ভুলবশত_প্রেম,৩৩,৩৪

0
814

#ভুলবশত_প্রেম,৩৩,৩৪
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৩৩

আমার নিশ্চুপতা উপলব্ধি করতে পেরে আদ্রিশ অপর পাশে মৃদু শব্দে হেসে উঠে বললেন,
” থাক, আজ আর এ নিয়ে কথা বলবো না। সময় সুযোগ বুঝে একদিন আমার সব প্রশ্নের জবাব আমি নিজ থেকেই দিয়ে দিবো। তুমি জানতে না চাইলেও। ”

আমি এ পর্যায়েও নির্বাক রইলাম। আদ্রিশ খানিক বাদে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো?”

আমি তখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। আজ রাতের আকাশটা ভীষণ কালো দেখাচ্ছে। চাঁদের আলোর ছিঁটেফোঁটাও নেই কোথাও। অর্থাৎ আজ অমাবস্যার রাত। রুমের আলোয় ব্যালকনিসহ চারপাশের পরিবেশ যতটুকু আলোকিত করছে তাতেই এ অমাবস্যার রাতের তমসাচ্ছন্নতা কিছুটূ হলেও মিটছে। আমি ব্যালকনির গ্রিল ধরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি প্রশ্ন করবেন? করুন।”

” তুমি এতো লাজুক কেনো বলো তো?”

আদ্রিশের হেন প্রশ্নে আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ভেতরে ভেতরে এ প্রশ্নের জবাব সাজিয়ে আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি কি কখনো একটা মেয়ের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখেছেন?”

” উঁহু, এখনো পর্যন্ত সে প্রয়োজন পড়েনি।”

” তাহলে আমার এমন লজ্জার কারণ আপনি জানবেন না। তবে একটি কথা তো জানেন তাই না? লজ্জা নারীর ভূষণ?”

” তা তো বহু আগে থেকেই জানি। কিন্তু…. ”

” ব্যস, এর বেশি গভীরে আপনাকে জানতে হবে না। ”

” বা রে….. আমার সাথে ঝগড়া করতে আসলে তো সব লাজ লজ্জা কোথায় যেনো রেখে আসো! আর একটু রোমান্টিক কথা বললেই লজ্জার চাদরে আপাদমস্তক নিজেকে পুরোপুরি আবৃত করে রাখো! এটা ঠিক না মিশমিশ। ”
বাচ্চাদের মতো অভিযোগের সুরে বললেন আদ্রিশ। এদিকে উনার এরূপ কথা শুনে আমি ঠোঁট চেপে হেসে ফেললাম। উনায় একটু জ্বালানোর জন্য বললাম,
” আচ্ছা, আমার এমন আচরণ আপনার পছন্দ হয় না, তাই তো? ঠিক আছে। আপনি তাহলে অন্য মেয়ে খুঁজুন। আমার দ্বারা এসব হবে না। ”

ওপাশে আদ্রিশ তড়িৎ গতিতে অনেকটা ধমকের সুরে বললেন,
” এই মেয়ে! আমি এটা কখন বললাম যে, আমার অন্য কাউকে লাগবে? কথার ডাবল মিনিং বের করো কেনো? আমার তোমাকে লাগবে মানে তোমাকেই লাগবে। তোমার অল্টারনেটিভ দিয়ে আমি চলতে পারবো না। ঝগড়া করবে, করো। আমার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে চুপচাপ বসে রইবে, রও। কিন্তু আমার তোমাকে চাই মানে চাই। যার জন্য এতো পাগলামি করা তাকেই যদি দিনশেষে না পাই তাহলে এসবে লাভ কি?”

আমি আদ্রিশের সম্পূর্ণ কথা শুনে মৃদু হেসে বললাম,
” আচ্ছা! কি করলেন গতকাল আপনি? আমি সেই প্রথমেই আপনাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আপনি বলেননি। এখন বলুন। ”

আদ্রিশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। অতঃপর ওপর পাশ হতে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। আদ্রিশ বললেন,
” থ্রেট দিয়ে সব কাজ সেরে ফেলেছি।”

আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কাকে থ্রেট দিয়েছেন!”

