ভুলবশত_প্রেম,৪০,৪১

0
776

#ভুলবশত_প্রেম,৪০,৪১
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৪০

প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে আদ্রিশ বললেন,
“এমাইট্রোফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরেরোসিস। রোগটার নাম শুনেছো?”

আমি ও ইমাদ ভাইয়া এপাশ ওপাশ মাথা দুলালাম। অর্থাৎ আমরা কেউই এ রোগের নাম শুনিনি৷ ফলে আদ্রিশকে বললাম,
” না। এ রোগের নাম আজ প্রথম শুনছি। ”

আদ্রিশ ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” শোনারও কথা না। কারণ রোগটা পরিচিত কোনো না রোগ না৷ পরিচিত না হওয়ার কারণ আছে। কারন এ রোগ কোনো রোগ না। সবচেয়ে বড় কথা, এ রোগের কোনো কিউর নেই। দ্যাট মিনস কোনো চিকিৎসা নেই৷ পুরোপুরিভাবে ঠিক হয় না এটা। ”

উনার কথা শুনে আমার ভেতরে কৌতূহল জাগলো। আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কিন্তু এ রোগে আসলে হয় কি?”

” এটা নার্ভাস সিস্টেমের একটা ডিজিজ। যেটা ব্রেইন আর স্পাইনাল কর্ডকে ইফেক্ট করে। এর কারণে মানুষ মাসলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ”

” মাসলের নিয়ন্ত্রণ বলতে?”

” এই যেমন ধরো, মাসল দূর্বল হয়ে যাবে এ রোগে। আর যতই রোগটা বাড়বে ততই মানুষের হাতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। কথা বলা, হাঁটাচলা করা এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসেও সমস্যা হয়। ”

” এটা কি জেনেটিক্যালি হয়?”

” হ্যাঁ। সেক্ষেত্রে রোগের কারণগুলো জানা থাকে না। ”

” এ রোগে কি মানুষ মারা যায়?”

” অবশ্যই। ডাক্তাররা ধরাবাঁধা সময়ও দিয়ে দেয় রোগীকে। মাত্র কয়েক বছর। এই ধরো তিন থেকে পাঁচ বছর। কিন্তু এমনও হয়েছে যে ডাক্তারদের নির্ধারণ করে দেওয়া সময়ের চেয়েও বেশি সময় বাঁচে অনেকেই। স্টিফেন হকিংই তার উদাহরণ।”

আদ্রিশের কথায় আমি ও ইমাদ ভাইয়া বিস্মিত হলাম। বিস্ময় সহিত জিজ্ঞেস করলাম,
” এর মানে এই রোগটা স্টিফেন হকিংয়েরও হয়েছিলো!”

” হ্যাঁ। আর উনি তো উনার জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া সময়ের চেয়েও অনেক বেশিদিন বেঁচেছিলেন। ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন উনি৷ ”

” এ রোগে মানুষ ধরাবাঁধা সময়ই বেঁচে থাকে কেনো? মানে, এ রোগে কি কারণে মানুষ মারা যেতে পারে ঐ সময়ের মধ্যে?”

” এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ মানুষই মারা যায় রেসপিরেটরি ফেইলিউরের কারণ। অর্থাৎ শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হওয়ার কারণে। শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যাও হয় সেই মাসল অর্থাৎ মাংসপেশির কারণে৷ এক্ষেত্রে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার সময় যে মাসলগুলো সাহায্য করে সেগুলো প্যারালাইসিস হয়ে যায়। এর কারনে মানুষ মারা যায়। তবে অনেক সময় শ্বাসপ্রশ্বাসে সাপোর্ট করার জন্য ট্রাকিওটমিও করা হয়। ”

এই বলে আদ্রিশ প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আমি উনার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা শেষে উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলেই ইমাদ ভাইয়া সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” এর মানে এই রোগের সাথে তোর ফর্মুলার কোনো সম্পর্ক আছে? ”

