ভৌতিকপ্রেম,পর্বঃ১৩,১৪
লেখা – Mahfuza_Monira
পর্বঃ১৩
– শীষ তুই কাঁদছিস?
শীষ পেছন না ঘুরেই চোখ মুছে বলে
– উঁহু না।
মিলি এগিয়ে এসে শীষের সামনে দাঁড়ায়।
– কিন্তু আমি তো তোর চোখে পানি দেখেছি।
– বাতাসে উড়ে ময়লা ঢুকে গিয়েছিল।
– মিথ্যাটাও বলতে পারিস না ঠিকমতো!
শীষ আর কিছু বললো না। চুপ করে রইলো।
মিলি রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে –
– ঘুরতে এসেছিলাম সবাই। ভেবেছিলাম কত মজা হবে,কত জায়গা ঘুরা হবে। নতুন পুরাতন কত জায়গা দেখা হবে। কিন্তু এত কিছু যে দেখতে হবে তা তো আর জানতাম না! আর রিনি,ও আজ যেটা করলো এর জন্যে একদিন ঠিক পস্তাবে দেখিস তুই। আবিদ ছেলেটাকে আমার কাছেও ঠিক লাগে না রে।
শীষ শার্টের হাতার উল্টো পিঠ দিয়ে ভেজা চোখ মুছে বলে-
– তুই তো জানিসই আমি কেমন। অনেক মেয়েই আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। অনেক মেয়েই আমার জন্য হাত পা কেটে হুলস্থুল কান্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু আমি কাউকে পাত্তা দেইনি। কেন দেবো? তাদের কে তো আমার ভালোই লাগেনি! কিন্তু যখন রিনি কে দেখলাম,একটা অন্যরকম কাজ করা শুরু করে মনের ভেতর। ওর গায়ের চাঁপা রঙ,খাড়া নাক, আর বাশের মতো সরু ঠোঁট! আর ঐ যে থুতনিতে থাকা তিল টা, সমস্ত মন প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আমার। ভেবেছিলাম ঢাকায় ফেরার পথেই ওকে জানাবো আমার ভালোলাগার কথা। কিন্তু তার আগেই….
শীষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মিলি এগিয়ে এসে শীষের কাধে হাত রাখে। স্বান্তনার স্বরে বলে-
– সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। খুব দ্রুতই রিনি ওর ভুল বুঝতে পেরে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। দেখে নিস তুই।
শীষ মিলির একটা হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে-
– তাই যেন হয় রে!
.
হঠাৎ বিধান দৌড়ে ওদের কাছে আসে। হাপাতে হাপাতে বলে –
– নিচে চল, ঝগড়া লেগেছে।
মিলি ভ্রু কুঁচকে বলে-
– তোহা তো চলেই গেছে। এখন আবার কার সাথে কার ঝগড়া লাগলো!
– সেতো গেলেই দেখতে পাবি।
.
.
ওরা তিনজন নিচে নেমে দেখে ডায়নিং রুমে আবিদ একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর ক্যাটিকে অবাধ্য ভাষায় গালাগাল করছে রিনি।
মিলি রিনির কাছে গিয়ে বলে-
– কি হয়েছে?! এভাবে চেঁচামেচি করছো কেন!?
রিনি মিলির দিকে তাকিয়ে কটমট করতে করতে বলে-
– চেঁচাবো না তো কি করবো! এই মেয়ের সাহস হয় কিভাবে আমাকে আবিদের বুক থেকে টান মেরে সরিয়ে নেওয়ার?? এবাড়িতে কাজ কাম করে,একজন আয়া আর নিজের জায়গাটা ভুলে যাচ্ছে! আবিদ তোমারও দোষ আছে। ওকে তুমি ফ্রেন্ড বলো কেন? ও তো তোমার বাসার আয়া! ধুর আয়াও না,বুয়া!!
