ভৌতিকপ্রেম,পর্বঃ১৭,১৮

0
1003

ভৌতিকপ্রেম,পর্বঃ১৭,১৮
লেখা – Mahfuza_Monira
পর্বঃ১৭

কফিশপে বসে আছে তোহা এবং নির্জন। অবশ্য নির্জনই ফোন করে ডেকেছে তাকে। তোহার সাথে কিসব জরুরি কথা আছে নাকি তার!

মাঝখানে ৩ দিন কেটে গেছে। এই ৩ দিনে বদলে গেছে অনেক কিছু। তোহা আগের মতো স্বাভাবিক হয়েছে। রিনিও নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার তাদের মাঝে ফিরে এসেছে। সব থেকে রিনি এখন আগের থেকে বেশ সুস্থ। তবে হসপিটালেই এডমিট। ডাক্তাররা বলেছেন দু একদিনের ভেতরেই তারা রিনি কে ডিসচার্জ করে দেবেন।

নির্জন থেমে থেমে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। তোহা এক দৃষ্টিতে নির্জনের কফি খাওয়া দেখছে। নির্জন তা বুঝতে পেরে খানিকটা বিব্রতবোধ করলো। সে কফির মগ টা একটু দূরে ঠেলে রেখে বলে-
– কি ব্যাপার! কফি খাচ্ছো না যে!

তোহা সোজাসাপটা বলে-
– অতিরিক্ত স্ট্রং কফি আমার ভালো লাগেনা।
– ওহ! কোন কফি খাও তাহলে?
– কোল্ড কফি।
– তাহলে অর্ডার করি। ওয়েটার…
– আরেহ না! করতে হবে না। গলা টা এমনেই ভাঙা একটু। এখন আবার ঠান্ডা খেলে…. আপনি বাদ দিন ওসব,আমাকে কেন ডেকেছেন তাই বলুন।

নির্জন বুঝে তোহা এভাবে ফাও বসে থাকতে পছন্দ করছে না। সে সোজা পয়েন্টে যেতে চায়। নির্জন ও তাই সোজা ভাবেই বলে-
– আমি সিলেট গিয়ে আবিদ নামটি খোঁজ করেছি। কিন্তু আবিদ নামের কেউ সিলেটের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান না। আর সব থেকে মজার বিষয় হলো,পুরো সিলেটে আবিদ নামের গোয়েন্দা বিভাগের কেউই নেই।

তোহার কপাল ধীরে ধীরে কুঁচকে যায়। আবিদ কি তবে মিথ্যে বলেছিল তাদের! কেন বললো?

তোহাকে ভাবনায় পড়ে যেতে দেখে নির্জন বলে-
– আমিও তোমার মতই ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু সত্য তো সত্যই।

তোহা ছোট্ট করে বলে-
– হু।

নির্জন উঠে দাঁড়ায়।
– এটার জন্যেই ডাকা তোমায়। তেমন বিশেষ কিছু না। এবার যেতে পারো। আমারো যেতে হবে। কাজ আছে হেড কোয়ার্টারে।

তোহা ব্যাগ কাধে নিতে নিতে বলে-
– আপনি প্রতিবার কোথায় কি করতে যান সেসব আমায় বলে যান কেন! লাইক আমি আপনার কিছু হই যেন! এরকম টাইপ দেখায় জিনিসটা।

মৃদু হাসে নির্জন।

– তুমি যথেষ্ট সুন্দর এবং গুণবতী। কিন্তু তাই বলে সব ছেলেরাই তোমার উপর লাইন মারার চেষ্টা করবে এমনটা ভেবো না। তুমি আমার কাছে নতুন পরিচিত একটি মুখ,একজন ফ্রেন্ড। এর বেশি কিছু না। আর সেই ফ্রেন্ডশিপের কারনেই বলি। জাস্ট মনে করো,এমনিই….

