ভুলবশত_প্রেম,৪৮,৪৯

0
1940

#ভুলবশত_প্রেম,৪৮,৪৯
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৪৮

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। ক্ষণিকের মাঝেই নিজেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। মুহূর্তমধ্যেই আমার হৃদপিণ্ড ধক করে উঠলো৷ তুমুল গতিতে দ্রিমদ্রিম শব্দে ভয়ের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সে। দু হাত পা বাঁধা দেখে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি, আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসা হয়েছে৷ আর এ কাজটি করেছে রোহান ভাইয়া। স্পষ্ট মনে করতে পারলাম সেসময় হোটেল রুমে রোহান ভাইয়া ছিলেন। কিন্তু উনি রুমে এলেন কি করে?

আমি সম্পূর্ণ চোখ মেলে পরিবেশটা দেখলাম। আমাকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে চারিদিকে আবছা অন্ধকার। কেমন যেনো গুমোট একটা পরিবেশ৷ ভ্যাপসা এক প্রকার গন্ধও এসে বাড়ি খেলো নাকে। বোধহয় জায়গাটা পরিত্যক্ত ধরনের বা কেউ খুব একটা আসা-যাওয়া করে না। কিন্তু এ জায়গাটা আসলে কোথায়? রোহান ভাইয়া আমাকে কোথায় এনে রেখেছেন? গুমোট পরিবেশের রুমে থেকে বাইরের পরিবেশ অনুমান করতে পারলাম না আমি।

হাত দুটো পিঠের দিকে বাঁধা, পা দুটোও বাঁধা। হাতের যন্ত্রণাকর বাঁধন খুলতে সাধ্যমত চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু ফলাফল শূন্য। পা দুটো নাড়িয়ে পায়েরও বাঁধন খুলতে চেষ্টা করলাম। খানিক সময়ের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলাম। হঠাৎ রুমে শব্দ শুনতে পেয়ে তটস্থ হয়ে বসে রইলাম আমি। নিশ্চয়ই রোহান ভাইয়া এসেছেন।
আমার ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করে রোহান ভাইয়াই রুমে ঢুকলেন। কালো একটা জ্যাকেট পরে মাথায় হুডি তুলে দিয়েছেন উনি। উনাকে দেখামাত্র শক্ত গলায় বলে উঠলাম আমি,
” এভাবে আমাকে কিডন্যাপ করার উদ্দেশ্য কি আপনার? ”

রোহান ভাইয়া হুডি খুলে ফিচেল হাসি দিলেন। ধীরেসুস্থে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে বললেন,
” উদ্দেশ্য যে ভালো কিছু না তা তুই ভালো করেই জানিস। ”

রোহান ভাইয়ার এ প্রতিক্রিয়ায় আমার শরীর ঘিনঘিন করতে লাগলো। আমি তীব্র ঘৃণা সহকারে বললাম,
” এক ফর্মুলার পিছনে এভাবে পরে আছেন কেনো আপনি? নিজ বুদ্ধিতে একটা বানলেও তো পারেন। ”

রোহান ভাইয়া কৌতুক শুনেছে এমন ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে বললেন,
” এতো সহজেই যে ফর্মুলা আমি নিতে পারবো সেখানে বছরের পর বছর সময় দিবো কেনো?”

” কে বলেছে আপনাকে যে আপনি এতো সহজেই ফর্মুলা নিতে পারবেন?”

” তা নয়তো কি? গতবার পারিনি। কিন্তু এবার পারবো। কারণ এবার আদ্রিশের কলিজায় হাত দিয়েছি আমি। ”
এই বলে উনি পূর্বের ন্যায় হেসে উঠলেন। উনার হাসি দেখে আমার শরীর জ্বলতে লাগলো। আমি প্রচণ্ড ঘৃণা সহকারে বললাম,
” আপনার মতো জঘন্য মানুষ হয়তো দ্বিতীয়টা নেই। ছিঃ একবারও কি আপনার বিবেকে বাঁধে না এসব করতে?”