ক্যাটি চটে যায়। রিনির দিকে তেড়ে এসে বলে-
– যেটা জানো না সেটা নিয়ে কথা বলতে আসবে না। উড়ে এসে জুড়ে বসেছো এখানে আর আমাকে কথা শুনাচ্ছো! আমি আয়া হলে তুমি কি? তুমি রক্ষিতা!!! আবিদের রক্ষিতা….
এপর্যায়ে আবিদ এসে ক্যাটির গালে ঠাস করে চড় মেরে বসে। ক্যাটি গালে হাত দিয়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে। তা দেখে রিনির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।
আবিদ রাগী স্বরে বলে-
– আজকে এই মুহুর্তে এই বাড়ি থেকে তুমি বেরিয়ে যাবে ক্যাটি। আর কখনো আসবে না। শুনেছো? আর কখনো আসবে না।
ক্যাটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। একবার রাগী দৃষ্টিতে রিনির দিকে তাকায়। তারপর দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
.
মিলি রিনি কে উদ্দেশ্য করে বলে –
– শান্তি হয়েছো এবার!? এবার যাও যত ইচ্ছে ঢলে পড়ো তোমার আবিদের গায়ে। কেউ আটকাবে না তোমাদের।
এরপর আবিদের দিকে তাকিয়ে বলে-
– আবিদ সাহেব,আমরা চলে যাবো। রাইট নাও!
আবিদ হতভম্ব হয়ে তাকায় মিলির দিকে। কোনোমতে বলে-
– তাহলে মিশন?
মিলি কঠিন সুরে বলে-
– গোল্লায় যাক, ডোন্ট কেয়ার!!
বিধান,শীষ ব্যাগ রেডি করো সবার। আর কোনো ড্রামা দেখার ইচ্ছে নেই আমার।
যত্তসব!!!
মিলি লম্বা লম্বা পা ফেলে নিজের রুমে দিকে এগিয়ে যায়। বিধান আর শীষ ও তাদের রুমের দিকে এগোয়। মিলি না বললেও তারা আজকেই চলে যেতো। কেননা এখানে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে।
.
ডায়নিং রুমে শুধু থাকে আবিদ আর রিনি। আবিদ অসহায় দৃষ্টিতে রিনির দিকে তাকিয়ে বলে-
– তুমিও চলে যাবে এখন?
রিনি মৃদু হেসে বলে –
– কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে…
.
.
বাসে উঠার পর থেকে তোহা শুধু কেঁদেই চলেছে। লিমন তোহার মাথা টা নিজের কাধে রেখে বলে-
– প্লিজ তোহা, আর কত কাঁদবে! জানো না তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না! প্লিজ থামো৷ আমার জন্যে হলেও থামো.. প্লিজ!?
তোহা লিমনের কাধে শুয়েই চোখ মুছে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে –
– আমি কোনোদিন ভাবিনি যে রিনি আমার সাথে এমন আচরণ করতে পারবে!! যতবার ওর কথা মনে পড়ছে ততবার মায়া লাগছে আর যখনি ওর বলা প্রতিটা কথা মনে পড়ছে, তখনি ওর জন্য নিজের মনে ঘৃণা সৃষ্টি হচ্ছে। একদিন ও ঠিক আমার কাছেই ফিরে আসবে। সেদিন আমিও ওকে বুঝাবো যে আমি আজ কতটা কষ্ট পাচ্ছি!!
.
– ম্যাম,আমি কি আপনার পাশের সিট টায় বসতে পারি?
তোহা মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে লম্বা,শ্যামবর্ণের একটা ছেলে তাকে উদ্দেশ্য করে কথা টা বলেছে। সে চাচ্ছে সেই সিটে বসতে যেখানে লিমন বসে আছে। তোহা লিমনের মুখের দিকে তাকায়।
লিমন নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তোহার দিকে। তোহা তারপর আর এক সেকেন্ড ও দেড়ি না করে ছেলে টাকে বলে-
– অন্য সিটে বসুন। দুটো সিটই আমি নিয়েছি।
– একা মানুষ! অথচ সিট দুটো কেন?
– আপনাকে কি বলতে হবে!? আমার ইচ্ছে,দুটো নি বা তিনটে!
