#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ২
#লেখিকা দিশা মনি
বর উপস্থিত নেই কিন্তু বৌভাত হচ্ছে, কথাটা শুনতে বেশ অদ্ভুত ঠেকলেও এমনই এক বৌভাতের আয়োজন চলছে শিকদার বাড়িতে৷ যেখানে পুরো অনুষ্ঠানেই উপস্থিত থাকবে বর, শুধুমাত্র বউকে নিয়েই ঘটবে এই অনুষ্ঠান।
সকাল সকাল রোকসানা শিকদার তাড়া দিয়ে মিষ্টিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছেন। অতঃপর তাকে একটা দামি শাড়ি এবং শিকদার বাড়ির কিছু ঐতিহ্যবাহী গহনা পড়ে তৈরি হয়ে নিতে বলেছেন। মিষ্টিও তার হিটলার শ্বাশুড়ির ভয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে। সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের রূপ দেখে নিজেই মোহিত হয়ে যায় মিষ্টি। মুখে দেখা মেলে এক চিলতে হাসির। অতঃপর বাস্তবতা বুঝতে পেরে সেই হাসি মিলিয়ে যায়। মিষ্টি স্বগতোক্তি করে বলে,
“এই সাজগোজের কি আসলেই কোন মূল্য আছে? যেখানে আমার সদ্য বিবাহিত স্বামীই নেই আমার পাশে!”
নিজের যাবতীয় দীর্ঘ শ্বাস আড়াল করে মিষ্টি সেজেগুজে বাইরে আসে। রুমের বাইরে পা রাখতেই মিষ্টি মুখোমুখি হয় তার বড় জা ফারিয়ার। ফারিয়া মিষ্টিকে দেখেই স্মিত হেসে বলে,
“আরে! তুমি ইতিমধ্যে তৈরিও হয়ে গেছ। বেশ সুন্দর লাগছে তো তোমায়।”
“ধন্যবাদ, ভাবি।”
“তুমি তাহলে শাড়ি পড়তে পারো?! মা তো আমায় বলল, যেন তোমায় সাহায্য করি শাড়ি পড়াতে।”
মিষ্টি বলে,
“বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে হতে পারি কিন্তু অকর্মণ্য নেই। মোটামুটি গৃহস্থালি সব কাজই করি।”
ফারিয়ার হাসি মিলিয়ে যায়। সে মিনমিন স্বরে বলে,
“তাহলে তো ভালোই। বাড়ির বউ তো এমনই হওয়া উচিৎ। যাইহোক, নিচে চলো। সেখানে সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
মিষ্টি ফারিয়ার কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়৷ অতঃপর পা বাড়ায় সামনের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই মিষ্টি টের পার পুরো শিকদার বাড়ি অতিথিদের ভিড়ে গিজগিজ করছে। দম ফেলারও যায়গা নেই। রোকসানা শিকদারের নজর গেলো মিষ্টির দিকে। মিষ্টিকে দেখেই তিনি এগিয়ে এসে বললেন,
“তৈরি হয়ে গেছ তাহলে! এসো,আমি তোমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।”
ব্যস, শুরু হয়ে গেলো এক বিরাট পরিচয় পর্ব। বিভিন্ন নিকটাত্মীয় থেকে শুরু করে দুঃসম্পর্কের কতো মানুষের সাথেই মিষ্টির পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। অতঃপর কিছু জরুরি কাজে একটু দূরে গেলেন। মিষ্টি তখন এত গুলো অপরিচিত মুখের মাঝে একদম একা হয়ে গেল৷ আর এই সুযোগেই কিছু মহিলা তাকে ঘিরে ধরল। মিষ্টি অস্বস্তি বোধ করতে লাগল এত অচেনা মানুষের ভীড়ে। তার এই অস্বস্তি বাড়িয়েই একজন ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করে বসলেন,
“আচ্ছা, তোমার স্বামী কোথায়? তাকে যে কোথাও দেখছি না।”
মিষ্টি বুঝতে পারল না এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে। এমন সময় পাশ থেকে আরেক মহিলা বলে উঠলেন,
“আমি তো শুনলাম, বিয়ের পরপরই নাকি কোন এক মিশনে রওনা দিয়েছে বিদেশে।”
“সে কি কথা! বিয়ের পর ঘরে নতুন বউ ফেলে বিদেশে চলে গেল! আদৌ কি কোন মিশন নাকি বউ পছন্দ হয়নি জন্য পালিয়ে গেল?!”