রোহান ভাইয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বিশ্রি রকমের একটা হাসি দিলেন। বললেন,
” আমি তো এখনও কোনে জঘন্য কাজ করিনি রে মিম। করবো। খুব শীঘ্রই করবো। যা তোর বোনের সাথে করতে পারিনি তা তোর সাথে করবো৷ বুঝতে পারছিস তো কি বলতে চাইছি আমি?”
এই বলে রোহান ভাইয়া বাজেভাবে আমার গালে স্পর্শ করলেন। উনার এ স্পর্শে আমার গা গুলিয়ে কেমন বমি পেলো। উনার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এলাম আমি। হাত পা দুটো ঘামতে শুরু করলো। আমার প্রতিক্রিয়া দেখে রোহান ভাইয়া হাসলেন। বললেন,
” এই ভয়টাই দেখতে চাচ্ছিলাম তোর চোখে। আমাকে থাপ্পড় দিয়ে অপমান করবি আর আমি কিছু করবো না তা ভাবলিও কি করে মিম? আমি এক তীরে দুই পাখি মারার প্ল্যানে আছি। বুঝছিস?”
এই বলে রোহান ভাইয়া খুব বিশ্রি রকমের একটা হাসি দিলেন৷ উনার হাসি দেখে ঘৃণায় চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললাম আমি। রোহান ভাইয়া পুনরায় বললেন,
” একটা সিক্রেট জানিস মিম? খুব বড় একটা সিক্রেট?”

আমি চোখ খুলে চাইলাম৷ রোহান ভাইয়া বাঁকা হেসে বললেন,
” তোকে কোথায় এনে রেখেছি জানিস? তোদেরই কোম্পানির গ্রাউন্ড ফ্লোরের বিল্ডিং এ। যেখানে সহজে কেউ আসে না৷ পরিত্যক্ত আর কি। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না? আদ্রিশের ধরা ছোঁয়ার মধ্যেই তুই থাকবি৷ অথচ আদ্রিশ তোকে খুঁজে পাবে না। ”

রোহান ভাইয়ার কথা শোনামাত্র আমি বিস্ফোরিত নয়নে উনার দিকে চাইলাম৷ উনি যে আমায় নিয়ে সিলেট শহর থেকে চলে এসেছেন তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি৷ এখন আদ্রিশ আমাকে কি করে খুঁজে পাবেন! উনি নিশ্চয়ই সিলেট শহরে তন্নতন্ন করে খুঁজছেন আমায়। কিন্তু আমি যে উনাদের কোম্পানিরই গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছি। কি করে সম্ভব আমাকে এখান থেকে বের করা? উনি নিশ্চয়ই অনুমানও করতে পারবেন না রোহান ভাইয়া এ কাজ করেছেন। তাহলে কি আমার মুক্তি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে? এখানেই বন্ধি থেকে রোহান ভাইয়ার ঘৃ’ণ্য ষ’ড়’য’ন্ত্রের শিকার হতে হবে?

রোহান ভাইয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আড়মোড়া ভেঙে বললেন,
” যাই একটু রেস্ট নিয়ে আসি। তারপর না হয় তোর কাছে আসবো। ততক্ষণ তুইও একটু রেস্ট নিয়ে নে৷ ”
এই বলে রোহান ভাইয়া হাতের নাগালে থাকা কাপড় দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিলেন। যেনো আমি চিৎকার না করতে পারি। এ পর্যায়ে আমার হাত ও পায়ের বাঁধন ছোটার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু শক্ত বাঁধন থেকে ছুট পাওয়া সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। আমার এ চেষ্টা দেখে রোহান ভাইয়া খুব করে হাসলেন। বললেন,
” চেষ্টা করে লাভ কি বল৷ এখান থেকে বের হওয়া এতোটা সহজ ভেবেছিস? আর তুই চেষ্টা করলেও বের হতে পারবি না। কারণ আমি তোকে বের হতে দিবো না। ”