– ওকে ওকে, কুল৷ এত হট হচ্ছেন কেন!?
তোহার মেজাজ বিগড়ে যায়। সিট থেকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে –
– একা একটা মেয়েকে পেয়ে ডিস্টার্ব করছেন!? লজ্জা করে না?
বাসের অন্য পুরুষেরা সবাই তোহাকে উদ্দেশ্য করে বলছে যে কি হয়েছে,তোহা চেঁচাচ্ছে কেন?
তোহা কাউকে কিছু না বলে সেই ছেলেটাকে বলে-
– গনধোলাই খেতে না চাইলে অন্য সিটে গিয়ে বসুন।
এরপর তোহা নিজের সিটে বসে যায়। ছেলেটি মনে মনে কিছু ভয়াবহ গালি উচ্চারণ করে তোহার নামে। তারপর বাস থেকেই নেমে যায়৷ তোহা তখনো রাগে ফুসছিল। লিমন তোহার মাথা টা নিজের বুকে চেঁপে ধরে বলে –
– রিনির রাগ অন্যের উপর ঝেড়ে দিলে! ওকে নো প্রবলেম। এবার ঠান্ডা হও। একটু ঘুমাও কিছুক্ষন।
তোহা আর কিছু না বলে চুপ করে ওভাবেই বসে থাকে।
.
.
রাত ১০ টা। রিনি নিজের রুমে একা একা বসে আছে। আবিদ টা সেই সন্ধ্যায় কোথায় বের হয়েছে! এখনো আসেনি। রিনির ভীষণ ভয় করছে। এত বড় বাড়িটায় সে একা।
মনে মনে দোয়া দুরুদ আওড়াচ্ছে রিনি। তাও সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে বারবার।
হঠাৎ কারেন্ট চলে যেতেই রিনি ধপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। ডায়নিং রুমের দিকে দৌড়ে আসে। হাতে থাকা ফোন টা দিয়ে ফ্ল্যাশ অন করে। ফ্ল্যাশ অন করতেই দেখে মেইন দরজার কাছে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। রিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-
– কে? কে ওখানে…
অবয়বটি রিনির গলার আওয়াজ পেয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসে। রিনি একপা একপা পিছনে এগোয়। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে,পা জমাট বেধে যাচ্ছে। রিনি এগোতে এগোতে একদম দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। অবয়বটা তখনো তার দিকেই এগিয়ে আসছে৷ রিনি চোখ বন্ধ করে ফেলে৷ খানিকবাদে টের পায় কেউ একজন তার খোলা চুলে হাত বুলাচ্ছে। রিনি চোখ মেলতেই অবয়ব টা বলে-
– আমার রিনি এত সুন্দর! আগে তো খেয়াল করিনি।
রিনি অস্ফুটস্বরে বলে-
– আবিদ…
আবিদ মৃদু হেসে বলে –
– ভূত ভেবেছিলে!?
রিনি লজ্জা পেয়ে বলে-
– না মানে!….
– থাক থাক,আমার লজ্জাবতী কে আর লজ্জা পেতে হবে না।
রিনি আবিদ কে সরিয়ে দিয়ে নিজের রুমে যায়। আবিদ ও তার পিছে পিছে যায় সেদিকে। রিনি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কপট রাগ দেখিয়ে বলে –
– বাসায় কে আসতে বলেছে! যাও না,যেখানে কাজে গেছো সেখানেই থাকো।
আবিদ রিনিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে-
– আমার রিনুপাখি টা রাগ করেছে বুঝি?
রিনি কঠিন সুরে বলে-
– জানিনা।
আবিদ রিনির চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে-
– বুঝেছি। ভীষণ রাগ করেছে। তার রাগ তো ভাঙাতেই হবে,তাইনা?
কথাটা বলেই আবিদ রিনির ঘাড়ে নাক ডুবায়৷ রিনি ঈষৎ কেঁপে উঠে। একটা অন্যরকম অনুভূতি ঘিরে ধরে তাকে। সেও আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে আবিদের সাথে সুখের রাজ্যে…..