” ইয়াসিরকে।”

আমার বিস্ময়ের মাত্রা পূর্বের তুলনায় আরো বেড়ে গেলো। আমি হা হয়ে বললাম,
” সোজা ইয়াসিরকে থ্রেট দিয়েছেন! আচ্ছা মানুষ তো আপনি! সাসপেন্স না রেখে পুরোটা বলতে কি সমস্যা হচ্ছে আপনার? ”

আদ্রিশ মৃদু শব্দে হেসে বললেন,
” সমস্যা তো একটাই, তোমার সাথে কথা বলার সময়সীমাটা কমে যাবে।”

আমি নিজের মাঝে উত্তেজনা ধরে না রাখতে পেরে কিঞ্চিৎ রাগত স্বরে বললাম,
” আপনি কথা ঘুরাবেন না আদ্রিশ। আমাকে সবটা বলুন। ”

” আচ্ছা, আচ্ছা। বলছি তো। কোনোরকম প্রশ্ন ছাড়া আমার কথা শুনে যাবে। এরপর যা বলার বলো। ”

” আচ্ছা বলুন আপনি। ”

অতঃপর আদ্রিশ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করলেন,
” গতকাল বাসায় গিয়েই ইয়াসিরের ফ্যামিলির সব খোঁজ খবর নিয়েছি। ইয়াসির সম্পর্কেও অনেক কিছু জেনেছি। খবরের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ছেলেটা বেশ নরম সরম। কিছুটা বোকাসোকা গোছের। ব্যস, ওর নেচার সম্পর্কে জানার পর আমার কাজ আরো সোজা হয়ে গেলো।
ওকে সন্ধ্যায়ই একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে নানারকম থ্রেট দিলাম। বেচারা ভয়ও পেয়ে গেলো। এরপর বাসায় গিয়ে আমার কথামতো সে তোমাকে রিজেক্ট করে দিলো। এই রিজেকশনটাকে আরো পাকাপোক্ত করতে আমি ইয়াসিরের বাবার সাথেও কথা বললাম। আংকেলও বেশ সরলসোজা প্রকৃতির মানুষ। আমি উনাকে সবটা বুঝিয়ে বললাম যে, আমরা একে অপরকে পছন্দ করি। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে তুমি সরাসরি তোমার বাবাকে আমার কথা বলতে পারোনি। এজন্য উনাকে রিকুয়েষ্ট করলাম, উনি যেনো তোমার বাবাকে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা বলে। ইভেন আমার কথাও যেনো বলে। আংকেল তোমার বাবাকে সবকিছু বললেনও। কিন্তু উনি সবকিছু বলেন আজ সকালে। তোমার বাবা ইয়াসিরের বাবার কথা শোনার পর অনেক চিন্তিত হয়ে পরেন। কিন্তু তোমার বাবার এ চিন্তা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি৷ কারণ আমার আব্বু আম্মু, ইমাদের আব্বু, আম্মু তোমার বাবাকে শান্ত করেন। নানারকম কথাবার্তার মাধ্যমে বুঝান। আর যেখানে ইয়াসির তোমাকে নিজ থেকে রিজেক্ট করেছে সেখানে এ বিয়ের সম্বন্ধ আগানোর তো কোনো প্রশ্নই উঠে না। ব্যস, এরপর আমার কাজ হয়ে গেলো। আমার মোটিভও ফুলফিল হলো। ”

আদ্রিশের জবানে পুরো ঘটনা শোনার পর বিস্ময়ে কিছুক্ষণের জন্য কথা বলা ভুলে গেলাম আমি। কয়েক মুহূর্তের নিশ্চুপ থেকে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি যে ইয়াসিরকে থ্রেট দিলেন, এটা ইয়াসির কাউকে বলেনি?”

” উঁহু। এতো কাঁচা প্ল্যান করিনি আমি। ইয়াসিরকে ভালোমতো টাইট দিয়ে তবেই সবটা করেছি। ”

” আপনি আমার আব্বুকে আমার কথা বলেছেন?”

” পাগল না কি! তোমার কথা বলবো কেনো? আমি শুধু আমার কথা বলেছি।”

” তাহলে ইয়াসিরের বাবা আমার আব্বুকে কিছু বলেনি তো?”

” আরে না। আমি আগেই বলে রেখেছি, যেনো তোমার কথা এর মধ্যে না আসে। ”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ক্ষণিকের জন্য থেমে অতঃপর সন্দেহ মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি ইয়াসিরকে কি এমন থ্রেট দিয়েছেন যে ও এক বছর আগের ঠিক হওয়া সম্বন্ধ এতো সহজেই ভেঙে দিলো?”