মিষ্টির পক্ষে এসব কথা সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। এরইমধ্যে একজন নারী বলে উঠলেন,
“আমার তো তোমার জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তোমার অবস্থাটা তো আমি বুঝতে পারছি। থাক মেয়ে, আর কষ্ট পেয়ো না। আজকালকার যুগ তো পরিবর্তন হয়েছে। যদি তোমার স্বামী আর ফিরে না আসে তাহলে তুমিও আরেকটা বিয়ে করে নতুন কারো সাথে সংসার শুরু করো।”
“মিসেস পাটোয়ারী!”
হঠাৎ করে গম্ভীর একটি কন্ঠ শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। কন্ঠটি ছিল রোকসানা শিকদারের। যতটা না তেজ তার কন্ঠে ছিল তার থেকেও বেশি তেজ নিয়ে তিনি এগিয়ে এলেন সকলের সামনে। অতঃপর কড়া গলায় বললেন,
“আমার ছেলের বউকে এসব কুপ্ররোচনা দেবেন না। নাহলে আমি ভুলে যাব সে আপনি আমাদের বাড়ির অতিথি।”
মিসেস পাটোয়ারীর মুখটা চুপসে গেল। রোকসানা শিকদার এবার সকলের উদ্দ্যেশ্য করে স্পষ্ট করে বললেন,
“সবাই কান খুলে শুনে রাখুন,আমার ছেলে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনে বের হয়েছে। সেসব আপনারা কেউ বুঝবেন না। তাই এই নিয়ে কথা বলা বন্ধ করুন।”
অতঃপর তিনি মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“সব সময় চুপ করে থাকা সমস্যার সমাধান নয়। চুপ থাকলে সমস্যার সমাধান হয় না বরং সমস্যা বাড়ে। কিছু স্থানে উচিৎ জবাবও দিতে হয়, সেটাও করার চেষ্টা করো।”
মিষ্টি স্থির হয়ে থাকে। রোকসানা শিকদার সকলের দিকে একটা রাগী দৃষ্টি দিয়ে চলে যান। মিষ্টিও তার সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে সরে যায়। সামনের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ করে একটি চেনা কন্ঠ শুনতে পায়।
“মিষ্টি..মাই গার্ল..”
গলার স্বর অনুসরণ করে তাকাতেই মিষ্টি দেখতে পায় তার মা সুইটি চৌধুরীকে। তাকে দেখামাত্রই মিষ্টি আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। অতঃপর দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে নিজের মাকে। তার দুচোখ বেয়ে উপচে পড়ছিল নোনাজল। সুইটি চৌধুরীও আবেগের সাথে নিজ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আবেগঘন স্বরে বলে,
“তুমি ঠিক আছ তো মাই ডটার? কোন কষ্ট হচ্ছে না তো এখানে মানিয়ে নিতে?”
মিষ্টি আলতো স্বরে বলে,
“না।”
সুইটি চৌধুরী নিজের মেয়ের কান্না টের পেয়ে বলেন,
“তাহলে কাঁদছ কেন?”
“তোমাদের কথা খুব মনে পড়ছিল।”
এমন সময় মিষ্টির বাবা মোর্শেদ চৌধুরীও সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন,
“এখন তো তোকে আমাদের ছাড়াই থাকার অভ্যাস করে নিতে হবে। বিয়ের পর যে শ্বশুর বাড়িটাই মেয়েদের সব!”