.
.
গভীর রাত।
রিনি গভীর ঘুমে।
কেউ একজন পর্দার আড়াল থেকে চাঁপা গলায় আবিদ কে ডাকে। আবিদ পর্দার পেছনে গিয়ে বলে-
– তুমি এসেছো? আমি তো তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। রাতের ডিনার ঘুমোচ্ছে। যাও,তুমিই আগে শুরু করো তাহলে।
চলবে….
ভৌতিকপ্রেম
পর্বঃ১৪
লেখা – Mahfuza_Monira
দুদিন পার হয়ে গেছে। এই দুদিনে তোহা একবারো রিনির খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেনি। করবেই বা কেন? রিনি কে তার!? কেউ না……কেউ না…….
আবিদ,শীষ আর মিলি ঢাকায় আসলেও তাদের সাথে দেখা পর্যন্ত করতে যায়নি তোহা। তারা বাসায় এলেও নিজেকে রুম বন্ধ করে রেখেছে তোহা। রিনির রাগ তাদের উপর দিয়ে কেন নিচ্ছে তা তাদের তিনজনের কেউ ভেবে পায়না।
তোহার বাবা – মা আবরার ও শেফা ভীষণ চিন্তিত তোহার এই অবস্থা দেখে। সারাদিন একা একা বসে থাকে,নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে রাখে। আবার এখন বন্ধুদের থেকেও নিজেকে দূরে দূরে রাখছে! হুট করে সিলেট থেকেও একা একা চলে এসেছে। কাউকেই কিচ্ছু বলছে না।
সন্ধ্যাবেলায় বিধান আর মিলি আরো একবার আসে তোহার সাথে দেখা করতে। কিন্তু ফলাফল ব্যর্থ। অনেকবার দরজায় টাকাটাকি করলেও তোহা দরজা খুলেনি। অপাশ থেকে বলে দিয়েছে তাদের চলে যেতে। সে কারো সাথে দেখা করবে না। মিলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিধানের কাধে হাত রেখে বলে-
– চল,চলে যাই।
– আরে এভাবে কিভাবে যাবো! ওকে দেখা করতেই হবে আমাদের সাথে। আমরা কী এমন করেছি যে আমাদের উপরেও রাগ ও? এটাও বলতে হবে ওকে।
তারপর দরজায় আরো জোরে দুম দুম করে বারি মেরে বিধান চেঁচিয়ে বলে –
– তোহা,তোহা…দরজা খোল বলছি। নয়তো ভেঙে ফেলবো কিন্তু এই দরজা। এভাবে কেন করছিস আমাদের সাথে উত্তর দে। যা করেছে রিনি করেছে,আমাদের সাথে কি হয়েছে তোর! বল আমাদের,বল তোহা।
ভেতর থেকে কোনো উত্তর আসে না। মিলি এবার আরো গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিধানের হাত দুটো ধরে বলে –
– বলেছি না চল। ওকে একা থাকতে দি কিছুদিন। ওর অবস্থাটাও বোঝ। যে ওর সব থেকে আপন আর বিশ্বস্ত ছিল, যে ওর জীবনের একটা অংশ ছিল সে যদি এমন করে, কেমন লাগবে? ওর মানসিক অবস্থা তো আমাদের বোঝা উচিত। তাই নয় কি? চল,চলে যাই। কয়েকদিন যাক,ও এমনিতেই আসবে আমাদের সাথে দেখা করতে দেখিস।
বিধান অসহায় দৃষ্টিতে একবার তাকায় তোহার রুমের দরজা টার দিকে। তারপর মিলি কে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
.
.
ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তোহার। রিনির বলা প্রতিটা বাক্য বারবার কানের কাছে বেজে বিদ্ধ করে তাকে। সে যতই চাইছে সেসব ভুলে নতুন স্বাভাবিক ভাবে জীবন টাকে চালাতে,ততবারই হীনমন্যতায় ভুগছে।
.
