#ভুলবশত_প্রেম,৫০(অন্তিম পর্ব)
#লেখনীতে:সারা মেহেক
দশ মিনিটের মাঝেই আমরা বাসায় চলে এলাম৷ আদ্রিশের অফিস হতে বাসার দূরত্ব মাত্র দশ মিনিট। বাসায় পৌঁছাতেই না পৌঁছাতেই আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো৷ বারবার বলতে লাগলো, ‘আমার মেয়ে দুটোর উপর নিশ্চয়ই কোনো খারাপ নজর পড়েছে। ‘
আম্মুর এতো কান্না দেখে আমি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম। যদিও আমি ভেতরে থেকে ভেঙে গিয়েছি৷ মোটামুটি একটা ট্রমায় চলে গিয়েছি।
আমার চোখের সামনে বারবার ঘটনাগুলো চলমান দৃশ্যের ন্যায় চলতে লাগলো৷ তবুও আম্মুকে বুঝ দিলাম যে আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। কারণ আমি আম্মুর সামনে দূর্বল হয়ে পড়লে আম্মু নিজেকে সামলে নিতে সময় নিবে।
একে একে উপস্থিত সবাই আমাকে নানাভাবে স্বান্তনা দিলো। আপু ও আভা আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলো। এরপর আম্মু আবারো আমাকে জড়িয়ে পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে কাঁদতে লাগলো। এক পর্যায়ে আব্বু আমাকে আম্মুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
” রুমে গিয়ে রেস্ট কর। তোর সাথে পরে কথা বলবো।
আদ্রিশ বাবা, ওকে রুমে নিয়ে যাও। আর তুমিও গিয়ে একটু রেস্ট করো। পরে আমরা কথা বলবো।”
আব্বুর কথামতো আদ্রিশ আমাকে নিয়ে রুমে চলে এলেন৷ রুমে এসে আমাকে সোফায় বসিয়ে আদ্রিশ আলমারি থেকে আমার জামা বের করে আনলেন। আমার হাতে থ্রিপিছ ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
” হাতমুখ ধুয়ে আসো মিশমিশ। একটু ফ্রেশ হলে ভালো লাগবে। ”
আদ্রিশের কথা শুনলাম। কিন্তু তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কারণ আমার চোখের সামনে, মস্তিষ্কে শুধুই রোহান ভাইয়া কেন্দ্রিক ঘটনাগুলো ভাসছে। আমি কিছুক্ষণ আদ্রিশের দিকে নির্বাক চাহনিতে চেয়ে রইলাম। আদ্রিশও আমার দিকে চেয়ে রইলেন। কিয়ৎক্ষণ বাদে আমার গালে আলত হাত রেখে নরম গলায় বললেন,
” ঠিক আছো মিশমিশ? ”
আদ্রিশের এ প্রশ্ন শুনে আমি অকস্মাৎ যেনো ভেঙে পড়লাম৷ মুহূর্তেই আদ্রিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। আদ্রিশ হয়তো আমার কান্না দেখে ভড়কে গেলেন। সাথে সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনার সুরে বললেন,
” এতো কান্না করো না৷ যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে মিশমিশ। ভাগ্য ভালো যে কোনো খারাপ কিছু হয়নি। ”
আমি সাথে সাথে কান্নারত অবস্থায় বললাম,
” খারাপ কিছু হয়নি৷ কিন্তু হতে যাচ্ছিলো আদ্রিশ। আপনি জানেন না, রোহান ভাইয়া আমাকে কতোটা বাজে ভাবে স্পর্শ করেছে৷ ”
এই বলে আমি আদ্রিশকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আদ্রিশ আমাকে নানা কথা বলে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
বেশ অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করার পর আমার কান্নার বেগ কমে এলে আমি ওয়াশরুমে চলে এলাম। দরজা বন্ধ করে শাওয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম৷ দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি শরীরে অবশিষ্ট নেই আমার। শাওয়ারের নিচে বসে শরীরের প্রতিটা অঙ্গ ঘষে ঘষে পরিষ্কার করলাম৷ যেনো রোহান ভাইয়ার ছোঁয়াটুকুও কোথায় না থাকে।
আনুমানিক এক ঘণ্টা পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলাম৷ ক্লান্ত দৃষ্টিজোড়া দেয়াল ঘড়ির দিকে চলে গেলো। সময় এখন রাত দুটো। চারপাশে নিস্তব্ধ নিরবতা জানান দিচ্ছে, এখন গভীর রাত হয়ে গিয়েছে।
ভেজা তোয়ালে ছাড়াতে গিয়ে আদ্রিশকে ব্যালকনিতে বসে থাকতে দেখলাম৷ আমাকে ব্যালকনিতে দেখে আদ্রিশ ইশারায় নিজের পাশে বসতে বললেন। আমি নিরবে উনার পাশে বসে পড়লাম। আদ্রিশ আমার ডান নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” এখন ভালো লাগছে?”
