ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ১৪ লেখিকা দিশা মনি

0
70

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ১৪
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টির সাথে আলাদা ভাবে কথা বলার জন্য তাকে নিয়ে একপাশে এলো ইয়াসিন। মিষ্টির মুখে একটা বিব্রতভাব ছিল। ইয়াসিন মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা, একটা কথা সত্য করে বলবেন? আপনি কেন তখন ওভাবে মিস এলিজার ফিয়ন্সের হাত ধরে ওভাবে টান দিলেন? এর পেছনে কি কোন জরুরি কারণ আছে?”

মিষ্টি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলে,
“আসলে কিভাবে ব্যাপারটা বলব, বুঝতে পারছি না৷ কিন্তু সত্যটা হলো যে, এলিজার হবু স্বামী মানে মিস্টার ইমানুয়েল পল উনি দেখতে একদম..একদম আমার স্বামী রাফসান শিকদারের মতোই। হ্যাঁ, ওনাদের চেহারায় কিছুটা ভিন্নতা আছে যেমন চুলের রং এবং চোখের রং আলাদা এমনকি মিস্টার পল একটু বেশি ফর্সা কিন্তু বাকি সব দিক একদম মিলে গেছে। আমার না প্রথমে মনে হয়েছিল যে উনিই হয়তোবা…”

ইয়াসিন অবাক হয়ে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? আপনি তো বলেছিলেন আপনার স্বামী একজন নেভি অফিসার যিনি মার্সেই তে কোন মিশনে এসেছিলেন। কিন্তু আপনার স্বামীর সাথে তাহলে কিভাবে ঐ মিস্টার পলের মিল পেলেন? উনি তো একজন ফ্রেঞ্চ পুলিশ।””

“আমিও তো সেটাই ভাবছি।”

“আচ্ছা, আপনার দেখতে কোন ভুল হয়নি তো? এমন তো হতে পারে যে আপনি দুজনের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন।”

“এটা আমারও মনে হয়েছিল। কিন্তু..ওনাদের দুজনের চেহারায় অনেক মিল। এতটা মিল স্বাভাবিক নয়। আর আমি রাফসান শিকদারকে বেশ কয়েকবার সামন থেকে দেখেছি ওনার ছবির সামনেও কয়েকবার দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ ওনাদের মধ্যে যে এত মিল তা বলে বোঝানো সম্ভব না। আপনি নিজেও যদি রাফসান শিকদারের ছবি দেখতেন তাহলে আপনিও একই কথা বলতেন বলে আমার বিশ্বাস।”

ইয়াসিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ওহ। আচ্ছা, ব্যাপারটা তাহলে ভাবতে হচ্ছে। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি নিজের মতো খোঁজ লাগিয়ে দেখছি কি করা যায়। যদি কোন তথ্য বের করতে পারি তাহলে সবার আগে আপনাকেই জানাবো।”

ইয়াসিনের এমন সাহায্য করার মনোভাব দেখে মিষ্টি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে,
“আপনাকে ধন্যবাদ। জানিনা আপনার ঋণ কিভাবে শোধ করব।”

“এত ভাবার কিছু নেই। আমাকে আপনি একজন বন্ধু ভাবতে পারেন। একজন বন্ধু তো আরেক বন্ধুকে স্বাভাবিক ভাবেই সাহায্য করতে পারে। তাই না?”

ইয়াসিনের কথা শুনে মিষ্টির চিন্তা অনেকটাই কমে যায়।

★★
নতুন দিন, মার্সেই শহরে আসার মিষ্টির বেশ কয়েক দিন পেরোনোর পর এখন সে আমিনার সাহায্যে এখানকার ভাষা অনেকটাই শিখেছে। যদিও পুরোপুরি শেখা হয়নি তবে ভালোই অগ্রগতি হয়েছে তার। এজন্য আজ আমিনা মিষ্টিকে বলল,
“চল, আজ আমরা দুজন মিলে মার্সেই পোর্ট থেকে ঘুরে আসি৷ তুমি এখানে এসেছ থেকে তো ঘরের চার দেয়ালেই বন্দি হয়ে আছ। একটু ঘুরতে গেলে মনটা ভালো হবে।”

মিষ্টি তখনো মিস্টার পলের ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত ছিল। তাই সে আপত্তি জানিয়ে বলে,
“আমার এখন ভালো লাগছে না। পরে কোন দিন যাই?”

এমন সময় ফাতিমা বিবি রুমে এসে বলেন,
“আমিনা তো ঠিকই বলছে। তুমি তো এখানে এসেছ থেকে সেভাবে কোথাও ঘুরতেই যাও নি। একদিন যদিওবা আমাদের সাথে মিস্টার ল্যুঁই এর বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেলে তাতেও কত কাহিনি ঘটে গেল। এভাবে চলতে থাকলে তো তোমার মানসিক অবস্থা ভেঙে পড়বে। তুমি একটু বাইরে ঘুরে আসো তাহলে দেখবা মনটা ভালো হবে আর মন ভালো হলে দেখবা সবকিছু ভালো লাগবে।”

মিষ্টি আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় আমিনা একপ্রকার জোরপূর্বক মিষ্টিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“মিষ্টি আপু চলো না অনেক মজা হবে।”

বলে একপ্রকার মিষ্টিকে টেনে তোলে। মিষ্টিও আর না করতে পারে না। আমিনার সাথে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে।