ওপাশে আদ্রিশ সশব্দে হেসে বললেন,
” ওটা টপ সিক্রেট ম্যাডাম। আপনাকে এসব জানতে হবে না। আর যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। ও নিয়ে এখন মাথা ঘামাবে না। তুমি বরং আমার সাথে এখন একটু কথা বলো।”

” কত কথাই তো বললাম। আর কথা বলতে মন চাইছে না। আজ রাখি। পড়া আছে, ঘুম আছে। আল্লাহ হাফেজ। ”
এই বলে আদ্রিশকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই আমি কল কেটে দিলাম। এই মহান কাজটা করে মনের ভেতর কেমন যেনো এক পৈশাচিক আনন্দ অনুভূত হলো। ওপাশে আদ্রিশের অবস্থা কি হয়েছে কে জানে!

আমি ব্যালকনি থেকে এসে ফোন রেখে পড়তে বসলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই আমার ফোনে ম্যাসেজের শব্দ বেজে উঠলো। স্ক্রিন অন করে ম্যাসেজ অপশনে যেতেই দেখলাম আদ্রিশ ম্যাসেজ দিয়েছেন,
” কালকের লাঞ্চটা আমার জন্য বরাদ্দ থাকবে ম্যাডাম। কলেজ শেষে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকো। আর কোনোরকমের বাহানা দিয়ে লাঞ্চ স্কিপ করবে না বলে দিলাম।
পড়া শেষ করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ো। হ্যাভ আ সুইট ড্রিম। ”

আদ্রিশের ম্যাসেজ পড়া মাত্র আপনাআপনি আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। আমি উনার ম্যাসেজের জবাব না দিয়ে ফোন রেখে পড়তে বসলাম।

—-

ক্লাস শেষে গেটের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই আদ্রিশ গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন সেখানে। রাস্তার ওপাড়ে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এলেন তিনি৷ দুপুরের মৃদুষ্ণ উজ্জ্বল রোদের আলোয় আদ্রিশের ক্যাজুয়াল ড্রেসআপ ও মুখভঙ্গিমা দেখে আমি কিছুক্ষণের জন্য বিবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। জিন্সের প্যান্টের উপর আকাশী রঙের শার্ট পরেছেন উনি। যার হাতা গুটানো রয়েছে কনুই পর্যন্ত। চোখে কালো রোদচশমা ও গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির অন্তরালে তৃপ্তিময় স্নিগ্ধ এক হাসি। উনার এরূপ মুখভঙ্গিমা ও দেহভঙ্গিমা দেখে আমি খানিক বিস্মিত হলাম এবং সত্য বলতে, মুগ্ধ হলাম। আশ্চর্য! এতোদিন উনি এই লুকে আমার সামনে আসেননি কেনো? না কি আমি উনাকে ঠিকমতো লক্ষ্য করিনি!

আদ্রিশ আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি তখনও উনার দিকে একপ্রকার নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিশ আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললেন,
” এভাবে নজর কেনো দিচ্ছেন ম্যাডাম? আমি কিন্তু অন্যের সম্পদ। অন্যের সম্পদের উপর এভাবে নজর দেওয়া কিন্তু ভীষণ রকমের অন্যায়।”

আদ্রিশের এরূপ কথায় আমি চট করে দৃষ্টি সরিয়ে অবিন্যস্তভাবে রাস্তার দিকে তাকালাম। আদ্রিশ আমার এ কাণ্ডে সশব্দে হেসে ফেললেন। হুট করে আমার হাত ধরে বললেন,
” চলো রাস্তা পার হয়ে গাড়িতে উঠি। তারপর কথা হবে। ”
এই বলে উনি আমার হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে গাড়িতে বসতে বললেন এবং নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লেন।
আমি গাড়িতে বসেই জানালার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখলাম। কারণ, তখন আদ্রিশ যা বললেন, তাতে এখন উনার দিকে সরাসরি তাকানো মানে ভীষণ লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়া। যা মোটেও কাম্য নয়।