এই বলে রোহান ভাইয়া উল্টো পথে পা বাড়ালেন৷ কিন্তু কি মনে করে আবারো ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
” আদ্রিশকে তোর কিডন্যাপিং এর কথা কখন বলেছি জানিস? যখন আমরা সিলেটে ছিলাম তখনই। ও বেচারা তো তখন থেকেই তন্নতন্ন করে খুঁজে যাচ্ছিলো তোকে। কিন্তু ততক্ষণে আমরা সিলেট ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্য এখন ও এখানেই আছে৷ কারণ ওকে আমরাই এখানে এনেছি। আফটার অল ফর্মুলা লাগবে আমাদের। কিন্তু এবার আমি ওর সাথে আর কোনো প্রকারের যোগাযোগ করিনি। কারণ ও যে লোকেশন ট্রেস করে ফেলবে। এজন্য এবার ইকবাল সাহেবের লোকদের দিয়ে কাজ করিয়েছি৷ আদ্রিশ ইকবাল সাহেবকে ফর্মুলা দিবে। তারপর তোর খোঁজ পাবে। কিন্তু ততক্ষণে তো সব শেষ। বুঝেছিস এবার? কি করে এক তীরে দুই শিকার করবো আমি? ওদিকে আদ্রিশের কাছে ফর্মুলাও নেওয়া হয়ে যাবে, আবার এদিকে তোর কাছ থেকে অপমানের শোধও তোলা যাবে। আচ্ছা, অনেক কথা বললাম। একটু জিড়িয়ে আসি। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া চলে গেলেন। আমি অসহায় চাহনিতে সেদিকে চেয়ে রইলাম। সহিসালামত বেঁচে ফিরার সব আশা দুরাশা মনে হচ্ছে আমার কাছে৷ সবদিক দিয়েই বিপদ ঘিরে ধরেছে। আদৌ কি এ থেকে বের হওয়া সম্ভব?

ঘোর বিপদে পরে সব সম্ভাবনা ধোঁয়ার ন্যায় উবে যেতে লাগলো। আমার দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে লাগলো। শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে এলো। ভয়ে ক্রমশ উর্ধগতিতে চলমান হৃদপিণ্ডটিও ধীরেধীরে নিস্তেজ হয়ে এলো যেনো। মস্তিষ্ক শূন্য অনুভূত হলো। তবুও জোরপূর্বক চেষ্টা করছি এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। সে আশাতেই চারপাশ তাকালাম৷ কিন্তু হাত পায়ের বাঁধন খোলার মতো কিছু পেলাম না।
হঠাৎ আমার দৃষ্টি আটকে রুমে কোনার একটি দেয়ালের দিকে। রুমের ঐ কোনায় ভেন্টিলেটর এর মতো বোধহয় কিছু দেখতে পেলাম। এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আমি ফ্লোর ঘেঁষে ডান পাশে এগিয়ে যেতে লাগলাম। একটু এগিয়ে যেতেই পিলারের পিছনে ভেন্টিলেটর দেখতে পেলাম। তৎক্ষনাৎ আমার ভেতরে সাহস ও আশা সঞ্চার হলো যেনো। কোনোরকমে ঐ ভেন্টিলেটরের কাছে গিয়ে আশেপাশে কেউ থাকলে হয়তো সাহায্য চাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানে যাবো কি করে? পা দুটো যে বাঁধা আমার!

আমি কিছুক্ষণ পায়ের বাঁধনের দিকে চেয়ে রইলাম। কি করে এটা খুলবো? হাত দুটো যে পেছনে বাঁধা। কিছুক্ষণ এ নিয়েই চিন্তা করলাম। অতঃপর বেশ দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে পা ভাঁজ করে পেছনের দিকে নিলাম। কোমড়ের কাছে বাঁধা হাত দুটো দিয়ে খুব কষ্টেসৃষ্টে বাঁধন খোলার চেষ্টা করলাম। বহু চেষ্টার পর এ পায়ের বাঁধন খুলতে সক্ষম হলাম। দু হাঁটুর সাহায্যে মুখের কাপড় টেনে সরিয়ে খুলে ফেললাম। সাথে সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি৷ অতঃপর কোনোপ্রকার বিলম্ব না করে দ্রুত উঠে সেই ভেন্টিলেটরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেন্টিলেটরটা অনেকটাই আমার নাগালে। শুধু পা দুটো একটু উঁচু করে দাঁড়ালেই বাইরের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।

বাইরে রাত হয়ে এসেছে। কিন্তু কত রাত অর্থাৎ সময় কত তা অনুমান করতে পারলাম না। মাথা উঁচু করে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে রইলাম। এই আশায়, যদি কেউ আসে।
বোধহয় পাঁচ দশ মিনিট বা তারও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। হঠাৎ এ বিল্ডিং থেকে বেশ খানিকটা দূরে একজন মানুষের অবয়ব দেখতে পেলাম। মুহূর্তমধ্যেই মানুষটি সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিগোচর হলো। আমি কোনোপ্রকার বিলম্ব না করে মুখ দিয়ে বিভিন্ন প্রকার শব্দ করতে লাগলাম। কোনো প্রকার বাক্য উচ্চারণ করলাম না। কারণ রোহান ভাইয়া যদি আশেপাশে থেকে থাকে তাহলে আমার কথার মাধ্যমেই নিশ্চিত তিনি ধরে ফেলবেন যে আমি বাইরে সাহায্য চাইছি।

