ভুলবশত_প্রেম,৩৬,৩৭

0
784

#ভুলবশত_প্রেম,৩৬,৩৭
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৩৬

আমায় এভাবে হাসতে দেখে আদ্রিশ তার চেহারায় অদ্ভুত কায়দা ফুটিয়ে তুলে কিঞ্চিত ক্রোধান্বিত গলায় বললেন,
” খবরদার হাসবে না বলে দিলাম। এদিকে আমি কষ্টে বাঁচি না। আর তুমি হাসছো!”

আদ্রিশের এরূপ কথা শুনে আমার হাসি পূর্বের তুলনায় আরো বেড়ে গেলো। আমি এবার বিছানায় বসে পেটে হাত চেপে হাসতে লাগলাম। উনার বাচনভঙ্গি, উনার চেহারার অভিব্যক্তি, সবকিছু আমাকে হাসতে বাধ্য করছে। আমার হাসির দমক এখন এমন যে, মনে হচ্ছে আমি নিজের সামনে কোনো কৌতুকে ভরপুর অনুষ্ঠান সংঘটন হতে দেখছি। আমার হাসি দেখে আদ্রিশ এ পর্যায়ে রাগ করলেন না৷ বরং সরু চোখে গমগমে চাহনিতে চেয়ে রইলেন৷ আমি হাসতে হাসতে বললাম,
” আপনাকে থ্যাংকস এর ডিব্বা এনে দিলেও কম হবে। তবুও বলছি, আজকের রাতে আমাকে এতো এতো হাসানোর জন্য থ্যাংকস আপনাকে। আজকের রাত আমি কখনোই ভুলবো না৷ পুরোপুরি স্মরণীয় হয়ে থাকলো আমার জন্য৷”

আদ্রিশ তেরছাভাবে আমার দিকে চেয়ে হতাশ গলায় বললেন,
” আমার জন্যও স্মরণীয় হয়ে থাকলো। যেখানে বউয়ের সাথে সময় কাটানোর কথা, সেখানে আমি এখন কাজে যাচ্ছি। আর আমার বউটাও মাশাআল্লাহ! বিয়ের রাতে পড়তে বসেছে! আর আমাকে বিদায় হতে দেখে সে হাসিতে ফেটে পড়ছে! এমন বউ মনে হয় সারা পৃথিবী খুঁজলেও পাওয়া সম্ভব না। এক্সেপশনাল কেস।”

আদ্রিশের শেষোক্ত কথা শুনে আমি গর্বিত বোধ করলাম৷ আহ,কি প্রশংসা! উনার দিকে চেয়ে আমি বিস্তৃত হেসে বললাম,
” জানি জানি৷ আমাকে বলতে হবে না৷ আমি এক্সেপশনাল একটা মানুষ, এটা বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না৷ আপনার তো এতে খুশি হওয়া উচিত। আমার মতো এক্সেপশনাল একটা লাইফ পার্টনার পেয়েছেন।”

আদ্রিশ কোনো জবাব দিলেন না। বিছানায় থাকা শপিং ব্যাগ থেকে ঘিয়ে রঙয়ের একটি টি শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন চেঞ্জ করতে। কিছুক্ষণের মাঝেই চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসে বললেন,
” এর শোধ আমি তুলবো মিশমিশ। মাইন্ড ইট। ”

আমি কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কার উপর?”

আদ্রিশ নির্বিকার গলায় বললেন,
” আপনার উপর ম্যাডাম৷ ”

আমি বিস্মিত হয়ে চোখজোড়া বড় বড় করে বললাম,
” আশ্চর্য তো! আমি কি করলাম!”

আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন না৷ বরং বাঁকা হেসে ধীরপায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
” আমার উপর এতো হাসার জন্য আমি শোধ তুলবো না?”

