ভুলবশত_প্রেম,৩৮,৩৯

0
719

#ভুলবশত_প্রেম,৩৮,৩৯
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৩৮

আদ্রিশের লেখা পড়ে মনের অজান্তে আমার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। কাগজটি ভাঁজ করে আমি আদ্রিশের দিকে চাইলাম। রাস্তার হলদে সাদা আলোয় উনার মুখশ্রীতে তৃপ্তির হাসি দেখলাম। উনি আমায় পরের কাগজটি খুলতে বললেন। উনার কথামত আমি তৃতীয় কাগজটি খুললাম। সেখানে লেখা,
” অভিমানী স্ত্রীর চেহারাটা কেমন হয় তা দেখার ইচ্ছে বহুদিনের। জানি, এতক্ষণে তোমার অভিমানী চেহারার দর্শন করে ফেলেছি আমি এবং নিঃসন্দেহে তা অপরূপ, অতুলনীয়৷ খুব ইচ্ছে হচ্ছে, তোমার অভিমানী গালে এই আঙুলগুলো ছোঁয়াতে। অতঃপর আমার ছোঁয়ায় তোমার লজ্জা মিশ্রিত মুখখানা দেখতে। তুমি না ভীষণ লাজুক মেয়ে। অতিরিক্ত লাজুকতায় পূর্ণ মেয়ে আমার সহ্য হয় না। কিন্তু তোমার এ লাজুকতাই যেনো তোমার আরেকটি পরিচয়। তুমি যেনো এই লাজুক ভাবেও অপর এক সত্ত্বার অধিকারী হও৷
আচ্ছা শোনো মাধবীলতা, আমার একটা আবদার রাখবে ? জানি, আকাশসম অভিমানের কঠিন এক পাহাড় তৈরি করে বসে আছো তুমি। কিন্তু তোমায় এ আবদার না করে থাকতে পারলাম না। খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার মাধবীলতাকে শাড়ী পরিহিত অবস্থায় দেখতে। যে কি না এখন আমার সারাজীবনের সুখ দুঃখের সাথী৷

তোমার আদ্রিশের এ অবাধ্য মনটা খুব করে চাইছে তোমাকে ‘বউ বউ’ রূপে দেখতে এবং আজকে তোমার এ ‘বউ’ রূপটাকে মাত্রই আমিই উপভোগ করবো। আজ আর কারোর সাধ্য নেই তোমাকে বউ রূপে দেখার।

আমার দেওয়া শাড়ীটা পরে ছাদে চলে এসো মাধবীলতা। আর হ্যাঁ, বাসার কাউকে আমার কথা বলো না। আজ একটু চুপিচুপি প্রেম করতে চাই তোমার সাথে। এসো কিন্তু সময় করে। ”

আদ্রিশের এ চিঠি পড়ে আমি লজ্জায় সংকুচিত হয়ে এলাম। ঢের টের পাচ্ছি, আদ্রিশ আমায় একনাগাড়ে দেখে চলছেন৷ চিঠি পড়ে আমি উনার দিকে আর তাকানোর সাহস পেলাম না। বরং চিঠিটা ভাঁজ করে দ্রুত রুমে চলে এলাম৷ আমার হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিক শব্দটা আমার কানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এসবের জন্য দায়ী একমাত্র আদ্রিশ। উনি যে আমায় এক মুহূর্তও শান্তিতে কাটাতে দেয় না। বড্ড খারাপ মানুষ উনি। কিন্তু উনি যে আবদার করলেন আমায় তার কি হবে? এ আবদার অগ্রাহ্য করার সাধ্য ও সাহস কোনটাই নেই আমার৷ উনার এমন মিষ্টি আবদার অগ্রাহ্য করার অর্থ সারাজীবন অপরাধবোধের সাথে সময় কাটানো। কিন্তু এও ঠিক যে আমি উনার উপর অভিমান করে আছি। তাহলে এ অভিমানের কি হবে? এ অভিমান নিয়ে কি উনার সামনে শাড়ী পরা সাজে? হয়তো সাজে না। কিন্তু আমি শাড়ী পরবো। উনার এ আবদার পূরণও করবো। তবে ক্ষীণ অভিমান নিয়ে৷ কারণ উনার কথায় আমার অভিমান অনেকটাই উবে গিয়েছে। আচ্ছা? উনি কি অভিমান ও রাগ ভাঙানোতে এতোটা পারদর্শী না কি আমিই অতি সহজে গলে গেলাম? নাহ, বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা।

এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি চুপিচুপি আব্বু আম্মুর রুমে গেলাম এই দেখতে যে তারা দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছে কি না। আমি পা টিপে টিপে আব্বু আম্মুর রুমের সামনে এলাম। বন্ধ দরজাটা খুব সাবধানে খুলে ভেতরে উঁকি দিলাম। হ্যাঁ, দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার আভার রুমে উঁকি মারার পালা। আমি পুনরায় চোরা পায়ে ওর রুমের সামনে গিয়ে উঁকি মারলাম। হ্যাঁ, আভাও ঘুমিয়ে পড়েছে। তাহলে দু’দিকেই রাস্তা পরিষ্কার। এবার রুমে গিয়ে জলদি শাড়ীটা পরে নিতে হবে।

—-

মেরুন রঙের শাড়ী, মেরুন রঙের রেশমী চুড়ি, কানের দুল পরে খুব সাবধানে বাসার প্রধান দরজা খুলে বের হলাম আমি। এক হাতে শাড়ীর কুঁচি ধরে খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে আমাকে। সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে দুটো কারণে। এক শাড়ী খুলে যাওয়ার ভয়, দুই হাতেনাতে ধরে পরার ভয়ে। দুটো ভয়ই আমাকে নাজেহাল করে তুলছে।

খুব সাবধানে কুঁচি ধরে এক সিঁড়ি করে উপরে উঠছি আমি৷ মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, এই বুঝি শাড়ী খুলে সব জড়িয়ে ধপাস করে পরে যাবো আমি। কিন্তু সাবধানী হওয়ায় তা আর হলো না। সফলভাবেই ছাদেই পা রাখলাম আমি।

আজ আকাশে মস্ত বড় এক চাঁদ উঠেছে। কলঙ্কিনী দাগে পূর্ণ চাঁদের আলোয় নিকষ কালো প্রকৃতি রূপালী রঙে রাঙায়িত হয়েছে। কি অদ্ভুত অবর্ণনীয় তার এ সৌন্দর্যতা! আবার চারপাশে ক্ষীণ শব্দের ঝিঁঝিঁ পোকারা গান গাইতে ব্যস্ত। মৃদুমন্দ হাওয়ার তালে গাছের পাতারা নৃত্য করতে ব্যস্ত। আর আমি! আদ্রিশের অপেক্ষা করতে ব্যস্ত। ছাদে পৌঁছানোর কয়েক সেকেন্ড হলেও আদ্রিশকে দেখতে পেলাম না। উনি কি আসেননি এখনও? নিচে গিয়ে কি একবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে আসবো?
এই ভেবে পিছনে ফিরতেই আচমকা কারোর সাথে ধাক্কা লাগলো আমার৷ ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে কয়েক কদম পিছিয়ে এসে পরে যেতে নিলাম আমি৷ কিন্তু এর পূর্বেই আমার কোমড় ধরে আমাকে সামলে নিলেন আদ্রিশ। চাঁদের আলোয় উনার চেহারা স্পষ্টত বিদ্যমান আমার কাছে। আমি নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আদ্রিশ আমায় ছেড়ে দিলেন এবং বিনাবাক্যে আমার দিকে একধ্যানে চেয়ে রইলেন উনি। উনার এ চাহনিতে স্বাভাবিকতার ছিঁটেফোঁটাও নেই। বরং উনার এ চাহনিতে মিশ্রিত আছে মা*দকতা, ঘোর যা আমায় লজ্জায় আকণ্ঠ ডুবিয়ে মা’রতে যথেষ্ট।
আমি উনার এ চাহনির সামনে টিকে থাকতে না পেরে ডান হাত দিয়ে উনার চোখ দুটো চেপে ধরে বললাম,
” আজ দেখি আপনার এ নজর দিয়েই আমাকে মে’রে ফেলবেন আপনি! ”

