ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ৯ #লেখিকা দিশা মনি

0
9

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ৯
#লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টি গায়ে একটি শীতের পোশাক জড়িয়ে রেখেছে। হাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র। মোর্শেদ চৌধুরী মিষ্টিকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন,
“তুমি যেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছ তাতে আমার পুরোপুরি সমর্থন আছে। আশা করি, তুমি এবার তোমার স্বামীকে নিয়েই ফিরবে।”

সুইটি চৌধুরী একটু দূরেই নাখোশ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মিষ্টি তার কাছে এসে বলে,
“আমাকে দোয়া করবে না মম?”

সুইটি চৌধুরী আর রাগ করে থাকতে পারেন না। মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
“আমার মন যে কোন ভাবেই মানছে না মিষ্টি। তুমি একা এরকম একটা অচেনা দেশে গিয়ে কিভাবে কি করবে? কাউকে একটা সঙ্গে নিয়ে গেলেও তো পারো।”

মিষ্টি বলে,
“আমি একাই যাব মম। আমি একাই ওনাকে খুঁজে বের করতে পারব। তুমি কোন চিন্তা করো না।”

সুইটি চৌধুরী কি বলবেন কিছু বুঝতে পারেন না। তার মন মানছিল না। তাই তিনি বলেন,
“আমিও যাই তোমার সাথে? তোমার বাবাকে বলি আমার পাসপোর্ট, ভিসার ব্যবস্থাও করে দিতে।”

” তুমি গেলে এখানে বাবার দেখাশোনা কে করবে মম? বাবার শরীরটা তো এখন বেশি ভালো যাচ্ছে না।”

“সেটাও ঠিক। কিন্তু ও বাড়ির কাউকে তো নিজের সাথে নিয়ে যেতে পারো।”

“আমি বললাম তো,আমি একাই পারব৷ তোমরা আমার উপর ভরসা রাখতে পারো।”

এরইমধ্যে রফিক শিকদার, রোকসানা শিকদার, ফারিয়া, রাহুল সবাই সেখানে উপস্থিত হয়। রফিক শিকদার মিষ্টির কাছে এসে বলেন,
“তোমার পাসপোর্ট, ভিসা প্লেনের টিকিট সব ভালো করে চেইক করে নিয়েছ তো? এসব ভালো করে চেইক করো। হারালে কিন্তু চলবে না।”

“জ্বি, আমি চেক করে নিয়েছি।”

রোকসানা শিকদার মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“তুমি আমায় নতুন আশা দেখিয়েছ মা, আমার ছেলেটা আবার আমার বুকে ফিরবে৷ আমি এই স্বপ্নই দেখি।”

“ইনশাআল্লাহ।”

ফারিয়া এসব কথা শুনে বিড়বিড় করে বলে,
“ঢং যত! মৃত মানুষকে নাকি জ্যান্ত অবস্থায় নিয়ে আসবে। আসল উদ্দ্যেশ্য তো বিদেশ ভ্রমণ করা বুঝি না আমি!”

রাহুল ফারিয়ার কথাটা শুনে রাগী হয়ে বলে,
“তুমি চুপ করো। এমনিতে তোমার জন্য আমার মিষ্টির সাথে যাওয়া হলো না। আমি তো চেয়েছিলাম ওর সাথে গিয়ে আমার ভাইটাকে খুঁজতে কিন্তু তুমি বাগড়া দিয়ে দিলে।”

“বেশ করেছি বাগড়া দিয়েছি। যেখানে তোমার ভাইয়ের অফিস থেকে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে সেখানে তুমি শুধু শুধু ওখানে গিয়ে কি করবে? ঐ মেয়েও দেখবে যাওয়ার কিছু দিন পর আবার ফেরত চলে আসবে। ওকে ওর মতো যেতে দাও। এমনিতে ওই তো জেদ দেখিয়ে বলেছে ও একাই যাবে। তাহলে ওকে ওর মতো যেতে দাও। তাহলেই তো ন্যাকা চুকে যায়।”

রাহুল আর কিছু বলে না৷ মিষ্টি সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে পা বাড়ায়। ঢাকা থেকে সে রওনা দেবে প্যারিস বিমানবন্দরের উদ্দ্যেশ্যে। সেখানে পৌঁছে অতঃপর প্যারিস থেকে মার্সেইতে যাবে।

মিষ্টি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন সেন্টারে প্রবেশের আগে শেষবারের মতো এক বার সবার মুখ দেখে নেয়। অতঃপর একটা প্রশান্তিময় হাসি দিয়ে ভেতরে যায়। তার চোখে এখন একটা অদম্য সাহস দেখা যাচ্ছে। এই সাহস দিয়েই যেন এক অপরিচিত শহরে গিয়ে নিজের স্বামীকে খুঁজে বের করে আনার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে।

