#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ১৯
লেখিকা দিশা মনি
মিষ্টির জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে একটি আবদ্ধ ঘরে আবিষ্কার করে। মিষ্টি চোখ খুলেও বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। ভয়ে তার কান্না করার উপক্রম ছিল। এমন সময় হঠাৎ সে বাইরের কোন একটা স্থান থেকে শোরগোলের আওয়াজ শুনতে পায়৷ অতঃপর ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে একটা দরজা। যা হালকা চাপানো৷ মিষ্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেই দরজাটা খুলে বেরিয়ে আসে সেই বদ্ধ রুম থেকে। অতঃপর সামান্য এগোতেই অবাক হয়ে যায়। কারণ সে আবার মার্সেই শহরে চলে এসেছে! মিষ্টি এটা বুঝতে পেরে হতবাক স্বরে বলে,
“আমি তো প্যারিসে ছিলাম তাহলে মার্সেই তে কিভাবে চলে এলাম?”
অতঃপর সে জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহুর্ত মনে করে। সেই কথাটা মনে করতেই ভীষণ ভয় জাগে তার মনে। অজানা আশংকায় কেপে ওঠে তার বুক৷ মিষ্টি বুঝতে পারে না এখন সে কি করবে। তার কি এখন আবার ইয়াসিনদের কাছে ফেরা উচিৎ? এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে থাকে মিষ্টির মনে। তবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না।
★★
ইমানুয়েল পল নিজের কার্যালয়ে বসে ছিল৷ তাকে ভীষণ উদ্বিগ্ন লাগছিল। এমন সময় কারো আগমন ঘটে। ইমানুয়েল পল চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পায় এলিজা ল্যুঁইকে। তাকে দেখেই পল খানিক বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে,
“আপনি এখানে কি করছেন মিস এলিজা? আমি তো বলেছিলাম আমি কিছু সময় একা থাকতে চাই। আপনি সেটা শোনেন নি?”
এলিজা হালকা হেসে বলে,
“এত রেগে যাচ্ছন কেন মিস্টার পল? আপনার এত রাগের কারণ কি?”
পল আর কিছু বলে না। এলিজা পলকে চুপ দেখে বলতে শুরু করে,
“দেখলেন তো, আমার সন্দেহটাই ঠিক। ঐ মিষ্টি নামক মেয়েটা কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত। প্যারিসে আজ যেই ব্লাস্ট হয়েছে তার পেছনে ওরই হাত রয়েছে।”
পল চোখ বন্ধ করে নেয়। এই অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যটা যেন সে মানতেই চায় না। এলিজা আরো রেগে বলে,
“আপনাকে ফ্রান্সে নিয়ে আসা হয়েছিল পৃথিবীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন আপনি? মিশনের উদ্দ্যেশ্য কি ভুলে গেছেন আপনি? আজ প্যারিসের রেলওয়ে স্টেশনে যে হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল তার ফলে কতটা মারাত্মক ফল হতে পারত বুঝতে পারছেন? ভাগ্য ভালো যে, পুলিশ সঠিক সময় ঐ মিষ্টিকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। তবে, তাতেও বা লাভ হলো কৈ? ঐ সন্ত্রাসীটা তো ঠিকই পালিয়ে গেল।”
পল এবার ক্রোধ প্রকাশ করে বলল,
“বেশিদিন পালিয়ে বেড়াতে পারবে না ও। খুব শীঘ্রই ওকে খুঁজে বের করব আমি।”
“এসবের কিছুই হতো না যদি আপনি ওকে জেল থেকে ছেড়ে না দিতেন। আমি তো আগেই আমার সন্দেহের কথা আপনার কাছে প্রকাশ করেছিলাম কিন্তু আপনি আমার কথা আমলে নিলেন না। ভুলে গেলেন যে, আমি ফ্রান্সের অন্য শক্তিশালী একজন গোয়েন্দা। আপনার থেকে আমার অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও বেশি। অথচ আপনি কোন এক অজানা কারণে ঐ মেয়েটাকে ছেড়ে দিলেন। আচ্ছা, এর কারণ কি মিস্টার পল? শুধু এটাই যে ঐ মেয়েটা আপনার দেশের নাগরিক? এজন্যই ওর প্রতি এত দয়া দেখিয়েছেন? নাকি অন্য কোন ব্যক্তিগত কারণ আছে?”
পল বলে ওঠে,
“মিস এলিজা..আপনি আমার ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।”
“দুঃখিত, মিস্টার পল। কিন্তু আপনার কাজকর্ম দেখে আমি এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি। আমি তো আপনাকে একজন ন্যায়পরায়ণ, বলিষ্ঠ ব্যক্তি ভেবেছিলাম। যে নিজ দায়িত্বে সব পিছুটান ভুলে পৃথিবী রক্ষার এই মিশনে নেমেছে। এজন্যই তো আমি আপনাকে এতটা বিশ্বাস করেছিলাম। অথচ আপনি কি করলেন? আপনি জানেন না, কতটা ঝুঁকি নিয়ে আপনাকে ফ্রান্সে নিয়ে এসেছিলাম আমি৷ নিজের দেশের সরকারের থেকেও ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছি। নিজের প্রভাব খাটিয়ে একটা মিথ্যা পরিচয় দিয়েছি আপনাকে। কিসের জন্য করেছি এসব? শুধু বিশ্বব্যাপী ধ্বংসলীলা চালানো ঐ সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করার জন্য। শুধু আপনাকেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আরো ৪০-৫০ জনকে এই কাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোতে। কেননা, এসব সন্ত্রাসীদের প্রধান টার্গেট ফ্রান্সের মতো পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোতে অশান্তি সৃষ্টি করে এখানকার পরমাণু অস্ত্র চুরি করে বিশ্বে ধ্বংসলীলা চালানো। সে জন্যই আপনার মতো অকুতোভয় কাউকে দরকার ছিল ফ্রান্সে। অথচ আপনি কি করলেন? এত স্পর্শকাতর একটা মিশনে যোগ দিয়েও এতটা ঢিলেঢালা ভাব দেখালেন?”