খানিক বাদেই আদ্রিশ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন,
” আমার কথায় দেখছি মাইন্ড করেছো তুমি। আরে মিশমিশ! আমি তখন মজা করেছিলাম। তুমি না দেখলে আমায় কে দেখবে বলো? তুমি পলকহীনভাবে আমাকে দেখো। কোনো অবজেকশন নেই। এমনকি তুমি চোখ দিয়ে গিলে খেলেও আমার কোনো অবজেকশন নেই। ”

আদ্রিশের শেষোক্ত কথায় আমি চট করে ঘুরে উনার দিকে তাকালাম। উনার এরূপ কথায় লজ্জায় আমার কান গরম হয়ে এলো। এদিকে আমায় এসব কথা বলে উনি উনার ঠোঁটের কোনে দুষ্টু বাঁকা হাসি বজায় রাখলেন। আমি উনার এরূপ ঠোঁটকাটা ধরণের কথার বিরোধিতা করে বললাম,
” ছিঃ ছিঃ, ইয়াক! কি বলছেন আপনি! মুখে লাগাম নেই নাকি। আমি আপনাকে গিলে খাবো কেনো! ”

আমার কথায় আদ্রিশ কৌতুক শোনার ন্যায় সশব্দে হেসে উঠে বললেন,
” এতো ছিঃ ছিঃ করছো কেনো? যা সত্যি তাই তো বললাম। ”

” এটা কোনো সত্য কথা বলেননি আপনি। একটা ডাহা মিথ্যে অভিযোগ দিলেন ।”

আদ্রিশ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বাঁকা হেসে বললেন,
” আচ্ছা! নাও, এ মিথ্যে অভিযোগকে সত্য করার সুযোগ দিলাম তোমাকে। ”

আমি নাক সিটকে বললাম,
” ছিঃ! লাগবে না আমার এ সুযোগ। আমি যথেষ্ট ভদ্র মেয়ে।”

আদ্রিশ সশব্দে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” যাও, এই ভদ্র মেয়েকে অভদ্র হওয়ার প্রজেক্ট হাতে নিলাম আমি। এখন আমার ওয়ান এণ্ড অনলি মিশন এটাই।”

আমি উনার কথা শুনে সরু চোখে উনার দিকে তাকালাম। লোকটা যে বড় ধরণের অভদ্র হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই লোকটার সাথে যে আমার বিয়ে হবে তা চিন্তা করতেই চিন্তায় আমার মাথার ভেতরটা অগোছালো হয়ে এলো।
কিছুক্ষণ বাদে আদ্রিশ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
” এই মিশমিশ! আজ আমার উপর ক্রাশ ট্রাশ খেয়ে বসে আছো না কি?”

উনার এহেন প্রশ্নে আমি বিস্মিত চাহনিতে চট করে উনার দিকে তাকালাম। এক পলক উনার দিকে চেয়ে পুনরায় সামনে চেয়ে আমতাআমতা করে বললাম,
” আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই!”

” কাজ নেই? তাহলে আমার উপর রোজ রোজ ক্রাশ খাওয়ার কাজ নিয়ে বসে পড়ো মিশমিশ।”

আমি আদ্রিশের দিকে চেয়ে ভেঙচি কেটে বললাম,
” এই কাজ নিতে আমি ইচ্ছুক নই। ”

আদ্রিশ তখন সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,
” এখন আমার সামনে বলছো যে, এই কাজ নিতে ইচ্ছুক নও। কিন্তু আমার অগোচরে কখন যে এই কাজটা নিয়ে বসবে আল্লাহ জানে! তখন আমায় বাঁচাবে কে মিশমিশ? আমি তো আমার রূপ যৌবন সব খোয়াবো দেখছি! অবশ্য, এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ”

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৩৪

আমি হতভম্ব হয়ে আদ্রিশের কথাগুলো শুনলাম। অতঃপর উনার কথার কি প্রত্যুত্তর দেওয়া যায় তা বুঝতে না পারায় আমি চুপচাপ বসে রইলাম। দু মিনিটের মাঝেই আমরা রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে লক্ষ্য করলাম আদ্রিশ আমাকে সেই রুফটপ রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছেন, যেখানে উনার সাথে আমার প্রথম কথা কাটাকাটি হয়।
আদ্রিশ আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্ক করে আসলেন। অতঃপর আমরা দুজনে রেস্টুরেন্টে গিয়ে কোনার দিকের একটি চেয়ারে বসে পড়লাম। আদ্রিশ টেবিল থেকে মেন্যুকার্ডটা নিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি খাবে বলো। ”