দুজন মিলে মার্সেই পোর্টের পুরাতন বাজারে যায়। বাজারটায় বেশ ভালোই ভীড় ছিল তবে বেশ সাজানো গোছানো। চারিপাশে সামুদ্রিক মাছের বাজারও বসেছে এবং সেখানে ক্রেতাদের ভীড়ও চোখে পড়ার মতো।

সমুদ্রের পারে এসে আমিনা মিষ্টিকে বলে,
“এই দেখ, এই হলো ভূমধ্যসাগর। এই ভূমধ্যসাগরের তীরেই অবস্থিত আমাদের মার্সেই শহর।”

মিষ্টি ভূমধ্যসাগরের বিপুল জলরাশির দিকে তাকিয়ে বলে,
“তার মানে এখন আমরা ভূমধ্যসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আছি?”

আমিনা সম্মতি জানায়। মিষ্টি ভূমধ্যসাগরের জলরাশির দিকেই তাকিয়ে ছিল। এমন সময় সাগরের পানিতে একটা চেনা মুখ দৃশ্যমান হতেই সে চমকে ওঠে। মিষ্টি কি এটা ঠিক দেখছে? নিজের চোখ কেও যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। মিষ্টি বলল,
“মিস্টার রাফসান শিকদার!”

বলেই সে পিছনে ফিরে তাকালো। তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল ছিল ইমানুয়েল পল। মিষ্টিকে নিজের দিকে ফিরতে দেখেই সে বলে ওঠে,
“কে আপনি?”

মিষ্টি পলের মুখ থেকে এই শব্দ শুনে চমকে গেল। আমতাআমতা আমতাআমতা করে বলে,
‘আমি..আমি মিষ্টি..’

“কোথা থেকে এসেছেন আপনি?”

“জ্বি..বাংলাদেশ..”

বলে থমকালো মিষ্টি। আমিনা মিষ্টির দিকেই তাকিয়ে ছিল। বোঝার চেষ্টা করছিল আসল ঘটনা কি। পল এবার আমিনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“যতদূর জানি আপনারা মরোক্কান বংশোদ্ভূত। তাহলে একজন বাংলাদেশী কিভাবে আপনাদের আত্মীয় হলো?”

আমিনা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল এমন প্র‍শ্ন শুনে। কি বলবে কিছু বুঝতে পারছিল না৷ অনেক ভেবে বলে,
“কে..কেন হতে পারে না?”

“তা পারে। যাইহোক, আপনি বাংলাদেশ থেকে কবে এদেশে এসেছেন?”

এই কথা শুনে মিষ্টি থমকে যায়। কি উত্তর দেবে এবার সে? কিছু সময় ভেবে বলে,
“মাস খানেক হলো।”

“আপনার পাসপোর্ট বা ভিসার মেয়াদ কি আছে?”

মিষ্টি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ালো।

“কই দেখি।”

মিষ্টির দুচোখ বিস্ফোরিত হলো। তার পাসপোর্ট, ভিসা সব তো ছিনতাই হয়ে গেছিল। এবার সে কি করবে? মিষ্টি কিছু বুঝতে পারছিল না৷ আমিনা ব্যাপারটা সামলাতে বলে,
“হয়তো এখানে আসার সময় নিয়ে আসতে ভুলে গেছে। আমাদের বাসাতেই আছে পাসপোর্ট ভিসা।”

পল হালকা হেসে তার পেছনে থাকা কিছু মহিলা পুলিশকে ইশারা করতেই তারা এগিয়ে এসে মিষ্টির হাতে হাতকড়া পড়ায়। মিষ্টি তাদের অনেক অনুনয় করে, আমিনাও কিন্তু তারা কোন কথা শোনে না। উলটে পল আমিনার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“থানায় এসে ওনার পাসপোর্ট, ভিসা দেখিয়ে ওনায় ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন।”

বলেই মিষ্টিকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমিনা ভীষণ ভীত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারছিল না কি করবে। তাই সে জলদি বাড়ি অভিমুনে রওনা দেয়। তাকে জলদি তার মা এবং ভাইকে এসব জানাতে পারে। নাহলে মিষ্টি অনেক বড় বিপদে পড়ে যাবে।

এদিকে মিষ্টিও পল তথা অন্য পুলিশ সদস্যদের সামনে অনেক অনুনয় বিনয় করতে থাকে কিন্তু তারা মিষ্টির কোন কথাই শোনে না। এরমধ্যে পলের ফোন বেজে ওঠে। এলিজা কল দিয়েছে। পল কলটা রিসিভ করতেও এলিজা বলে ওঠে,
“কি করছ?”

“একজন অপরাধীকে গ্রেফতার করছি যে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। এবার তাকে নিয়ে থানায় যাব। সেখানে গিয়ে আরো অনেক তথ্য বের করতে হবে। এমনও হতে পারে যে এই অবৈধ অভিবাসী আমাদের দেশের কোন ক্ষতি করতে এসেছে নাকি। এমনও কি হতে পারে যে, কোন সন্ত্রাসী সংঘটনের সাথে যুক্ত।”

মিষ্টি যদিও ফ্রেঞ্চ ভাষা তেমন একটা বোঝে না কিন্তু যতটুকু বুঝল তাতেই তার অন্তরাত্মা কেপে উঠল।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here