মিষ্টির ভীষণ অভিমান ছিল তার বাবার উপর। তাই আর সে কিছু বলল না। শুধু নীরব থাকল। তার বাবার দিকে তাকালো অভিযোগের চোখে। এমন সময় হঠাৎ করে সেখানে উপস্থিত হলেন রফিকুল শিকদার। রাফসানের বাবা তথা তার মোর্শেদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুই বন্ধুই একে অপরকে জড়িয়ে ধরল।
রফিকুল শিকদার হেসে বললেন,
“এখানে আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো?”
“আরে না, কষ্ট হবে তো। আমার তো মেয়েটাকে দেখার জন্য মনটা ভীষণ ছটফট করছিল। আমার মিসেসের অবস্থাও অনেকটা একই। তাই চলে এলাম।”
রফিকুল শিকদার বলেন,
“এটা এখন তোর মেয়ের বাপের বাড়ি। তাই যখন ইচ্ছা হয় আসবি, এসে নিজের মেয়েকে দেখে যাবি।”
সুইটি চৌধুরী হঠাৎ করে বলে ওঠেন,
“আচ্ছা, আপনার ছেলে রাফসান…ও কোথায়? ওকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
রফিকুল শিকদারের মুখের হাসি হঠাৎ মিলিয়ে যায়। তিনি বেশ নতসুরেই বলেন,
“ও হ্যাঁ, একটা কথা তো আপনাদের জানানো হয়নি৷ মিষ্টিও নিশ্চয়ই আপনাদের কথাটা জানায় নি। আসলে..আমার ছেলে..রাফসান ও আসলে গতকাল রাতেই একটি মিশনে চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে ফ্রান্সের মার্সেই পোর্টের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছে। ওর ফিরতে ফিরতে কয়েক মাস লেগে যাবে।”
রফিকুল শিকদারের কথা শুনেই সুইটি চৌধুরী নিজের মেয়ের দিকে তাকান। মিষ্টির চোখের জলের রহস্য এবার তার কাছে পুরোপুরি পরিস্কার। এবার তিনি রাগী চোখে নিজের স্বামী মোর্শেদ চৌধুরীর দিকে তাকান।এমনিতেই তিনি এই বিয়ে নিয়ে খুশি ছিলেন এখন এই কথা জানার পর তার অসন্তোষ বৃদ্ধি পেল। তিনি কোন রাখঢাক না রেখেই বললেন,
“এটা কেমন কথা? আপনার ছেলের কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই? বিয়ে করতে না করতেই আমার মেয়েটাকে এভাবে একা রেখে চলে গেল?”
মোর্শেদ চৌধুরী নিজের স্ত্রীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“আহ, সুইটি। এমন ভাবে বলছ কেন? এটা ভুলে যেও না যে রাফসান একজন নেভি অফিসার। ওর কিছু দায়িত্ব আছে। হঠাৎ করে কাজ পড়ে গেলে আর কি করার?”
“তুমি তো চুপই থাকো। এতোই যদি কাজের প্রতি ভালোবাসা তাহলে বিয়ে করতে গেছিল কেন? শুধু শুধু আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিল।”
“এখানে জীবন নষ্টের কি আছে? ও তো কয়েক মাসের মিশনেই গেছে, সারাজীবনের জন্য তো আর যায়নি।”
সুইটি চৌধুরী নিজের স্বামীর কোন কথা গ্রাহ্য না করে বললেন,
“তোমার জেদেই আমার মেয়ের বিয়েটা হলো। নাহলে আমার বা মিষ্টির কোন ইচ্ছাই ছিল না এই বিয়ে হবার৷ এখন আমি আমার মেয়েকে কোনভাবেই সাফার করতে দেব না।”
“সুইটি চুপ করো! সবাই দেখছে।”
“আমি কিচ্ছু কেয়ার করি না। মিষ্টি তুই চল আমার সাথে, তোকে আর এক মুহুর্তও এখানে থাকতে হবে না।”
বলেই তিনি মিষ্টির হাত ধরে টান দেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