” আপনি যা ওর্ডার করবেন তাই। আমার তেমন কোনো স্পেসিফিক পছন্দ নেই৷ আর হ্যাঁ, এই ওর্ডার দেওয়ার নিয়ে আমাকে জোর করবেন না একদম। না হলে কিন্তু পুরো রেস্টুরেন্টের খাবার ওর্ডার করে ফেলবো আমি। তখন বসে বসে বিল মিটিয়ে দিয়েন। ”

আমার কথায় আদ্রিশ ঠোঁট চেপে হেসে বললেন,
” একটা প্রশ্নের এতো বড় জবাব আশা করিনি আমি৷ যাই হোক, আমার পছন্দের ওর্ডারই দিচ্ছি তাহলে। ”
এই বলে উনি ওয়েটারকে ডেকে সিজলিং চিকেন ও ফ্রাইড রাইস ওর্ডার দিলেন। ওয়েটার ওর্ডার নিয়ে চলে যাবার পর আদ্রিশ আমার দিকে মুচকি হেসে তাকালেন। ভ্রু জোড়া নাচিয়ে উৎসুকতার সহিত জিজ্ঞেস করলেন,
” তো ম্যাডাম, কি অবস্থা আপনার?”

আমি সাবলীল গলায় জবাব দিলাম,
” এজ ইউজ্যুয়াল যেমন থাকে তেমন।”

আমার কথায় মুহূর্তেই আদ্রিশের চেহারা হতে সকল উৎসুকভাব ফুঁস করে উবে গেলো। উনি ভ্রু কুঁচকে খানিক অভিযোগের সুরে বললেন,
” অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি! এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরও নো চেঞ্জ! ”

উনার কথা শুনে ঠিক বুঝতে পারলাম উনি কি নিয়ে কথা বলছেন। ব্যাপারটা বুঝার পরও অবুঝের মতো ভান করে বললাম,
” কি চেঞ্জ হবে আমার শুনি? কোনো চেঞ্জ হওয়ার দরকার ছিলো কি? কোনো চেঞ্জ না আসলে সমস্যা? ”

আদ্রিশ আমার কথার সুরেই হয়তো আমায় ধরে ফেললেন। আমি যে উনার সাথে দুষ্টুমি করছি তা বুঝতে উনার নিমিষের জন্যও সময় লাগলো না। উনি এ পর্যায়ে বাঁকা হেসে বললেন,
” আমার সাথে মজা করা হচ্ছে তাই না? একবার তোমায় বাগে পেয়ে গেলে তখন বুঝিয়ে দিবো মজা কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি।”

আদ্রিশের সেই ঠোঁট বাঁকানো হাসি এবং হু*ম*কি স্বরূপ কথা শুনে আমি মুহূর্তেই চুপসে গেলাম। উনি যে আমায় শুধু হু*মকি দিয়েই প্রায় শতভাগ দমিয়ে ফেলতে পারেন, এ বিষয়টা আবারো হাতে কলমে প্রমাণিত করলেন উনি৷
আদ্রিশ আমার মুখভঙ্গিমার পরিবর্তন দেখে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। আমি উনাকে এরূপ হাসতে দেখে বিহ্বল হয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেঙচি কেটে বললাম,
” সবসময় যে আপনারই জয় হবে এমনটা ভাবা উচিত নয়। ”
এই বলে আমি অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে টেবিলের চারপাশ দেখতে লাগলাম। আমার কথার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আদ্রিশ পূর্বের ন্যায় হাসি বজায় রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসলেন। ডান হাতের আঙুল দিয়ে টেবিলের উপর খটখট শব্দ করতে করতে ঠোঁট উল্টিয়ে বললেন,
” আই লাইক ইউর কনফিডেন্স লেভেল মিশমিশ। বাট তোমাকে এটা মাথায় রাখা উচিত কার সামনে, কখন এবং কতটুকু কনফিডেন্স দেখালে তুমি বিপদে পড়বে না। ”

আমি চট করে উনার দিকে চেয়ে তড়িৎগতিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললাম,
” তাহলে আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি এই কনফিডেন্স দেখিয়ে বিপদ ডেকে এনেছি? ”

” সময় হলেই নিজের উত্তর পেয়ে যাবে। ”
এই বলে উনি এগিয়ে এসে টেবিলের উপর দু হাত রাখলেন। আমার দিকে চেয়ে আমার বা হাতটা ধরে বললেন,
” এই যে আংটিটা পরে আছে। এতে তোমার মাঝে কোনো পরিবর্তন আসেনি?”