আদ্রিশ হতাশাজনক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” হ্যাঁ। আর এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। ”
এই বলে আদ্রিশ ক্ষণিকের জন্য থামলেন। অতঃপর বললেন,
” এই রোগ পুরোপুরিভাবে ঠিক করা যায় না। তবে কিছু থেরাপির মাধ্যমে এটার উপশম করা যায়। আমার মাথায় কি চলছিলো আল্লাহ ভালো জানেন। অনেকদিন ধরেই এই রোগটা সম্পর্কে অনেক রিসার্চ করছিলাম। এ রোগ হলে যেনো পেশেন্ট পুরোপুরিভাবে ঠিক হতে পারে সেজন্য একটা ড্রাগ ফর্মুলা খুঁজছিলাম। অনেক রিসার্চের পর একটা ড্রাগ বানাতে পেরেছি৷ কিন্তু এটা এখনও প্রসেসিং পর্যায়ে আছে। অর্থাৎ এতে আরো রিসার্চের প্রয়োজন। এখন ড্রাগটা যে পর্যায়ে আছে এটা যদি রোগীর শরীরে ইনজেক্ট করা হয় তাহলে রোগী কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যেতে পারে বা তার অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে পারে। যেখানে আমি রোগীর প্রাণ বাঁচাতে ড্রাগ ফর্মুলা বের করছি সেখানে আমি কিছুতেই চাইবো না রোগী মারা যাক। এজন্য এই ড্রাগ নিয়ে আরো রিসার্চ করতে হবে। ”

আদ্রিশের কথায় আমি বিস্ফোরিত নয়নে ক্ষণিকের জন্য উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ এতোদিন ধরে আমি উনাকে চিনি। অথচ উনি এ ব্যাপারে আমাকে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেননি!

এই অব্দি উনার কাছে যা যা শুনলাম তাতেও আমার মনে প্রশ্ন রয়ে গেলো যে, রোহান ভাইয়া এখন কেনো ফর্মূলাটা চাইছেন? এ চিন্তার সূত্র ধরেই আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি ড্রাগটা পুরোপুরি বানিয়ে ফেললেই রোহান ভাইয়া সেটি চাইতে পারতেন। এখনই বা কেনো চাইছেন উনি?”

আদ্রিশ পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” ও চাইছে এ ড্রাগটা ইউজ করে আমার ক্যারিয়ার, আব্বুর কোম্পানির নাম নষ্ট করতে। এখন এ ড্রাগ ওর হাতে দেওয়ার পর ও যদি কোনো রোগীর শরীরে এটা ইনজেক্ট করে তাহলে রোগী নির্ঘাত মারা যাবে এবং এর সম্পূর্ণ দায়ভার পরবে আমার ও আমাদের কোম্পানির উপর। এ কারণে সরকার আমাদের কোম্পানিও বন্ধ করে দিতে পারে আর আমাদের রেজিস্ট্রেশনও ক্যান্সেল করিয়ে দিতে পারে। তাহলে বুঝতে পারলে রোহান কেনো এই ফর্মুলাটা চাইছে?”

সম্পূর্ণ ব্যাপারটি ধরতে পেরে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ বসে রইলাম। রোহান ভাইয়া যে কতোটা খারাপ মানুষ তা চিন্তা করতেই আমার শরীর শিউরে উঠলো। আদ্রিশ আরো বললেন,
” আমার মনে হয় মিস্টার ইকবালের সাথে ও ডিল করেছে এই ফর্মূলা বাইরের দেশে বিক্রি করার জন্য৷ এমনও হতে পারে যে মিস্টার ইকবাল ফর্মুলাটা নিয়ে বাকি প্রসেসিং করিয়ে এটা নিজের নামে চালাবেন। হয়তো……”

আদ্রিশের কথা সম্পূর্ণ শেষ হতে না হতেই আবারো উনার ফোনে কল এলো। স্ক্রিনে শুধু নাম্বার দেখেই আদ্রিশ সুপ্ত রাগ নিয়ে বললেন,
” রোহান আবারো কল করেছে। ”

উনার কথা শোনামাত্রই ইমাদ ভাইয়ার চেহারার রঙ বদলিয়ে গেলো। উনি উদ্বিগ্নতার সহিত আদ্রিশকে বললেন,
” কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিস আদ্রিশ।”

আদ্রিশ ইমাদ ভাইয়ার কথামতো কাজ করলেন। কল রিসিভ করতেই ওপাশে রোহান ভাইয়া বললেন,
” ওহ হ্যাঁ, তোদেরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন দেওয়া হয়নি। ”

আদ্রিশ কিছুটা ক্রোধান্বিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ইনফরমেশন দেওয়া বাকি আছে তোর?”

