ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ১৭ লেখিকা দিশা মনি

0
68

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ১৭
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টি এখন কিছুটা সুস্থ অনুভব করছে৷ তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতাল থেকে দ্রুত আবার ফিরে যাবে৷ এমন ভাবনা থেকেই সে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ইয়াসিন এসে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টির সামনে৷ মিষ্টি ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“সব ফর্মালিটিস পূরণ করা হয়ে গেছে? এখন আমি ফিরতে পারবো তো?”

ইয়াসিন বলে,
“হুম, পারবেন।”

মিষ্টি এবার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“এবার আমি যত দ্রুত সম্ভব নিজের দেশে ফিরে যেতে চাই।”

মিষ্টির মুখে এই কথা শুনে ইয়াসিন চপসে গেল। তার মুখে যেন আধার নেমে এলো। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
“কেন? আপনি নিজের স্বামীকে আর খুঁজবেন না?”

মিষ্টি আবারো মনে পড়ে যায় ইমানুয়েল পলের কথা। যদিও সে নিশ্চিত নয় এটাই রাফসান কিনা কিন্তু তবুও তার ব্যবহার মিষ্টিকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। না চাইতেও তার বুকের বাঁ-পাশটা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে। মিষ্টি আনমনে বলে ফেলে,
“যে ধরা দিতে চায়না, লুকিয়ে থাকতে চায় তাকে আর খুঁজে কি লাভ?”

ইয়াসিন মিষ্টির কথা শুনে অবাক হয়ে বলে,
“মানে? আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।”

“কিছু না। আমার বাড়ির লোকের সাথে অনেক দিন থেকে কোন যোগাযোগ নেই৷ তারা নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তা করছে৷ এবার আমায় ফিরতে হবে।”

ইয়াসিন আর কিছু বললো না৷ শুধু উদাস চোখে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল।

★★
মিষ্টিকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরল ইয়াসিন। মিষ্টিকে ফিরতে দেখে ফাতিমা বিবি আর আমিনা তো ভীষণ খুশি৷ ফাতিমা বিবি হরেক রকম রান্না করেছেন মিষ্টিকে খাওয়ানোর জন্য। আয়োজনের কোন কমতি রাখতে চান না তিনি। এদিকে আমিনাও মিষ্টির সাথে চিপকে আছে। সে প্রথমেই মিষ্টির পাশে বসে দুঃখ প্রকাশ করে বলে,
“আমার জন্যই তোমাকে এত কষ্ট সহ্য করতে হলো, মিষ্টি আপু। না আমি তোমাকে জোর করে মার্সেই শহরে ঘুরতে নিয়ে যেতাম আর না তোমায় এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে পড়ত হত। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও।”

মিষ্টি হালকা হেসে বলে,
“কি যে বলো না তুমি! তোমার কি দোষ এখানে? এটা তো একটা দূর্ঘটনার মতো ছিল।”

ফাতিমা বিবি খাবার নিয়ে আসতে আসতে বলেন,
“তবে দোষটা আমাদেরও কম নয়। তুমি নাহয় এখানে নতুন কিন্তু আমরা তো নয়। আমাদের উচিৎ ছিল আগেই থানায় একটা জিডি করে রাখা তাহলে আর এই দিন দেখতে হতো না। যাইহোক, যা হবার হয়েছে এখন তো আর বলেকয়ে কিছু বদলানো যাবে না। এই নাও, তুমি এই চিকেন স্টু টা খেয়ে নাও। শরীরে একটু বল পাবে।”

মিষ্টি খুশি হয়ে বাটিটা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে। এমন সময় হঠাৎ করে এলিস সেখানে চলে এসে বলে,
“ভেতরে আসতে পারি?”

এলিসকে দেখে ফাতিমা বিবি ভীষণ খুশি হন। বলেন,
“আরে এলিস, হ্যাঁ, এসো ভেতরে এসো।”

এলিস ধীর পায়ে হেঁটে ভেতরে আসে। অতঃপর ইয়াসিনের দিকে তাকায়। ইয়াসিনের দৃষ্টি ছিল মিষ্টির দিকে। এলিস এসেই বলে,
“আপনাদের সবার জন্য একটা ভালো খবর আছে।”

ফাতিমা বিবি জানতে চান,
“কি খবর?”

“মিসেস মিষ্টির পাসপোর্ট ও ভিসা পাওয়া গেছে। যেই চোরটা এগুলো চুরি করেছিল সে গতকালই পুলিশের হাতে পড়েছে এবং তার কাছ থেকে এসব উদ্ধার হয়েছে।”

এলিসের কথা শুনে মিষ্টি খুশি হয়ে বলে,
“কি বলছেন কি আপনি মিস এলিস? তাহলে আমার পাসপোর্ট, ভিসা সব পাওয়া গেছে৷ আমি তাহলে এবার দেশে ফিরতে পারবো!”

“হ্যাঁ!”

মিষ্টির মুখে তৃপ্তির হাসি। ফাতিমা বিবি, আমিনাও খুশি হন৷ তবে ইয়াসিনকে একটুও খুশি লাগছিল না। এরইমধ্যে আমিনা একটু বিসাদের সুরে বলে ওঠে,
“তাহলে কি তুমি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবে মিষ্টি আপু?”