আমি চট করে উনার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
” জানি না। আর পরিবর্তন আসলেও আপনাকে বলবো না। আপনি খুবই খারাপ। কি দিয়ে কি বলে ফেলবো তার নেই ঠিক। আর আপনি সেটা নিয়ে বসে থাকবেন।”

আদ্রিশ ঠোঁট চেপে হেসে ফেললেন। আমার দিকে চেয়ে রহস্যময় চাহনিতে বললেন,
” আমি কেমন, কতোটা খারাপ, কতোটা ভালো, তা এখনও বোঝার ক্ষমতা তোমার হয়নি মিশমিশ। কিন্তু যেদিন বুঝবে আমি কেমন সেদিন হয়তো আরেক দফা আমার প্রেমে পড়ে যাবে তুমি। ”
এই বলে উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। আমি তৎক্ষনাৎ উনার কথার প্রতিবাদ করে বললাম,
” হুহ, আমি খারাপ লোকেদের প্রেমে পড়ি না।”

আমার কথা মাটিতে পড়তে না পড়তেই উনি তীব্র বিশ্বাসের সাথে বললেন,
” পড়ো না মানে! আমার প্রেমে পড়ে তুমি একদম মজে গিয়েছো।”

” হ্যাঁ তাই তো….আপনাকে কে বলেছে এই কথা? আমার তো মনে পড়ে না আমি এমন কিছু বলেছি আপনাকে। ”

” সব কথা কি বলার প্রয়োজন হয়? তুমি কি ভেবেছো, তুমি না বললে আমি তোমার চোখ দেখে বুঝবো না?”

” বাহ! আপনি নিজেকে এতো জ্ঞানী ভাবেন! ”

আদ্রিশ এ পর্যায়ে বিস্তৃত হেসে ঘোর লাগা কণ্ঠে বললেন,
” উঁহু জ্ঞানী নয়। আমি নিজেকে আমার মাধবীলতার প্রেমে মগ্ন এক প্রেমিক পুরুষ ভাবি। ”

আদ্রিশের এরূপ কথার ধরণে আমি মুহূর্তেই মিইয়ে গেলাম। আমার ভেতরে ক্ষীণ অস্থিরতার আভাস পেলাম আমি। ফলে নিজেকে সামলে নিতে চারপাশে অবিন্যস্ত দৃষ্টি স্থাপন করে রেস্টুরেন্টে আসা প্রতিটি মানুষকে দেখতে লাগলাম। এদিকে আদ্রিশও নিশ্চুপ বসে রইলেন৷ হয়তো বিনাবাক্য আমাকে নিষ্পলক দেখে যাচ্ছেন!

কিছুক্ষণের মাঝেই ওয়েটার আমাদের টেবিলে খাবার সার্ভ করে চলে গেলো। আমরা দুজনে ধীরেসুস্থে খাবার খাওয়া শুরু করলাম। আমাদের মাঝে নিরবতা পূর্ণ পরিবেশ দেখে আমিই অগ্রসর হয়ে কথা শুরু করলাম,
” আপনি কি রোজ এভাবেই বাইরে বের হোন?”

আদ্রিশ খেতে খেতে আমার দিকে জিজ্ঞাসু চাহনিতে চেয়ে বললো,
” এভাবে মানে?”

” এই মানে, আপনি কি রোজ এমন ড্রেসআপে, এমন স্টাইল করে বের হোন?”

আমার প্রশ্নে আদ্রিশ মৃদু শব্দে হেসে উঠে বললেন,
” হঠাৎ এ প্রশ্ন কেনো?”

