#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ২৪
লেখিকা দিশা মনি
মিষ্টি ও রাফসান একসাথে বসে কিছু সময় কথা বলে। অতঃপর মিষ্টি বলে ওঠে,
“আমি তাহলে এখন উঠি।”
রাফসান জানতে চায়,
“কোথায় যাবে এখন তুমি?”
“আমাকে এখন এই বাজারেই অবস্থান করতে হবে। এখানে নজর রেখে দেখতে হবে যদি ওদের পরবর্তী গতিবিধি সম্পর্কে কোন তথ্য পাই।”
রাফসান কিছুটা উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,
“এখানে থাকাটা এতটা নিরাপদ নাও হতে পারে৷ এমনিতেই তোমার উপরে একবার প্রাণঘাতী হামলা হয়েছিল। যদি আবারো ওরা তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে।”
“এই মিশনে তো সব পিছুটান ভুলেই নাম লিখিয়েছিলাম আমরা, মিস্টার রাফসান। তাহলে এখন কি আর এত ভয় পেলে চলবে?”
মিষ্টির এই কথার পরে রাফসান আর কিছু বলতে পারে না। তবে তার মিষ্টির জন্য চিন্তাও দূর হচ্ছিল না। অনেক ভেবে রাফসান বলে,
“আমি এদিকে নজর রাখছি। নতুন কোন তথ্য পেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। আপাতত তুমি আমার সাথে চলো।”
“কিন্তু..”
“কোন কিন্তু নয়। এই মিশনটা সফল ভাবে শেষ করতে হলে আমাদের দুজনকেই সুস্থ থাকতে হবে। সেটা মাথায় রেখো।”
মিষ্টি আর অমত করতে পারে না। অতঃপর রাফসান মিষ্টিকে নিজের গাড়িতে করে ভূমধ্যসাগরের তীরের রাস্তা ধরে নিয়ে যেতে থাকে। মিষ্টি গাড়ির জানালা দিয়ে মার্সেই বন্দরের দৃশ্যগুলো দেখছিল। এদিকে রাফসান গাড়ি চালাতে চালাতে বারংবার আড়চোখে মিষ্টিকে দেখছিল। এই মেয়েটাকে বিয়ে করেই দেশে ফেলে চলে এসেছিল সে, বাবার বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও কখনো সেরকম কথা বা দেখা সাক্ষাৎও হয়নি। অথচ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরে মার্সেইতে সাক্ষাতের পরই এই মেয়েটার প্রতি এক আকাশ সমান মায়া অনুভব করছে রাফসান। একথা ভাবতেই রাফসান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ আসলেই কি সব পিছুটানের উর্দ্ধে যাওয়া সম্ভব মানবজাতির পক্ষে?
এরইমধ্যে মিষ্টি হঠাৎ করে বলে ওঠে,
“আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়? এরপর কি ঐ সমস্ত সন্ত্রাসীরা আরো ভয়াবহ কোন পরিকল্পনা করছে? আগের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় এখন নতুন করে তারা কি ভাবতে পারে? আরো ভয়াবহ কিছু কি ঘটাতে পারে তারা?”
“এব্যাপারে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমি যতদূর শুনলাম গোটা মার্সেই শহরজুড়ে ক্রিসমাসের সময়টা রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে এবং শহরজুড়ে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। ফ্রান্স সরকার গোটা ব্যাপারটা নিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসেছে। ব্যাপারটাকে গুরুত্ব নিয়েই দেখছে তারা। আশা করি, বড় কোন দূর্ঘটনা এড়ানো যাবে।”
মিষ্টি তবুও নিশ্চিত হতে পারে না। এদিকে রাফসান একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে বলে,
“নামো এখন।”
মিষ্টি গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে বলে,
“এটা কার বাড়ি?”
“আমার।”
“কি?”
“মানে ইন্সপেক্টর ইমানুয়েল পলের। ইমানুয়েল পল বলতে ফ্রান্সে আসলেই একজন ছিলেন। যতদূর শুনেছি তিনি বেশ সাহসী এবং দূর্ধষ পুলিশ অফিসার ছিলেন। তবে কিছু বছর আগেই হঠাৎ করে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। তিনিও এই মিশনের সাথে যুক্ত ছিলেন। আর আমাকে যখন ফ্রান্সে পাঠানো হয় তখন তার পরিচয়েই পাঠানো হয়।”
মিষ্টি রাফসানের কথা শুনে খানিক অবাক হয়। রাফসান মিষ্টিকে বলে,”আর কতক্ষণ এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে? ভেতরে চলো।”
“আচ্ছা।”
অতঃপর দুজনেই বাড়ির ভেতরে পা রাখে। মিষ্টিকে একটা সোফায় বসতে বলে রাফসান ভেতরে চলে যায়। অতঃপর নিজের পোশাক পরিবর্তন করে বাইরে এসে মাথা চুলকে বলে,
“তোমার পড়ার মতো কোন পোষাক নেই আমার কাছে..বাইরে থেকে হয়তো কিনতে হবে।”
“ব্যাপার না।”
“আচ্ছা, চলো। আমরা লাঞ্চটা করে নেই একসাথে। আসলে এখানে সবকাজ আমার নিজেকেই করতে হয়৷ রান্নাবান্নায় তো আমি ওতোটা পটু না। কোন রকমে একটু চিকেন স্টু বানিয়েছি। একটু খেয়ে দেখতে পারো, আশা করি খারাপ হবে না খেতে। আর রাজি না থাকলেও বলতে পারো, আমি বাইরে থেকে খাবার অর্ডার দেই।”
“থাক, তার কোন প্রয়োজন নেই৷ আমি আপনার বানানো খাবারই খাবো।”
মিষ্টির এই কথায় রাফসান হালকা হাসে। অতঃপর মিষ্টিকে ডাইনিং টেবিলে বসতে বলে। রাফসান নিজেই মিষ্টিকে সব খাবার পরিবেশন করে দেয়৷ অতঃপর নিজেও খেতে বসে। মিষ্টি রাফসানের চিকেন স্টুটা বেশ আয়েশ করেই খাচ্ছিল। রাফসান জিজ্ঞেস করে,
“কেমন হয়েছে চিকেন স্টু টা?”