আমি নিম্ন স্বরে জবাব দিলাম,
” আগের চেয়ে কিছুটা ভালো লাগছে। ”
” চিন্তা করো না মিশমিশ। খুব দ্রুতই সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু একটু সময়ের প্রয়োজন। ”
আমি ফিরতি জবাব দিলাম না৷ চুপচাপ বসে রইলাম৷ হঠাৎ মনে একটা প্রশ্ন জাগতেই আমি তৎক্ষনাৎ আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি জানলেন কি করে যে আমি ওখানে আছি?”
আদ্রিশ আমার দিকে এক পলক তাকালেন। অতঃপর পুনরায় সম্মুখপানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
” তুমি যার কাছে হেল্প চেয়েছিলে সে আমাদের ল্যাবের তৃতীয় তলার গার্ড। কি যেনো প্রয়োজনে সে নিচে নেমে ঐ এরিয়ার মধ্যে যায় যে এরিয়ার পরিত্যক্ত রুমে রোহান তোমাকে আটকে রেখেছিলো। তুমি যখন হেল্পের জন্য বিভিন্ন রকম আওয়াজ দিচ্ছিলে তখন প্রথম দফায় ও খেয়াল করেনি সেটা। কিন্তু এরপর ও ‘কিছু শুনেছে’ এই সন্দেহের জোরে আশেপাশে দেখতে থাকে। এরপর ও ঐ রুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে আলো আসতে ঐ দিকে যায়। ভেন্টিলেটরে উঁকি দিয়ে যখনই দেখে তোমাকে আর রোহানকে দেখে তখনই ও কল করে আমাকে জানায়, গ্রাউন্ড ফ্লোরের রুমে একটা ছেলে একটা মেয়েকে বেঁধে রেখেছে। ওর কথা শুনে আমি চট করে ধরে ফেলি ওটা তুমিই হবে। এরপর আর কি…দেরি না করে দ্রুত গাড়ি নিয়ে নেমে পড়ি। পথে শাহেদ সাহেবকেও কল করে দেই ওখানে আসার জন্য। ”
এই বলে উনি প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আর আমি মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। কিছুক্ষণ বাদে পুনরায় উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” ইকবাল সাহেবের কি হলো?”
” উনাকে পুলিশ এরেস্ট করেছে৷ ”
আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম, ‘ওহ’। অতঃপর আদ্রিশ বললেন,
” ফর্মুলাটা বানিয়ে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি। জানি না, এ নিয়ে আর কতদিন বিপদে পড়তে হবে আমাদের। মাঝেমধ্যে মন বলে, সব পেপারস, রিয়েকশন, নোটস, সব জ্বালিয়ে ফেলি। একেবারে অস্তিত্বই মিটিয়ে দেই। আমার….”
আদ্রিশকে মাঝ পথে থামিয়ে বললাম,
” এসব কেনো বলছেন? যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। এবার আপনি আপনার পুরো মনোযোগ ঐ ড্রাগ প্রসেসিং উপর দিন৷ আমি আপনার পাশে আছি। ”
আদ্রিশ আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন। আমার হাতের মুঠোয় চুমু দিয়ে বললেন,
” সবসময় তোমাকে পাশে চাই মিশমিশ। সবসময়।”
আমি মৃদু হেসে বললাম,
” আমি সবসময় আপনার পাশে থাকবো আদ্রিশ। সবসময়।”
.
দেখতে দেখতে আমাদের বিবাহিত জীবনের দেড় বছর কেটে গেলো। আদ্রিশ ও আমার বিবাহ বার্ষিকীর দু মাস আগে জানতে পারলাম আমার ভেতরে আলাদা একটা জীবন গড়ে উঠছে৷ প্রথম যখন এ সংবাদটা পাই তখন আমাদের কারোর খুশির সীমা ছিলো না৷ আদ্রিশও খুব খুশি ছিলেন। কিন্তু আমার পড়ালেখা বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। এভাবে বাচ্চা পেটে ক্লাস পরীক্ষা কি করে সম্ভব? আমি অবশ্য তখন আদ্রিশকে বলেছিলাম সব সামলে নিবো আমরা৷ কিন্তু দিন যেতে যেতে সবকিছু যেনো আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিলো৷ মুড সুইং, শারীরিক পরিবর্তন সব সহ্য করে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে পড়তে হয়েছে। ক্লাস চলাকালীন যখন আমার পেট কিছুটা দৃশ্যমান হতে শুরু করলো তখনই আমি মেডিকেলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। তবে বাসায় বসে আদ্রিশের সাহায্যে পড়ালেখা চালিয়ে গেলাম।
সাত মাসের পেট নিয়ে নড়াচড়া করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার। এর মধ্যে পড়ালেখা যেনো বিলাসীতা। তবুও আমি বই নিয়ে বিছানায় বসে বসে আছি। তবে পড়ছি না, ঝিমুচ্ছি৷ হঠাৎ আদ্রিশ আমার হাত থেকে বই নিয়ে বললেন,
” পড়ছো না তো বসে আছো কেনো? চলে ব্যালকনিতে যাই। ”
এই বলে আমার সম্মতি দেওয়ার পূর্বেই আদ্রিশ আমার হাতে ধরে ব্যালকনিতে নিয়ে এলেন। একটি বেতের চেয়ারে নিজে বসে আমাকে ওপরটিতে বসালেন। অতঃপর বললেন,
” তোমার এতো ঘুম দেখে আমার খুব চিন্তা হয়। ”
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কিসের চিন্তা? ”
” এই যে আমাদের মেয়েকে নিয়ে চিন্তা। আমাদের মেয়েও যদি তোমার মতো ঘুমপাগলি হয় তখন!”
