ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ২৯ লেখিকা দিশা মনি

0
44

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ২৯
লেখিকা দিশা মনি
মিষ্টি অন্ধকার কক্ষে বসে ঝিমোচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে রুমে আলো জ্ব্বলে ওঠে। মিষ্টি সামনে তাকাতেই দেখতে পায় ইয়াসিন তার সামনে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাকে দেখেই মিষ্টি মৃদু হেসে বলে,
“আপনি এসেছেন! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

ইয়াসিন উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
“নিশ্চয়ই আপনার খুব খিদে পেয়েছে, তাই না? এই খাবার টুকু খেয়ে নিন।”

বলেই মিষ্টির দিকে একটা খাবারের থালা এগিয়ে দেয়। মিষ্টির সত্যিই খুব ক্ষিধে পেয়েছিল। তাই সে খেতে শুরু করে দেয় এবং বলে,
“আপনার সাথে খুব জরুরি কথা আছে। আসলে আমি রাফসানের সাথে কথা বলতে চাই। আপনি একটু ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?”

“কেন? আমার উপর বিশ্বাস হচ্ছে না, বুঝি?”

“না, না বিষয়টা মোটেই সেরকম নয়। আসলে…”

“আপনি আগে খাবারটা খেয়ে নিন৷ তারপর বাকি সব হবে।”

মিষ্টি আর কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করে। আচমকা ইয়াসিন বলে ওঠে,
“আচ্ছা, মিষ্টি আপনি কি আমার জীবনের গল্প শুনতে ইচ্ছুক?”

“আপনার জীবনের গল্প?”

“হুম। আমার অতীত সম্পর্কে। শুনবেন?”

ইয়াসিনের কন্ঠে ছিল কাতরতা। মিষ্টি আর বেশি কিছু না ভেবে বলে,
“আচ্ছা, বেশ। বলুন আমি শুনছি।”

ইয়াসিন এবার তার অতীতের কথা বলতে শুরু করে,
“আমার জন্ম হয়েছিল আফ্রিকার দেশ মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কা শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত একটা পরিবারে। আমার বাবা ছিলেন একজন সাধারণ দিনমজুর। তবে আমাদের জীবনে স্বচ্ছলতার অভাব থাকলেও ভালোবাসার কোন অভাব ছিল না। আমার বয়স যখন ৫ বছর তখন আমার বোন, আমার আমিনা পৃথিবীতে আসে। আমার আনন্দ যেন তখন আরো বেড়ে যায়। তবে..এই সুখ বেশিদিনের জন্য ছিল না। খুব শীঘ্রই এই নোংরা, জঘন্য পৃথিবী তার জঘন্য খেলা শুরু করে আমার সাথে। আমার বয়স তখন ১২ কি ১৩ হঠাৎ করে একদিন আমাদের বাড়িতে কিছু লোক এসে হামলা চালায়। আমার বাবা তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল কিন্তু সময়মতো সেই টাকা ফেরত দিতে পারে নি। এজন্য তারা এসে অনেক চিল্লাপাল্লা করে। আমি আমার ৭ বছর বয়সী বোনটাকে সাথে নিয়ে চুপচাপ সব দেখে যাই। ততদিনে আমার বাবার অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়। মাদকের কবলে পড়ে তিনি নিজের নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেন৷ আর এরপরই আমাদের জীবনে সবথেকে কালো রাতটা চলে আসে। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে আমার বাবা তার কয়েকজন বন্ধুর কাছে আমার..আমার মা বোনকে এক রাতের জন্য বিক্রি করে দেয়..”

কথা বলতে বলতে ইয়াসিনের গলা ধরে আসছিল। এদিকে মিষ্টি এসব শুনে হতবাক হয়ে যায়। ইয়াসিন আবারো বলা শুরু করে,
“সেই রাতটা আমি কখনো ভুলব না। আমার চোখের সামনে ওরা আমার মা-বোনকে একের পর এক..”