আদ্রিশকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে আমি সংকুচিত হয়ে এলাম। ঠোঁটের কোনে যে অবশিষ্ট হাসি ছিলো তা মুহূর্তেই উবে গেলো। হৃদপিণ্ডটা ধীরেধীরে তার স্পন্দন বৃদ্ধি করতে লাগলো। কণ্ঠনালীও প্রায় শুকিয়ে এলো। আমি খাটের হেডবোর্ডের অংশ থেকে কিছুটা দূরে বসে ছিলাম। আদ্রিশকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে আমি হেডবোর্ডের দিকে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। উনি আমায় দেখে বললেন,
” কি হলো? এতোটুকুতেই ভয় পেয়ে গিয়েছো!”

আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে মেকি সাহসিকতা দেখিয়ে বললাম,
” মোটেও না। আপনি বাঘ না ভাল্লুক যে আপনাকে ভয় পাবো?”

এই বলে আমি দৃষ্টিনত করে আমার পরনের ওড়নার শেষাংশ মুঠোর মধ্যে পুরে নিলাম। মন চাইছে এখনই উঠে পালিয়ে যাই৷ কিন্তু এ কাজ করলে যে আদ্রিশের কাছে সারাজীবন ভিতু খেতাব পেয়ে বসে থাকতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং, হাজার ভয় পেলেও আমি পালিয়ে যাওয়ার মতো বোকামি কাজটা করবো না। কিন্তু তাই বলে কি বসে থাকবো! আমার দ্বারা তো এভাবে বসে থাকা যাচ্ছে না!

আদ্রিশ এতোক্ষণে আমার যথেষ্ট কাছে চলে এসেছেন৷ উনি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে থেকে ক্রমান্বয়ী কণ্ঠে বললেন,
” যদি ভয়ই না পেয়ে থাকো, তাহলে আমার দিকে তাকাও। ওভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে আছো কেনো?”

আদ্রিশের এরূপ প্রশ্নে আমি কয়েক মুহূর্তের সময় নিলাম। অতঃপর উনার এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই উনি অকস্মাৎ আমার দিকে ঝুঁকে এলেন। কোনো কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই উনি আমার কানের কাছে মুখ এনে লহু কণ্ঠে বললেন,
” তোমার কাছে এলেই তো আমাকে সবসময় বাঘ, ভাল্লুকই ভাবো। এমনটা ভাবার কারণ কি?”

আদ্রিশের এরূপ কণ্ঠ শুনে আমার মাঝে শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতির উদয় হলো। মস্তিষ্কের নিউরনগুলোয় সেসময়ের জন্য তাদের কাজ করা বন্ধ করে দিলো। আমি একই অবস্থায় এক প্রকার জমাট বেঁধে বসে রইলাম। আদ্রিশ আমার নিকট হতে কোনো জবাব না পেয়ে ক্ষীণ শব্দে হাসলেন। অতঃপর উনি মাথা তুলে আনত অবস্থাতেই আমার মুখোমুখি অবস্থান করলেন। উনার এবং আমার মাঝে হয়তো দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চির। আদ্রিশকে এভাবে মুখোমুখি দেখে আমি সরাসরি উনার দিকে চেয়ে থাকতে পারলাম না। ফলস্বরূপ খিঁচে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলাম। আদ্রিশ পুনরায় ক্ষীণ শব্দে হাসলেন। আমার কপালের পাশে উড়ে চলা ছোট চুলগুলোকে আমার কানের পিছে গুঁজে দিয়ে নে’শাক্ত কণ্ঠে বললেন,
” এতো ভয় পাও কেনো মাধবীলতা? আমার কাছে আসা কি তোমার পছন্দ হয় না? সবসময় ভীত থাকো কেনো? তবে যাই বলো না কেনো, তোমার এ ভীত চাহনি আমায় খুব আ’কৃষ্ট করে। কেনো, তা জানি না। তবে তোমার এ চাহনিতেও আমি বারংবার আহত হই৷ না জানি তোমার এ চাহনি, এ রূপে আমি কবে যেনো নিহত হয়ে যাই৷”
এই বলে আদ্রিশ আচমকা আমার ডান গালে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে পূর্বের ন্যায় বললেন,
” আমার উপর হাসার ছোট্ট একটা শাস্তি। সময় থাকলে সুদে আসলে সব শাস্তি উসুল করতাম। কিন্তু আজকের জন্য এতোটুকুই।”
এই বলে আদ্রিশ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তৎক্ষনাৎ আমি চোখ মেলে তাকালাম। আদ্রিশের এরূপ কাজে আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। উনার এরূপ কাজ বিশ্বাস করতে এখনও কষ্ট হচ্ছে আমার। আচমকা কি করলেন উনি! এমনটা কখনোও আশা করেছিলাম না৷ নাহ, মানুষটা খুবই খারাপ। এভাবে হঠাৎ হঠাৎ আমাকে চমকে দেন কেনো উনি! উনার এ জ্বালায় তো আমার জীবন হারাম হয়ে যাবে। কবে যেনো উনার এরূপ অকস্মাৎ কাজকর্মে আমি ছোটখাটো একটা হার্ট এটাক করে বসে থাকি।
আমি আদ্রিশকে এ নিয়ে কিছু বলতে যাবো কিন্তু এর পূর্বেই উনি আমার টেবিল হতে হাত ঘড়ি পরতে পরতে মৃদু হেসে বললেন,
” তোমায় এটুকু ছোঁয়াতেই তুমি হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গলে যাও। না জানি ভবিষ্যতে কি হবে।”
এই বলে উনি পূর্বের হাসি বজায় রেখে আমার দিকে তাকালেন। উনার কথা কর্ণপাত হতেই আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম,
” কি খারাপ মানুষ আপনি!”