রোহান ভাইয়া প্রচণ্ড উৎসুকভাবে বললেন,
” তোর নাফিসা ভাবীর প্রাই’ভেট ভিডিও আছে আমার কাছে। বুঝতে পারছিস? ওর শা’ও’য়া’র নেওয়ার ভিডিও আছে আমার কাছে। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া পৈশাচিক আনন্দে হেসে উঠলেন।
রোহান ভাইয়ার এ কথা শোনার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি নিজের কানকে কিছুতেই এ কথা বিশ্বাস করাতে পারলাম না। আকস্মিক ঘটনার ধাক্কায় আমি ধপ করে নিচে বসে পড়লাম। স্তব্ধ চাহনিতে আদ্রিশের ফোনের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার পুরো পৃথিবী যেনো চক্কর দিতে শুরু করলো। শেষমেশ আমার আপুর ইজ্জত সম্মান সব খোয়া গেলো! রোহান ভাইয়া আমার আপুর মানসম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলো!

ইমাদ ভাইয়া কোনো কথা বলছেন না। উনি স্তব্ধ চাহনিতে আদ্রিশের দিকে চেয়ে রইলেন। আদ্রিশের দৃষ্টিও একই। এরূপ অকল্পনীয় কিছু ঘটনার সম্মুখীন উনি হবেন তা হয়তো উনি কল্পনাও করেননি।
ক্ষণিক বাদে রোহান ভাইয়া বলে উঠলেন,
” কি ব্যাপার? সব দেখি এক্কেবারে চুপ হয়ে গেলো। বড়সড় ঝটকা লাগলো না কি রে?”

আমরা কেউই কোনোরূপ কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে রইলাম না। কয়েক সেকেন্ড বাদে আদ্রিশ থমথমে গলায় বললেন,
” এজন্যই তুই নাফিসা ভাবীকে কিডন্যাপ করেছিস? ”

” অবভিয়েসলি….. আমার কাছে একটা মেয়ের এতো বড় দূর্বল জিনিস রয়েছে আর সেটার আমি ফায়দা উঠাবো না। এটা টোটালি ইম্পসিবল দোস্ত। তোর ফর্মুলা পাওয়ার জন্য আমি প্রথমে তোর ওয়ান এন্ড ভালোবাসা মিমকে কিডন্যাপ করার প্ল্যানিং করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে নাফিসার ভিডিও পাওয়ার পর আমার পুরো প্ল্যানই চেঞ্জ হয়ে গেলো। শেষমেশ প্ল্যান মোতাবেক আমি নাফিসাকে কিডন্যাপ করাই।
এখন সবচেয়ে বড় কথা…… তুই বা তোর পরিবারের কেউ যদি নাফিসার কিডন্যাপের ব্যাপারে পুলিশ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিস, তাহলে আই সয়্যার, নাফিসার ভিডিও আমি ভাইরাল করে দিবো। তখন বুঝে নিস, কত ধানে কত চাল। তাহলে নাফিসাকে ছাড়িয়ে নিতে কি করতে হবে তোকে? সিম্পল, ফটাফট আমাকে ফর্মুলা দিবি আর নাফিসাকে নিয়ে যাবি। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া খট করে কল কেটে দিলো।

(বি:দ্র: আজকের পর্বে আমি যে রোগটি সম্পর্কে আলোচনা করেছি তার সবটাই সত্য। নেট থেকে ইনফরমেশন কালেক্ট করে লিখেছি। সবচেয়ে বড় কথা, গল্পের প্রয়োজনে আমি এটা ব্যবহার করেছি যে রোগটি সারিয়ে তোলার জন্য ড্রাগ বা মেডিসিন উদ্ভাবন করা হয়েছে। কিন্তু আসলে এ রোগ পুরোপুরি সারিয়ে তোলার জন্য কোনো ড্রাগ বা মেডিসিন উদ্ভাবন করা হয়নি৷ আমি গল্পের প্রয়োজনে কাল্পনিকভাবে এটি ব্যবহার করেছি। তাই দয়া করে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। আর এই ইনফরমেশন নিয়ে লেখার কারনেই এ পর্ব দিতে দেরি হয়েছে। দুঃখিত?)

