#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ২৭
লেখিকা দিশা মনি
রাফসানকে এখনো অব্দি ভীষণ উদ্বিগ্ন লাগছে৷ এলিসের নিখোঁজ হবার পর ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। এদিকে এলিজা নিজের বোনকে খুঁজে না পেয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে মিষ্টি পড়েছে দোটানায়। মিষ্টি রাফসানকে উদ্বিগ্ন দেখে তার কাধে হাত রেখে বলে,
“আপনি কোন চিন্তা করবেন না। এই সমস্যা সমাধান করার কোন না কোন উপায় ঠিকই বের হবে। মিস এলিসকে আমরা খুঁজে পাবোই!”
“কিন্তু কিভাবে?”
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জানতে চায় রাফসান। এরইমধ্যে হঠাৎ করে থানায় হুলস্থুল বেধে যায়। সবাই একস্থানে হয়ে হট্টগোল করছিল। কি হয়েছে বুঝতে না পেরে মিষ্টি ও রাফসান সেদিকে এগিয়ে যেতেই থমকে যায়। সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা লাশ আনা হয়েছে। কিছু সময় পরেই এলিজা ছুটে এসে লাশের মুখ থেকে কাপড় ছড়ায়। অতঃপর দেখা যায় এলিসের নিথর দেহ। বেচারি মেয়েটার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা কষ্ট দিয়ে তাকে মারা হয়েছে। এলিজা নিজের বোনের লাশ দেখে হু হু করে কেঁদে ওঠে। মিষ্টি ও রাফসানও হতবাক হয়ে যায়। মিষ্টি বলে ওঠে,
“ঐ সন্ত্রাসীরা মিস এলিসকে শেষ করে দিল!”
রাফসান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
“আমরা পারলাম না মিস এলিসকে বাঁচাতে। নিজেকে ভীষণ ব্যর্থ মনে হচ্ছে।”
মিষ্টি ক্রোধের সাথে বলে,
“কি চায় এসমস্ত সন্ত্রাসীরা? কেন তারা এই পৃথিবীকে ধ্বংস করার মিশনে নেমেছে? কেন এত এত নীরিহ মানুষকে হ–ত্যা করছে? কি উদ্দ্যেশ্য তাদের? আর কারাই বা রয়েছে এসবের পেছনে? সকলের খোঁজ আমাদের বের করতেই হবে। নাহলে এভাবে আরো হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারাতে থাকবে। আমাদের নিজেদের কাজের গতি বাড়াতেই হবে মিস্টার রাফসান। এত মানুষকে আমরা কিছুতেই ম*রতে দিতে পারি না।”
রাফসানও বলে,
“ঠিক বলেছ তুমি। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধরতে হবে। এরা আরো কোন বড় ক্ষতি করার আগেই আমাদের এদের ধরতে হবে। নাহলে যে গোটা মানব সভ্যতা বিপদের মুখে পড়বে।”
মিস্টার ল্যুঁই প্যারিস থেকে কিছু সময় আগেই ফিরলেন। সেখান থেকেই সরাসরি থানায় এলেন তিনি। এসেই নিজের মেয়ের মৃতদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে মিষ্টির ভীষণ খারাপ লাগল। মিষ্টি বলল,
“নাহ, এভাবে আর কোন বাবার বুক খালি হতে দেয়া যাবে না। আমাকে এবার কোন স্টেপ নিতেই হবে।”
★★
এলিসের দেহের পোসমর্টেমের পর মার্সেই শহরের একটি খ্রিষ্টান কবরস্থানে এলিসকে দাফন করা হয়। এলিসের শেষকৃত্য সেখানেই সম্পন্ন হয়। ফাতিমা বিবি, আমিনা সবাই এসেছিল সেখানে। কিন্তু ইয়াসিন আসেনি। মিষ্টি ব্যাপারটা লক্ষ করেছে৷ তার মনে ব্যাপারটা নিয়ে কেমন খটকা লাগছিল। কারণ সে যতদূর বুঝেছে এলিস মেয়েটা ভীষণ ভালোবাসত ইয়াসিনকে। ইয়াসিনের মনে হয়তো সেরকম অনুভূতি ছিল না। কিন্তু তাই বলে মেয়েটা মরে যাবার পরেও একবার দেখতে এলো না। মিষ্টি এব্যাপারে জানতে ফাতিমা বিবির কাছে যান। ফাতিমা বিবি এলিসের জন্য দুফোটা অশ্রু বিসর্জন করেন। এলিস গিয়ে ফাতিমা বিবিকে জিজ্ঞেস করে,
“আন্টি, আপনার ছেলে কোথায়?”
ফাতিমা বিবি মিষ্টিকে দেখে অবাক হন। বলেন,
“মিষ্টি মা, তুমি এখানে? তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?”
