। আপুর বিয়ের পরই আমার বিয়ে হবে। তাঁর ছেলে বিদেশ থেকে আসার পরপরই আমাদের বিয়েটা দিয়ে দিবে। ব্যস, আব্বু পূর্বপরিচিতির রেশ ধরে তখন ব্যাহিকভাবে রাজি হয়ে যায়। পরে আরো খোঁজখবর নিয়ে সব ঠিকঠাক থাকায় সকলেই রাজি হয়ে যায়। সে সময় আমি আব্বু আম্মুর কথা রেখে বিয়েতে রাজিও হয়ে যাই। কারণ আমার ইচ্ছে ছিলো, আব্বু আম্মুর পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো। কিন্তু এ বিয়েতে শুরু থেকেই আমার খুব একটা আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু আব্বু আম্মুর পছন্দ,খুশি ভেবে আমি এই বলে নিজেকে বুঝ দেই যে, একবার বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো বা এমনটাই হবে!
ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারে বসে বসে আমি নিজেকে নিয়ে ভাবলাম৷ নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। নিজের অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ আপু এসে আমার পাশের চেয়ারে বসে কোনোরূপ ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে বসলো,
” তুই ইয়াসিরকে বিয়ে করতে চাইছিস না?”
আপুর এহেন প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কিয়ৎক্ষণ আপুর পানে নিষ্পলক চেয়ে রয়ে অতঃপর বললাম,
” তোর এমন কেনো মনে হলো আপু?”
ব্যালকনির কৃত্রিম আলোয় আপুর ঠোঁটের কোনে বিজ্ঞের ন্যায় হাসি দেখলাম। আপু বললো,
” দু তিন বছর হলেও তোর চেয়ে আমি বড়৷ আম্মুর সাথে কথা বলার সময় তোর চেহারার অবস্থা দেখেছি আমি৷ তুই যে বিয়েতে রাজি না সেটা আব্বু আম্মুকে বললেই তো পারিস। ”
আমি কিছুক্ষণ নত মস্তকে বসে রইলাম৷ অতঃপর বললাম,
” আব্বু আম্মু এতে খুব কষ্ট পাবে। ”
” সারাজীবন তুই থাকবি ঐ ছেলের সাথে। আব্বু আম্মু না৷ সেক্ষেত্রে পছন্দটা তোরও তো হওয়া চাই। ঠিক না?”
” হ্যাঁ। কিন্তু আমার সে সাহসটুকু নেই।”
আপু আমার কথা শুনে আমায় আশ্বস্ত করে বললো,
” এ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। এ আমার উপর ছেড়ে দে। তুই শুধু শিওর হয়ে আমাকে জানা। ”
এই বলে আপু নিমিষের মাঝেই কৌতূহলী কণ্ঠে পুনরায় বললো,
” আচ্ছা তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?”
আপুর এহেন প্রশ্নে আমি চট করে আপুর দিকে তাকালাম। আমার চোখেমুখে ক্রমেই আড়ষ্টতা ছেয়ে আসলো। আপু পুনরায় হয়তো আমাকে একই প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু এর পূর্বেই ব্যালকনিতে জেবা ভাবী এসে আপুকে বললো,
” তুমি এখানে বসে আছো! আমি তোমাকে ফোন দিয়ে দিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি। ”
আপু ঈষৎ চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কেনো, কি হয়েছে ভাবী? কোনো সমস্যা? ”
জেবা ভাবী আপুর প্রশ্নে উত্তেজিত হয়ে বললেন,
” মনে নেই? আজ দুপুরে বলেছিলাম, বাসায় পিজ্জা বানাবো আমরা। ভুলে গিয়েছো না কি?”
