ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ১০ #লেখিকা দিশা মনি

0
47

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ১০
#লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টি মোবাইলটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েই মৃদু হাসল। অতঃপর কিছু একটা মনে করে নিজের সোয়েটারের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করল। এটা রাফসানের লেখা সেই চিঠিটা। এই চিঠিতে আগের কথা গুলো লেখার পর স্পষ্ট করে রাফসান বলেছে,
“তবে যদি আপনার কখনো মনে হয়, আমাকে খুঁজতে চান আপনি তাহলে ফ্রান্সের মার্সেই শহরে চলে আসবেন। এখানে এসে আপনি সবার সাথে বলতে গেলে বাইরের দুনিয়ার সবার সাথেই সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেবেন। আমি যথাসময়ে আপনার সাথে দেখা করব। ততদিন পর্যন্ত কোন ভাবে কাটিয়ে নেবেন।”

মিষ্টি চিঠিটা শক্ত করে মুঠো করে ধরে বলে,
“এখন আমি কি করব? এখানে আসার আগে তো কোন হোটেলও বুক করা হয়নি। সবার আগে একটা ভালো হোটেল বুক করতে হবে।”

এমন ভাবনা থেকেই মিষ্টি একটু সামনে এগিয়ে গেল। কিছু দূর যাবার পর একটি পার্ক দেখতে পেল। সেই পার্কে বসেই একটা হোটেল বুক করে নিল৷ অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে যেই না হাটতে শুরু করবে এমন সময় কোথা থেকে যেন একজন লোক এসে তার হাতে থাকা ব্যাগ কেড়ে নিয়ে দিলো একটা ভো দৌড়। মিষ্টি হতবাক স্বরে বলে উঠল,
“আমার ব্যাগ…”

বলেই লোকটার পেছনে যেতে লাগল। যেতে যেতে বলল,
“আমার ব্যাগটা দিয়ে যান…”

মিষ্টি এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে সামনে এগোতে লাগল। একটু পর সে খেয়াল করল তার পাশ দিয়ে একটা যুবক দৌড়াতে লাগল ঐ লোককে ধরার জন্য। মিষ্টি একটু থেমে দম নিল। মিষ্টি একটু অপেক্ষা করে আবার দৌড়াতে যাবে এমন সময় যুবকটি এসে তার হাতে ব্যাগটি তুলে দিল এবং ফরাসি ভাষায় কিছু বলল। মিষ্টি তার কথা বুঝল না। না বুঝে হতবাক চাহনিতে চেয়ে রইল। যুবকটি এবার ইংরেজিতে বলল,
“এই নিন আপনার ব্যাগ।”

মিষ্টি ব্যাগটা হাতে নিলো। একটু যেন হাফ ছেড়ে বসল। ব্যাগটা হাতে নিয়ে মনে মনে বললো,
“উফ, অনেক বড় বাঁচা বেচে গেলাম এই ব্যাগে আমার পাসপোর্ট, ভিসাসহ সব জরুরি ডকুমেন্ট এবং কিছু ফরাসি মুদ্রাও ছিল।”

কিন্তু পার্স ব্যাগটা হাতে নিতেই তার সব হাসি মিলিয়ে গেল। কারণ ব্যাগটা সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল। মিষ্টির যেন এবার কান্না পেয়ে গেল। এই রকম সময় সে সবকিছু ছাড়া এই অজানা অচেনা শহরে কিভাবে থাকবে টাকা ছাড়া? তার উপর পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া সে দেশেও ফিরবে না এমনকি যদি এই দেশের কতৃপক্ষ তাকে ধরে ফেলে তাহলে তো জেলে যাওয়া কনফার্ম। মিষ্টি তাই তো কান্না-কান্না মুখ করে থাকল। যুবকটি আবারো ইংরেজিতে বলল,
“কোন সমস্যা?”

মিষ্টি বুঝতে পারল না এই অজানা দেশে সে কিভাবে এমন অজানা কাউকে ভরসা করে কিছু বলবে। কিন্তু এই যুবককে ভরসা করা ছাড়া তার আর কিছু করারও নেই তার উপর যেহেতু যুবকটি তাকে সাহায্য কর‍তে এগিয়ে এসেছিল তাই ভরসা করে বলল,
“আমি একজন বিদেশী নাগরিক। ফ্রান্সে কিছু কাজ করার জন্য আসছিলাম। এই ব্যাগে আমার পাসপোর্ট, ভিসা সবকিছুই ছিল। এমনকি টাকা-পয়সাও। কিন্তু এখানে এখন কিছুই নেই।”

যুবকটি নিজের মাক্স খুলে বলল,
“এটা তো অনেক বড় একটা সমস্যা। আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?”

মিষ্টি যুবকটিকে ভালো করে দেখল। ছেলেটির চেহারা বেশ আরবীয় আরবীয় একটা ভাব আছে। মিষ্টি বলল,
“বাংলাদেশ।”

“আমি একজন মরোক্কান বংশোদ্ভূত। আমি ১০ বছর থেকে মার্সেইতে থাকি। তাই এখানকার আইন-কানুন সম্পর্কে সব জানি। আপনি নিশ্চয়ই মুসলিম তাই না?”