“সেসব অনেক কথা। আপনাকে পড়ে নাহয় বলব। কিন্তু এখানে আপনারা সবাই এসেছেন অথচ মিস্টার ইয়াসিন আসেনি। ব্যাপারটা কেমন জানি খটকা লাগছে আমার।”
ফাতিমা বিবি কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আমিনা তার সামনে এসে বলে,
“ভাইয়া কিছু জরুরি কাজে মার্সেই শহরের বাইরে আছে। তাই আসতে পারে নি।”
এ কথা শুনে মিষ্টি আর তেমন একটা মাথা ঘামায় না। কিন্তু রাফসান কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে সন্দেহের দৃষ্টিতে আমিনার দিকে তাকায়। আমিনা নজর যায় রাফসানের দিকে। তাকে নিজের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমিনা ভয়ে ঘামতে শুরু করে।
এলিসের শেষকৃত্যের কার্যক্রম মিটে যেতেই মিষ্টি ও রাফসান সেখান থেকে একসাথে রওনা দেয়। অতঃপর মিষ্টিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে রাফসান বলে,
“আমাকে এখন কিছু জরুরি কাজে বাইরে যেতে হবে। তুমি সাবধানে থেকো।”
“আচ্ছা,আপনিও সাবধানে যাবেন।”
“হুম।”
বলেই রাফসান রওনা দেয়। তার মনে হচ্ছে সে সত্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এবার তাকে সমস্ত সত্যটা জানতেই হবে।
রাফসান খুব দ্রুত বেগে গাড়ি চালাতে থাকে। অতঃপর ভীষণই সংরক্ষিত একটি গোপন স্থানে গিয়ে বলে,
“এসে গেছি। কিন্তু ও কি এখনো এসেছে?”
একটু পরেই একটা নারীর আগমন ঘটে। তার আগমন টের পেয়েই রাফসান বলে ওঠে,
“আপনি তাহলে এসেছেন!”
“জ্বি।”
“তো মিস ডিটেকটিভ নাকি আমিনা? কি নামে ডাকব আপনাকে?”
আমিনা মাথা নত করে বলে,
“যেটা ভালো মনে করেন।”
“দেখুন, আপনি আমাদের মিশনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন সহকর্মী। আপনার অতীত গোয়েন্দা রিপোর্টের অনেক ভালো ফাইলস দেখেই আপনাকে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনের অংশ করা হয়েছিল৷ এই মিশনে যুক্ত হওয়ার সময় আমরা সবাই সব পিছুটান ত্যাগ করি। নিজের অতীতের সব সম্পর্কের থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোটাকেই নিজেদের মুখ্য উদ্দ্যেশ্য ভাবি। আমি আশা রাখি, আপনিও এই একই চিন্তাভাবনা করেন। শুরুর দিকে আপনার ইন্টেলিজেন্স আমায় এতোটা মুগ্ধ করেছিল বলেই আমি আপনাকে নিজের বিশ্বস্ত গোয়েন্দা বানিয়েছিলাম। একারণেই মিষ্টি এই দেশে আসার পর আমি আপনাকে দায়িত্ব দেই ওকে দেখে রাখার। আর আপনিও নিজের ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে মিষ্টিকে আশ্রয় দিয়ে ওকে সব সময় নজরে রাখেন। এজন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু…আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই পর্যায়ে এসে আপনি কোন কারণে আমার সাথে, এই মিশনের সাথে বেঈমানি করছেন। আমার এই ধারণাটা কি সঠিক মিস আমিনা? আপনি কি কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের থেকে লুকিয়ে রেখেছেন?”
“..”
“চুপ করে থাকবেন না মিস আমিনা। আপনার এই চুপ থাকার জন্য ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ঐ সন্ত্রাসী চার্চে হামলা করে নিরপরাধ ১৬ জন মানুষকে মেরে ফেলেছে। যার মধ্যে ৩ বছর বয়সী একটা বাচ্চাও আছে। এবার অন্তত কিছু বলুন। নাহলে এভাবে আরো অনেক নিরপরাধ মানুষ খু**ন হবে। তাই আমি আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি, এবার অন্তত কিছু বলুন।”
★★
মিষ্টি চুপচাপ সোফায় বসে ছিল। তার মনে অনেক ভাবনাই খেলা করছিল। হঠাৎ করে বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠতেই মিষ্টি উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়৷ অতঃপর ইয়াসিনকে দেখে অবাক হয়ে বলে,
“আপনি!”
“আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে মিসেস মিষ্টি। আমার সাথে আসবেন একটু?”
“কি কথা?”
“সেসব এখানে বলা যাবে না। আপনি দয়া করে আমার সাথে আসুন।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি আসছি।”
বলেই মিষ্টি নিজের ফোন ও কিছু জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়। রাফসান নিজের ক্যাবে করে মিষ্টিকে কোথাও নিয়ে যেতে থাকে।
এদিকে,
রাফসান আমিনাকে চুপ থাকতে দেখে ভীষণ রেগে যাচ্ছে। এমন সময় তার ফোন বেজে ওঠে। রাফসান ফোনটা রিসিভ করতেই মিষ্টি বলে ওঠে,
“হ্যালো, আপনি শুনছেন? আমি মিস্টার ইয়াসিনের সাথে একটু বের হয়েছি। অনেকক্ষণ থেকে আপনাকে ফোন করছি কিন্তু আপনি কলটা রিসিভ করছেন না..”
এটুকু বলার পরই কলটা কেটে যায়। ফোন লাউড স্পিকারে থাকায় আমিনা সবটা শোনে। সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠে,
“স্যার, আপনি মিষ্টি আপুকে আটকান। ও যেন ভাইয়ার সাথে না যায়।”
“মানে?”
“ভাইয়া ঐ সন্ত্রাসী সংগঠনের একজন সদস্য যারা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে চায়।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