আদ্রিশ মৃদু শব্দে হেসে উঠলেন। আলতো হাতে আমার হাতটা সরিয়ে নিদারুণ নে’শাক্ত কণ্ঠে বললেন,
” আজ না হয় আমার চাহনিতে একটু করে মৃ’ত হও। আমি না হয় ঢের ভালোবাসা দিয়ে তোমায় জীবিত করে তুলবো।”

এই বলে আদ্রিশ আমার কোমড় ধরে আমাকে নিজের নিকটে নিয়ে এলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। আদ্রিশ সেদিকে তোয়াক্কা করলেন না৷ বরং আমার চোখ হতে চশমা খুলে নিজের প্যান্টের পকেটে রাখলেন। অতঃপর আমার গালে আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে পূর্বের ন্যায় বললেন,
” ভেবেছিলাম তোমায় দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে যাবো। কিন্তু তুমি তো আমায় পাগল বানিয়ে ছাড়লে তোমার এ রূপে। আচ্ছা? এ রূপ এতোদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলো? আজ তোমায় না ডেকে আনলে তো এ রূপে আমি ঘায়েল হতাম না। এবার আমার এ ঘায়েল অবস্থার উন্নতি ঘটাতে কি করবে তুমি? তোমার স্বামী কিন্তু ঘায়েল হয়েই কুপোকাত হয়ে যাবে মিশমিশ। তোমার নতুন এ অদেখা রূপে আমায় ঘায়েল না করলেও পারতে তুমি। ”

আদ্রিশের কথায় আমি টিকতে পারলাম না। লজ্জায়, অনুভূতিতে উপায়ন্তর না পেয়ে টুপ করে উনার বুকে মাথা লুকালাম আমি। দু হাত দিয়ে জাপটে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। উনিও মৃদু শব্দে হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। খানিক বাদে টিপ্পনী কেটে বললেন,
” আজ আমার বউয়ের লাজ লজ্জা সব দেখি উধাও হয়ে গিয়েছে। কি ব্যাপার বলো তো? কি মনে করে সেই লজ্জা ভুলে আমায় নিজ থেকে জড়িয়ে ধরলে?”

আদ্রিশের এরূপ কথায় আমি লজ্জা পেলাম ঠিকই। কিন্তু উনার বুক থেকে মাথা তোলার সাহস পেলাম না। কারণ এরপর উনার সেই চাহনিতে ডুবে ম’রার চেয়ে এভাবে থাকা ঢের ভালো। আমি মৃদু হেসে বললাম,
” আপনার ঐ নজর থেকে বাঁচতেই এতো কিছু করা। আপনি জানেন না আপনার ঐ দুটো চোখ কতোটা খা’রাপ!”

আদ্রিশ এবার সশব্দে হাসলেন। আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমাকে উল্টো ঘুরিয়ে দিলেন। অতঃপর আমার কাঁধে থুতনি রেখে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
” আমার চোখদুটো খারাপ না কি তোমার এ রূপ, তোমার এ সৌন্দর্য খা’রাপ? যা আমাকে মোটেও ঠিক থাকতে দেয় না। আচ্ছা? আমায় দেখে কি তোমার প্রেম প্রেম পায় না?”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
” তা জানি না। আর জানলেও আপনাকে বলবো না। আপনার মতো আমি এতো বে’হায়া নই যে মুখে যা আসবে সব বলে দিবো। ”

” এমন বে’হায়াই হতে হয় মিশমিশ। এই আমি বেহায়া না হলে তোমার প্রতি ভালোবাসা দেখতে কি করে? আর আমি তোমার এ লাজুকতায় মাখা চেহারাখানা দেখতাম কি করে?”