“জ্বি।”

“আমার নাম ইয়াসিন আল খলিলি। আমিও একজন মুসলিম। আমি পাশেই একটা ছোট্ট গলিতে একটা ভাড়া বাড়িতে আমার মা ও বোনের সাথে থাকি। আপনার অবস্থা দেখে যা মনে হচ্ছে আপনার সাহায্যের প্রয়োজন। আপনি চাইলে আমার সাথে আমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারেন। তারপর যদি কোন ভাবে আপনার সমস্যার সমাধান করা যায় তাহলে নাহয় গেলেন।”

মিষ্টি কিছুটা চিন্তিত ছিল৷ সে কি করবে এখন? তার বলার মতো কিছুই নেই। সে কি এই যুবককে বিশ্বাস করতে পারে? ইয়াসিন বোধহয় বুঝল ব্যাপারটা। তাই হালকা হেসে বলল,
“আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। একজন মুসলিম হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব আরেকজন মুসলিমকে সাহায্য করা।”

“কিন্তু আপনার পরিবার…”

“আমার পরিবারকে নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।তারা আপনাকে দেখলে আরো খুশি হবে। ”

মিষ্টি এবার যেন একটু ভরসা পেল। সে বলল,
‘বেশ৷ চলুন।’

ইয়াসিন যেতে যেতে মিষ্টিকে বলল,
“আমার মা ফাতিমা আল খলিলি। উনি মার্সেইয়ের একটা গ্রোসারি শপে কাজ করেন। আমার বোন আমিনা আল খলিলি এখানকার একটা কলেজে পড়ছে। আমি ক্যাবচালক হিসেবে কাজ করি এখানে। আমার যখন ১৪ বছর বয়স তখনই আমার মা আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে ফ্রান্সে আসেন৷ তখন থেকে আমরা এখানেই থাকি।”

ইয়াসিনের সাথে মিষ্টি ধীরে ধীরে গলির ভেতরে হাঁটতে লাগল। আশেপাশের দৃশ্য দেখে মিষ্টির মনে হলো জায়গাটা বেশ পুরনো, কিন্তু পরিচ্ছন্ন। ছোট ছোট বাড়িগুলো সাজানো, যেন একেকটা ছোট্ট পরিবারের গল্প বলে। ইয়াসিন মাঝেমাঝে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে তার চেহারার অস্বস্তি বুঝতে পারছিল। হালকা হেসে সে বলল,

“আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। এটা মার্সেইয়ের পুরনো অংশ। এখানে মানুষজন বেশ বন্ধুবৎসল। আমরা সবাই একে অপরকে সাহায্য করি।”

মিষ্টি কেবল মাথা নাড়ল। তার মনে এখনো দ্বিধা কাটেনি, তবে ইয়াসিনের কথাগুলো কিছুটা সান্ত্বনা দিল। কয়েক মিনিটের হাঁটার পর ইয়াসিন একটি ছোট্ট, কিন্তু সুন্দর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। দরজার সামনে একটি পুরনো জানালার পর্দা দেখা গেল।

“এই বাড়িটাই আমাদের।”

ইয়াসিন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ঘরে ঢুকতেই মিষ্টি দেখল ঘরটা ছোট হলেও খুব গোছানো। দেয়ালে বেশ কিছু ছবি টাঙানো। একটি ছবি বিশেষভাবে মিষ্টির দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ছবিটায় ইয়াসিন, তার মা, এবং তার বোন একসাথে বসে হাসছে।

“আম্মু, আমি ফিরেছি!”

ইয়াসিনের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটি পরিপাটি বয়স্কা মহিলা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তার মুখে আন্তরিক হাসি। তিনি মিষ্টিকে দেখে একটু অবাক হয়ে বললেন,

“কে এই মেয়ে?”

ইয়াসিন মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টির পরিচয় করিয়ে দিল। সব কথা শুনে ফাতিমা আল খলিলি মিষ্টির দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরে বললেন,

“তুমি একদম চিন্তা করো না মা। নিশ্চিত্তে এটাকে নিজের বাড়ি ভেবেই থাকতে পারো।”

মিষ্টি অবাক হলো এই আন্তরিকতার সামনে। এতদিন সে ভেবেছিল, বিদেশে কেউ কখনো এত আপন হতে পারে না। কিন্তু এই পরিবার যেন এক মুহূর্তে তার সব ভুল ভেঙে দিল।

ফাতিমা তাকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন,
“এই ঘরটা তোমার জন্য। এটা ছোট, তবে আরামদায়ক। তুমি বিশ্রাম নাও। এরপর আমরা একসাথে রাতের খাবার খাবো।”

মিষ্টি ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ঢুকল। ঘরটা ছোট হলেও বেশ সাজানো। মিষ্টি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল। দূরে কিছু শিশু খেলা করছে। এত কিছুর পর, তার মনে একটুখানি শান্তি অনুভব হলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here