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪১

ইমাদ ভাইয়া মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন। উনার দৃষ্টি হতবিহ্বল। মুখশ্রীতে তীব্র আতঙ্ক। ইমাদ ভাইয়া বিমর্ষ গলায় বললেন,
” আমার সব শেষ রে আদ্রিশ। সব শেষ। ”

আদ্রিশ ম্লান দৃষ্টিতে ইমাদ ভাইয়ার দিকে চাইলেন। স্বান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়াস করে বললেন,
” চিন্তা করিস না ইমাদ। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে। নাফিসা ভাবীর কিছু হবে না। ”

আদ্রিশের চাহনি ও কণ্ঠস্বর স্পষ্ট জানান দিচ্ছে উনি মন থেকে এসব বলতে পারেননি। ইমাদ ভাইয়াকে মিথ্যে স্বান্ত্বনা দিয়েছেন। কেননা কোথাও না কোথাও উনিও আপুকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। এদিকে আমি ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ছি। বারংবার আপুর চেহারা আমার দৃষ্টির সম্মুখে ভাসমান হলো। আমি কিছুতেই রোহান ভাইয়ার কণ্ঠে বলা শেষ কথাগুলো ভুলতে পারছি না। উনি যদি আপুর সাথে কিছু করে বসেন তখন কি হবে? সবচেয়ে বড় কথা আপু এখন কি অবস্থায় আছে তার কিছুই জানি না আমরা। আপুকে কিভাবে রেখেছে, কি করছে আপুর সাথে কিছুই জানা নেই আমাদের। শুধু এটুকু জানি, রোহান ভাইয়া মানুষটা প্রচণ্ড খারাপ, প্রচণ্ড স্বার্থপর, প্রচণ্ড ভয়ংকর। উনি যদি আপুর সাথে কিছু করে বসে তখন আমাদের কিছুই করার থাকবে না৷ কিছুই না। আচ্ছা? আপুর ভিডিও পাওয়ার ব্যাপারটা আব্বু আম্মুর কান অব্দি পৌঁছালে কি হবে? আব্বু আম্মু সইতে পারবে তো তাদের মেয়ের এ অবস্থা? সবচেয়ে বড় কথা, আপুর শ্বশুর শাশুড়ী এ নিয়ে জানলে কি হবে! আপুকে তারা মেনে নিবে তো? এসব আমার ভাবনায় আসতেই আমার সম্পূর্ণ শরীর শিউরে উঠলো। আতঙ্কে দু হাত ঠাণ্ডা হওয়ার উপক্রম হয়ে এলো।
আমি ইমাদ ভাইয়া ও আদ্রিশের দিকে অসহায় চাহনিতে চাইলাম। নিস্তরঙ্গ গলায় ইমাদ ভাইয়াকে বললাম,
” ইমাদ ভাইয়া? আপুর এ ভিডিওর ব্যাপারটা শুধু আমাদের তিনজনের মাঝে রাখা যায় না?”

ইমাদ ভাইয়া চোখ তুলে চাইলেন আমার দিকে। মুহূর্তেই উনার দু চোখ দেখে চমকে উঠলাম আমি। উনার দু চোখ প্রায় রক্তলালের ন্যায় রঙ ধারণ করেছে। উনি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” এ নিয়ে বাইরে টু শব্দটুকুও হবে না। ”

ইমাদ ভাইয়ার জবাবে আমি ক্ষীণ স্বরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম৷ যদিও জানি, ইমাদ ভাইয়া কখনোই এ ব্যাপারে অন্য কারোর সাথে আলোচনা করতেন না।

ক্ষণিক সময় বাদে আদ্রিশ উঠে দাঁড়ালেন। ব্যালকনির কাছে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন,
” এখন নাফিসা ভাবীকে কিভাবে বাঁচাবো তাই ভাবতে হবে। ইমাদ? তোর মাথায় কিছু আসছে?”

