ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ১৬ লেখিকা দিশা মনি

0
55

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ১৬
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টি কারাগারের মধ্যে বন্দি হয়ে কান্না করে চলছিল। ফাতিমা বিবি ততক্ষণে জেলে এসেছেন মিষ্টির সাথে দেখা করার জন্য কিন্তু পল মিষ্টির সাথে কাউকেই দেখা করতে দিচ্ছ না। ফাতিমা বিবি অনুনয়ের সাথে পলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“দয়া করে মেয়েটার সাথে দেখা করতে দিন। বিশ্বাস করুন, ওর কোন দোষ নেই।”

পল এবার রেগে বলে,
“আপনি বেশি কথা বলবেন না। নাহলে আপনাকেও জেলে ভড়ব।”

আমিনা পলের কথা শুনে রেগে বলে,
“খবরদার আমার মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করবেন না।”

পল আর কিনা বলতে যাবে এমন সময় এলিস ইয়াসিনের সাথে থানায় চলে আসে। তাদের সাথে ছিল এডভোকেট ভল্ট। এলিস এসেই ইমানুয়েল পলের উদ্দেশ্যে বলে,
“মিস্টার, পল। আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।”

তাদের আসতে দেখে ফাতিমা বিবি নিশ্চিত হয়ে বলেন,
“তোমরা এসেছ? মিষ্টিকে জেল থেকে বের করার ব্যবস্থা করো না। এনারা শুধু শুধু মেয়েটাকে আটকে রেখেছেন। ও কোন অন্যায় করে নি।”

ফাতিমা বিবির কথা শুনে ইয়াসিন বলে,
“তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না আম্মু। মিসেস মিষ্টির কিছুই হবে না।”

এডভোকেট ভল্ট এগিয়ে এসে বলে,
“এখানে ফ্রেঞ্চ সরকারের কিছু ডকুমেন্টস আছে। এখানে স্পষ্ট বলা যে, ওনার পাসপোর্ট ভিসা খোঁজার জন্য ইতিমধ্যেই কাজ চলছে এবং বাংলাদেশের এম্ব্যাসি থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে যে ওনার পাসপোর্ট, ভিসা সবই করা ছিল। আশা করি, এরপর আর কিছু জানার নেই আপনাদের। মেয়েটাকে ছেড়ে দিন। ”

পল কিছু বলতে গিয়েও দমে গেল। তার থেকেও উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার স্বাক্ষর আছে এই ডকুমেন্টস গুলোতে। তাই সে চাইলেও এখন আর কিছু করতে পারবে না। তাই পল অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার অধীনস্থ কিছু মহিলা পুলিশের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“যান, গিয়ে ওনাকে নিয়ে আসুন।”

“ওকে স্যার।”

কিছু সময় পর কিছু মহিলা পুলিশ মিষ্টিকে ধরে নিয়ে আসে। মিষ্টি কোন রকমে হাঁটছিল৷ বিগত কিছু সময় তার উপর যা টর্চার হয়েছে তা মিষ্টিকে একদম ঘায়েল করে দিয়েছে। মিষ্টিকে আসতে দেখেই ফাতিমা বিবি ছুটে গিয়ে বলেন,
“তুমি ঠিক আছ তো? আল্লাহ, এ কি অবস্থা! কি করেছে এনারা তোমার সাথে?”

মিষ্টি ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে,
“আমি ঠিক আছি।”

ইয়াসিন উদ্বিগ্ন হয়ে সামনে এগিয়ে এসে মিষ্টিকে আগলে নিয়ে বলে,
“আপনি একদম ঠিক নেই। এক্ষুনি আমার সাথে হাসপাতালে যাবেন চলুন।”

মিষ্টির প্রতি ইয়াসিনের এরকম কেয়ার দেখে এলিসের কিছুটা খারাপ লাগে। আমিনা এলিসকে খেয়াল করে তার কাছে গিয়ে বলে,
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সিস্টার এলিস। তোমার জন্যই আমরা মিষ্টি আপুকে একদম সহি সালামত ফিরে পেলাম।”

ফাতিমা বিবিও এলিসকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলে,
“হ্যাঁ, তুমি না থাকলে না জানি মেয়েটার উপর দিয়ে আরো কত কি যেত! আল্লাহ মাফ করুক।”

“এভাবে বলবেন না। আপনাদের সাহায্য করতে পেয়ে আমিও অনেক খুশি।”

অতঃপর সে এগিয়ে এসে মিষ্টির কাধে হাত রেখে বলে,
“তুমি একদম ভয় পেয়ো না। ইয়াসিন, চলো ওকে আমরা নিকটস্থ কোন হাসপাতালে নিয়ে যাই।”

“হ্যাঁ, চলুন।”

তারা সবাই যেতে নেবে এমন সময় ইমানুয়েল পল মিষ্টির একদম সামনাসামনি এসে বলে,
“আজ শুধুমাত্র যথাযথ প্রমাণ এবং বাধ্যবাধকতার জন্য আমি আপনাকে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আপনার উপর আমার নজর সব সময় থাকবে। যদি আমি কখনো এটা নিশ্চিত হই যে, আপনি সত্যিই এদেশে কোন খারাপ উদ্দ্যেশ্য নিয়ে এসেছেন তবে মনে রাখবেন সেই দিনটাই আপনার জীবনের শেষ দিন হবে।”

মিষ্টি ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে পলের দিকে তাকায়৷ বিগত কিছু দিনে এই লোকটার প্রতি ঘৃণা তার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে৷ মিষ্টি আর পলের দিকে ফিরেও তাকায় না। ইয়াসিন ও এলিস তাকে ধরে ধরে সামনে নিয়ে যেতে থাকে।

★★
হাসপাতাল বেডে শুয়ে আছে মিষ্টি৷ তার সামনেই বসে আছেন ফাতিমা বিবি। এলিস ও আমিনা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ফাতিমা বিবি মিষ্টির হাতটা আলতো করে ধরে বলেন,
‘ওরা তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছে, তাই না মা?”