আমি নানা প্রকারের শব্দ করে লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটি যেনো কিছুতেই কিছু শুনছে না। অদ্ভুত! ক্ষণিকের মাঝেই আমার বেঁচে ফেরার একমাত্র সম্বল স্বরূপ লোকটি আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো। আমি হতাশ হয়ে দেয়াল ঘেঁষেই বসে পড়লাম। দু চোখ বেয়ে নিঃশব্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ রোহান ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে আমি চকিতে ফিরে তাকালাম।
” হেল্প চাচ্ছিলি না কি মিম? পেয়েছিস? পাবিও না। কারণ এ দিকটায় কেউ আসে না। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া ক্রুর হাসি দিলেন। মুহূর্তমধ্যেই পরনের শার্টের বোতাম খুলতে খু্লতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। পৈশাচিক আনন্দিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
” ভেবেছিলাম আরেকটু পর আসবো। কিন্তু তুই তোর ভুলের কারণে সময়টাকে কমিয়ে আনলি। কি আর করার৷ পরে যা করবো তা এখন করে নিলেই হয়। ”
রোহান ভাইয়া অগ্রসরমান চলন ও কথায় ভয়ে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো।

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৯

রোহান ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু আমার পিছিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। উনার চোখেমুখে এ মুহূর্তে যে হিংস্রতা ফুটে উঠেছে তা ভেতর থেকে আমাকে কাঁপিয়ে দিলো। আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাসে চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হতে শুরু করলো। কিন্তু হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতিতে পরার পূর্বেই আমি নিজেকে শক্ত করলাম। মস্তিষ্ককে সচল হতে কঠিন চাপ দিলাম। যেনো সে আমায় সাহায্য করে। আমার এখন সাহায্যের দরকার। অন্য কারোর নয়, নিজের। এ মুহূর্তে নিজেই নিজের একমাত্র ভরসাস্থল।

রোহান ভাইয়ার অগ্রসরমান পদক্ষেপে আমি শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উনাকে ধাক্কা দিলাম৷ রোহান ভাইয়া আচমকা প্রতীয়মান ঘটনায় টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যান৷ তৎক্ষণাৎ কাল বিলম্ব না করে আমি উঠে দাঁড়ালাম। মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াতে আমাকে বেগ পেতে হলো। হাত দুটো পিছনে বাঁধা থাকায় শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য। তবুও ক্ষণিকের চেষ্টায় উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম। দরজার লক্ষ্য করে দৌড়াতে নিলেই আচমকা রোহান ভাইয়া আমাকে পিছন থেকে টেনে ধরেন। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই ধাক্কা দিয়ে আমাকে মেঝেতে ফেলে দিলেন উনি। হাত পেছনে থাকায় প্রথম দফায় আঘাত লাগলো হাতে। প্রচণ্ড জোরে। মনে হলো হাতের আঙুলগুলো মড়মড় করে ভেঙে গেলো৷ ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলাম আমি। রোহান ভাইয়া আমার দিকে চেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
” ভালোই চালাকি করতে পারসি তো তুই! কিন্তু এসবের আগে তোর এটা মনে রাখা উচিত, এমন পরিস্থিতিতে একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ে কখনোই পেরে উঠতে পারে না।”