আদ্রিশ এবার শব্দ করে হেসে বললেন,
” বউয়ের কাছে খারাপ হতে দোষ কি?”

আমি উনার এরূপ বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বললাম,
” অনেক দোষ। অনেক অনেক। আপনি আমার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এমন কাজ করবেন কেনো? আমার অনুমতি নিবেন না কেনো?”

আদ্রিশ ততক্ষণে দরজার কাছে চলে গিয়েছেন। আমার এরূপ কথা শুনে উনি ঈষৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন,
” সুযোগ পেলে সাধুও অনুমতিহীন চোর হতে চায়। তাহলে এক্ষেত্রে আমি কেনো পিছে পড়ে থাকবো?”

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৩৭

আদ্রিশের শেষোক্ত কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। খুব ভাবলাম। অতঃপর অনুধাবন করলাম, লোকটা খুবই সুযোগ সন্ধানী মানুষ। সুযোগ পেলে আমাকে লজ্জা দিতে মোটেও পিছ পা হবেন না উনি। ইশ! উনার কাছ থেকে কিভাবে লুকিয়ে থাকবো আমি? উনি আমার কাছাকাছি ঘেঁষলেও যে আমি লজ্জায় একদম মিইয়ে পড়ি!

আদ্রিশ চলে যেতেই আমি বিছানা থেকে নেমে দরজা আটকে সুদীর্ঘ কয়েকটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। অতঃপর নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়ে অগোছালো রুমটা গোছানো শুরু করলাম। আমার পরনের শাড়ীটা সকালের রোদে দেওয়ার জন্য বারান্দায় ছাড়িয়ে রেখে আসলাম। পরনের গহনাগুলো বক্সে ভরে আপাতত আমার আলমারিতে রেখে দিলাম৷ আগামীকাল সকালে আম্মুর হাতে সবগুলো গহনার বক্স দিয়ে এই ঝামেলা থেকে মুক্ত হবো।
এভাবে আমার সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে আদ্রিশের শেরওয়ানি গুছানো শুরু করলাম। উনার পরনের শেরওয়ানি গুছাতে বেশ বেগ পেতে হলো আমাকে৷ তবে বেশ কষ্টেসৃষ্টে শেরওয়ানিটা গুছিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অতঃপর শেরওয়ানিটা হাতে নিতেই আদ্রিশের ব্যবহারকৃত পারফিউমের ঘ্রাণ আমার নাকে এসে বাড়ি খেলো। কি মনে করে আমি এক ধ্যানে আদ্রিশের শেরওয়ানিটির দিকে চেয়ে রইলাম। মনের অজান্তেই উনার শেরওয়ানির উপর হাত বুলিয়ে দিলাম। উপলব্ধি করলাম, আমার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। ভাবতেই ভীষণ অবাক লাগছে, আজ থেকে এই মানুষটি শুধু আমার। উনার উপর একজন স্ত্রী হিসেবে শুধুমাত্র আমার কর্তৃত্ববোধ থাকবে। হাজার মানুষের ভীড়ে আদ্রিশকে আমি আমার আপন বলতে পারবো। আজ থেকে উনার সাথে সকল সুখ দুঃখ ভাগ করবো। উনার মাঝে নতুন করে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে নিবো। আমার সকল ভালোবাসা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা উনাকে ঘিরেই আবর্তিত হবে। অদ্ভুত! কবুল বলার মাধ্যমেই উনি সম্পূর্ণরূপে আমার হয়ে গেলো! আমার বাকিটা জীবনের সাথী হয়ে গেলো। আমার বুড়ো বয়সের সঙ্গী হয়ে গেলো। আচ্ছা? উনি যে আমায় এতো ভালোবাসেন,আমি কি উনাকে এতো ভালোবাসতে পারবো? হয়তো হ্যাঁ বা হয়তো না। আচ্ছা? উনাকে কতোটা ভালোবাসতে পারি, তা কি চেষ্টা করা উচিত? উচিত হয়তো। তবে এ চেষ্টায় হয়তো আমি এক পর্যায়ে হেরে যেতে পারি৷ কারণ আদ্রিশের ভালোবাসা আমাকে জিততে দিবে না মনে হয়।