ইমাদ ভাইয়া তৎক্ষনাৎ কোনো জবাব দিলেন না। বরং উঠে দাঁড়িয়ে আদ্রিশের নিকটে গেলেন। উনার সম্মুখে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” হ্যাঁ এসেছে। ”

আদ্রিশ ও আমার চক্ষুজোড়া মুহূর্তেই আশার আলোয় সপ্রতিভ হলো। আমি তৎক্ষনাৎ উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি? জলদি বলুন ইমাদ ভাইয়া। ”

ইমাদ ভাইয়া স্থির চাহনিতে আদ্রিশের দিকে চেয়ে বললেন,
” ঐ ফর্মূলা। ঐটাই নাফিসাকে ছাড়ানোর একমাত্র উপায়। ”

উনার এরূপ জবাবে অবিলম্বে আদ্রিশ তেঁতে উঠলেন। বললেন,
” পাগল হয়ে গিয়েছিস না কি? তোকে ওসব সম্পর্কে সবটা বলার পরও তুই এমন সল্যুউশন দিস কি করে?”

ইমাদ ভাইয়াও আদ্রিশের কথার পিঠে তেঁতে উঠে বললেন,
” তো আমি কি করবো আদ্রিশ? আর কোনো উপায় আছে তোর কাছে? ”
এই বলে উনি জবাবের অপেক্ষায় আদ্রিশের দিকে চাইলেন। স্বভাবতই আদ্রিশ জবাব দিতে ব্যর্থ হলেন। ইমাদ ভাইয়া পূর্ণ উদ্যমে রাগত স্বরে বললেন,
” জানতাম তোর কাছে কোনো উপায় থাকবে না। কারণ এসবের জন্য তুই দায়ী। তোর কারণেই নাফিসার আজ এ অবস্থা। ”

আদ্রিশ হতবাক হয়ে বললেন,
” আমি এসবে দায়ী হলাম কি করে? শুধু শুধু আমাকে দায়ী করিস না ইমাদ।”

” শুধু শুধু না। অবশ্যই কারণেই তুই দায়ী। তোর ঐ ফর্মূলার কারণেই আজ এতো কিছু। ”

” তুই এভাবে আমাকে দোষ দিতে পারিস না ইমাদ। ”

” অবশ্যই দোষ দিবো। তোর কারণে নাফিসার আজ এ অবস্থা। তুই ফর্মূলাটা ওকে দিয়ে দিলেই পারিস। তাহলেই ও নাফিসাকে ছেড়ে দিবে। ”

” তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস না কি ইমাদ? রোহানকে এসব দিলে ও কি করতে পারে তা তুই আইডিয়াও করতে পারবি না৷ আমি মরে গেলেও ঐ ফর্মূলা দিবো না। ”

আচমকা ইমাদ ভাইয়া আদ্রিশের শার্টের কলার চেপে ধরে রাগত স্বরে বললেন,
” তোকে দিতেই হবে। তোর জন্যই আজ নাফিসা ওর কবলে। তুই ঐ ফর্মূলা দিবি মানে দিবি। আমি আর কিছু জানি না। ”

এ পর্যায়ে আদ্রিশও প্রচণ্ড ক্রোধে ইমাদ ভাইয়ার টিশার্টের কলার চেপে ধরে বললেন,
” আমি কখনোই রোহানকে ঐ ফর্মূলা দিবো না। এটা জেনে রাখ তুই। ”

ইমাদ ভাইয়া ও আদ্রিশের এহেন কাণ্ড দেখে আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। তৎক্ষণাৎ উনাদের কাছে গিয়ে একে অপরের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনাদের শক্তির কাছে ব্যর্থ হলাম। আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া ঠাণ্ডা চাহনিতে একে অপরের দিকে চেয়ে আছেন। আমি পুনরায় উনাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললাম,
” আপনাদের দুজনের মাথা ঠিক আছে তো? শুধু শুধু অকারণে নিজেদের মধ্যে লড়ছেন কেনো? ছাড়ুন প্লিজ। আপনাদের এ চিৎকার চেঁচামেচি নিচ অব্দি গেলে অনেক সমস্যা হয়ে যাবে। ”

সাথে সাথে আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া একে অপরের কলার ছেড়ে দাঁড়ালেন। ইমাদ ভাইয়া ক্লান্তশ্বাস ছেড়ে চেয়ার টেনে বিছানার কাছে বসলেন। আর আদ্রিশ আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। ইমাদ ভাইয়ার দিকে নিমিষের জন্য চেয়ে আমার দিকে চাইলেন। নিরাধার কণ্ঠে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমারও এমনটা মনে হয় মিশমিশ যে এসবের জন্য আমি দায়ী?”