আমি কোনোরূপ জবাব দিলাম না। আদ্রিশ পুনরায় বললেন,
” মেরুন রঙটা যে তোমার গায়ে এভাবে মানিয়ে যাবে ভাবতে পারিনি আমি। গায়ে মেরুন রঙ, আকাশে চাঁদের আলো সব দিয়ে অপ্সরী লাগছে তোমায়। ”

আমি সশব্দে হেসে আদ্রিশের হাতে চাপড় মেরে বললাম,
” এতো তেল কিভাবে দিতে পারেন আপনি? তেলেট বুঝি দাম নেই। ”

আদ্রিশ আমার কথায় আঘাত পেয়েছে এমন ভান করে বললেন,
” আহ! প্রেমিকের অনুভূতি প্রকাশকে তেল মা’রা বলে দিলে তুমি!”

” উঁহু, প্রেমিক নয়। স্বামী। আপনার প্রেমিক নামক অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। ”

” ইশ! ভুল কথা বললে। আমি বরং স্বামী রূপেই প্রেমিক হওয়ার নতুন যাত্রা শুরু করলাম কাল হতে। এখন এই প্রেমিকের ঢের ঢের রূপ দেখবে তুমি। ”
এই বলে আমার কাঁধে অধর ছোঁয়ালেন উনি। উনার এ স্পর্শে আপাদমস্তক কেঁপে উঠলাম আমি। নিজেকে উনার থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সকল শক্তিও হারালাম আমি।

—–

নতুন নতুন জিনিসের ইয়া লম্বা লিস্ট নিয়ে আমি ও আপু মার্কেট করতে বের হলাম। প্রথমে আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া আমাদের সাথে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমরাই তাদের আসতে নিষেধ করলাম। বললাম, মেয়েদের শপিং এ ছেলেদের থাকা উচিত নয় এবং আমরা নিবোও না। আমাদের এ যুক্তিতর্কে ইমাদ ভাইয়া হার মানলেন না। নিজে না আসলেও আমাদের পিছু পিছু দুজনে বডিগার্ড পাঠিয়ে দিলেন।
মার্কেটে এসে আমাদের থেকে একশ হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দিলাম৷ বডিগার্ডদের। প্রথমে তারা রাজি না হলেও আমার হুমকিধামকিতে রাজি হলো তারা।
বেশ…..মার্কেট শেষ হওয়ার পূর্বেই আপু ওয়াশরুমে যেতে উদ্যত হলো। আপু একা থাকায় আমিও আপুর পিছু পিছু এলাম। লেডিস ওয়াশরুমে আমাদের ঢুকতে দেখে বডিগার্ড দুজনে বেশ দূরত্বে দাঁড়িয়ে রইলো।

আমি আর আপু ওয়াশরুমে ঢুকলাম। আপাতত ওয়াশরুমে কাউকে না দেখে আমরা ওয়াশরুম থেকে বেরিয় টুকটাক গল্প শুরু করে দিলাম।
আচমকা ওয়াশরুমের প্রধান দরজা খুলে নির্দ্বিধায় চার পাঁচজন লোক ঢুকে পরলো। তাদেরকে লেডিস ওয়াশরুমে প্রবেশ করতে দেখে আমি ও আপু বিস্মিত হলাম। কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে আমি বললাম,
” আশ্চর্য! আপনারা কারা? লেডিস ওয়াশরুমে কেনো ঢুকেছেন? আপনাদের…..”
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই তন্মধ্যে একটি লোক আমার পিছনে এসে আমার মুখে একটু রুমাল চেপে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবিহ্বল হয়ে পরলাম এবং প্রথম নিঃশ্বাস নিতে না নিতেই সামনের সবকিছু ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে শুরু করলো। মুহূর্তে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। বুঝতে পারছি আমার ক্লোরো’ফর্ম শুকানো হয়েছে। কিন্তু এখন কিছু করার নেই। আমার চোখজোড়া ধীরেধীরে বুজে এলো। সাথে সাথে লোকটি আমাকে তাড়াহুড়ো করে ফ্লোরে ছেড়ে দিলো। স্পষ্ট অনুভব করলাম আমার হাত পা নির্জীব হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। আধো আধো চোখে দেখতে পেলাম আপুও নিস্তেজ হয়ে আছে এবং সেই লোকগুলো আপুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৩৯