আমি কিছুক্ষণ আদ্রিশের শেরওয়ানিটির দিকে চেয়ে থেকে চোখজোড়া বন্ধ করলাম। অতঃপর উনার শেরওয়ানিটা জড়িয়ে ধরে উনাকে অনুভব করার চেষ্টায় মত্ত হলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেলো আমার৷ এ কারণে আম্মুর বকা শুনতে শুনতে কোনোরকমে নাকেমুখে নাস্তা দিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। পথিমধ্যে আদ্রিশের হালচাল জিজ্ঞেসের জন্য দুবার কল করলাম। কিন্তু উনি কল রিসিভ করলেন না। তৃতীয়বারে কল করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বেই আমি কলেজে চলে এলাম৷ অতঃপর ফোনটা সাইলেন্ট করে ক্লাসে ঢুকে পড়লাম।
.
আজ ঠিক ঠিক দুটো ত্রিশে ক্লাস শেষ হয়েছে৷ গতকাল রাতের অপর্যাপ্ত ঘুম, আজ সকালে মস্ত তাড়াহুড়ো করে আসা, সব মিলিয়ে আবারো আজকে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। ধীরেসুস্থে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ গেটের সামনে দাঁড়ালাম। রাস্তার ওপারে দৃষ্টি দিয়ে কেনো যেনো মনে হলো, আদ্রিশ হয়তো আমাকে নিতে আসবেন। আচ্ছা? সত্যিই কি উনি আমাকে নিতে আসবেন। না কি শুধু শুধু আমি উনার উপর প্রত্যাশা করে আছি?
এ মনে করতে করতে আমি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে উনাকে ফোন দিতে উদ্যত হলাম। এজন্য যে, উনি আমাকে সত্যিই নিতে আসবেন না কি এটা আমার কোনো প্রকারের ভ্রম?
ফোনের স্ক্রিন অন করতেই দেখলাম, আদ্রিশ সকাল দশটার দিকে আমাকে একবার কল করেছিলেন। উনার কল দেখে আমি উত্তেজিত হয়ে তৎক্ষনাৎ কল ব্যাক করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং কল ব্যাকও করলাম। কিন্তু ওপাশে আদ্রিশের কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না৷ একবার, দুবার, তিনবার। অতঃপর আমি আশাহত হয়ে ফোনটা তার যথাস্থানে রেখে দিয়ে রিকশায় উঠলাম। অনুধাবন করলাম, কিছুক্ষণ পূর্বের ভাবনাটা আজকের জন্য অপূরণীয় একটা ভাবনা ছিলো, ভ্রম ছিলো। অতিরিক্ত প্রত্যাশা ছিলো।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আটটা বাজতে চললো। অথচ আদ্রিশের কোনো খোঁজ খবর নেই। প্রবাহমান সময়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে লাগলো আমার অভিমান৷ আদ্রিশের প্রতি আমার অভিমান। যা আমার জন্য একদম নতুন৷ হয়তো
অভিমানের এ অনুভূতিটা নতুন বলেই অভিমানের পাল্লাটা ভারী হলো। ভীষণ ভারী। প্রচণ্ড অভিমানে সিদ্ধান্ত নিলাম, উনাকে আর কল করবো না৷ এমনকি উনি কল করলেও রিসিভ করবো না৷ রিসিভ করবোই বা কেনো? বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই কাজের চাপে যে মানুষটা সদ্য বিবাহিতা বউকে ভুলে যায় তার কল কেনো রিসিভ করবো আমি? তার সাথে কেনো কথা বলবো আমি?
আজ আদ্রিশের এ উপেক্ষায় হাড়ে হাড়ে টের পেলাম সেই বাণীর সত্যতা, ‘প্রেম ভালোবাসা বিয়ের আগেই সুন্দর। বিয়ের পরে মানুষটা তোমার হয়ে গিয়েছে৷ এখন তাকে ভালোবাসা দাও বা না দাও। সে তো তোমার কাছেই থাকবে। ‘
তাহলে কি আদ্রিশও আমাকে আর ভালোবাসবেন না? কাজের চাপে আমাকে ভুলে যাবেন? না কি আমি বেশিই ভেবে ফেলছি? উফ! আজ যা হওয়ার হয়ে যাক। আদ্রিশের সাথে আমি কথা বলবো না মানে কথা বলবো না। আজ উনার মিষ্টি কথায়ও আমি গলবো না।