আমি আদ্রিশের গালে এক হাত রেখে কোমল কণ্ঠে বললাম,
” উঁহু। আপনি কোনোদিক দিয়েই এসবের জন্য দায়ী নন। ইমাদ ভাইয়া রেগে আছেন এ মুহূর্তে। আপনার উচিত উনাকে সামলানো। কিন্তু আপনিও যদি রেগে যান তাহলে পরিস্থিতি সামলানোর খুব কঠিন হয়ে যাবে। বুঝতে পারছেন আমার কথা?”

আদ্রিশ মন্থর গতিতে মাথা দুলালেন। ম্লান হেসে আমার পানে চাইতেই আমি উনাকে ছেড়ে দিয়ে কিঞ্চিৎ দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি গিয়ে দাঁড়ালেন ইমাদ ভাইয়ার নিকটে। ইমাদ ভাইয়ার সম্মুখে বিছানায় বসে বললেন,
” ঠাণ্ডা মাথায় সবটা ভাবতে হবে ইমাদ। এভাবে রাগারাগি করলে কখনোই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব না। আমরা যেহেতু পুলিশের সাহায্য নিতে পারছি না সেক্ষেত্রে আমাদের মধ্যেই কিছু না কিছু প্ল্যানিং করতে হবে। ”

ইমাদ ভাইয়া হতাশাব্যাঞ্জক কণ্ঠে বললেন,
” কিন্তু কি করবো আমরা? আমার মাথা পুরোপুরি ব্ল্যাঙ্ক হয়ে আসছে। কিচ্ছুই মাথায় আসছে না। ”

আদ্রিশ ক্ষণিক সময় নিয়ে কিছু ভাবলেন। অতঃপর বিছানার উপর হতে ফোন নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কন্ট্যাক্ট লিস্ট হতে কারোর নাম্বার নিয়ে কল দিলেন। আমি এ দেখে কৌতূহলী হয়ে উনার পাশে গিয়ে বসলাম।
খানিক সময় নিয়ে ওপাশের ব্যক্তিটি কল রিসিভ করলেন। তৎক্ষণাৎ আদ্রিশ স্বাভাবিক কণ্ঠে সাধারণ হালচাল জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপর বললেন,
” দিদার? আমাকে একটা হেল্প করতে পারবি?”

“……”

” আমি একটা নাম্বারের লোকেশন জানতে চাইছিলাম। আমাকে লোকেশনটা ট্রেস করে জানাতে পারবি? খুব আর্জেন্টলি দরকার।”

“…..”

” প্লিজ দিদার। হেল্পটা খুব দরকার। আর্জেন্ট না হলে বলতাম না। ”

“…..”

” আচ্ছা। একটু দ্রুত দেখে আমাকে জানা। রাখছি। ”

এই বলে আদ্রিশ ফোন রেখে রোহান ভাইয়ার নাম্বার ঐ ব্যক্তিটিকে দিয়ে বললেন,
” একটু সময় লাগবে। ওয়েট করি।”

দীর্ঘ সময়ের জন্য আমরা তিনজনে চুপচাপ বসে রইলাম। আচমকা আদ্রিশের ফোন বেজে উঠতেই আমি চমকে উঠলাম। আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়াও কিঞ্চিৎ চমকে উঠলেন।
আদ্রিশ কল রিসিভ করেই লাউডস্পিকারে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” হ্যাঁ দিদার, বল। ”

” তুই আমাকে যে নাম্বার দিলি তার লোকেশন দুইবার দু জায়গায় এসেছে। প্রথমবার যখন কল করেছিলো তখন ওর লোকেশন ছিলো ‘গ্রিন ভিউ’ রেস্টুরেন্টে। পরেরবার যখন কল করলো তখন লোকেশন ছিলো হাইওয়েতে। এখন ওর লোকেশন ভূইয়া রোডের একটা বাড়িতে।”