আপু এ পর্যায়ে মৃদু হেসে জবাব দিলো,
” না ভাবী। মনে আছে। চলো রান্নাঘরে যাই। ” এই বলে আপু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে চেয়ে বললো,
” তোর সাথে রাতে কথা বলছি আমি। ”
আমি প্রতিক্রিয়াহীন চাহনিতে আপুর দিকে চেয়ে রইলাম। এদিকে জেবা ভাবী আমায় বললেন,
” মিম, তুমিও আসো আমাদের সাথে। ”
এ মুহূর্তে আমার মাঝে তীব্র অনিচ্ছা এবং বিতৃষ্ণা একটি ভাব বিরাজ করায় আমি কৃত্রিম হেসে ভাবীকে বললো,
” আমার পড়া আছে ভাবী। আপনারাই বানান পিজ্জা।”
আমার জবাবে জেবা ভাবী মৃদু হেসে আপুকে নিয়ে চলে গেলেন। অতঃপর আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চোখের পাতা সন্নিবদ্ধ করলাম। এপার ওপার নানা ভাবনা শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ দূর্বল পা জোড়া এগিয়ে নিয়ে ব্যালকনির রেলিং এর কাছে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ রজনীর চাঁদ তারা খচিত আকাশপানে চেয়ে রইলাম৷ অতঃপর নিচে দৃষ্টি নামাতেই ইমাদ ভাইয়াদের গার্ডেনে আদ্রিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দু হাত প্যান্টের পকেটে পুরে ঘাড় উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার আচমকা উপস্থিতি এবং এহেন চাহনিতে আমি যেমন বিচলিত হলাম তেমন বিব্রতও হলাম। আমি নিমিষের জন্য উনার দিকে চেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত চাহনিতে এদিক ওদিক তাকালাম৷ কেউ দেখে ফেললো না তো! আদ্রিশকে এভাবে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে যে কেউ সন্দেহ করবে। তখন যে আমার মান সম্মান সব এ বাড়িতেই খোয়াতে হবে তা ঢের জানা আছে আমার।
ত্রস্ত চাহনিতে চেয়ে আশেপাশে কাউকে না দেখে আমি আদ্রিশের দিকে চাইলাম৷ রগান্বিত হয়ে চাপা কণ্ঠে বললাম,
” আপনার মাথার সত্যিই খারাপ। ওখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”
আদ্রিশ মৃদু হেসে ইশারায় বললেন, কিছু শুনতে পাচ্ছেন না তিনি। অতঃপর আঙুলের ইশারায় আমায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললেন। এরই মাঝে উনি পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বার ডায়াল করে তা কানে ধরলেন। তৎক্ষণাৎ আমার হাতে থাকা ফোনটি বেজে উঠলো। অর্থাৎ আদ্রিশ আমাকে কল করেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি উনার কল দেখে তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে উনার দিকে চাইলাম।অতঃপর অকপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
” নিজের মানসম্মানের খেয়াল নেই মানলাম। অন্তত আমার মানসম্মানের খেয়াল তো রাখতেন! এভাবে বিনা চিন্তায় হুটহাট আপনি এখানে চলে এলেন!”
আদ্রিশ আমার এরূপ কথায় কোমল হাসি দিয়ে বললেন,
” এসব কাজ বিনা চিন্তায় এবং হুটহাট করতে হয় মিশমিশ।”
” খবরদার আমাকে আর ঐ নামে ডাকবেন না। নেক্সট থেকে আপনার মুখে ঐ নাম শুনলে খবর আছে। ”
” আচ্ছা? কি করবে তুমি?”
” সেটা আপনার ভাববার বিষয় না। ”
” ওকে। দ্যান ডু হোয়াট ইউ ওয়ান্ট। বাট আমি তোমায় এ নামেই ডাকবো। তুমি আমায় মে*রে ফেললেও তোমায় এ নামেই ডাকবো চিরকাল।”
” আশ্চর্য! সাধারণ কথাকে আপনি ম*রার কথায় নিয়ে যাচ্ছেন কেনো? মাথা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে না কি?”
আদ্রিশ এক হাত প্যান্টের পকেটে রেখে আমার দিকে স্নিগ্ধ চাহনিতে তাকালেন। অতঃপর মনোমুগ্ধকর সে হাসি দিয়ে বললেন,
” সে তো বহু পূর্বেই হয়েছে৷ ”
আদ্রিশের এরূপ কথা শুনে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। আমি প্রচণ্ড রাগ দেখিয়ে উনায় বললাম,
” আপনার এসব রঙচঙ মেশানো কথা আমার একদম পছন্দ হয় না। আপনাকে রেস্টুরেন্টে আমার জবাব শুনিয়ে দেওয়ার পরেও আপনি কি কারণে আমার পিছে পড়ে আছেন? রিজেক্ট নামক শব্দটার সাথে কি আপনি পরিচিত না? না কি রিজেক্ট হওয়ার শোক সামলে উঠতে পারেননি আপনি? আপনার সুবিধার জন্য সোজা কথায় আবারো বলে দিচ্ছি আমি৷ আপনি যা চান, সেটা কখনোই সম্ভব না। কখনোই না। শুনতে পেরেছেন আমার সব কথা?”