এই বলে উনি পুনরায় আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন৷ এদিকে ব্যাথার চোটে আত্মরক্ষা করার মতো শক্তিটুকু পাচ্ছি না। ঠোঁট কামড়ে ধরে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। ততক্ষণে রোহান ভাইয়া প্রায় আমার কাছে চলে এসেছেন৷ উনার হিংস্র ধাবা আমার দিকে এগিয়ে দিতেই আমি কোমড়ের ব্যাথা উপেক্ষা করে পাশে সরে এলাম। রোহান ভাইয়া তীক্ষ্ণ হাসি দিয়ে বললেন,
” কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবি? এই রুমের বাইরে যাওয়ার মতো ক্ষমতা তোর নেই, এটুকু জেনে নে।”
এই বলে রোহান ভাইয়া আমার দিকে পুনরায় এগিয়ে আসতে নিলেন। এ পর্যায়ে উনার ভারসাম্য টালমাটাল করে দিতে এক পা দিয়ে উনার পায়ের মাঝ বরাবর লাথি দিলাম। তৎক্ষনাৎ উনি ভারসাম্য হারিয়ে পুনরায় মেঝেতে পড়ে গেলেন। হয়তো পায়ে বেশ ব্যাথা পেয়েছেন উনি৷ ফলে ব্যাথায় ককিয়ে উঠে অ’শ্রাব্য ভাষায় আমাকে গা’লি দিলেন উনি। আমি সেদিকে তোয়াক্কা না করে কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। এ মুহূর্তে হাতের বাঁধন খোলা আবশ্যক হয়ে গিয়েছে আমার জন্য। কিন্তু এ কাপড়ের বাঁধন কেউ খুলে না দেওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই খোলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। ঐ অবস্থাতেই আমি দরজার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কোনোমতে দৌড়ে দরজার কাছে যেতেই রোহান ভাইয়া পুনরায় আমাকে পিছন থেকে জাপটে ধরলেন৷ উনার বাঁধন হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে প্রাণপণে চেষ্টা করে চলছি আমি৷ কিন্তু উনার শক্তির সাথে কিছুতেই পেরে উঠতে পারছি না। আমার এ প্রচেষ্টা দেখে রোহান ভাইয়া পূর্বের তুলনায় আরো শক্ত করে জাপটে ধরলেন আমায়। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
” এতো তেজ আসে কোথা থেকে? আমাকে এতো ঘুরানোর পরিণাম তোকে আজ ভোগ করতে হবে। আমার সাথে এতো চালাকি হবে না। ”

এই রোহান ভাইয়া আমাকে বাজেভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করলেন। উনার এ স্পর্শে আমার গা গুলিয়ে বমি আসতে লাগলো। নিজের শরীরের প্রতি নিজেরই ঘৃণা ধরে গেলো।
নিজেকে বাঁচানোর শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে আমার পা দিয়ে রোহান ভাইয়ার পায়ে শক্ত করে চাপা দিলাম। অতর্কিতে আক্রমণ হওয়ায় রোহান ভাইয়ার বাঁধন আলগা হয়ে যায়। তৎক্ষনাৎ সুযোগ বুঝে দরজার কাছে চলে আসি আমি৷ দরজা হালকা ভিড়িয়ে দেওয়া থাকায় সহজেই পা দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসি আমি। লম্বা করিডোর ধরে দৌড়াতে থাকি৷ করিডোরের শেষপ্রান্তে পৌঁছাতেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম রোহান ভাইয়া রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন৷ উনাকে দেখে আমার মাঝে চাপা ভয়টা পুনরায় জেগে উঠলো। এতক্ষণ আমার মাঝে ভয়টা যেনো প্রায় না-ই হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বেঁচে ফেরার পথ পেয়ে এবং উনাকে আমার পিছু নিতে দেখে আমার মাঝে ভয়ের সঞ্চার হলো।
আমি প্রাণপণে ছুটে চলছি। দৌড়াতে দৌড়াতে বিল্ডিং এর প্রধান গেটের সামনে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম গেটে হয়তো দারোয়ান থাকবে এবং আমি তার কাছ থেকে সাহায্য নিবো। কিন্তু গেটের আশেপাশে কোনো দারোয়ানকে দেখতে পেলাম না আমি। সাহায্যের শেষ আশাটুকুও ক্ষীণ হতে শুরু করলো। আমি গেট পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। রোহান ভাইয়া দৌড়াতে দৌড়াতে আমার নাগালে চলে এসেছেন।
কয়েক কদম যেতেই আচমকা আদ্রিশের গাড়ি দেখতে পেলাম। মুহূর্তমধ্যেই খুশিতে আমার চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। স্পষ্ট অনুভব করলাম, আদ্রিশের গাড়ি দেখে আমার ঠোঁটের কোনে বিজয়ী হাসি ফুটে উঠেছে। সাথে আমার দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। হয়তো আদ্রিশকে এ মুহূর্তে এখানে পেয়ে। কিন্তু আমি স্বস্তি অনুভব করলাম৷
আমায় দেখামাত্র আদ্রিশ গাড়িতে ব্রেক কষলেন। হন্তদন্ত করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার কাছে ছুটে এলেন। আমায় দেখে মলিন হেসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। উনাকে কাছে পেয়ে আমার নিঃশব্দের কান্না তখন আওয়াজ তুলে আমার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো। আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। সে মুহূর্তে আদ্রিশকে অনেক কিছু বলার থাকলেও কান্নার দমকে কিছুই বলতে পারলাম না৷ উনি মলিন হেসে বললেন,
” অবশেষে পেলাম তোমায়। আমি ভেবেছিলাম…..”