তোহা লজ্জা পায়৷ নির্জন তাকে লাইন মারবে! এমন কথা তার মাথায় আসলো কিভাবে…

তোহা হাসার চেষ্টা করে।
তা দেখে নির্জন বলে-
– অহেতুক হাসি আমার ভালো লাগে না। চলি।

নির্জন বিল মিটিয়ে বেরিয়ে যায়। তোহার হাসি মুহুর্তেই গায়েব হয়ে যায়। লোকটা এমন কেন!
মুখে কিছু আটকায় না নাকি…..!!
.
.
বাসায় ফেরার পথে তোহা ভাবে একবার হাসপাতাল যাওয়া যাক। রিনিকে দেখে আসা যাক।
.
হাসপাতালে গিয়ে তোহা বেশ অবাক হয়।
বিধান,মিলি,শীষ,লিমন আগে থেকেই সেখানে। তোহা কে দেখে বিধান বলে-
– বলেছিলাম না,লিমন যখন এখানে তাহলে তোহাও ঠিক আসবে। ওকে কল করতে হবে না। দেখলি তো…আমার কথাই ফললো।

তোহা বিধানের কথার জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে।
– তোরা!! এখানে.. আর শায়েরা আন্টি কই? মা কি বাসায় চলে গেছে?

মিলি তোহার পাশে দাঁড়িয়ে বলে-
– আরে আস্তে আস্তে প্রশ্ন কর। সব প্রশ্ন একসাথে করলে কিভাবে জবাব দিবো।

তোহা চোখ পাকিয়ে তাকায়। তা দেখে মিলি বলে-
– একটু মজাও বুঝিস না!! সিরিয়াস ওয়ালি…
আমরা আসলাম রিনিকে দেখতে।তখন রিনির মা আর তোর মা দুজনেই ছিল। তারা সারাক্ষন এখানেই থাকে। এমনকি রাতেও। তাই ভাবলাম তাদের বাসায় পাঠিয়ে দি। একটু বিশ্রাম তো তাদেরও দরকার। তো তাদের পাঠিয়ে আমরা রয়ে গেলাম।

তোহা মৃদু হেসে বলে –
– কত ভালো রে তোরা।
.
রিনির পাশে বসে তোহা বলে-
– কেমন লাগছে তোর এখন? শরীরে এনার্জি আসতেছে?

রিনি মাথা দুলায়।
– হ্যাঁ আগের থেকে বেশ সুস্থ আছি। শুধু হাসপাতাল থেকে বের হতে পারলেই বাঁচি। এখানে মানুষ থাকে…!!

তোহা হেসে ফেলে।
– নিজেই তো ডাক্তার,আর ডাক্তার হয়ে এমন কথা বলছিস!

তোহার কথা শুনে রিনি জিভ কাটে।

তোহা রিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

– দেখি,কালকেই ডাক্তারদের সাথে কথা বলে তোকে নিয়ে যেতে পারি কিনা।

রিনি তৃপ্তিভরা চোখে তোহার দিকে চেয়ে থাকে।
.
.
– একটা বলার ছিল তোদের সবাইকে।

তোহার কথা শুনে সবাই ওর দিকে দৃষ্টিরোপ করে। তোহা নিজের ঠোঁটে কামড়ায় কিছুক্ষণ। এরপর বলে-
– আবিদ আমাদের মিথ্যে বলছিল। সে কোনো গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান না। আর এই কথাটা আমি নির্জনের থেকে জানতে পেরেছি।

কারো কাছেই আবিদ সাবজেক্ট এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তবুও সবাই একটু চমকায়। শুধু মুচকি হাসে লিমন। ওর হাসি দেখে তোহা বলে-
– হুদাই হাসো কেন? দাতের বারান্দা কি খুলে যায় একটু হলেই?
এবার লিমন আরো জোড়ে হাসে। ওর হাসি দেখে গরম চোখ করে তাকিয়ে থাকে তোহা।

লিমন নিজের হাসি সংযত করে বলে –
– আমি আগেই জানতাম আবিদ কোনো গোয়েন্দা ফোয়েন্দা না।

তোহা ভ্রু কুঁচকে বলে-
– তুমি জানতে?
– হু জানতাম। সে তোমাদের ঢপ মেরেছে। আবিদ অনেক আগে থেকেই আমাদের ফলো করছিল। সে শুধু চেয়েছে আমাদের সবাইকে তার টার্গেট বানাতে। আর আমিও ভূত। সে ভেবেছে আমি হয়তো তার সাপোর্ট দিবো। কিন্তু যখন সে জানতে পারে,আমি আর তোহা একটা রিলেশনশিপে আছি সে ভড়কে যায়। এরপর রিনি আর তোহার ঝগড়া,তোহার চলে আসা,রিনি বাদে বাকিদের চলে আসা,সব কিছু তার প্ল্যান কে ফেইল করে দেই। সে যখন আমাদের কাউকেই পেলো না,তখন ভাবে তাহলে রিনিকেই টার্গেট করুক। আর তাই করে।

