#ভুল_মানুষ
#মাসুমা_মিজান_মিম
টানা দুই ঘন্টা কথা কাটাকাটির পর যখনি রিসাদ বলল, “আমার ডিভোর্স চাই!” ঠিক তখনি সদ্য ঘুম থেকে উঠা আমার ৬ মাসের ছেলেটা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল।
“আমার ডিভোর্স চাই,” কী নিষ্ঠুর বাক্য! কী নির্দয় তার বাচনভঙ্গি! কতটা সাবলীল ভাবে বলে দিল তার ডিভোর্স চাই! কতটা কঠিন এই ডিভোর্স নামক শব্দটা! নিমেষেই জানিয়ে দিল আজ তার জীবনে বড্ড অপ্রয়োজনীয় আমি।
ছেলেটা জন্মের পর থেকেই লক্ষ্য করছিলাম তার পরিবর্তনগুলো। কখনোই তার এই পরিবর্তনের কারণ আমি জানতে চাইনি। ভেবেছিলাম হয়তো অফিস-কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু কিছুদিন ধরে তার পরিবর্তনগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো। যে মানুষটাকে প্রতিদিন ঠেলে ঠুলে অফিসে পাঠাতে হতো আজ সেই মানুষটাই অফিসের অজুহাতে বাসা থেকে বের হতে পারলেই বাঁচে, ইচ্ছে করে দেরী করে বাসায় ফিরে, কাজের অজুহাতে রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলে কাটিয়ে দেয়, যে মানুষটা আমাকে কোনো কাজ করতে দিত না আজ সেই মানুষটাই কাজে একটু দেরি হলে গায়ে পর্যন্ত হাত তুলতে দু’বার ভাবে না। একটা মানুষের এতোটা পরিবর্তন কি করে হয়?
আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী ছিল। তাকে সারপ্রাইজ দিব বলে না জানিয়েই ছেলেকে নিয়ে শপিংয়ে গিয়েছিলাম। শপিংমলের পাশের একটা রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি হাত ধরে একটা মেয়ের সাথে দেখলাম। হঠাৎ শরীর কেঁপে উঠল। মনকে প্রশ্ন করলাম এই কি সেই মানুষটা যাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম! বুকে পাথর চাপা দিয়ে ডায়াল করলাম তার নম্বরে। রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে কড়া কন্ঠে জবাব আসলো, “অফিসে আছি। প্রচুর ব্যস্ত, ফোন রাখো।” তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, এটাই কি তোমার অফিস? আর এই কি তোমার কাজ? কিন্তু করিনি। ছেলেটাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলাম।
সে বাসায় আসলে সকল ভাবনা ভুলে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলাম যে, তার এই পরিবর্তনের কারণ কি? তারপর থেকেই শুরু হয় কথা কাটাকাটি। একপর্যায়ে ডিভোর্স! আমাকে নাকি তার আর প্রয়োজন নেই। তার জীবনে নাকি আমি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বস্তু। সে অন্যকাউকে ভালোবাসে!
অথচ দুবছর আগে ঠিক এই দিনে বাবা-মায়ের অবাদ্ধ হয়ে এই বেকার ছেলেটার হাত ধরেছিলাম শুধুমাত্র ভালোবাসি বলে। বাবা মায়ের ভালোবাসা ভুলে স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম শুধুমাত্র তার জন্য। তার শূন্য পকেটে, সুখে-দুঃখে সবসময় তার পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। কতদিন যে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটিয়ে দিয়েছি তার কোনো ঠিক নেই। বাবা-মায়ের আদরের দুলালী হয়েও রাতের পর রাত কাটিয়েছি বৃষ্টির পানি পরা ফুটো টিনের চালের নিচে। আজ তার বাড়ি-গাড়ী সব হয়েছে শুধু মানুষটাই আমার হলো না।
বাবা বলেছিল ‘মারে তুই ভুল ছেলেকে ভালোবেসেছিস, ছেলেটা তোকে ভালোবাসে না’। বাবার কথা শুনিনি সেদিন চলে এসেছিলাম এই স্বার্থপর মানুষটার হাত ধরে। হয়তো বাবা-ই সেদিন ঠিক ছিল আমি ছিলাম ভুল। ভুলেই গিয়েছিলাম সময়ের ব্যবধানে ভালোবাসার মানুষটাও একসময় অপরিচিত হয়ে যায়। আজ বাবাকে খুব মনে পরছে। খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে বাবাকে জড়িয়ে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, বাবা সেদিন তুমিই ঠিক ছিলে আমিই ভুল ছিলাম, ভুল মানুষকে ভালোবেসে ছিলাম। আমাকে মাফ করে দিয়ো বাবা, মাফ করে দিয়ো মা। মাফ করে দিয়ো তোমাদের এই স্বার্থপর মেয়েটাকে।
(সমাপ্ত)