আকাশসম অভিমান ও ক্ষোভ নিয়ে জোরপূর্বক পড়ার টেবিলে বসলাম। কিন্তু লাভ হলো না কিছুই। আমার সামনে ঠিকই বইটা খোলা রইলো। কিন্তু আমার মাথায় চলতে লাগলো আদ্রিশের কাজ ও কথা। সত্যিই উনি আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বেন। উনি আমাকে এমন বানিয়ে দিয়েছেন যে, উনার জ্বালা সহ্য করার ক্ষমতাও আমার নেই। আবার উনার এই জ্বালা ছাড়া বেঁচে থাকার উপায়ও জানা নেই। কি মুসিবত! আমাকে উনি উভয় সংকটে ফেলে দিয়ে গেলেন!

এই ভাবতে ভাবতে আচমকা আমার ফোনটা বেজে উঠলো। তৎক্ষনাৎ আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। মনে জানালায় উঁকি দিলো প্রজ্জ্বলিত একটি নাম, আদ্রিশ। নিশ্চয়ই আদ্রিশ ফোন করেছেন। অবশেষে উনার সদ্বুদ্ধি হলো। হলে কি! আমি কল রিসিভ করে চুপটি করে বসে থাকবো। উনার উপর বিশাল অভিমান দেখাবো। তারপর কিছু সময়ে গেলে আমি স্বাভাবিক হবো। এই ভেবে আমি ফোনটা হাতে নিলাম। কিন্তু এ কি! স্ক্রিনে তো আদ্রিশের নাম উঠেনি। আননোন একটা নাম্বার থেকে কল এসেছে। মুহূর্তেই আমার সব প্রত্যাশা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। উদাস মুখে উপায়ন্তর না পেয়ে কল রিসিভ করলাম আমি। ওপাশে ভদ্রতার সহিত একজন বলে উঠলো,
” ম্যাম, আপনার নামে একটি পার্সেল এসেছে। আপনার দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি আমি। অনুগ্রহ করে পার্সেলটা রিসিভ করুন। ”