★★★
দীর্ঘ ১২ ঘন্টার উড়ানের পর প্লেন ল্যান্ড করল প্যারিস বিমানবন্দরে। মিষ্টি বিমান থেকে অবতরণ করেই অবাক চোখে চারিদিকে তাকাচ্ছিল। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানুষের আগমন ঘটেছে বিমানবন্দরে। এত সব মানুষের মাঝে সে একদম অপরিচিত এবং ভীত হয়ে উঠেছে। মিষ্টি মনে একটু সাহস সঞ্চার করে বলল,
“নাহ, আমায় এভাবে ভীত হয়ে থাকলে চলবে না। যে কাজের জন্য ফ্রান্সে এসেছি সেই কাজ আমায় সম্পন্ন করতেই হবে। আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে মিস্টার রাফসান শিকদারকে। ওনাকে আবার ওনার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও ওনার থেকে যে আমার অনেক প্রশ্নের উত্তরও জানা বাকি।”

প্যারিসে এসে মিষ্টি প্রথমেই আগে থেকে বুক করে রাখা একটি হোস্টেলে ওঠে। সেখানেই সে আজকের রাতটা অতিবাহিত করবে। অতঃপর কাল সকালে মেট্রোতে করে মার্সেই শহরের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়বে। মিষ্টি প্যারিসের যেই হোস্টেলটায় অবস্থায় করছিল সেখান থেকে আইফেল টাওয়ার দেখা যায়। মিষ্টি জানালায় দাঁড়িয়ে আইফেল টাওয়ার দেখছিল। রাত্রিতে নানান আলোয় জ্বলজ্বল করে আইফেল টাওয়ার যা দেখে এত চিন্তার মাঝেও তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

এরইমধ্যে মিষ্টি বাসায় একটা কল করে। বিপরীর দিক থেকে ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে সুইটি চৌধুরী বলে ওঠেন,”কে”

“আমি, মিষ্টি মম।”
“তুমি ঠিকঠাক মতো পৌঁছে গেছ তো?”

“হ্যাঁ, মা। আমি এখন প্যারিসের একটি হোস্টেলে আছি। কাল সকালে মেট্রোতে করে মার্সেইয়ের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেব।”

“ওহ। আচ্ছা, সাবধানে যেও। আর ব্যাগপত্র সব সামলে রেখো।”

“ঠিক আছে।”

“আর একটা কথা,বেশিদিন ওখানে থাকার দরকার নেই। চার-পাঁচদিন একটু খোঁজ খবর নাও তারপর কিছু জানতে না পারলে আবারো ফিরে আসিও। নাহলে ঝামেলা হতে পারে। এভাবে অচেনা অজানা দেশে একা একটা মেয়ে হিসেবে সারভাইভ করা অনেক কঠিন।”

“তুমি চিন্তা করো না। আমি চেষ্টা করব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে ওনাকে খুঁজে বের করার।”

অতঃপর কিছুক্ষণ কথা বলে সে কলটা রেখে দিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এখানে আসার পর সে ফ্রান্সের একটা সিম কিনে নিয়েছিল। মিষ্টি এবার ফোনটা ডেস্কে রেখে বলে,
“এই দেশ থেকে তো আমি তখনই ফিরব যখন মিস্টার রাফসান শিকদারের দেখা পাবো। তার আগে কখনোই নয়।”

সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে মিষ্টি প্যারিস মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে যায়। একটু পরেই মেট্রো চলে আসে। মিষ্টি মেট্রোতে উঠে পড়ে। এখন তার গন্তব্য মার্সেই। ফ্রান্সের বন্দর নগরী তথা প্রবেশদারও বলা হয় এই শহরকে। মিষ্টি মেট্রোতে বসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। আর মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা তারপরেই সে পা রাখতে চলেছে মার্সেই শহরে। মিষ্টি একবার ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। ফ্রেঞ্চ সময় সকাল ৭ টা বাজে। একটু পরেই মেট্রোরেল কতৃপক্ষ কতৃক তাদের জন্য সকালের ব্রেকফাস্ট দেয়া হলো। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সাথে মেয়োনিজ চিকেন ও কোকা কোলা দেয়া হলো ব্রেকফাস্টে। মিষ্টি সেটা খেয়ে নিলো। এরপর সমত কেটে যেতে লাগল। ঠিক ২ ঘন্টা পর মেট্রো রেল এসে থামল মার্সেই শহরে। মিষ্টি মেট্রো থেকে নেমেই একটা আনন্দ অনুভব করল। তার দুচোখেও খুশির ঝিলিক। মিষ্টি স্মিত হেসে বলল,
“অবশেষে পৌঁছে গেলাম কাঙখিত মার্সেই শহরে। ভূমধ্যসাগরের একদম তীরে এসে দাঁড়িয়ে আছি যেন। এবার এখান থেকেই আমার জীবনের নতুন একটা অধ্যায় শুরু হলো।”

বলেই সে নিজের ফোনটা বের করে ফেলে দিল ডাস্টবিনে। একটা রহস্যময় আভা দেখা গেল তার চোখে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here