মানুষের অভিমান জমে গলার কাছে দানার মতো পাকিয়ে গেলে সেটা সহজে গেলা যায়না। আর উগলে দেওয়া যায়। তখন অভিমানের আক্রশ থেকে ক্ষোভ হয়,কঠিন রাগ হয়।
কোথা থেকে একটা বড়,শক্তমতন পাথর এসে বুকের উপর বসে যায়। তখন সম্পর্ক গুলো তুচ্ছ মনে হয়। সবথেকে কাছের মানুষগুলোর সাথেও দুদন্ড ভালো আচরণ করতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে অভিমানের আড়ালে থাকা মানুষটিকে ক্ষমা করতে। ইচ্ছে করে বড় একটা বালির গাড়ি এনে,তাকে তার তলে যদি পিষে দেওয়া যেতো,তবেই বোধহয় ভালো হত। তবেই বোধহয় এই মন শান্ত হতো।
.
.
তোহাদের বাসা টা ডুপ্লেক্স। তোহার রুম টা দোতালায়। বিধান আর মিলি নিচতলায় নামতেই তাদের নিজের রুমে ডেকে পাঠান শেফা। বিধান মিলি একবার দুজন দুজনের দিকে তাকায়। দুজনের মনেই একই প্রশ্নের উদয় হয়। হঠাৎ কি মনে করে ডেকে পাঠালো!
যাক,আগে যেয়েই দেখি।
.
রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বিধান বলে-
– আমরা আসবো আন্টি?
শেফা কাউচে বসে পত্রিকা পড়ার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বিধানের কথায় আর চেষ্টায় ছেদ পড়ে। পত্রিকা রেখে তিনি উঠে দাঁড়ান। বিধানের দিকে হাসি হাসি মুখ করে বলে-
– তোমরা আমার মেয়ের বন্ধু। আমারো ছেলে-মেয়ের মতো। তোমরা কেন যে আমার রুমে আসতে নিলে পারমিশন নিতে যাও বুঝিনা! এসো,ভেতরে এসো।
বিধান,মিলি দুজনেই রুমে প্রবেশ করে।
শেফা দুকাপ কফি আনতে বলে বেয়ারা কে। এরপর ওদের কে উদ্দেশ্য করে বসতে বলে। বিধান,মিলি কোনো কিছু না বলেই চুপ করে বসে পড়ে।
শেফা উদ্বিগ্ন ভাবে পায়চারি করতে থাকে রুমের ভেতর। প্রায় ২ মিনিট পায়চারির পর সেও এসে ওদের সামনের সোফায় বসে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে-
– আমি জানিনা,সিলেটে কি হয়েছে। আর কেনই বা তোহা এরকম হয়ে গেছে। সারাটা দিন ঘরে বসে থাকে,ডাকলেও বের হয়না সহজে। রুমে গেলেও কথা বলেনা তেমন। খায়না,ঘুমায় না,কোনো কেয়ারই নেই নিজের প্রতি। আচ্ছা তোমরা তো ছিলে ওর সাথে। বলো না,কি হয়েছে ওর? কেন ও এরকম পালটে গেলো হুট করে??
বিধান মিলির দিকে তাকায়। তার চোখ দিয়েই সে মিলি কে প্রশ্ন করে যে সবকিছু বলবে কিনা!
