ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ২৮ লেখিকা দিশা মনি

0
28

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ২৮
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টির জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে অন্ধকার একটা কুঠুরিতে। চোখ মেলে তাকিয়েই সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। হঠাৎ করেই কারো পায়ের শব্দে মিষ্টি অবাক হয়ে যায়। কোনরকমে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াতেই খোলা দরজা থেকে আগত আবছা আবছা আলোয় ইয়াসিনের অববয় স্পষ্ট দেখতে পায় মিষ্টি। ইয়াসিনকে দেখেই খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিষ্টি বলে,
“আপনি তাহলে এখানেই আছেন। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। আপনাকে দেখে একটু সাহস সঞ্চার হলো মনে। কিন্তু এ আপনি আমায় কোথায় নিয়ে এসেছেন?”

ইয়াসিন বলল,
“আপনার নিরাপত্তার জন্যই আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি মিসেস মিষ্টি। একজন বন্ধু হিসেবে আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন। আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো না।”

“আপনার উপর আমার অগাধ বিশ্বাস আসে। আপনি যেভাবে আমায় অতীতে সাহায্য করেছিলেন তা আমি কখনো ভুলব না। কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আমার এমন কি বিপদ হতে পারে যে আপনি আমায় এখানে নিয়ে এলেন! আর রাফসানকেও তো কিছু জানালো হলো না৷ উনি তো চিন্তা করবেন আমার জন্য।”

এপর্যায়ে ইয়াসিন বলে,
“মিস্টার রাফসান শিকদারের আদেশেই আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আসলে, এখানকার সন্ত্রাসীরা আপনাদের উপর টার্গেট করছে। তাই আপনাকে বাঁচাতেই এই উদ্যেগ নেয়া হয়েছে!”

“ওহ আচ্ছা। আমাকে এভাবে কতদিন লুকিয়ে থাকতে হবে?”

“যতদিন না আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।”

মিষ্টি অকপটে ইয়াসিনের বলা কথাগুলো বিশ্বাস করে নেয়। কারণ তার চোখে ইয়াসিন একজন বিশ্বস্ত বন্ধু। ইয়াসিন মিষ্টির দিকে একটা টিফিন বক্স বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“এই নিন,এখানে কিছু খাবার আছে। এগুলো খেয়ে নিন।”

“আপনি খেয়েছেন?”

“হুম।”

বলেই ইয়াসিন বেরিয়ে যায়। ইয়াসিন বাইরে আসতেই তার টিমের একজন সদস্য ক্রিস্টোফার বলে ওঠে,
“এই মেয়েটাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছ? একেও মেরে ফেলো। এর বেঁচে থাকা আমাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।”

ইয়াসিন ক্রিস্টোফারকে চোখ রাঙানি দিয়ে বলে,
“চুপ! একদম চুপ। ওর কোন ক্ষতি করার কথাও ভাববি না।”

ক্রিস্টোফার রেগে বলে,
“গতকাল তো ঠিকই একটা মেয়েকে এখানে নিয়ে এসে নির্মমভাবে মেরে ফেললে, তাহলে আজ হঠাৎ এই মেয়েটাকে এত দয়া দেখাচ্ছ কেন? মেয়েটা নিশ্চয়ই তোমার দয়ার পাত্র না। আর এমনিতেও আমরা যেখানে গোটা পৃথিবীকে ধ্বংস করার মিশনে নেমেছি সেখানে একটা মেয়ের প্রতি এত দরদ তোমার আসছে কোথা থেকে? এমনিতেও যখন এই পৃথিবী ধ্বংস হবে তখন সবাইকেই মরতে হবে৷ এটাই তো আমাদের উদ্দ্যেশ্য। এই পৃথিবী একটা নোংরা যায়গা। এই পৃথিবীর টিকে থাকার কোন প্রয়োজন নেই৷ এই পৃথিবী শুধুই আমাদের কষ্ট দিয়েছে। তাই আমরা চাই না যে, আরো কোন মানুষ এই পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকুক। আর কেউ এত কষ্ট পাক। মরে যাওয়া মানেই সব সমস্যার সমাধান হওয়া৷ তাই এই পৃথিবীর সব মানুষের মরে যাওয়া উচিৎ। তাহলেই আর কোন সমস্যা থাকবে না কারো। ঐ মেয়েটাকেও মেরে ফেলো। মুক্তি দাও ওকে এই নোংরা পৃথিবী থেকে।”

ইয়াসিন এপর্যায়ে ক্রিস্টোফারকে ধমক দিয়ে বলে,
“এই মুহুর্তে আমার সামনে থেকে দূর হও। তোমার পরামর্শ মেনে চলতে বাধ্য নই আমি। গেট লস্ট।”

ক্রিস্টোফার ইয়াসিনের মুখে এমন ধমক শুনে রেগেমেগে চলে যেতে পা বাড়ায়। ইয়াসিন ক্রিস্টোফারের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“যদি ওকে আমার মারারই হতো তাহলে সেদিনই মারতাম যেদিন মার্সেই শহরে ওকে প্রথম দেখি। সেদিন তো ওকে মারার উদ্দ্যেশ্যেই আমি মেট্রোরেল স্টেশনের দিকে গিয়েছিলাম। কিন্তু জানি না কেন..সেদিন ওকে দেখার পর আর ওকে মারতে পারিনি। এই নোংরা পৃথিবী থেকে মুক্তি দিতে পারি নি ওকে। কেন জানি আমার মন আমায় বলেছিল, এই মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। আমি আজও চাই, এই মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পৃথিবীর সব বিপদ থেকে। কিন্তু কেন? কেন আমার মধ্যে এই পরিবর্তন হলো?”