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। মাথার উপর স্থির অবস্থানে থাকা ফ্যানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম আমি। অতঃপর পাশ ফিরে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম, জায়গাটা আমার পরিচিত নয়। তবে পুরোপুরি অপরিচিতও নয়। পুরো রুমের এক মাথা হতে অপর মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা আদ্রিশের রুম৷ কিন্তু আমি এ রূমে এলাম কি করে?
আচমকা আপুর কথা মনে পড়তেই আমি চট করে উঠে বসলাম। মনে হাজারো প্রশ্নের মেলা বসলো যেনো। আপু কোথায়? আপুকে কি সত্যি কিডন্যাপ করেছে না কি অন্য কিছু? আপুর খোঁজ কি পেয়েছে ওরা? নাহ, কিছুই বুঝতে পারছি না। কাউকে জিজ্ঞেস করা দরকার। কিন্তু রুমেও তো কেউ নেই। সবাই গেলো কোথায়?
এই ভাবতে ভাবতে আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। রুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম আব্বু আম্মু, আদ্রিশ, ইমাদ ভাইয়াসহ তিন বাড়ির প্রায় প্রতিটা সদস্য ড্রইং রুমে উপস্থিত। সকলের মুখশ্রীতে বিরাজমান রয়েছে দুশ্চিন্তার ছাপ। আম্মু ও আভা নীরবে কান্না করছে। আমি তাদের দেখে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম। আদ্রিশ আমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন। শেষ দু সিঁড়ি এগিয়ে এসে হাত ধরে আমাকে নামতে সাহায্য করলেন। আমার দিকে চেয়ে নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” এখন কেমন ফিল করছো মিশমিশ? দূর্বল লাগছে কি?”

আমি ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিলাম,
” হালকা একটু দূর্বল লাগছে। আগে বলুন আপুর কি হয়েছে? আমি যা আন্দাজ করছি এমন কিছুই হয়েছে?”

আদ্রিশ বুঝতে পারলেন আমি আপুর কিডন্যাপিং এর কথা বলছি। উনি মুখ ছোট করে বললেন,
” হ্যাঁ। নাফিসা ভাবীকে কিডন্যাপ করেছে। ”

আদ্রিশের কথায় আমি থমকে দাঁড়ালাম। যদিও আপুর কিডন্যাপিং এর কথা পূর্বেই আন্দাজ করেছিলাম তবুও আদ্রিশের জবানো এ কথা শুনে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। অঘোষিতভাবে দু চোখ বেয়ে টুপটুপ করে অশ্রু ঝরতে লাগলো। আদ্রিশ আমাকে নিয়ে এসে আম্মুর পাশে সোফায় বসালেন। আম্মু আমাকে দেখেই কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিলো। আমাকো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
” আমার মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে গেলো? কি করছে ওর সাথে? ও ঠিক তো আছে? নাফিসাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে মা? আমাকে বল না মা……”

আম্মুর এ করুণ কণ্ঠের সুর বারবার আমার কানে বাজতে লাগলো। এ কারণে আপুর জন্য চিন্তার পাহাড় পূর্বের তুলনায় আরো বৃদ্ধি পেলো। আম্মু আমাকে এভাবেই কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলো। অতঃপর আব্বু এসে আম্মুকে ছাড়িয়ে নিয়ে আভাকে বললো,
” আভা, তোর আম্মুকে নিয়ে গেস্টরুমে যা। বেচারি কান্না কান্না করতে শেষ হয়ে যাবে। ”
এই বলে আব্বু আম্মুকে বললো,
” এতো চিন্তা করো না। শুধু দোয়া করতে থাকো। আমাদের নাফিসাকে সহিসালামত পেয়ে যাবো ইন শা আল্লাহ। ”

আম্মু আব্বুর কথা শুনেও না শোনার ভান করলো। বরং পূর্বের তুলনায় আরো বেশি কাঁদতে লাগলো। আভা তা দেখে আম্মুকে জোরপূর্বক গেস্ট রুমে নিয়ে গেলো।
আম্মু চলে যেতেই আমি কান্না থামানোর চোখ করে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপুর কোনো খোঁজ পাওয়া গিয়েছে? ”