আমি সরু চোখে আদ্রিশের দিকে তাকালাম। বললাম,
” ভালো হবে। খুব ভালো হবে। আমরা মা মেয়ে সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাবো।”
” কখনোই না। আমি সবসময় আমার মেয়েকে নিয়ে খেলবো। ওকে এতো ঘুমাতে দিবো না। ”
এই বলে আদ্রিশ মেঝেতে বসে আমার পেটের উপর কান পেতে বললেন,
” কি আম্মু? বাবার সাথে সারাদিন খেলবে না বলো?”
আদ্রিশ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। অতঃপর বললেন,
” ঐ যে দেখো, আমার আম্মুটা বলেছে ও সারাদিন আমার সাথে খেলবে। ”
আদ্রিশের কথায় আমি ভেঙচি কেটে বললাম,
” হুহ শখ দেখে বাঁচি না।”
এই বলে আমি আদ্রিশের দিকে তাকালাম৷ হঠাৎ কি মনে করে আদ্রিশকে বললাম,
” একটা প্রশ্ন করবো। উত্তর দিবেন?”
” হুম দেওয়ার মতো হলে দিবো। ”
” অনেকদিন থেকেই এ প্রশ্ন আপনাকে করতে চাইছিলাম। কিন্তু করা হয়নি। ”
” কি প্রশ্ন? ”
” আচ্ছা আপনি কবে থেকে বুঝতে পারলেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন? বা এর শুরু কোথা থেকে?”
আদ্রিশ আমার প্রশ্নে মৃদু হাসলেন। বললেন,
” তোমার সাথে আমার প্রেমটা হয়েছে ভুলবশত। আনইন্টেনশনালি। ”
আমি চোখমুখ কুঁচকে বললাম,
” কেমন? বুঝলাম না ঠিক। ”
আদ্রিশ প্রত্যুত্তরে বললেন,
” ইমাদের গায়ে হলুদের দিন আম্মু এক মেয়ের ছবি দেখিয়েছিলো। সে মেবি নাফিসা ভাবীর ফ্রেন্ড ছিলো। আম্মু বললো, মেয়েকে দেখে এসে নিজের মতামত জানাতে। আমি তখন পুরো ব্যাপারটা স্কিপ করে যেতে চেয়েছিলাম। কারণ ওসব বিয়ে, বাচ্চা, প্রেম, ভালোবাসায় আমি বেজায় বিরক্ত ছিলাম৷ ওসবের ধারের কাছে আসতে চাইনি৷ তবুও আম্মু এ নিয়ে জোর করলো খুব৷ পরে আম্মুর মন রাখতে মনের বিরুদ্ধে রাজি হয়েছিলাম। মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে এসে ঐ মেয়ের ধারের কাছেও ঘেঁষবো না৷ কিন্তু ঐ যে ভাগ্য, নাফিসা ভাবীর ফ্রেন্ডকে দেখতে এসে তোমাকে চোখে পড়লো। তখন থেকেই একটু একটু ভালোলাগা থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। তখন থেকেই নিজের কথায় অটল থাকতে পারলাম না। ভুলবশত তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম। ”
এই বলে আদ্রিশ সশব্দে হেসে উঠলেন৷ উনার সাথে হেসে উঠলাম আমিও। কিছুক্ষণ আমাদের হাসাহাসি চলতে থাকলো। অতঃপর হাসি থামিয়ে আদ্রিশ মৃদু হেসে বললেন,
“ভুলবশত প্রেমে পড়ার মতো অদ্ভুত ঘটনা এ জগতে খুব কমই আছে বলে মনে হয় আমার।”
❤️সমাপ্ত❤️