নিজের মনে চলা এই প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায় না ইয়াসিন। সে শুধু এটাই জানে যে, সে গোটা পৃথিবীর সবাইকে এমনকি নিজের পরিবারের সবাইকে শেষ করতে এক বার না ভাবলেও মিষ্টির গায়ে একটা আঁচড় কাটতেও তার হাত কাপবে।

★★★
রাফসান উদ্ভ্রান্তের মতো চারিদিকে মিষ্টিকে খুঁজে বেরাচ্ছে। দীর্ঘ ১২ ঘন্টা যাবত মিষ্টির কোন খোঁজ নেই। আমিনার কাছ থেকে ইয়াসিনের সত্যতা জেনে এবং মিষ্টিকে ইয়াসিন কোথাও একটা নিয়ে গেছে এটা জানার পর থেকে রাফসাম দুদণ্ডও শান্তিতে থাকতে পারছে না। রাফসান চারিদিকে অসহায়ের মতো খুঁজে চলেছিল মিষ্টিকে। কিন্তু তার কোন খোঁজ এখনো অব্দি নেই।

আমিনা রাফসানের সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে। তার চোখে জল স্পষ্ট। সে কাতর স্বরে বলে,
“নিজের ভাইকে বাঁচাতে আমি আপনাদের সাথে বেঈমানী করেছি। তার সত্যটা লুকিয়ে রাখার জন্যই আজ এতো গুলো নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এমনকি মিষ্টি আপুর জীবনও আজ সংকটে।”

রাফসান রাগী কন্ঠে বলে,
“তুমি সত্যটা লুকিয়ে যা অপরাধ করেছ তার শাস্তি তুমি অবশ্যই পাবে। তবে সবার আগে আমাদের মিষ্টিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে হবে। সেজন্য আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।”

“মিষ্টি আপুকে উদ্ধার করার জন্য যা করার আমি তাই করবো। আমি আপনার সঙ্গে আছি।”

“একবার শুধু আমি মিষ্টিক উদ্ধার করি তারপর ঐ ইয়াসিনকে ওর কাজের জন্য উপযুক্ত শাস্তি দেব।”

★★
মিষ্টি দীর্ঘ ২৪ ঘন্টা ধরে এভাবে থাকতে থাকতে ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠল। সে তো এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কি কারণে এভাবে তাকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। তার উপর ইয়াসিনের ব্যবহারও এখন জানি তার কিরকম ঠেকছে। সবথেকে বড় কথা, মিষ্টি এখানে এসেছে থেকে ইয়াসিন ছাড়া আর কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি। অথচ রাফসানের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তার ভেতরটা ছটফট করে চলেছে। মিষ্টি এসব ভাবনা থেকেই বলে,
“রাতে ইয়াসিন এলে ওনাকে বলতে হবে যে আমি রাফসানের সাথে কথা বলব। এভাবে থাকতে একদমই ভালো লাগছে না।”

★★
“কি ইনফরমেশন পেয়েছ?”

গম্ভীর কন্ঠে কথাটি জানতে চায় রাফসান। তার সামনে দাঁড়ানো একজন গোয়েন্দা বলেন,
“আমি এই সন্ত্রাসী সংগঠনের একজন সদস্যের আসল পরিচয় জানতে পেরেছি। তার নাম ক্রিস্টোফার। সে মার্সেই শহরেরই বাসিন্দা। এখানকার একটি চার্চে কাজ করে। ছেলেটা অনাথ, একটি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। একদম সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থাকে। তাকে দেখে কেউ বুঝবেই না সে এতো বড় একজন অপরাধী।”

“বুঝলাম। এখন কোথায় গেলে তার সন্ধান পাবো?”

“আমাদের টিম তাকে ধরতে ইতিমধ্যেই চার্চের দিকে রওনা দিয়েছে। হোপফুলি, খুব শীঘ্রই আমরা তাকে পেয়ে যাব।”

রাফসান উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“গাড়ি বের করো। আমিও যাব সেখানে।”

“ওকে।”

রাফসান গাড়িতে করে চার্চের দিকে রওনা দেয়। চার্চে পৌঁছেই দেখে একটা ছেলে একজন পুলিশ সদস্যকে গানপয়েন্ট করে পালানোর চেষ্টা করছে। রাফসান সুকৌশলে নিজের বন্দুক দিয়ে গুলি করে ছেলেটির হাতে। যাতে করে ছেলেটির হাত থেকে বন্দুক পড়ে যায়। এই সুযোগে অন্যান্য পুলিশ অফিসাররা ছেলেটিকে গ্রেফতার করে নেয়। রাফসান এগিয়ে এসে বলে,
“তোমার খেলা শেষ ক্রিস্টোফার। এবার ভালোয় ভালোয় সব সত্য স্বীকার করো। নাহলে…”

ক্রিস্টোফার তবুও তেজ দেখিয়ে বলে,
“আমায় ধরে কোন লাভ নেই। আমি কোন কথা স্বীকার করবো না। এই ফা**ক দিস ওয়াল্ড৷ এই পৃথিবী ধ্বংস হোক। সব মানুষ মারা যাক। কেউ না বাচুক।”

বলেই সে একটা পুলিশ সদস্যের হাত থেক বন্দুক কেড়ে নিয়ে নিজেই নিজের কপালে গু**লি করে নিজেকে শেষ করে দেয়। রাফসান হতবাক হয়ে সমস্ত দৃশ্য দেখে। ক্রিস্টোফারের সন্ধান পেয়ে মিষ্টিকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষীণ আশা জন্মেছিল রাফসানের মনে। অথচ সেই আশাটাও যেন ক্রিস্টোফারের মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হয়ে গেল।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here