মিলি মৃদু মাথা নাড়িয়ে বোঝায়, না। না বলাটাই শ্রেয় বোধহয়।
বিধান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শেফার দিকে তাকিয়ে বলে-
– আন্টি,আজ উইশ,আমিও এই কারনটা জানতাম! আসলে আমরাও কিছু জানিনা। একদিন হুট করেই তোহা বললো, ও ঢাকায় আসবে। এরপর আমাদের কাউকে না জানিয়ে ও চলে আসে। আমরা পরে যখন ওকে কোথাও খুঁজে পাই না,তখন আমরা খবর নিয়ে জানতে পারি যে ও ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। পরে তাই,আমরাও চলে আসি। বিশ্বাস করুন,আন্টি। আমরা কিচ্ছু জানিনা।
শেফা মৃদু হাসলেন। কফি চলে এলো। তিনি কফি দুটো বিধান আর মিলি কে অফার করে বললেন-
– জানো বিধান এন্ড মিলি,আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির টপ ছাত্রী ছিলাম।অবশ্য সেখান থেকেই আমার এসব রাজনীতি তে ঢোকা। পলিটিক্স করলেও পড়ালেখায় আমার কখনো খারাপ মেধা ছিল না। বেশ ভালো মার্কস পেতাম প্রতিটা পরীক্ষায়৷ এজন্য অবশ্য আমার ভার্সিটি শেষে ঢাকা ভার্সিটি থেকে আমার জন্য অফার এসেছিল। ভার্সিটির প্রফেসর হিসেবে। কিন্তু সব তো সবাই কে দিয়ে হয় না। এসব টিচিং ও আমায় দিতে হতো না বিধায় করিনি। আচ্ছা,তোমরা কি জানো আমার ভার্সিটির পড়ার বিষয় কোনটা ছিল?
বিধান মিলি দুজনেই মাথা নাড়ে।
শেফা আবারো মৃদু হেসে বলে –
– মনোবিজ্ঞান। আমি কারো চেহারা দেখলেই তার মনে কি চলছে বলে দিতে পারি৷ আর এটাও জানি তোমরা সব জানো, সব কিছু। কিন্তু আমাকে বলছো না।
শেফা একটু থামলেন। বিধান মিলির দিকে অসহায় ভাবে তাকায়।
শেফা আবারো বললেন-
– দেখো,তোহা আমার একমাত্র মেয়ে। আর একমাত্র মেয়ের এমন আচরণ আমি মোটেও মানতে পারছি না। তাই তোমাদের কে রিকুয়েস্ট করছি,প্লিজ আমাকে বলো। হয়তো আমিই কোনো সমাধান বের করতে পারবো আর আমার আগের সেই হাসি খুশি তোহাকেও খুঁজে পাবো।
বিধান হাত থেকে কফির মগ টা আস্তে করে কাঁচের টেবিলটার উপর রাখে। শেফার দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে-
– সরি আন্টি। আপনার আন্দাজ ঠিকই। আমরা জানি সত্যিটা। কিন্তু আমরা আপনাকে বলতে পারবো না।
শেফা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে-
– কিন্তু কেন?
– কারন তোহা যদি জানতে পারে কষ্ট পাবে। এটা ওর একান্ত ব্যাপার যে ও কাকে কাকে জানাবে আর কাকে কাকে না। আমার মনে হয় তোহা খুব দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে। তখন ও যদি চায়,ও নিজেই আপনাকে বলবে। এমনিতেই মেয়েটার অনেক কষ্ট,অনেক কষ্ট পেয়েছে ও,আমি ওর অজান্তে ওর পারসোনাল ব্যাপার কারো সাথে শেয়ার করে,ওর কষ্ট আর বাড়াতে চাইনা।
শেফা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিধানের দিকে। এবার মিলিও কঠিন গলায় বলে-
– বিধান যা বলেছে ঠিক বলেছে। আপনি তার চেয়ে বরং অপেক্ষা করুন। তোহাকে একটু সময় দিন৷ ও ঠিক হবে। খুব দ্রুতই হবে,ইনশাআল্লাহ।
বিধান মিলি চলে যায়। শেফা আবারো পত্রিকা হাতে নিয়ে বৃথা পড়ার চেষ্টা চালাতে থাকেন।
.
.
কফির মগ হাতে নিয়ে চুপ করে বসে আছে তোহা। কেন এমনটা হলো! কেন?? এমনটা হওয়া কী খুব জরুরি ছিল? খুউউউউউব?