মিষ্টি বলে,
“যেতে তো আমাকে হবেই৷ তবে তোমাদেরকে আমি কখনো ভুলব না। এরপর সময় পেলেই তোমাদের সাথে দেখা করতে চলে আসব আবার মার্সেইতে।”

ফাতিমা বিবি মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“আমি তোমার জন্য এটাই দোয়া করব যে, যেখানেই যাও তুমি সুখী হও। কখনো কোন দুঃখ, কষ্ট তোমায় স্পর্শ না করুক। আর জীবনের সব কষ্ট কাটিয়ে উঠো।”

ইয়াসিন মিষ্টির কাছে এসে বলে,
“আপনার কি এখনই ফিরে যাওয়ার খুব দরকার? আপনার স্বামীর সম্পর্কে কোন তথ্যই তো এখনো জোগাড় হয় নি। আর একটু চেষ্টা করে দেখুন না!”

মিষ্টি ইয়াসিনকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“আমি আর ওনাকে খুঁজতে চাই না। ভাগ্যে যদি থাকে তাহলে উনি আবার একদিন ফিরবেন ইনশাআল্লাহ। ততদিন পর্যন্ত আমি নাহয় অপেক্ষা করে নিলাম।”

ফাতিমা বিবি বলেন,
“এটা তুমি ঠিক বলেছ। সবকিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। তাছাড়া তোমার পরিবারও নিশ্চয়ই তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছে। তোমার উচিৎ তাদের কাছে ফিরে যাওয়া।”

ইয়াসিন এসব কথা শুনে যে বড্ড নাখোশ সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এলিস ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। অতঃপর মিষ্টিকে বলল,
“আপনি নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করুন। তারপর আমি আপনার ফ্লাইটের টিকিট ম্যানেজ করছি।”

“আচ্ছা।”

★★
ইমানুয়েল পল চিন্তিত মুখে নিজের রুমে পায়চারি করছিল। এমন সময় হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। ইমানুয়েল দরজাটা খুলে এলিজাকে দেখে। কিছুটা বিরক্তির ছাপ ভেসে ওঠে তার চোখেমুখে। এলিজা সেটা খেয়াল করে বলে,
“কি হয়েছে? তোমার চোখমুখ এমন কেন লাগছে সুইটহার্ট?”

ইমানুয়েল এলিজাকে জোরপূর্বক ভেতরে এনে অতঃপর দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বলে,
“এখন অন্তত এই নাটকটা বন্ধ করুন মিস এলিজা ল্যুঁই। আমরা এখন একা আছি, এখন এসব নাটকের প্রয়োজন নেই।”

এলিজা বলে,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তো বলুন এখন আপনার পরবর্তী প্ল্যান কি? আমাদের বিয়েটা কি হবে?”

“মিশনের কাজের বাইরে কোন কিছুতে আমার আগ্রহ নেই। আপনি সেটা খুব ভালো করেই জানেন।”

“কিন্তু আপনিও তো এটা খুব ভালো করেই জানেন যে, যদি আপনাকে নিজের পরিচয়টা লুকাতে হয় তাহলে আমাকে বিয়ে করতেই হবে। কারণ এখনো চারপাশে অনেক স্পাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরমধ্যে যদি কোন ভাবে আপনার সত্যটা তাদের সামনে ধরা পড়ে যায় তাহলে কিন্তু এই মিশন পুরো ব্যর্থ হয়ে যাবে।”

“এই নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও হবে মিস এলিজা। এই মিশন আমি কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেবো না। এই মিশনটা আমার বহু বছরের স্বপ্ন, বহুদিনের আশার প্রতিফলন। এর সাথে পুরো মানবজাতির স্বার্থ জড়িয়ে,এই পৃথিবীর ভবিষ্যতও অনেকাংশে এর উপরই নির্ভরশীল। তাই আমি যে করেই হোক এই মিশনটা সফল করব৷ তবে আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

“কিন্তু কেন জানতে পারি?”

“কারণ আমি বিবাহিত!”

★★
মিষ্টি রাত্রিবেলা হতাশ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। রাত যত গভীর হচ্ছে তার উদাসীনতা যেন ততই বাড়ছে। একফোটা ঘুমও পাচ্ছে না। বরঞ্চ মনে জেগে উঠছে হাজারো প্রশ্ন। আর এই সব প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দু ঐ একটা মানুষই “ইমানুয়েল পল”

মিষ্টি আর কিছু সময় এভাবে কাটিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। দুচোখের পাতা বন্ধ করে মনে মনে স্বগতোক্তি করে বলল,
“না, আমি আর ভাবব না ওনাকে নিয়ে। উনি আমার স্বামী রাফসান শিকদার নন, আমার স্বামী এতটা নির্দয় হতে পারে না। উনি অন্য কেউ, এই সত্যটা আমায় মানতেই হবে। কিন্তু তাহলে রাফসান শিকদার কোথায়? উনি কি তাহলে সত্যিই হারিয়ে গেছেন?”

নিজেকেই নিজে এই প্রশ্ন করে মিষ্টি কোন উত্তর পেল না। আর কিছু সময় পর সে এভাবেই ঘুমিয়ে গেল। তার পাশে শোয়া আমিনা অবশ্য অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এদিকে মিষ্টি ঘুমানোর কিছু সময় পর কেউ একজন তার ঘরে এলো। মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে নিজের থেকে দূরে কোথাও যেতে দেব না। কারণ..জ্যা তি আমে!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here