” দারুণ। আমার তো খুব ভালো লেগেছে। আপনি বেশ ভালোই রান্না করেন।”
“পাম দিচ্ছ?”
“আরে না..সত্যি..আমি নিজেও এত ভালো রান্না করতে পারি না। এত ভালো কেন..আমি তো কিছুই পারি না বলতে গেলে।”
“আহারে! আমার কত শখ ছিল বউয়ের হাতে রান্না খাওয়ার আর আমার বউ কিনা বলছে সে তেমন ভালো রান্নাই পারে না..”
কথাটা বলেই থেমে যায় রাফসান৷ মিষ্টির মুখে খানিক অস্বস্তি লক্ষ্য করে সে। মিষ্টি হঠাত বলে ওঠে,
‘কোন ব্যাপার না। আমি খুব শীঘ্রই ভালো কিছু শেখার চেষ্টা করবো। অতঃপর আপনাকে সেই খাবারটা বানিয়ে খাওয়াবো। শুনেছি ফ্রান্সে অনেক সুন্দর সুন্দর ডিশ রয়েছে।’
“যতো যাই বলো, আমার কাছে বাঙালি খাবারই সেরা।”
“সে তো হবেই।”
এরপর দুজনেই হাসি মজা গল্পে মেতে ওঠে।
★★
ক্রিসমাসের আর মাত্র এক দিন বাকি। গোটা মার্সেই শহরজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক জোরদার করা হয়েছে৷ মিষ্টি ও রাফসান আজ বেরিয়েছে একসাথে। মার্সেইয়ের সারা রাস্তা জুড়ে নানান বর্ণিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত রয়েছে৷ এত উৎকন্ঠার মাঝেও উৎসবের আমেজে তেমন ভাটা পড়ে নি। যদিও মানুষের আনাগোনা কিছুটা কম তবে পরিস্থিতি বেশ শান্ত এবং স্বাভাবিক। মিষ্টি খেয়াল করল হালকা হালকা তুষার এসে পড়ছে তার শরীরে। রাফসান সতর্ক কন্ঠে বলে,
“মনে হচ্ছে এখন তুষারপাত হবে। চলো আমরা নিরাপদ কোন স্থানে যাই।”
মিষ্টি রাফসানের হাতটা শক্ত করে আকড়ে ধরে বলে,
“আমার খুব ইচ্ছা ছিল, তুষারপাত দেখার। একটু অপেক্ষা করবেন কি? এখানে থেকে আমি তুষারপাতের অনুভূতি নিতে চাই।”
“বেশ।”
কিছু সময়ের মধ্যেই আকাশ বেয়ে তুষার বর্ষিত হতে থাকে। তুষারপাত হতে দেখে মিষ্টি এখন বাচ্চাদের মতো খুশি হয়। রাফসান শুধু মুগ্ধ চোখে মিষ্টিকে দেখে যায়। ধীরে ধীরে তুষারপাতের পরিধি বাড়ে। মিষ্টির এবার ঠান্ডা লাগতে পারে ভেবে রাফসান বলে,
“এবার চলে এসো। বেশিক্ষণ এভাবে থাকা ঠিক নয়।”
“আর একটু থাকি না..”
রাফসান মিষ্টির হাত ধরে হেচকা একটা টান দেয়। যার ফলে মিষ্টি একদম তার বুকের উপর এসে পড়ে। মিষ্টি সেখান থেকে রাফসানের হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারছিল৷ তার নিজের হৃদস্পন্দনও যেন দ্বিগুণ হচ্ছিল। ধীরে ধীরে সে মুখ তুলে তাকায়। রাফসানও কিছুটা ঝুঁকে আসে। তাদের মধ্যে আর অল্প কিছুই দূরত্ব ছিল। দুজনেই দুজনের নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারছিল। এই তুষারপাত যেন তাদের জন্য আরো বেশি প্রেমময় পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছিল।
রাফসান এবার নিজের ঠোঁট মিষ্টির ঠোঁটের আরো কাছে নিয়ে আসে। আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে মিষ্টির ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। ঘটনায় আকস্মিকতায় মিষ্টি নিজের দুচোখ বন্ধ করে নেয়। মিষ্টি ও রাফসানের এই প্রণয় চলে তুষারপাতের তালে। দুজন যেনো একে অপরের মাঝে হারিয়ে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
[পর্বটা অনেক শান্ত ছিল তাই না পাঠকগণ? কোন ব্যাপার না, ঝড়ের আগে আবহাওয়া একটু ঠান্ডাই থাকে। আসন্ন বিরাট ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হন সবাই।]