পল মাথা নিচু করে দেয়। তার এখন খানিকটা আফসোস হচ্ছে। এলিজা শুরুতেই তাকে এমন কিছু গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছিল যে মিষ্টি এই সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকতে পারে আর সেজন্যই তাকে গ্রেফতার করে টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যদিওবা পলের নিজেরই কাছে কেমন জানি খারাপ লাগছিল মিষ্টিকে এভাবে টর্চার সেলে পাঠাতে। কেননা, মেয়েটা তো তার জন্যই এদেশে এসেছে। তবে যেহেতু এলিজার মতো এত তুখোড় একজন গোয়েন্দা দাবি করেছিল মিষ্টির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে তাই আর সে এ নিয়ে কোন আপত্তি করতে পারে নি। পরে যখন এত নির্যাতন সহ্য করেও মিষ্টি কিছু বলল না৷ আবার একজন স্বনামধন্য আইনজীবী তার হয়ে কথা বলল, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই পল মিষ্টিকে ছেড়ে দেয়। কেননা, তার নিজেরও মন কেমন করছিল মিষ্টির জন্য। তবে এখন তার মনে হচ্ছে, সে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। আবেগের বশে বিবেক হারানো উচিৎ হয়নি তার। যেভাবে সব পিছুটান ভুলে, অতীতকে পেছনে ফেলে, নিজের আসল পরিচয়কে হ*-ত্যা করে সে এই মিশনে নেমেছিল তার সেই পিছুটানই কি এখন তার মিশন ব্যর্থ করে দেবে? পল সেটা হতে দেবে না।
এমন সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছুটে এসে বললেন,
“স্যার, একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। আমি খবর পেয়েছি, মিষ্টি নামক ঐ সন্ত্রাসীকে মার্সেই পোর্টের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।”
পল চোয়াল শক্ত করে বলে,
“এক্ষুনি আমার টিমকে প্রস্তুত করো। ঐ সন্ত্রাসীকে ধরতে হবে আমাদের। সে জীবিত হোক বা মৃত!”
“ওকে, স্যার।”
বলেই সে বেরিয়ে যায়। এদিকে এলিজা পলকে স্পষ্ট করে বলে দেয়,
“আশা করি, নিজের এই জেদ আর মনোবল শেষ অব্দি বজায় রাখবেন মিস্টার পল। ঐ সন্ত্রাসীকে আরো কোনরকম দয়া দেখাবেন না।”
পল মাথা নাড়ায়।
★★
মিষ্টি উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে মার্সেই পোর্ট এলাকায় হেটে চলছে। যদিও তার মন চাইছিল ইয়াসিনদের সাথে দেখা করতে কিন্তু সে করল না। কারণ যেভাবে তাকে প্যারিসে গ্রেনেডসহ হাতেনাতে ধরা হয়েছিল তাতে করতে হয়তো ইতিমধ্যেই তাকে সন্ত্রাসী তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। এই মুহুর্তে সে ইয়াসিনদের সাথে দেখা করে তাদের কোন বিপদে ফেলতে পারে না। এজন্য আপাতত সে কোনরকমে স্কার্ফে মুখ লুকিয়ে চলছে। কিন্তু হঠাৎ করে সাইরেনের শব্দ শুনে তার বুকটা কেপে ওঠে। সে দেখতে পায় একটা পুলিশের গাড়ি এগিয়ে আসছে তার দিকেই। মিষ্টির মনে হঠাৎ করে ভয় জেগে ওঠে। সে আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে একদম ভূমধ্যসাগরের তীরে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর আর কোন উপায় না দেখে মার্সেই বন্দরের সামনেই দাঁড়ানো একটা জাহাজে উঠে পড়ে।পল ও অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা তাকে অনুসরণ করতে করতে সেই জাহাজে উঠে পড়ে।
মিষ্টি নিজেকে বাঁচাতে জাহাজের মধ্যেই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু একসময় পল তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে তার দিকে বন্দুক তাক করে। মিষ্টি এবার ভয় পেয়ে যায়। পল তাকে বলে,
“আপনার পালানোর আর কোন পথ নেই।”
মিষ্টি বলে,
“বিশ্বাস করুন, আমি কিছু করিনি। আমি কোন সন্ত্রাসী নই।”
“বিশ্বাসের আর কোন সুযোগ নেই। হয় ধরা দিন, আর নয়তো…”
মিষ্টি ভয়ে পুনরায় পালানোর চেষ্টা করে এতে পল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বন্দুকের ট্রিগারে একটা চাপ দেয়। গুলিটা বের হয়ে ঠিক মিষ্টির কাধকে ভেদ করে। মিষ্টি হতবাক হয়ে তাকায় পলের দিকে। পলও হতভম্ব। মিষ্টি গিলিবি হয়েই জাহাজ থেকে পড়ে যায় ভূমধ্যসাগরের মধ্যে৷ ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে ভূমধ্যসাগরের অতল সাগরে। তার রক্তের স্রোত মিশে যায় ভূমধ্যসাগরের তীরজুড়ে…
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