ডেলিভারি বয়ের এহেন কথায় আমি ভীষণ অবাক হলাম। কারণ আমি তো কোনো ওর্ডার করিনি৷ তাহলে পার্সেল এলো কোথা থেকে?
এ নিয়ে অংক কষতে কষতে আমি দরজা খুলে পার্সেল রিসিভ করলাম। ডেলিভারি বয় আমার হাতে একটি ভারী বক্স এবং একটি বুকে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। এদিকে আব্বু রুম থেকে জিজ্ঞেস করলো, কে এসেছে। আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম, ডেলিভারি বয়। আব্বু প্রত্যুত্তর করলে না।

আমি রুমে এসে দরজা আটকে ভারী বক্সটা রেখে বুকেটা দেখলাম। বুকের এক কোনায় একটি বেশ ভারী ধরণের একটি কাগজ দেখলাম। কাগজটি হাতে নিতেই আমার মনে সন্দেহের সূচনা ঘটলো। নিশ্চয়ই এটা আদ্রিশ পাঠিয়েছেন।
আমি সন্দেহবশত কাগজটি খুললাম। চিঠির খামের মতো কাগজটিতে পরপর তিনটি কাগজ ভাঁজ করা। তন্মধ্যে প্রথম কাগজটি খুলতেই দেখলাম গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
” জলদি করে ব্যালকনিতে চলে আসো মিশমিশ। কোনো এক্সকিউজ দেখাবে না৷ আর আমার কথার অবাধ্য হওয়ার চেষ্টা তো মোটেও করবে না৷ করলে, এক্ষুণি তোমাদের বাসায় চলে আসবো।”

তীব্র অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি খামটি নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম৷ দৃষ্টি সামনে নিক্ষেপ করতেই আদ্রিশের আবছা চেহারা দৃষ্টিগোচর হলো। উনাকে দেখে আমার মনে অভিমানের বিশাল পাহাড় এসে খাঁড়া হয়ে দাঁড়ালো। ফলে বিন্দুমাত্র হাসিও ফুটলো না আমার মুখশ্রীতে। এদিকে আদ্রিশ এরূপ আমাকে দেখে দূর হতে নিজের দু কান ধরে চেহারায় অসহায় ভাব ফুটিয়ে তুললেন। ইশারায় ভাবভঙ্গি এমন দেখালেন যে, উনাকে যেনো আমি ক্ষমা করে দেই। কিন্তু আমি এবার নাছোড়বান্দা হলাম। উনাকে যে কিছুতেই ক্ষমা করবো না। ফলে আমি ভেঙচি কেটে উনাকে না করে দিলাম। আদ্রিশ পুনরায় চেহারায় কিউট ধরনের ভাব ফুটিয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু আমি আবারো ভেঙচি কাটলাম। এবার আদ্রিশ ভান করে সুদীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর উনি ক্ষণিকের জন্য চিন্তাভাবনা করে ঠোঁটের উপর দু আঙুল চওড়াভাবে রেখে হাসির প্রতিক দেখিয়ে ইশারায় হাসতে বললেন আমায়। কিন্তু আমি ভাবলেশহীন রূপে উনার এ কীর্তিকলাপ দেখলাম। বেশ কিছুক্ষণের প্রচেষ্টার পরও যখন উনি আমায় হাসাতে ব্যর্থ হলেন তখন ইশারায় বললেন, খাম হতে এর পরের কাগজটি দেখতে। প্রথম দফায় আমি রাজি না হলেও যখন উনি দু হাত জোড় করে আমায় কাগজটি খুলে দেখতে বললেন, তখন আমি খানিক ভাব দেখিয়ে কাগজটি খুললাম। সেখানে গোঁটা গোঁটা অক্ষরে লেখা রয়েছে,
” নবীন যুগের ডাকপিয়ন হয়ে হৃদয়ে খচিত অনুভূতিগুলো পত্রে নিঙরে তোমার নামে বিলি করলাম মাধবীলতা। অনুগ্রহপূর্বক তোমার প্রেমে মত্ত এই পাগল প্রেমিকের অনুভূতিগুলো গ্রহণ করবে কি তুমি?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here