আদ্রিশের কথা সম্পূর্ণ শেষ হতে না হতেই রোহান ভাইয়া গলা উঁচিয়ে বললেন,
” তোকে এখানে মোটেও আশা করিনি আদ্রিশ।”

আদ্রিশ রোহান ভাইয়ার কথা কানে তুললেন না৷ আমার দিকে ক্ষণিকের জন্য উদ্বিগ্ন চাহনিতে চেয়ে রইলেন। অতঃপর আমার হাতের বাঁধন খুলে দিতে দিতে শান্ত গলা বললেন,
” গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি না বলা পর্যন্ত বের হবে না। ”

আমি বাধ্য মেয়ের মতো আদ্রিশের কথা শুনে ফুঁপাতে ফুঁপাতে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। আদ্রিশ আমাকে গাড়িতে রেখে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মুহূর্তমধ্যেই কোমড়ের পিছন থেকে পিস্তল বের করে রোহান ভাইয়ার দিকে তাক করলেন। রোহান ভাইয়া আদ্রিশের বরাবর দাঁড়িয়ে আছেন। আদ্রিশের হাতে পিস্তল দেখে উনার চেহারা মুহূর্তেই পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। উনি আমতা আমতা করে বললেন,
” এটা কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে আদ্রিশ। এভাবে কথা নেই বার্তা নেই হুট করে পিস্তল তাক করলি কেনো?”

আদ্রিশ শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” তোর মতো মানুষের জন্য শুধু পিস্তল তাক করে রাখলে হবে না। পিস্তলের সব ক’টা গুলি তোর বুকের মধ্যে বিঁধিয়ে তবেই শান্ত হতে হবে।”

রোহান ভাইয়া ভীতসন্ত্রস্ত চাহনিতে আদ্রিশের দিকে চাইলেন। দূর থেকেই হাত উঁচিয়ে আদ্রিশকে বাঁধা দেওয়ার ইশারায় বললেন,
” দেখ আদ্রিশ, পিস্তল নামা৷ ভালো হবে না বলছি।”

” কি ভালো হবে কি হবে না তা তোর ভাবার দরকার নেই। তুই যে কত বড় জা’নো** তা ভালো করে টের পেয়েছি আমি৷ তোর শরীরের অবস্থা দেখেই টের পাচ্ছি, তুই ভালো কিছু করার উদ্দেশ্যে ওকে কিডন্যাপ করিসনি। ”

” তুই জানলি কি করে যে আমরা এখানে আছি?”

” সে কথা তোর জানতে হবে না। আপাতত এখন নিজের প্রাণ বাঁচানোর কথা চিন্তা কর।”
এই বলে চোখের পলকেই আদ্রিশ রোহান ভাইয়ার পেটের ডান দিকে শুট করে দিলেন। উনার তাৎক্ষণিক এ কাজে আমি থ বনে রোহান ভাইয়ার দিকে চেয়ে রইলাম। রোহান ভাইয়া ততক্ষণে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে বললেন,
” এটা তুই ঠিক করলি না আদ্রিশ। এর ফল ভালো হবে না বলছি। ”

