ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ১ #লেখিকা দিশা মনি

0
14

১.
বাসর ঘরে প্রবেশ করেই মিষ্টি জানতে পারল তার সদ্য বিবাহিত স্বামী তাকে একা ফেলেই রওনা দিয়েছে ফ্রান্সের উদ্দ্যেশ্যে। কথাটা শোনামাত্রই মিষ্টি হতাশার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বসে পড়লো বিছানার মাঝে৷ নজর বুলিয়ে দেখল ফুল দ্বারা সজ্জিত বিছানাটার দিকে। এসব এখন তার কাছে মূল্যহীন।

বিছানায় বসেই মিষ্টি ভাবতে থাকে বিগত কিছু দিনে কিভাবে বদলে গেল তার জীবন। অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ুয়া মিষ্টির জীবন ছিল বেশ সাদামাটা। ধনী বাবার একমাত্র মেয়ে হিসেবে জীবনে কোন কিছুর অভাব ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই তার বাবা মোর্শেদ চৌধুরীর সিদ্ধান্ত নেন মিষ্টির বিয়ে দেয়ার। মিষ্টি কিংবা তার মা সুইটি চৌধুরী কেউই এই সিদ্ধান্তে রাজি ছিল না। তবুও মোর্শেদ চৌধুরীর জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছোট ছেলে নেভি অফিসার রাফসান শিকদারের সাথে। ২১ বছর বয়সী মিষ্টি যখন জানল তার বিয়ে হতে চলেছে বছর ২৯ এর রাফসানের সাথে তখন তো সে সরাসরিই না করে দিয়েছিল এই বিয়ের জন্য। কিন্তু মোর্শেদ চৌধুরীর জেদের কাছে সেসব আপত্তি ধোপে টিকল না। এসব কথা ভেবেই বর্তমানে ছলছল চোখে বিছানার চাঁদর আকড়ে ধরল বৃষ্টি। এমন সময় কারো উপস্থিতি টের পেয়েই নিজের চোখের জল মুছে দাঁড়িয়ে পড়ল মিষ্টি। শিকদার বাড়ির কর্তী তথা রাফসান শিকদারের মা রোকসানা শিকদার বেশ ঠাটবাট দিয়ে প্রবেশ করলেন ঘরের মধ্যে। তাকে দেখে মিষ্টি খানিকটা স্তিমিত হলো। রোকসানা শিকদার মহিলাটা বেশ কড়া ধাঁচের। হয়তো আর্মি অফিসার স্বামীর সাথে জীবনধারণ করতে করতেই এতটা কড়া হয়ে গেছেন। তিনি রুমে এসেই মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছ যে আমার ছেলে ইতিমধ্যেই কিছু জরুরি কাজে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফ্রান্সের মার্সেই বন্দরের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছে।”

মিষ্টি দুপাশে মাথা নাড়িয়ে জানাল,
“জ্বি।”

রোকসান শিকদার আবারো স্বভাবচরিত ভাবেই গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“রাফসান একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশনে গেছে। ফিরতে ৩-৪ মাস সময় লাগতে পারে। তুমি নিশ্চয়ই একজন নেভির কাজ এবং জীবন সম্পর্কে অবগত তাই তোমাকে আর এই বিষয়ে বেশি কিছু বললাম না। এসব ভারী শাড়ি-গহনা বদলে হালকা কোন পোশাক পরিধান করে শুয়ে পড়ো৷ আর হ্যাঁ, আমার ছেলে নেই জন্য কিন্তু এখানে কোন অনুষ্ঠান আটকে থাকবে না। শিকদার বাড়ির ঐতিহ্য মেনেই আগামীকাল তোমার বৌভাত হবে। সেসবের জন্য তৈরি থেকো৷ আর হ্যাঁ, একটা শেষ কথা বলে যাই। বিয়ের পর আমাদের বাড়ির বউয়েরা খুব একটা বাপের বাড়িতেও যায় না। আমার বড় বৌমাও বছরে এক আধবার বাপের বাড়ি যায়। তুমি আবার ভেবো না, তোমার স্বামী বাড়িতে নেই বলে বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারবে। সেটি হচ্ছে না। এই বাড়িতে থাকতে হলে তোমায় এই বাড়ির সমস্ত নিয়ম মেনেই চলতে হবে। বুঝলে?”

মিষ্টি দুপাশে মাথা নাড়াল। রোকসানা শিকদার আর দাঁড়ালেন না। দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি বেরিয়ে যেতেই মিষ্টি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। বাবার বন্ধুর স্ত্রী হিসেবে ছোটবেলা থেকেই এই মহিলাকে চেনে মিষ্টি। তার এখনো মনে আছে, এই মহিলা কতটা কড়া। ছোটবেলায় একবার শিকদার বাড়িতে ঘুরতে এসে বাগানে কিছু ফুল ছেড়ার জন্য এই মহিলা সবার সামনে তাকে কি অপমানটাই না করেছিল। আজো সেসব ঘটনা মনে করলে মিষ্টির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সেই ঘটনার পর থেকে তো মিষ্টি রোকসানা শিকদারের নাম দিয়েছিল, “লেডি হিটলার” এসব ভেবে এই পরিস্থিতিতেও সামান্য হাসির রেখা ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে। পরবর্তীতেই বাস্তবতা বুঝতে পেরে সেই হাসি মিলিয়ে যায়। মিষ্টি বেশ ভালোই বুঝতে পারে এতদিন সে যেই স্বাধীন, আভিজাত্যপূর্ণ জীবন কাটিয়েছে তা আর কাটাতে পারবে না। এখন তাকে এই শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ জীবনই কাটাতে হবে। এজন্যই বিয়েটা করতে চায়নি সে। কিন্তু এখন আর এসব ভেবে কি লাভ? যা হবার তা তো হয়েই গেছে।