“কি বলছেন এসব আপনি? ফাতিমা আন্টি…আর আমিনা তো তখন অনেক ছোট ছিল।”

“এই নোংরা পৃথিবীর নোংরামোর শিকার বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ সবাই হতে পারে মিষ্টি। জানেন, সেদিনের ঘটনা নিজ চোখে দেখার পর আমার এই পৃথিবীর প্রতি চরম ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে। আর তার পরের দিনই আমি একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলি। নিজের বাবার প্রতি আমার ঘৃণা এতোটাই বেড়ে গেছিল যে আমি নিজের হাতে তাকে….আমি একটা রড হাতে নিয়ে সেটা দিয়ে তার মাথায় কমপক্ষে ২০-২৫ বার আঘাত করি। কি আর করবো বলুন? আমার বাবা যে আর আগের মতো ছিল না। নেশার বশে আর টাকার লোভে এক জানোয়ারে পরিণত হয়েছিল। এই নোংরা পৃথিবী যে কাউকে ভালো থাকতে দেয় না, কাউকে না। এই ঘটনার পরই আমার মা খুব ভয় পেয়ে যায়। তিনি সেদিনই আমাকে আর বোনকে নিয়ে পালিয়ে কাসাব্লাঙ্কা সমুদ্র বন্দরে চলে যান। সেখানে একটা কন্টেইনার ভর্তি জাহাজ ফ্রান্সে আসার জন্য রওনা দিচ্ছিল। মা তখন নিজের কাছে থাকা কিছু গহনা তুলে দেয় জাহাজের কিছু কর্মীর হাতে। তার বিনিময়ে তারা অবৈধভাবে আমাদের এই মার্সেই শহরে নিয়ে আসে। তারপর এখানে আমাদের এক নতুন জীবন শুরু হয়।”

এতক্ষণ ধরে এসব শুনে মিষ্টির গলা দিয়ে আর খাবার নামছে না। ইয়াসিনের চোখের দিকে তাকিয়ে সে তার দুঃখগুলো বোঝার চেষ্টা করছে। ইয়াসিনের চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রুবর্ষণ হচ্ছে। মিষ্টি কাপা কাপা হাতে ইয়াসিনের কাধে হাত রেখে বলে,
“এখানে আসার পর তো সব ঠিক হয়ে যায়, তাই না?”

ইয়াসিন একটা উপহাসের হাসি দিয়ে বলে,
“এই নোংরা, জঘন্য পৃথিবী কি এতটা মহান যে সব কিছু ঠিক করে দেবে? মার্সেই শহরে এসে কিচ্ছু ঠিক হয়নি মিষ্টি। বরং আমাদের জীবন যেন এক নতুন জাহান্নামে প্রবেশ করে। এখানে আসার কিছুদিন পরই আমাদের এখানকার পুলিশ ধরে ফেলে। তারা আমাকে এবং আমার মা-বোনকে অভিবাসী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আরো এক দূর্বিষহ জীবন কাটাই আমরা। সেই অভিবাসী ক্যাম্প যেন ছিল একখন্ড নরক
আমাদের সেখানে মাত্র একবেলা খাবার দেয়া হতো। তাও বাসি খাবার। ফ্রান্সের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে যেসব খাবার বেচে যেত বা মানুষ এটো করে রাখত তাই দেয়া হতো আমাদের। বিনিময়ে করিয়ে নেয়া হতো অমানবিক পরিশ্রম। জানো, নিজের চোখে আমি কয়েকজন ঐ ক্যাম্পে আত্ম** করতে দেখেছি এইসব সহ্য করতে না পেরে। শুধু তাই নয়, এই ক্যাম্পের কিছু কর্মী ছিল ভয়ংকর নারীলোভী। প্রতিদিন রাতেই তারা বহু নারীকে ক্যাম্পের পেছনে নিয়ে গিয়ে..”