আদ্রিশ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” এখনও পাওয়া যায়নি।”

আমি আর প্রত্যুত্তর করলাম না। আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো লেডিস ওয়াশরুমের প্রতিটি ঘটনা৷ খানিক বাদে চারপাশের বিস্তর নীরবতা ভেঙে ইমাদ ভাইয়া আচমকা রেগে বলে উঠলেন,
” শা’লা বডিগার্ড দুটো এতোটা অকর্মা এটা জানতাম না। পাহাড়ের মতো শরীর নিয়েও যদি ওরা কাউকে প্রটেক্ট না করতে পারে তাহলে ঐ শরীরের ফায়দা কি? আমার মন চাইছে ঐ দুটোকে ইচ্ছামতো পিটাই। ”
এই বলে ইমাদ ভাইয়া কিছুক্ষণ থামলেন। ক্ষণিক বাদে পুনরায় বললেন,
” এতো সিকিউরিটি রেখে লাভ হলো কি? সেই শেষমেশ যার ভয়ে ছিলাম তাই হলো। আসলে মিম আর নাফিসাকে ঐ পিঁপড়ার মতো বডিগার্ডের ভরসায় দিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছি। দরকার ছিলো আমার অথবা আদ্রিশকে সেখানে থাকা। ”
এই বলে ইমাদ ভাইয়া দু হাতে মুখ ঠেকিয়ে প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে লাগলেন। আর আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলাম। এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে,এতো সহজে আপুর কিডন্যাপিং হওয়ার পিছনে কোথাও না কোথাও আমিও দায়ী। আমি যদি ঐ বডিগার্ড দুটোকে দূরে দূরে না থাকতে বলতাম তাহলে হয়তো এ অঘটনটা ঘটতো না।

ইমাদ ভাইয়ার সম্পূর্ণ কথা শুনে কামাল আংকেল সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কিসের ভয়ে ছিলি ইমাদ? তুই আগেই কি এসব আন্দাজ করেছিলি?”

কামাল আংকেলের এহেন প্রশ্নে আমার মনে ভয় ঢুকে গেলো। ইমাদ ভাইয়া যে কারণে বাসার সিকিউরিটি বাড়িয়েছেন তা আমরদ চারজন বাদে আর কেউ জানে না। এখন যদি ইমাদ ভাইয়া রাগের বশে সে কারণটা বলে দেয় তাহলে?
কামাল আংকেলের প্রশ্নের সাথে আব্বুও তাল মিলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কিসের কথা বলছো ইমাদ? নিজের মধ্যে কিছু রেখো না। আমাদের বলো। ”

ইমাদ ভাইয়া চট করে উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” আমার মাথাটা প্রচণ্ড ব্যাথা করছে। কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। আদ্রিশ আমাকে তোর রুমে নিয়ে চল প্লিজ। ”
এই বলে উনি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। উনার পাশাপাশি আদ্রিশও সেদিকে পা বাড়ালেন। প্রথম সিঁড়িতে পা রেখেই ইমাদ ভাইয়া পিছে ফিরে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
” মিম, তুমিও আসো। কিছু কথা আছে। ”

ইমাদ ভাইয়ার এহেন কথায় আমি কিছুটা দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে গেলাম। সামনের দিকে চেয়ে দেখলাম, এখানে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের চেহারায় সন্দেহের সুক্ষ্ম ছাপের দেখা মিলছে। কোনো সন্দেহ নেই যে ইমাদ ভাইয়ার কথাবার্তায়ই সকলেই নানা কিছু সন্দেহ করেছেন। আমি নিমিষের জন্য সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে ইমাদ ভাইয়া ও আদ্রিশের পিছু পিছু এলাম।

ইমাদ ভাইয়া ও আমি রুমে ঢুকতেই আদ্রিশ ভেতর থেকে দরজা আটকিয়ে দিলেন। উনাকে দরজা আটকিয়ে দিতে দেখে আমি সাথে সাথে দুজনকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনারা কেউ পুলিশকে জানাননি? ”

ইমাদ ভাইয়া ব্যালকনির দরজার সামনে দাঁড়ালেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” জানিয়েছি। কিন্তু পুলিশ এখনো রিপোর্ট লিখেনি। যদিও তারা ভেতরে ভেতরে খোঁজ করছে। ”

এ শুনে আমি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। অতঃপর সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এসব রোহান ভাইয়ার কাজ তাই না?”