তাই এসব ভাবনা ছেড়ে নিজের ট্রলি ব্যাগ থেকে একটা নাইট ড্রেস বের করে নেয় মিষ্টি৷ অতঃপর গহনা ও ভারী বেনারসি শাড়িটা খুলে রেখেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। সারাদিনের এত ধকল আর ক্লান্তির জেরে বিছানায় শোয়ামাত্রই রাজ্যের ঘুম এসে ধরে তার চোখে। তবুও মিষ্টি ঘুমাতে পারছিল না। তার মানসপটে ভেসে উঠছিল ৬ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট, শুভ্ররাঙা ত্বকের সেই বলিষ্ঠ সুঠামদেহী পুরুষের কথা। তার চোখমুখ জুড়ে ছিল গাম্ভীর্য। সেই রাগী চোখ, রুক্ষ মুখ এবং তীক্ষ্ণ স্বরে বলা কবুল স্বরটা যেন এখনো তার কানে বাজছে। মিষ্টি নিজের দুচোখ বন্ধ করে বলল,
“এ কেমন ভাগ্য আমার? বিয়ের রাতেই কিনা আমায় জানানো হলো আমার স্বামীকে আমি কাছে পাবো না ৩-৪ মাসের জন্য! এই জীবনই কি আমার প্রাপ্য ছিল।”

~~~~~~~~~~~~~~
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বেশ কিছুক্ষণ আগেই রওনা দিয়েছে একটি সামরিক নৌযান। সেই নৌযানের একপ্রান্তেই দাঁড়িয়ে আছে বলিষ্ঠ দেহী এক সুদর্শন পুরুষ। চোখ তার আকাশের দিকে স্থির৷ যেন রাতের আকাশে তারাদের মাঝে কোন বিশেষ হিসাব মিলাতে ব্যস্ত সে। হঠাৎ করেই পিঠে কারো স্পর্শ পেতেই পেছনে ফিরে তাকালো সেই পুরুষ। দেখতে পেল নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা সহকর্মী আরমান হোসেনকে। আরমান হোসেন বলে উঠল,
“কি ব্যাপার রাফসান? নববধূকে ফেলে রেখে বিদেশযাত্রা করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বুঝি?”

রাফসান হাসে, তবে সেই হাসিতে ছিল না কোন মুগ্ধতা বরং ছিল এক গ্রাস তাচ্ছিল্য। হাসির সাথেই সে বলে ওঠে,
“এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো আরমান, যে আমার কাছে সবার আগে আমার কাজ৷ তারপরে বাকি সবকিছু। আর বিয়ে..এই বিয়েটাও আমার কাছে অনেকাংশে মূল্যহীন। শুধুমাত্র বাবার কথা রাখার জন্যই আমি বিয়েটা করেছি। তবে আমার মিশন সম্পর্কে তুমি নিজেও খুব ভালো ভাবে অবহিত। তাই এই সম্পর্কটাও সুতোতেই ঝুলে আছে বলা যায় যা যেকোন মুহুর্তে ছিড়ে যাবে।”

আরমান হতাশ সুরে বলে,
“এতটা পাষাণ হয়ো না রাফসান। মেয়েটার কথাও একবার ভাবো। হয়তো মেয়েটা তোমার আশায় বসে আছে!”

রাফসান একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
“তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। তোমাকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, আমি যেই মিশনে ফ্রান্সের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছি তা কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ। এই মিশন সফল করে আমার ফেরার সম্ভাবনা অনেক কম। আর যদি সফলভাবে মিশনটা কমপ্লিটও করতে পারি তবুও হয়তোবা বাকি জীবনটা আমাকে নিজের পরিচয় লুকিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে।”

আরমান রাফসানের দিকে তাকিয়ে ছিল অনিমেষ। রাফসান বলে,
“তুমি তো জানো, এই মিশনের জন্য আমি এত গুলো বছর ধরে কিভাবে নিজেকে তৈরি করেছি, কোন পিছুটান ফেলে রাখিনি। কিন্তু শেষ সময়ে বাবার আকুল আবেদন ফেলতে পারলাম না। যেভাবে বাবা আমায় বলল, তার আমার কাছে শেষ আবদার এটাই যেন আমি তার পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করি তখন আমি আর না করতে পারি নি। আর তাই তো..”

আরমান রাফসানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“আমি বুঝতে পারছি তোমার ব্যাপার টা৷ আমি এটাও জানি, তোমার ভবিষ্যতটাও সামনে সুখকর নয়। তবে আমি বন্ধু হিসেবে তোমায় এতটুকু ভরসা দিতে পারি, যেকোন বিপদে আমার সাহায্য চাইলে তুমি নিশ্চয়ই সাহায্য পাবে।”

“তোমার মতো বন্ধু এবং সহকর্মী পেয়ে নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হচ্ছে আরমান।”

এবার দুই বন্ধুর মুখেই হাসি ফুঁটে। অন্যদিকে আকাশের চাঁদটা আজ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছিল যেন। বঙ্গপোসাগরের উথাল-পাতাল ঢেউ জানাল দিচ্ছিল কোন অজানা ভবিষ্যতের। যা হয়তো লুকিয়ে আছে ভূমধ্যসাগরের তীরে!

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ১
#লেখিকা দিশা মনি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here