তোহা উঠে এসে লিমনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
– এতই যদি জানতে তাহলে আমাদের আগে বলো নি কেন? আমরা রিনিকে ফেলে কোথাও যেতাম না। তাহলে আজ রিনির এই অবস্থাও হতো না।

লিমন একটু ভয় পায়। তোহা যদি মেরে টেরে বসে তাকে!
একটু দূরে সরে বলে-
– আমিও তো আগে জানতাম না। জেনেছি যেদিন সিলেট যাই। সেদিন আমার আবিদের সাথে দেখা হয়। সেদিন সেই সব বলে।আরে এটাও বলে যে সে রিনি কে ছাড়বে না।

কথাটা শুনে রিনির শ্বাস বেড়ে যায়। লিমন দৌড়ে রিনির কাছে গিয়ে বলে-
– প্লিজ,ভয় পেও না। আমি ওকে বলেছি যে ও যদি আসে আর, তবে আমি ওদের কাউকে ছাড়বো না। আর তুমি যে তৃতীয় ব্যক্তি কে দেখেছিল,সে কে জানো?

রিনি এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ায়।

লিমন বলে-
– সে সিলেটের একটা চার্চের ফাদার। মানুষের সামনে সে একজন মহান ব্যক্তি,অতি ভদ্র লোক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে ভ্যাম্পায়ার।
আবিদের সাথে আমার একটা ডিল হয়। আমি ঐ ফাদারের ভ্যাম্পায়ারের কথা কাউকে বলবো না। যদি সে ক্যাটিকে নিয়ে এই দেশ ছেড়ে চলে যায়। আর আবিদ তাই করেছে। সে হিমালয় চলে গেছে। ফরেভার….

রিনির স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

তোহা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বলে –
– কয়টা দিনের ভেতর কত কিছু ঘটে গেলো আমাদের জীবনে! আল্লাহ,এবার আর কিছু না হলেই হয়। আমরা সবাই ভালো থাকতে চাই। ভালো থাকতে চাই…

মিলিও দম ফেলে বলে-
– ঠিক বলেছিস রে,ঠিক বলেছিস।
.
ওরা আর কিছুক্ষণ থেকে সবাই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শীষ থেকে যায়। সে রিনির পরিবারের কেউ না আসা পর্যন্ত থাকবে।
তোহা মুচকি হাসে। মনে মনে ভাবে ‘এবার রিনি টার একটা গতি হোক শীষের সাথে। তাহলে সে একদম চিন্তা মুক্ত।’
.
.
বাসায় ফেরার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে শাওয়ার নেয় তোহা। আজ তার ভীষণ ভালো লাগছে। সব কিছু কত সুন্দর আর সাবলীল হয়ে গেছে।

এভাবেই যেন থাকে সব…
তোহা বারবার সেই দোয়াই করে।
.
.
নিচে নেমে দেখে শেফা সোফায় বসে আপেল কাটছে। তোহা শেফার পাশে গিয়ে বসে।

– আজকে না তোমার কিটি পার্টি ছিল মা। গেলে না?

শেফা আপেল কাটতে কাটতেই জবাব দেয়।
– নাহ,ভাবছি এখন থেকে এসব কমিয়ে দিবো। বয়স হয়ে গেছে। আর কত?

তোহা মুচকি হাসে। সে জানে শেফা বয়সের কারনে না,তার কারনে এসব রাজনীতি আর সোশ্যাল একটিভিটিজ থেকে নিজেকে দূরে সরাচ্ছে। শেফা যতই ব্যস্ত থাকুক,সে তো তোহার মা। একমাত্র মা….
আসলেই সে তোহাকে ভীষণ ভালোবাসে।

তোহা আচমকাই শেফাকে জড়িয়ে ধরে।
শেফা চমকে যায়।
তোহা জড়িয়ে থেকে বলে-
– চুল গুলো পানিতে ভিজে এলোমেলো হয়ে আছে। একটু আঁচড়ে দেবে মা?
.
.
রাতের বেলা খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসে। আবরার বারবার তোহার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। তোহা বুঝতে পেরে বলে –
– বাবা,তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছো আমায়?