মিষ্টি জোরপূর্বক হেসে বলে,
“একটু কষ্ট তো হয়েছে তবে ব্যাপার না,,,”

“দেখবে আল্লাহ ওদের এর শাস্তি একদিন না একদিন ঠিকই দেবে। তোমাকে দেখে তো আমারও নিজের অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। এক সময় আমার সাথেও ওরা এমন করেছিল ঐ টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে। জানি না, ওরা কেন এমন করে! নিরপরাধ মানুষকে কেন কোন শক্তপোক্ত প্রমাণ ছাড়া এভাবে কষ্ট দেয়! এটা কি ধরনের আইন? আমাদের দোষ কি? শুধু এটাই যে আমরা বাইরের দেশ থেকে এখানে এসেছি। এজন্য আমাদের সাথে এমন পশুর মতো ব্যবহার করবে?”

এমন সময় ইয়াসিন হাতে কিছু মেডিসিন নিয়ে প্রবেশ করে বলে,
“এই নিন মিসেস মিষ্টি এই ওষুধ গুলো খেয়ে নিন।”

মিষ্টি বলে,
“এসবের আবার কি দরকার ছিল। শুধু শুধু এত খরচ কেন করতে গেলেন আমার জন্য বলেন?”

মিষ্টির কন্ঠে একধরনের ক্লান্তি আর কৃতজ্ঞতা মিশে ছিল। ইয়াসিন হালকা হাসল আর বলল,
“আপনার জীবনের মূল্য টাকার চেয়ে অনেক বেশি, মিসেস মিষ্টি। আর খরচের কথা ভাববেন না, এটা আমার দায়িত্ব। আপনি এখন ওষুধ খান, তারপর একটু বিশ্রাম নিন।”

ফাতিমা বিবি মিষ্টির মাথায় হাত রেখে বললেন,
“হ্যাঁ মা, ইয়াসিন ঠিকই বলছে। তুমি একটু বিশ্রাম নেও, অনেক ধকল গেছে তোমার উপর।”

মিষ্টি মাথা নিচু করে বলল,
“আল্লাহ আপনাদের ভালো রাখুক। আমি জানি না, আমি আপনাদের কি দিয়েছি যে আপনারা আমার জন্য এত করছেন!”

এলিস, যে এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, এবার এগিয়ে এসে বলল,
“আমরা কেউ কারও জন্য কিছু পাইনি, মিষ্টি। কিন্তু কেউ যখন সত্যিই সমস্যায় পড়ে, তখন পাশে দাঁড়ানোই সবচেয়ে বড় পাওয়া। তুমি একদম এসব নিয়ে ভাববে না।”

মিষ্টি মাথা নাড়ল, কিন্তু তার ভেতরটা কেমন জানি অস্থির হয়ে উঠছিল। পলের শেষ কথাগুলো এখনো কানের মধ্যে বাজছে। ‘তোমার উপর আমার নজর সবসময় থাকবে!’

কেন? সে কি ভুল কিছু করেছে? নাকি এখানে কিছু একটা এমন ঘটছে যার সঙ্গে সে নিজেও জড়িয়ে পড়েছে?

★★

পরদিন সকালে হাসপাতালের জানালার পাশে বসে ছিল মিষ্টি। চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে যায় সেই বন্দি সময়, সেই অন্ধকার ঘর, সেই ভয়ানক প্রশ্নবাণ…

“আপনি কি এখন ভালো অনুভব করছেন?”

মিষ্টি চমকে পেছনে তাকাল। ইয়াসিন দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা ছোট্ট ফলের ঝুড়ি।

“হ্যাঁ, আমি ভালো আছি।”
মিষ্টি হেসে বলল।

ইয়াসিন চেয়ার টেনে তার সামনে বসল। “তাহলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি কিসের কথা ভাবছেন?”

মিষ্টি একটু চুপ করে থাকল, তারপর মৃদু স্বরে বলল, “ইন্সপেক্টরপলের কথা…”

ইয়াসিন ভ্রু কুঁচকে বলল, “ওই লোকটার কথা? ও তো একেবারে অমানুষ! আপনি কেন ওর কথা ভাবছেন?”

“ঠিক জানি না। না চাইতেও ওনার কথাই ভাবছি।”

“আমার মনে হয় না, উনি আপনার স্বামী। যদি তাই হতো তাহলে আপনার সাথে এমন ব্যবহার কখনো করত না। উনি অন্য কেউ।”

“আপনার কথাই হয়তোবা ঠিক।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here