আদ্রিশের এহেন কাজে আমি কিয়ৎক্ষণ থ বনে বসে রইলাম৷ অতঃপর বড় কিছু ঘটে যাওয়ার ভয়ে উনাকে বাঁধা দিতে আমি গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। কিন্তু উনাকে বাঁধা দেওয়ার পূর্বেই উনি রোহান ভাইয়ার কথার তোয়াক্কা না করে সেদিকে খানিক এগিয়ে গেলেন। আচমকা কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি রোহান ভাইয়ার দু পায়ের মাঝ বরাবর গুলি চালিয়ে দিলেন। উনার এহেন কাজে বিস্ময়ে আমার মুখে হাত চলে এলো। আমি বিস্ফোরিত নয়নে একবার আদ্রিশের দিকে, তো একবার রোহান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। আদ্রিশের দৃষ্টি কঠিন, চোখমুখ শক্ত। উনি রোহান ভাইয়ার দিকেই পিস্তল তাক করে বললেন,
” কি? মজা লাগলো? খুব তো শখ করেছিলো পুরুষত্ব খাটানোর তাই না? কিন্তু এখন? এখন কি হবে? ”
এই বলে উনি আবারো রোহান ভাইয়ার দু পায়ে দুটো গুলি চালিয়ে দিলেন। পরপর চারবার শুটিং করতে দেখে আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। বিস্ময়ে কিয়ৎক্ষণের জন্য কথা বলতে ভুলে গেলাম।

রোহান ভাইয়ার পায়ে গুলি করে আদ্রিশ কিয়ৎক্ষণ উনার দিকে চাইলেন। বললেন,
” পিস্তলের চারটা গুলিই বোধহয় তোর ভাগ্যে ছিলো। যাই হোক, এতোদিন পর শুটিং করে বেশ আনন্দ পেলাম। থ্যাংকস ফর দা অপরচুনেটি ইয়ার।”
এই বলে উনি উল্টো পায়ে গাড়ির দিকে এগুতে এগুতে শক্ত কণ্ঠে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,
” গাড়িতে বসো মিশমিশ। ”

আদ্রিশের এ রূপ আমার কাছে অপরিচিত। উনি যে এভাবে রোহান ভাইয়াকে শুট করবে তা কল্পনাতেও ছিলো না। আমি হতভম্ব চাহনিতে উনার দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলাম। উনি ততক্ষণে গাড়ির কাছে চলে এসেছেন৷ গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” কি হলো? কথা শুনোনি?”

আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম,
” হ্যাঁ বসছি। বসছি।”
এই বলে আমি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। ক্ষণিকের জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে রোহান ভাইয়াকে এক নজর দেখে নিলাম। প্রচণ্ড ব্যাথায় উনি ছটফট করছেন। গোঙাচ্ছেন। উনার এ দূর্দশা দেখে একটু হলেও খারাপ লাগলো আমার৷ যদিও উনি আমার সাথে যা করেছেন তাতে বিন্দুমাত্র সহানুভূতিও আসার কথা না।

আমি ঘাড় ফিরিয়ে আদ্রিশের দিকে চেয়ে বললাম,
” উনি কি এখানেই থাকবে?”

আদ্রিশ ততক্ষণে গাড়িতে বসে পড়েছেন। আচমকা আমায় ধমক দিয়ে বললেন,
” এতো কথা বলো কেনো? গাড়ি থেকে বের হতে বলিনি তাও বের হয়েছো। এখন বসতে বলছি তো বসছো না কেনো?”

আদ্রিশের ধমক শুনে আমি একটু কেঁপে উঠলাম। তৎক্ষনাৎ গাড়িতে বসে পড়লাম। আমার বসা মাত্র আদ্রিশ গাড়ি স্টার্ট দিলেন। বললেন,
” রোহানকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। ”

আমি তৎক্ষনাৎ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললাম,
” উনাকে যেভাবে গুলি মেরেছেন, এতে যদি উনি মারা যায়?”

” মরবে না। আর মরলেও শান্তি। অন্তত সমাজ থেকে একটা কিট তো মরবে। ”

আমি এবার জোর গলায় বললাম,
” আদ্রিশ, ভেবেচিন্তে কথা বলুন। রোহান ভাইয়া মারা গেলে আপনার নামে মা’র্ডা’রের কেস হতে পারে। ভেবে দেখেছেন এটা?”

আদ্রিশ চট করে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। ঠাণ্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
” তোমায় এতো চিন্তা করতে বলিনি৷ ওর বাঁচুক, মরুক, ব্যাপারটা আমি সামলে নিবো। শাহেদ সাহেবের টিম অন দা ওয়ে। উনারা এসে রোহানকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। এখন আর একটা কথাও যেনো তোমার মুখ দিয়ে না বের হয়। মাইন্ড ইট।”

এই বলে উনি গাড়ি ঘুরিয়ে বাসার দিকে নিলেন। উনার এ আদেশে আমি একদম নিশ্চুপ বসে রইলাম।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here