আবরার খাওয়া থামিয়ে বলে –
– না আসলে…
মানে…..

তোহা হেসে ফেলে।

– উফ, বাবা। আমি তোমার মেয়ে হই,মা না। যে এত ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে হবে। সোজাসুজি বলো না।

আবরার তোহার কথা শুনে হেসে ফেলে। পাতলা,পুতুলের মতো দেখতে মেয়ে তার। আজ যদি নির্জনের মা,আবরার কে ডেকে তোহাকে নিজের ছেলের বউ করতে না চাইতো,তবে হয়তো আবরার কোনোদিনই বুঝতো না যে তার সেই ছোট্ট পরী টা কত্ত বড় হয়ে গেছে।

আবরার লুকিয়ে চোখের জল মুছে নেয়।

তোহার দিকে তাকিয়ে বলে-
– তোর কি বিয়ে করার ইচ্ছে আছে এখন তোহা?

তোহা,শেফা দুজনেই চমকে তাকায় আবরারের দিকে।
আবরার থতমত খেয়ে বলে-
– না মানে,নির্জনের মা তোকে নির্জনের বউ আর তার ঘরের দ্বিতীয় মেয়ে করতে চায়।

চলবে….

ভৌতিকপ্রেম
পর্বঃ১৮
লেখা – Mahfuza_Monira

– বাবা,আমি এই মুহুর্তে কোনো বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত না!

আবরার ঠোঁট বাকা করে বলে –
– কিন্তু নির্জনের মা তো ভীষণ করে আমাকে বললো তোকে সে তার দ্বিতীয় মেয়ে হিসেবে চায়।

তোহা শান্ত গলায় বলে-
– নির্জন সাহেব কি এই কথা জানে?
– হয়তো না! আবার হয়তো হ্যাঁ!

তোহা আর কিছুনা। ভাতের পাতে পানি ঢেলে উঠে যায়। ধিমি পায়ে চলে আসে নিজের রুমে।

শেফার ভীষণ রাগ হয়। আবরারের দিকে দাতে দাত চেঁপে বলে-
– এই,তোহা যখন চাচ্ছে না করতে ব্যস করবে না। মেয়েটাকে শান্তিতে দুটো খেতেও দিবেনা!!!
আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
– তোমার আবার আজ কি হলো! এত রাগ দেখাচ্ছো কেন?
শেফা আরো রেগে বলে-
– তো কি চুমু দিয়ে কথা বলবো? দু লোকমা খেতেও দিলে না মেয়েটাকে। কি দরকার ছিল এখন এসব কথা তুলার! আজ কতদিন পর মেয়েটার মন টা সুন্দর হয়েছিল আর তুমি!! ধুরঃ!

শেফাও নিজের ভাতের পাতে পানি ঢালে। রাগে গজগজ করতে নিজের রুমের দিকে এগোয়। একা টেবিলে বসে থাকে আবরার। তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে এই মা মেয়ের ঘটনা। কি হলো দুজনের!! সে তো আর বলেনি বিয়ে টা করতেই হবে!!
উফ এদের নিয়ে আর পারা গেলো না…
নির্জনের মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। তার অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের সংসার হারালে চলবে না। কিছুতেই না…….
.
.
তোহাকে চুপ করে বসে থাকতে লিমন বারবার ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। তোহা লিমনের হাবভাব দেখেও কিছু বলে না। লিমন ভাবে সে কি কিছু করেছে আজ! তোহা রেগে আছে কেন! উম,নাহ কিছু তো মনে পড়ছে না। তাহলে কি তোহাকে জিজ্ঞেস করবে? যদি আবার মারে…..!
উফ লিমন বাবাজি,বউকে এত ভয় পেলে চলবে!? মারুক না,দুটো মারুক৷ একদম তো আর মেরে ফেলবে না।

লিমন আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে।

– তোহা,ও তোহা। আমার তাহুপাখি টা…জানুপাখি টা…কলিজার অর্ধেক….

লিমন পুরো বাক্য শেষ করার আগেই তোহা খপ করে লিমনের কলার চেঁপে ধরে। চোখ পাকিয়ে বলে-
– কলিজার অর্ধেক কেন? বাকি অর্ধেক কাকে দিয়েছিস?

