#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ২০
লেখিকা দিশা মনি
পল মিষ্টিকে পড়ে যেতে দেখে হতবাক হয়ে যায়। সে তো মিষ্টিকে গুলি করতে চায়নি! কিভাবে তার দ্বারা এত বড় ভুল হয়ে গেল! পল এক মুহুর্তের জন্য ভাবল সে পানিতে ঝাঁপ দেবে মিষ্টিকে বাঁচানোর জন্য। আর এক মুহুর্ত সময় দেরি না করে সে ভূমধ্যসাগরের জলে ডুব দিতে চায় কিন্তু তার টিমের কিছু লোক তাকে আটকে বলে,
“স্যার, এখানে অনেক গভীর পানি। এখানে ঝাঁপ দিবেন না।”
“ছাড়ো আমায়,”
“স্যার, আপনি এমন করছেন কেন? একটা সন্ত্রাসীই তো পড়ে গেছে৷ তার তো মরে যাওয়াই উচিৎ। আপনি ওনাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।”
পল কিছু বলতে পারে না। তবে নিজের বিবেকের কাছে সে ধাক্কা খাচ্ছিল। তাই সবার সব বাধা অতিক্রম করে সে ভূমধ্যসাগরের জলে ঝাঁপ দেয়। ভালো সাতার পাড়ার পরও সে এই গভীর জলে হাবুডুবু খেতে থাকে। আশেপাশে মিষ্টিকে খুঁজতে থাকে কিন্তু ফলাফল শূন্য! মিষ্টিকে না পেয়ে হতাশার শ্বাস ফেলে পল। অতঃপর মনে মনে বলে,”এটা কি হওয়ার ছিল আমার সাথে? মিষ্টির কিছু না হলে যে আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারব না। হে আল্লাহ, আপনি কৃপা করুন আমার উপর। মিষ্টিকে যেন আমি খুঁজে পাই।”
পলের এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে সে খেয়াল করে কিছু ডুবুরি তার আশেপাশে। তারা দ্রুত পলকে জোরপূর্বক জাহাজে টেনে তোলে। পল রেগে বলে,
“আমায় এভাবে তুললেন কেন? আমায় মিষ্টিকে খুঁজতে হবে।”
ডুবুরি দলের একজন সদস্য বলে ওঠে,
“আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা খুঁজে দেখছি যদি ওনাকে পাওয়া যাই।”
এরপরই মিষ্টির খোঁজ শুরু হয়। কিন্তু কিছু সময় কেটে ওঠেও মিষ্টির কোন খোঁজ না পেয়ে তারা ফিরে আসে। পল তাদের হতাশাগ্রস্ত চেহারা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ তার অনুশোচনার বোঝা বাড়ে।
★★
পল নিজের অফিসে বসে ছিল। তাকে ভীষণ মনমরা লাগছিল। এমন সময় কারো আগমনে তার ধ্যান ভাঙে। এলিজা পলের কক্ষে প্রবেশ করতে করতে বলে,
“কি ব্যাপার মিস্টার পল? আপনাকে এত উদাস লাগছে কেন?”
পল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। কিন্তু কিছু বলে উঠতে পারে না। এলিজা একগাল হেসে বলে,
“চারিদিকে আপনাকে নিয়ে কতো প্রশংসা হচ্ছে জানেন! আমার তো এসব শুনে ভীষণ ভালো লাগছে। আপনার কাজে আমি নিজেও ভীষণ আনন্দিত।”
পল বলে,
“আপনি আমায় একটু একা থাকতে দেবেন? আমার এখানে কিছুই ভালো লাগছে না।”
“এত উদাস হবার কি আছে এখানে? একটু হাসুন, আমি একটা পার্টির আয়োজন করেছি আপনার সফলতা উদযাপন করতে। সেই পার্টিতে যোগদান করুন।”
পল এবার ভীষণ রেগে বলে,
“আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন না মিস এলিজা? আমার কিছু স্পেস দরকার৷ আপনার এত আনন্দ করার ইচ্ছা হলে যান গিয়ে যত খুশি আনন্দ করুন। আমাকে এসবে ইনভলভ করার চেষ্টা করবেন না।”
“মিস্টার রাফসান শিকদার! আপনি কিন্তু নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার সাথে এমন অসভ্যতামি করার রাইট আপনার নেই।”
এলিজার মুখে নিজের আসল মুখটা শুনে রাফসান আরো রেগে বলে,
“আমায় আর এই নামে ডাকবেন না। রাফসান শিকদার মারা গেছে। আমি নিজে মেরে ফেলেছি তাকে। যেটুকুও বা বেঁচে ছিল সেটাও আজ আমি শেষ করে ফেলেছি। এখন শুধু নির্দয় অফিসার ইমানুয়েল পল বেঁচে আছে!”
তাদের মধ্যে এমন তর্কযুদ্ধই চলছিল এমন সময় রাফসানের অধীনস্থ একজন স্টাফ এসে বলে,
“স্যার, আপনি জলদি আসুন। একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আপনাকে দেখাতে চাই।”
রাফসান ভ্রু কুচকে বলে,
“কি দরকারি জিনিস?”
“আপনি আসুন। এলেই দেখতে পারবেন।”
রাফসান আর কথা না বাড়িয়ে রুমের বাইরে আসে। তার একটা গোপন কক্ষে চলে যায়। সেখানে যেতেই একজন ছদ্মবেশী গোয়েন্দার মুখোমুখি হয় সে৷ যার হাত-মুখ সবকিছুই বাধা। সেই গোয়েন্দাকে রাফসান নিজেই নিয়োগ করেছে। রাফসান তার কাছে এসে বলে,
“বলো, কি নিউজ এনেছ তুমি?”
“অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা নিউজ। এই ভিডিওটা দেখুন।”
রাফসান একটা সিসিটিভি ফুটেজের স্ক্রিনে মনযোগ দেয়। এই সিসিটিভিটা মেট্রো স্টেশনের মধ্যকার। এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেট্রোর মধ্যে যখন মিষ্টির চোখ একটু লেগে যাচ্ছিল তখনই কেউ একজন এসে সুকৌশলে মিষ্টির সাথে নিজের ব্যাগটা চেঞ্জ করে নিয়ে চলে যায়। দুজনের ব্যাগটা এতটাই সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল যে স্বাভাবিক ভাবে পার্থক্য বের করা সম্ভব নয়। এই দৃশ্যটা দেখেই রাফসান নিজের হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। চিৎকার করে বলে ওঠে,
“এসবের মানে কি?”
“আপনি যা সন্দেহ করেছিলেন সেটাই ঠিক মিস্টার পল। মিসেস মিষ্টি একদম নির্দোষ। তাকে এসব ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছে।”
“কি বলছ তুমি? কিন্তু কে করবে এই কাজ? মিষ্টির সাথে কার শত্রুতা থাকতে পারে?”
সেই ছদ্মবেশী গোয়েন্দাটা বলে,
“সেটাই তো আসল প্রশ্ন। কিন্তু স্যার, আমি তো আগেই আপনাকে এই বিষয়ে সতর্ক করেছিলাম যে হয়তোবা মিসেস মিষ্টিকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তাহলে আপনি কেন তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালেন?”
রাফসান কিছু একটা ভেবে বলে,
“আমার উদ্দ্যেশ্য মিষ্টিকে গুলি করা ছিল না। আমার উদ্দ্যেশ্য ছিল ওকে গ্রেফতার করা। আর সবথেকে বড় কথা আমার রাইফেলে কোন গুলিই ছিল না।”
“তার মানে গুলিটা আপনি করেন নি?”
“না।”
“তাহলে মিসেস মিষ্টিকে গুলিটা করল কে?”
“সেটাই তো ভাবছি।”
ছদ্মবেশী গোয়েন্দা বলে ওঠে,
“ওহ বুঝেছি৷ তার মানে এর পেছনে ঐ সন্ত্রাসী সংগঠনেরই কারো হাত থাকতে পারে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, কে আছে এসবের পেছনে?”
“সেটাই তো খুঁজতে হবে। যাইহোক, মিষ্টি এখন কেমন আছে?”
ছদ্মবেশী গোয়েন্দা রাফসানের এহেন প্রশ্ন শুনে হালকা হেসে বলে,
“আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার স্ত্রী একদম ঠিক আছে। তার গায়ে লাগা গুলিটা বের করা হয়েছে। যদিও এখনো জ্ঞান ফেরেনি তবে চিন্তার কিছু নেই দ্রুতই ফিরবে হয়তোবা।”
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মিষ্টির খেয়াল রাখবেন। এখন হয়তোবা ও আমায় ভুল বুঝবে। তবে একসময় ঠিকই সবটা বুঝবে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না, স্যার। আমি সব সামলে নেব। এখন আপনার কি আর কোন বিশেষ আদেশ আছে আমার প্রতি?”
“হ্যাঁ, মিষ্টির এই ভিডিওটা অনলাইনে ভাইরাল করে দিতে হবে। পারবা না?”
“জ্বি, পারব।”
“আমি চাই না মিষ্টিকে কেউ অপরাধী হিসেবে দেখুক। ওর সত্যটা সামনে আসা দরকার। যাতে করে আর কেউ ওকে সন্ত্রাসী না ভাবে।”
রাফসান গভীর চিন্তায় মগ্ন। মিষ্টিকে নিয়ে তার মনে এক অজানা ভয় কাজ করছে। সে জানে, যদি মিষ্টি জ্ঞান ফিরে তার সাথে কথা বলতে না চায়, তাহলে সে কোনোভাবেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
★★
মিষ্টির চোখ ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। ঘরের ছাদটা ধূসর রঙের। আশেপাশে শোনা যাচ্ছে যন্ত্রের বীপবীপ শব্দ। সে অনুভব করতে পারে, শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথাটা ভারী লাগছে, হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেছে।
হঠাৎ করে পাশ থেকে একটি অপরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসে।
“আপনি কেমন অনুভব করছেন?”
মিষ্টি চোখ সরু করে তাকিয়ে দেখে একজন নার্স তার পাশে দাঁড়িয়ে। নার্সের মুখে হাসি, কিন্তু চোখে কৌতূহল।মিষ্টি বলে,
“আমি… আমি কোথায়?”
মিষ্টির কণ্ঠ কাঁপছিল।
“আপনি হাসপাতালে, মিসেস মিষ্টি। আপনি ভাগ্যবান, গুলিটা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গে লাগেনি। আর হ্যাঁ, আপনি এখন নিরাপদ।”
নিরাপদ? মিষ্টি কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বলে ওঠে,
“কে আমাকে এখানে এনেছে?”
“এটা বলা যাবে না, তবে একজন ভদ্রলোক আপনাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।”
মিষ্টির মনে পড়ে গেল পলের কথা। সেই ভয়ানক মুহূর্ত… সেই গুলির শব্দ… তারপর গভীর সমুদ্রের ঠান্ডা জল। তার মানে, সে বেঁচে গেছে!
কিন্তু পল? সে কি এখনো তাকে একজন সন্ত্রাসী ভাবছে?
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