মিষ্টি আর শুনতে পারছিল না। মানুষের জীবন যে এতো কঠিন হতে পারে সেটা ভেবেও তার কেমন জানি লাগছে৷ অথচ সে জীবনে এর সিকি ভাগ কষ্টও ভোগ করে নি। ইয়াসিন আরো বলে ওঠে,
“ঐ ক্যাম্পে আমাদেরকে আরো ২ বছর থাকতে হয়। ততদিনে পৃথিবীর প্রতি আমার ঘৃণা আরো বেড়ে যায়। আমি বুঝতে পারি, এই পৃথিবীতে মানুষ রূপী এক একটা শয়তান কিভাবে ঘুরে বেড়ায়। তখন থেকে আমার শুধু মনে হতে লাগে, যদি সুযোগ পেতাম তাহলে আমি এই নোংরা পৃথিবীকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতাম।”

মিষ্টি বলে,
“আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি মিস্টার ইয়াসিন। আপনার উপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে। কিন্তু কি করবেন বলুন? জীবন কারো কারো জন্য ভীষণ নির্মম হয়৷ এক্ষেত্রে আমাদের কারোর কিছু করার নেই। কিন্তু এই পৃথিবীর সব মানুষ খারাপ না। এত খারাপের মাঝেও অনেক ভালো কিছুও আছে এই পৃথিবীতে।”

ইয়াসিন হঠাৎ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। মিষ্টি অবাক হয়। ইয়াসিন হাসি থামিয়ে বলে,
“কোন ভালো কিছু নেই এই পৃথিবীতে। জানেন, ঐ শরণার্থী শিবির থেকে বের হবার পর আমাদের সাথে কি হয়েছিল? আমার মা আর কোন কাজ না পেয়ে প**তিতালয়ে নাম লিখিয়েছিল। আর সেই পতিত**লয়ের মালিক কে জানেন? মিস্টার ল্যুঁই, এলিসের বাবা! যাকে সবাই মহান লোক মনে করেন।অথচ ঐ মহান লোকটাই আমার মাকে এই নোংরা কাজে নামিয়েছিল!”

“কি বলছেন কি আপনি এসব?”

“হ্যাঁ, ঠিকই বলছি আমি। তারপরেও দেখবেন, আমার মা ঐ লোকটার প্রতি কত কৃতজ্ঞ। কারণ উনি আমার মাকে একটা কর্মের সংস্থান করে দিয়েছেন যাতে উনি আমাকে আর বোনকে লালন পালন করতে পারেন।”

“কিন্তু আপনার মা তো একটা গ্রোসারি শপে কাজ করে।”

“ওটা তো দিনের বেলা। কিন্তু রাতের বেলা আমার মা…”

থেমে যায় ইয়াসিন। তার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হয়না। এদিকে মিষ্টি তখনো হতবিহ্বল হয়ে গেছিল একদম। এত নির্মম সত্য জানার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ইয়াসিন হঠাৎ করে মিষ্টিকে প্রশ্ন করে বসে,
“এখন আপনি বলুন, আমার যায়গায় থাকলে কি আপনার এই পৃথিবীর প্রতি ঘৃণা জন্মাতো না?”

মিষ্টি বলে,”হয়তো জন্মাতো..”

“আমি নিশ্চিত বলতে পারি, আমার যায়গায় থাকলে আপনিও এই পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চাইতেন। যেমনটা আমি চাই।”

মিষ্টি এবার পুরোদস্তুর অবাক হয়ে যায়। সে বলে ওঠে,
“তার মানে..”

“হ্যাঁ, আমি সেই কুখ্যাত সন্ত্রাসী দলের অন্যতম এক সদস্য যে এই পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চাই।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
(ইয়াসিনের অতীত জেনে কেমন লাগছে? তার যায়গায় থাকলে আপনিও কি এটাই চাইতেন? 🙂)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here