ইমাদ ভাইয়া কিছু বললেন না। বরং আদ্রিশ হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
” ঐ কু”ত্তা ছাড়া আর কে-ই বা এতো জঘন্য কাজ করবে। ঐ…..”

আদ্রিশের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই উনার ফোনে একটি কল এলো। উনি পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে।”

ইমাদ এ শুনে সাথে সাথে ছুটে এসে আদ্রিশের সামনে দাঁড়ালেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন,
” নিশ্চয়ই রোহান কল করেছে। রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রাখ।”

আদ্রিশ ইমাদ ভাইয়ার কথামতো কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রাখলেন। কল রিসিভ হতেই ওপাশে রোহান ভাইয়ার কণ্ঠ শোনা গেলো,
” আদ্রিশ….বন্ধু আমার। কেমন আছো তুমি? বহুদিন পর তোমাকে মনে করলাম।”

রোহান ভাইয়ার তীব্র উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শুনে আমার শরীরে জ্বাল ধরলো। আদ্রিশ হাতের মুঠো শক্ত করে বললেন,
” ফোন করেছিস কেনো?”

ওপাশে রোহান ভাইয়া উচ্চস্বরে হেসে বললেন,
” এতো মাসুম হচ্ছিস কেনো আদ্রিশ? তুই জানিস না তোকে আমি কেনো কল করেছি? ”

আদ্রিশ কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরবে রয়ে আমাদের দিকে চাইলেন। অতঃপর রোহান ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
” নাফিসা ভাবীকে কেনো কিডন্যাপ করেছিস? ”

পুনরায় রোহান ভাইয়া হো হো করে হেসে উঠলেন।হাসির দমেকে বললেন,
” এই তো, নিজের ইন্টেলিজেন্সি বের করছিস তুই।”

” আমার প্রশ্নের জবাব দে রোহান। নাফিসা ভাবীকে কিডন্যাপ করার কারণ কি?”

রোহান ভাইয়া এ পর্যায়ে রসিয়ে রসিয়ে বললেন,
” কেনো আবার? আমার পুরোনো প্রেম সে। তাকে নিজের করে পেতে এনেছি আমার কাছে। তোরা তো ওর সাথে আমাকে মিল করিয়েই দিলি না। শেষমেশ বিয়ে দিলি ইমাদ নামের ঐ অকর্মার সাথে!”

রোহান ভাইয়ার কথা শুনে ইমাদ ভাইয়া প্রচণ্ড রেগে গেলেন। আদ্রিশের কাছ থেকে ফোন নিয়ে রোহান ভাইয়াকে দু চারটা গা’লি দিয়ে বললেন,
” নাফিসার যদি কিছু হয় তোকে আমি ছাড়বো না রোহান। ভালো মতো বলছি ওকে ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছে দে।”

রোহান ভাইয়া ওপাশে বিস্মিত হওয়ার ভান করে বললেন,
” ও বাবা! এ দেখি ইমাদ সাহেব! তা কেমন আছেন ইমাদ সাহেব?”

” রোহান, তোর এসব কথাবার্তা আমার একদম সহ্য হচ্ছে না। নাফিসাকে ঠিকঠাকমতো বাসায় দিয়ে যা।”

” মামা বাড়ির আবদার না কি ইমাদ সাহেব? ওকে এতো সহজে ছেড়ে দিলে এতোদিন অপেক্ষায় থেকে আনতাম না কি!”

আদ্রিশ এবার উঠে এসে রাগত স্বরে বললেন,
” কি চাস তুই রোহান? তুই নিশ্চয়ই শুধু নাফিসা ভাবীকে ঐ কারনে কিডন্যাপ করিসনি। আর কি রিজন আছে?”