আমি এ পর্যায়ে খানিক চুপসে গেলাম। অবিন্যস্ত কণ্ঠে বললাম,
” না মানে এমনিই আর কি। ”

আদ্রিশ পুনরায় পূর্বের ন্যায় হেসে উঠে বললেন,
” বলা যায়, প্রায় সবসময়ই এভাবে বের হই। ”

আদ্রিশের কথায় আমার মুখ ভার হয়ে এলো। তৎক্ষনাৎ মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরলো। এর মানে আদ্রিশ রোজ মেয়েদের ইমপ্রেস করার মতলবে বের হোন? আর এমনটা যদি না-ও হয়ে থাকে, তবুও তো উনাকে দেখে রাস্তায় রাস্তায় মেয়েরা ক্রাশ খেয়ে বসে থাকবে! কি সাংঘাতিক ব্যাপার!

আমায় এরূপ নিশ্চুপ থাকতে দেখে আদ্রিশ চমকপ্রদ গলায় বললেন,
” ওয়াও! মিশমিশ তুমি জেলাসও হতে পারো!”

উনার এ প্রশ্নে তৎক্ষনাৎ আমার মনে হলো, আমি জবাবে উনাকে বলি, ‘হ্যাঁ আমি জেলাসও হতে পারি৷ কোনো সমস্যা?’ কিন্তু আমি এরূপ কিছু না বলে সরু চোখে উনার দিকে চেয়ে বললাম,
” কে বললো আমি জেলাস?”

” তোমার চোখে স্পষ্ট লেখা ভেসে উঠছে, ‘আই এম জেলাস’।”

আমি পূর্বের ন্যায় বললাম,
” আমার চোখ কোনো খাতা নয় যে, সব কথাই এখানে ভেসে উঠবে। ”

” তোমার চোখ কোনো খাতা না কি জানি না৷ কিন্তু আমি এখানে সব পড়তে পারি। সব।”

আমি উনার আরোপের প্রতিবাদ করে বললাম,
” আপনি এখন যা পড়েছেন, ভুল পড়ছেন। এমন কিছুই হয়নি।”

আদ্রিশ অত্যুজ্জল হেসে বললেন,
” আচ্ছা, যাও তোমাকে এ নিয়ে ঘাঁটলাম না৷ আফটার অল, জেলাস হওয়া তোমার মৌলিক অধিকার। জেলাস হতেই পারো। ”

আমি উনার কথার প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ রইলাম৷ সরু চোখে উনার দিকে চেয়ে এক চামচ ফ্রাইড রাইস মুখে নিয়ে চিবুতে লাগলাম। আদ্রিশও খেতে খেতে পুনরায় বললেন,
” তুমি যদি বলো, তাহলে ছেঁড়া জামাকাপড় পরেই বের হবো আমি। তাহলে কোনো মেয়ের নজরে পড়বো না। এবার খুশি তো?”

আমি পূর্বের ন্যায় নিশ্চুপ রইলাম। মূলত এ প্রশ্নের জবাবে আমি কিছু বলার মতো সাহস পেলাম না। যদিও আমি মনে মনে ঠিকই এ প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’ বলে আছি। কিন্তু এটা তো আদ্রিশকে জানানো সম্ভব নয়।

আদ্রিশ খাবার শেষ করে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন,
” তাহলে আগামী শনিবার থেকে তোমার প্ল্যানিং কি? আই মিন বিয়ের পর তোমার প্ল্যানিং কি?”

আমার খাবার তখনও শেষ হয়নি। আমি এক চামচ রাইস মুখে পুরে উনাকে থোরাই কেয়ার না করে বললাম,
” কি প্ল্যান থাকবে? কোনো প্ল্যানিং নেই। আমি তো আর বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ী যাচ্ছি না। সিঙ্গেলের মতো জীবন কাটাবো।”

আদ্রিশ আমার কথা শোনামাত্র চট কর এগিয়ে এলেন। গাঢ় গলায় হুমকি স্বরূপ বললেন,
” এমন ইচ্ছা ভুলেও মাথায় আনবে না। এমন হলে আমি তখনই তোমায় তুলে নিয়ে এসে আমার কাছে বন্দি খাঁচায় ভরে রাখবো।”

আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য উনার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলাম। অতঃপর পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বললাম,
” আ-আপনার প্ল্যান কি?”

আদ্রিশ এবার আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আমুদে গলায় বললাম,
” কি আবার প্ল্যান থাকবে। তোমার সাথে চুটিয়ে প্রেম করবো। ভরপুর রোম্যান্স করবো। আর সময় সুযোগ বুঝে জোড়ায় জোড়ায় টুইন বেবি নিবো৷ ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here