শেফা এসে তোহার পাশে বসতে বসতে বলেন-
– কফি হাতে নিয়ে বসে আছিস,খাচ্ছিস না,আবার ফেলছিস ও না। তুই না খেলে আমায় দে,আমিই খাই।
তোহা মুখ ঘুরিয়ে একবার তাকায় শেফার দিকে কিন্তু সে শক্ত করে ধরে থাকে কফির মগ টা। শেফা কে দেয় না।
শেফা তোহার কোনো উত্তর না পেয়ে বলে-
– কালকে তোদের ভার্সিটির প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট দিবে। যাবিনা?
তোহা কঠিন গলায় বলে –
– নাহ।
– বিধান মিলি এসেছিল।দেখা করলি না যে?
– এমনিই।
– ওওও…
শেফা কি বলবেন আর খুঁজে পান না। চুপ করে বসে থাকেন। কতক্ষণ বসে থাকার পর তোহা বলে-
– কিছু বলার না থাকলে যাও মা। আমায় একা থাকতে দাও।
শেফা চিন্তিত গলায় বলে-
– সিলেট থেকে আসার পর একাই আছিস রে মা,কেন? আমাদের কি বলা যায়না যে কি হয়েছে? আমি আর তোর বাবা কি তোর এতই পর?
মৃদু হাসে তোহা। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে-
– পর নও আবার এত আপন ও নও মা। তা,আজ এখানে? তোমার তো এখন কোনো ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং বা কিটি পার্টিতে থাকার কথা!
শেফা নিচু গলায় বলে –
– খোটা দিচ্ছিস?
– উঁহু খোটা দিচ্ছি না। যার কাছে তাদের মেয়ের থেকে টাকা রোজগার টাই সব তাদের কে খোটা দেওয়ার মন মানসিকতাও আমার নেই!
– তোহা…..
– প্লিজ মা,ইমোশনাল হবে না একদম। এসব ইমোশনাল ড্রামা ভালো লাগে না। প্লিজ গো,প্লিজ৷ আই ওয়ান্ট টু স্টে এলোন নাও। সো প্লিজ গো….
শেফা আর কথা বাড়ালেন না। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে তার। আচলের কোনা মুখে গুঁজে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
তোহা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায় আবার।
রাত, কত অদ্ভুত!
রাতের বেলাও চেনা শহর টা কত অচেনা লাগে!
.
লিমন এসে নিঃশব্দে তোহার পাশে বসে। জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলেই-
– এভাবে কতদিন থাকবে তোহা?
তোহাও বাহিরের দিকে তাকিয়েই বলে-
– যতদিন না রিনিকে কষ্টে দেখবো ততদিন।
– অভিমান থেকে ক্ষোভ জমে গেছে,তাইনা?
– জানিনা।
– আচ্ছা,বাদ দাও। কফি খাওয়া হয়েছে?
– ইচ্ছে করছে না।
– খেতে হবে না।ফেলে দাও।
তোহা সাথে সাথে মগখানা ছুড়ে মারে।
দেয়ালে লেগে কফির মগ টা চার টুকরো হয়ে যায়।
লিমন নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে থেকে বলে-
– কফি ফেলে দিতে বলেছিলাম,মগ ভাংতে বলিনি।
প্রতিউত্তরে তোহা চুপ করে থাকে। লিমন জানে তোহা আর তার সাথে কথা বলতেও চাচ্ছে না এখন। থাক না,সে একাই তার মতো ভালো থাক।
লিমন উঠে ছাদে চলে আসে।
আকাশে আজ চাঁদ টাও নেই।
আচ্ছা চাঁদেরও কি মন খারাপ? চাঁদের গার্লফ্রেন্ড ও কি তোহার মতো চুপচাপ বসে থাকে সব সময়?
আচ্ছা,চাঁদের কি গার্লফ্রেন্ড হয়? হয় বোধহয়!
আচ্ছা,চাঁদের গার্লফ্রেন্ড বুঝি তারা? কিন্তু আকাশে কত তারা! কোন তারা টা চাঁদের গার্লফ্রেন্ড ? নাকি সবগুলোই…
এত গুলো গার্লফ্রেন্ড চাঁদের….
ভাবতেই নিজের মনে নিজেই হেসে উঠে লিমন।
চলবে…….