ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ২২ লেখিকা দিশা মনি

0
45

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ২২
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টি ভূমধ্যসাগরের তীরের ঐ ক্রিসমাস বাজারেই কাজ করছিল৷ দোকানে ঘুরতে আসা সকল ব্যক্তিসহ আশেপাশে দৃশ্যমান সকল মানুষের দিকেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল৷ দোকানের মালকিন বৃদ্ধা মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“কি হলো? তুমি কি কাউকে খুঁজছ?”

মিষ্টি বলে,
“না, কাউকে খুঁজছি না৷ আচ্ছা, ক্রিসমাসের আর কয়দিন বাকি?”

বৃদ্ধা ভেবে বলেন,
“এই তো, আর মাত্র ২ দিন পরেই ক্রিসমাস।”

বৃদ্ধার কথা শুনেই মিষ্টি মনে মনে কিছু একটা হিসাব নিকাশ করে। অতঃপর মনে মনে বলে,
“তাহলে আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। চারিদিকে আরো ভালো করে নজর রাখতে হবে। যেকোন সময় যেকোন অঘটন ঘটে যেতে পারে।”

এই ভাবনা থেকেই মিষ্টি বৃদ্ধাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“আপনি একটু এখানে থাকুন। আমি একটু আসছি।”

বলেই সে বাইরে আসে। একটু দূরে সরে এসে খেলায় করে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটছে নাকি কোথাও৷ হঠাৎ করে মিষ্টি কারো একটা সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। ডান হাটুতে বেশ খানিকটা চোট পেয়ে সে আহ করে ওঠে। আর ঠিক সেই সময়েই কাছে পিঠে কোথাও একটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।

মিষ্টি সজাগ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“তাহলে যার আশংকা করছিলাম সেটা ঘটেই গেল! হে আল্লাহ, আপনি আমার সহায় হোন৷ আমাকে কিছু একটা করতে হবে।”

★★
ইয়াসিন এলিসকে ক্যাবে নিয়ে তার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনার বাসায় এসে গেছি। এখন আপনি নামতে পারেন।”

এলিস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিন্তু আমি তো তোমার ক্যাব ৩ ঘন্টার জন্য বুকড করেছিলাম। আর তিন ঘন্টা হতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি আছে।”

এলিসের কথা শুনে ইয়াসিন বিরক্ত হয়৷ কিছুটা রাগী স্বরেই বলে,
“তো এখন কি এই পাঁচ মিনিটের জন্য আপনাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে?”

“নাহ, তার দরকার নেই৷ আমি বরং এই পাঁচ মিনিট তোমার গাড়িতেই বসে থাকি৷ আরো পাঁচটা মিনিট ধরে দুচোখ ভড়ে তোমায় দেখি!”

ইয়াসিন এবার তীব্র রাগে ফেটে পড়ে নিজের আসন থেকে নেমে এলিসকে গাড়ি থেকে টেনে নামায়। ঘটনার আকস্মিকতায় এলিস হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে৷ ইয়াসিন তীব্র ক্রোধের সহিত বলে ওঠে,
“এই শুনুন, এতদিন আপনার অনেক নাটক আমি সহ্য করেছি৷ কিন্তু আর নয়। আজ আপনাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আমার আপনার প্রতি কোন আগ্রহ নেই৷ আপনি যদি ভেবে থাকেন এমন এমন কথা বলে আমার মন জয় করতে পারবেন তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আমার আপনার বা আপনার এসব কথা নিয়ে কোন ভাবান্তর নেই। আপনি এভাবে আমায় বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকুন। আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলে সেটা আপনার জন্য ভালো হবে না।”

ইয়াসিনের থেকে এহেন কথা শুনে এলিস ব্যথিত স্বরে বলে,
“এভাবে কেন বলছ ইয়াসিন? আমাকে কি তোমার সত্যিই একটুও ভালো লাগে না? কেন আমি কি দেখতে অসুন্দর? আমার মধ্যে কি ভালো লাগার মতো কোন কিছু নেই? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না?”

“না, যায়না। হতে পারে আপনি সুন্দরী। হতে পারে আপনি গুণবতী। কিন্তু আপনার আর আমার মধ্যে কোন কিছু হওয়া সম্ভব নয়। আর তাই, আমি আপনাকে আজ শেষ বারের মতো বললাম, এরপর থেকে আমার সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন।”

এলিসের চোখে জল চলে আসে৷ সে হাতের উল্টোপিঠে চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে বলে,
“বেশ, আমি এখন থেকে তোমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলব। এতেই যদি তুমি সুখী হও তাহলে তাই হবে। আমি আর তোমার ত্রীসীমানাতেও আসব না। তবে একটা কথা জেনে রেখো, নিজের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি আমি শুধু তোমাকে আর তোমাকেই ভালোবেসে যাব। আমার এই ভালোবাসা মিথ্যা নয়। একদিন তুমিও সেটা উপলব্ধি করবে দেখো।”

বলেই সে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমের দিকে দৌড় দেয়। ইয়াসিন সেখানেই দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ অতঃপর নিজের গাড়ি চালিয়ে রওনা দেয় বাড়ির দিকে।