আদ্রিশ আমার পানে নিস্তব্ধ চাহনিতে চেয়ে আছেন। হয়তো আমার এরূপ ব্যবহার উনি কখনোই আশা করেননি। আদ্রিশ ক্ষণিকের জন্য আমার দিকে একই চাহনিতে চেয়ে রইলেন। অতঃপর শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” ওখানেই দাঁড়াও। এক পা-ও এদিক ওদিক নড়বে না। আমি আসছি। ”
এই বলে উনি চট করে কল কেটে দিলেন। চোখের পলকে গার্ডেন ছেড়ে বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়ালেন। আদ্রিশের এরূপ প্রতিক্রিয়ায় এ পর্যায়ে আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অতঃপর আদ্রিশের হুমকিপূর্ণ কথাগুলো স্মরণ করতে করতে ত্রস্ত পায়ে রুমের দরজা বন্ধ করতে এগিয়ে গেলাম। আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি আমার হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন। শুকনো একটা ঢোক গিলে ফোনটা দ্রুত বিছানায় ফেলে তড়িঘড়ি করে দরজা লক করে দিলাম আমি। নিমিষের মাঝেই দরজার ওপারে আদ্রিশের উপস্থিতি টের পেলাম। আদ্রিশ মৃদু তবে ক্ষিপ্রতার সহিত দরজায় টোকা মারতে লাগলেন। দরজার নিকটে এসে ক্ষিপ্রতার সহিত বললেন,
” দরজা খোলো। আমি সামনাসামনি কথা বলতে চাই। ”
আদ্রিশের এরূপ আচরণের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম। আচমকা এহেন পরিস্থিতির শিকার হওয়ায় আমি প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেলাম। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো আমার। শুকনো একটা ঢোক গিলে কম্পনরত কণ্ঠে বললাম,
” কিন্তু আমি এভাবে কথা বলতে চাই না। ”
এদিকে দরজায় আদ্রিশের টোকা দেওয়ার শব্দ ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। উনি পূর্বের ন্যায় বললেন,
” এ মুহূর্তে তোমার চাওয়া না চাওয়া কোনো ম্যাটার করে না আমার জন্য। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই মানে চাই। দরজা খোলো। ”
আদ্রিশের এরূপ আচরণে প্রচণ্ড ভয়ে আমার চোখজোড়া ভিজে এলো। আমি কোনো প্রকারে নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে বললাম,
” আপনি প্লিজ যান এখান থেকে। নিচে কেউ আপনাকে দেখেনি?”
” নিচে কেউ বসে নেই। তুমি কথা না ঘুরিয়ে দরজা খোলো। ”
” নিচে কেউ দেখেনি, এর মানে এই নয় যে, এখনও আপনাকে কেউ দেখবে না। কেউ রুম থেকে বেরুলেই আপনাকে এভাবে দেখতে পাবে। তখন আমার কি হবে জানেন আপনি?”
” তোমার কি হবে তা জেনে আমার লাভ নেই। তুমি কি আমার কথা একবারো ভেবেছো?
এখন দরজা খোলো বলছি। এই যে, এখন আস্তে করে কথা বলছি। কিন্তু তুমি এ মুহূর্তে দরজা না খুললে আমি জোরে কথা বলতে বাধ্য হবো মিশমিশ। এতে এ বাড়ির সবাই কি ভাবলো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।”
আমি পরিস্থিতির যাঁতাকলে পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। শূন্য মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লক্ষ্য করলাম, আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে। আজকের এ পরিস্থিতির জন্য আমি কিছুতেই প্রস্তুত ছিলাম না। এহেন পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লাম আমি। অতঃপর নিমিষের চিন্তাভাবনায় দরজা খুলতে উদ্যত হলাম। দরজা খুলতেই……
#চলবে