” আমাকে কল করার আগে ওর লোকেশন কোথায় ছিলো? ”

” সরি দোস্ত। ওটা বের করা যায়নি। কারণ গত দুদিন পর আজই এ নাম্বারটা ওপেন করা হয়। ”

লোকটির তথ্যগুলো শোনার পর আমরা একে অপরের দিকে নিমিষের জন্য তাকালাম। আদ্রিশ লোকটিকে ধন্যবাদ বলে কল কেটে দিলেন। অতঃপর কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন,
” দ্যাট মিনস ও এখন বাসায়।
রোহান কম চালাক নয়। ও হয়তো আইডিয়া করেছে আমরা ওর লোকেশন ট্রেস করবো। এজন্য নাফিসা ভাবীকে যে জায়গায় কিডন্যাপ করে রেখেছে সেখান থেকে আমাকে কল করেনি। হয়তো ঐ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার পর ফোন অন করে আমাদের কল করে। ”

আমি ও ইমাদ ভাইয়া আদ্রিশের সাথে সায় দিলাম। ইমাদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
” তাহলে ও কোথায় নাফিসাকে লুকিয়ে রাখতে পারে?”

আদ্রিশ বললেন,
” অবশ্যই ওর চেনাপরিচিত কোনো জায়গায়। কিন্তু সমস্যা হলো, ওর সেই চেনাপরিচিত জায়গা আমরা কিভাবে খুঁজে পাবো?”

” আচ্ছা? এমন পরিস্থিতিতে রোহান নাফিসাকে কোথায় লুকিয়ে রাখতে পারে বলে তোর মনে হয়?”

” যতদূর মনে হয় ও এমন কোনো জায়গায় নাফিসা ভাবীকে লুকিয়ে রেখেছে যেখানে পৌঁছানো হয়তো সহজ। কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনা সেখানে পৌঁছাবে না। ”

এই বলে আদ্রিশ ভাবুক চাহনিতে ইমাদ ভাইয়ার দিকে চাইলেন। ইমাদ ভাইয়া ক্ষণিক বাদে চট করে বললেন,
” ওদের বাড়িতে? কারণ কেউ নিশ্চয়ই ভাববে না যে নরমালি কিডন্যাপ করলে কেউ তার বাড়িতে লুকিয়ে রাখবে।”

আমি তৎক্ষনাৎ বিরোধিতা করে বললাম,
” নাহ। রোহান ভাইয়া কখনোই উনার বাড়িতে আপুকে লুকিয়ে রাখবেন না। কারণ উনাদের বাড়ির প্রায় সব জায়গায় উনার বোন ও মা প্রায়ই যায়। এমনকি উনাদের বাড়ির পিছনের সাইডে গোডাউন মতো যে জায়গা আছে সেখানেও রিতু মাঝে মাঝেই যাওয়া আসা করে। আগে আমি যখন রিতুদের বাসায় যেতাম তখন রিতু প্রায়ই আমাকে সেখানে নিয়ে যেতো। এজন্য, আমার মনে হয় না রোহান ভাইয়া বাড়িতে আপুকে লুকিয়ে রেখেছে।”

আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া পুনরায় ভাবতে লাগলেন। খানিক বাদে আদ্রিশ অনুসন্ধানী কণ্ঠে বললেন,
” তাহলে নাফিসা ভাবীকে কোথায় লুকিয়ে রাখতে পারে ও?”

আদ্রিশের প্রশ্নের জবাবে আমি ক্ষণিকের জন্য এ নিয়ে ভাবলাম। ভাবনার মাঝে একটা জায়গার ব্যাপারে মাথায় আসতেই আমি চট করে বললাম,
” আমার মনে হয় আমি জানি, রোহান ভাইয়া আপুকে কোথায় রেখেছে।”

আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া প্রজ্জ্বলিত চাহনিতে আমার দিকে চাইলেন। ইমাদ ভাইয়া ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায়? কোথায় রেখেছে ওকে?”

” আমার মনে হয়……..”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here