★★
মার্সেইয়ের ক্রিসমাস বাজারে আজ বেশ হট্টগোল লেগে গেছে। যতদূর জানা গেছে, বিস্ফোরণটা বেশ লঘু মাত্রার ছিল এবং এতে তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তবে এই ঘটনাতে অনেক মানুষ আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকজন সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।

পুলিশের একটা টিম ঘটনার তদন্তে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ইমানুয়েল পলও ছিল। দূর থেকে ইমানুয়েল পলকে দেখতে পায় মিষ্টি। সাথে সাথেই নিজের মুখটা নিকাবে আবৃত করে নেয়।

মিষ্টি সরু চোখে ইমানুয়েলের দিকেই তাকিয়ে ছিল৷ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়৷ অতঃপর নিজের দোকানে ফিরে যায়। সেখানে ঐ বৃদ্ধা মহিলা মিষ্টিকে দেখে বলেন,
“তুমি ঠিক আছ তো? শুনলাম বাজারে নাকি একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে? আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। তার মধ্যে আবার তোমাকে কোথাও না দেখতে পেয়ে আমার ভয় আরো বেড়ে গেছিল। আচ্ছা, কে বা কারা এই ঘটনাটা ঘটালো?”

মিষ্টি তাকে আশ্বস্ত করে বলে,
“আমি একদম ঠিক আছি। পুলিশ এসেছে ঘটনার তদন্ত করতে। আশা করি, এসবের সাথে জড়িতরা ধরা পড়বে।”

এমন সময় কিছু পুলিশ সদস্য তাদের দোকানের সামনে আসে। তাদের মধ্যে একজন মিষ্টিকে আপাদমস্তক দেখে বলে,
“আপনি বোরকা কেন পড়েছেন? আপনার মুখটা দেখতে চাই। আপনার বোরকাটা সরান তো।”

মিষ্টি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই নিজের মুখ থেকে বোরকাটা সরিয়ে দেয়। মিষ্টিকে দেখেই তো দুজন পুলিশ সদস্য অবাক হয়ে যায়। তারা কিছু বলতে যাবে এমন সময় বাজারের মধ্যে আরো কিছু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সকলেই সজাগ হয়ে ওঠে। মানুষ এলোপাতাড়ি দৌড়াতে শুরু করে। মিষ্টি সাবধানে বৃদ্ধাকে আকড়ে ধরে বলে,
“আপনি আমার সাথে আসুন। আপনাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

বলেই সে বৃদ্ধাকে নিয়ে রওনা দেয়। এদিকে মার্সেই বাজারে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ হঠাৎই বিস্ফোরণ ঘটছিল৷ পুলিশি নিরাপত্তা সত্ত্বেও সকলের চোখ এড়িয়ে এধরণের ঘটনা ঘটছিল। কে বা কারা রয়েছে এর পেছনে সে নিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।

★★
ইমানুয়েল পল একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করেছে। এই লোকটাকে গত কয়েকদিন থেকে বাজারের চারপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে। ইমানুয়েল পল এই মুহুর্তে তাকে সরাসরি প্রশ্ন করে,
“বলুন, আপনি কি এসবের সাথে কোন ভাবে জড়িত? মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন না। নাহলে আপনার বিপদ বাড়বে।”

আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ ঐ ব্যক্তিটি মুখ খোলে না। যা ইমানুয়েল পলকে আরো রাগিয়ে দেয়। সে ঐ ব্যক্তিটিকে সজোরে একটা থাপ্পড় মে*রে বলে,
“ভালো চাইলে মুখ খোল, নাহলে তোর বিপদ বাড়বে।”

এতক্ষণে লোকটা মুখ খুলে বলে,
“বিপদ আমার নয়, বিপদ হবে তোদের। এই মার্সেই শহর, ফ্রান্স, এই গোটা পৃথিবী সব..সহ ধ্বংস হয়ে যাবে। কিচ্ছু টিকে থাকবে না। তোরা কিচ্ছু করতে পারবি না কিচ্ছু না।”

“তবে রে..তোর এত বড় সাহস..”

ইমানুয়েল পল আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে বাজারে কিছু বন্দুকধারী ব্যক্তি প্রবেশ করে। তারা এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। সবটা এতটাই তাড়াতাড়ি ঘটে যায় যে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকে প্রাণ হারায়

ইমানুয়েল পলের দিকেও কেউ একটা গুলি ছুড়ে মা*রে তবে সঠিক সময়ে মিষ্টি এসে পলকে ধাক্কা দিয়ে রক্ষা করে। অতঃপর তাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“আপনি ঠিক আছেন তো রাফসান?”

মিষ্টির মুখে নিজের আসল নাম শুনে রাফসান হতবাক হয়ে যায়। মিষ্টি রহস্যময় একটা চাহনি দিয়ে বলে,
“এখনই এতোটা অবাক হবেন না। এখনো অনেক অবাক হওয়া বাকি আছে আপনার।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here