” এই যে, এই যে, এই হলেন আমাদের ট্যালেন্টেড, উপস মাল্টিট্যালেন্টেড আদ্রিশ সাহেব। দেখো তোমরা সবাই। আমাদের আদ্রিশ সাহেব কি মারাত্মক ট্যালেন্টের অধিকারী! ”

” রোহান, সোজাসুজি তোর ডিমান্ডে চলে আয়। ”

ওপাশে রোহান ভাইয়া আয়েশি ভঙ্গিতে হাই ছেড়ে বললেন,
” তোর ঐ ড্রাগের ফর্মূলা আমায় দিয়ে দে আমার নাফিসাকে নিয়ে যা। ”

আদ্রিশ সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন,
” মোটেও না। ঐ ড্রাগের ফর্মূলা তোর হাতে কিছুতেই দেওয়া যাবে না। তুই ভালো করেই জানিস ঐ ড্রাগ কারোর উপর এপ্লাই করা হলে কি হবে।”

” জি হ্যাঁ। আমি এও জানি যে ঐ ড্রাগ এখন যে পর্যায়ে আছে সে পর্যায়ে কোনোরকম কিছু হলেই তোদের কোম্পানি ব্যানড,লকড হয়ে যাবে। সাথে তুই আর তোর বাপ দু জনেই জেলে চলে যাবে। বাহ, ভারী মজাদার ইনফেকশন তো!”

রোহান ভাইয়া ও আদ্রিশের এহেন কথোপকথনে আমি ও ইমাদ ভাইয়া বিস্মিত চাহনিতে আদ্রিশের দিকে চেয়ে রইলাম। তাহলে রোহান ভাইয়া এসব করেছেন আদ্রিশের কাছ থেকে সেই ফর্মুলা পাওয়ার জন্য?

আদ্রিশ বললেন,
” এর ফল সবই তোর জানা। তারপরও এর পিছনে পরে আছিস কেনো?”

ইমাদ ভাইয়া শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” সেসব জেনে তোর লাভ নেই। আমি যেটা বলছি সেটা কর। আমার হাতে ঐ ফর্মূলা দিয়ে নাফিসাকে নিয়ে চলে যা। আর হ্যাঁ, ইমাদ সাহেব। আপনার বউকে ঠিকঠাক পেতে চাইলে আপনার বন্ধুকে আমার ডিলে রাজি হতে বলুন। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া কল কেটে দিলেন। সাথে সাথে আমি ও ইমাদ ভাইয়া প্রশ্নাতুর চাহনিতে আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আদ্রিশ আমাদের দিকে এক নজর চেয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন। বিরবির করে বললেন,
” আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছি ঐ রিসার্চট করে। ”

আমি আদ্রিশের সম্মুখপানে দাঁড়িয়ে বললাম,
” কি বানিয়েছেন আপনি যার কারণে রোহান ভাইয়া এভাবে আপনার পিছনে পরে আছে? এমনকি সে আপুকে পর্যন্ত কিডন্যাপ করে নিয়েছে!”

আদ্রিশ আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বরং হাঁটুর উপর দু-হাত রেখে থুতনিতে ভর দিয়ে বসে রইলেন। এবার ইমাদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার আদ্রিশ? বল।”

আদ্রিশ মিনমিনে কণ্ঠে বললেন,
” এটা কনফিডেনসিয়াল। আপাতত তোদের সাথে শেয়ার করা সম্ভব হচ্ছে না। ”

আদ্রিশের এরূপ কথা শুনে ইমাদ ভাইয়া রেগে পাশে থাকা চেয়ারটা ফেলে বললেন,
” কিসের কনফিডেনসিয়াল? ওখানে নাফিসা বিপদে পড়েছে। আর তোর ফর্মুলা না কি হ্যানত্যানের কনফিডেনসিয়াল ব্যাপার যাচ্ছে না। কি নিয়ে এসব হচ্ছে। আমি সব শুনতে চাই। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। ”

আদ্রিশ অসহায় চাহনিতে আমার ও ইমাদ ভাইয়ার দিকে তাকালেন। অতঃপর প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন……..

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here