লিমন থতমত খায়। আমতা আমতা করে।

– না না,আমার পুরো কলিজা টা… কি হয়েছে গো তোমার কলিজা। আপসেট দেখাচ্ছে যে আমার বাবুটাকে!

তোহা লিমন কে ছেড়ে দিয়ে আবার আপসেট হয়ে বসে থাকে। আপসেট গলায় বলে-
– বাবা আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে! ঐ যে নির্জন আছেন না,উনার মা নাকি আমাকে তার ছেলের…..

লিমন চোখ বড় বড় করে ফেলে।

– তোহা, ও তোহা। ফাইজলামি করছো? প্লিজ এরকম মজা করো না।

তোহা আড়চোখে চায় লিমনের দিকে।
লিমন হুরমুরি খেয়ে তোহার সামনে হাটু গেড়ে বসে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে-
– সকাল বেলা গরম পরোটা আর ভাজি করে খাওয়াবো। দুধ চা,রঙ চা,অপরিজিতা চা,গোলাপী লাল নীল যেই চা-ই বলবা সব হাজির করে দিবো। দুপুরে তোমার পছন্দের আইটেমের রান্না করবো। সন্ধ্যা হলেই কফি পেয়ে যাবা। স্ট্রং কফি। বলাও লাগবে না পাক্কা। আর রাতে.. যা বলবা তাই। আই মিন,তুমি যা বলবা তাই পাবা। তাই করবো। জাস্ট আমাকে ছেড়ে… আমাকে ছেড়ে…

লিমন আর বলতে পারে না। গলা ধরে আসে তার। হুহু করে কেঁদে ফেলে সে।
তোহা তাচ্ছিল্য করে বলে –
– আল্লাহ তোমাকে মেয়ে কেন বানালো না! এত ফ্যাচফ্যাচানি আমিও করতে পারিনা যতটা তুমি পারো!
লিমন কিছু বলে না। কান্না আরো বাড়িয়ে দেয়।

তোহা হাত ধরে ঝাকি মেরে বলে –
– হইছে। চুপ। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। কোথাও না।চুপ একদম চুপ।

ঝাড়ি খেয়ে লিমনের কান্না থেমে যায়। তোহা লিমনের ভেজা চোখ মুছে দিতে দিতে বলে-
– আমি জানি,তোমার সাথে ফিউচার নেই। আমাদের হয়তো কোনোদিন বাচ্চাও হবে না নিজেদের! কিন্তু…তোমার জন্য আমার ফিলিংস সত্য। আমরা এভাবেই থাকবো আজীবন।কথা দিচ্ছি।

লিমনের টনক নড়ে। আসলেই তো!
সে এটা কেন ভেবে দেখেনি!
.
তোহাকে যখন প্রথমবার এক কুয়াশা ভরা সন্ধ্যায় ছাদে বসে থাকতে দেখে, লিমন হুট করেই তার প্রেমে পড়ে যায়। সে চায়নি তোহাকে তা জানাতে,চেয়েছিল দূর থেকেই তোহাকে ভালোবাসতে। কিন্তু…
গোলাল দিতে যেয়ে এক মাঝরাতে তোহা তাকে দেখে ফেলে। ধরে ফেলে।
তারপর…ভালোবাসার মতো বিশুদ্ধ গোলাপের সৃষ্টি হয়।

তোহা কে সে সুখী রাখতে পারবে,তোহার জৈবিক চাহিদাও সে পূরন করতে পারবে। কিন্তু বাচ্চা!!
সেটা তো অসম্ভব। ভূতের কখনো বাচ্চা হয় না।
আর তোহা একটি মেয়ে। প্রতিটি মেয়েরই কাম্য তার স্বামী সংসার আর বাচ্চা নিয়ে একটা সুখের পরিবার গড়ে উঠুক। তোহাকে সেই খুশি থেকে কেন বঞ্চিত করবে লিমন তবে? শুধুমাত্র তোহাকে ভালোবাসে বলে?
ভূতদের ভালোবাসতে নেই। আসলেই নেই….
কিন্তু লিমন ভালোবেসেছে। আর এখন সেই ভালোবাসা প্রমানের সময় এসেছে। লিমন মনে মনে ভাবে,’দূরে থেকেও কাউকে ভালোবাসা যায়। ভীষণ ভাবে যায়।’
.
তোহা লিমনের গাল দুহাতে চেঁপে ধরে বলে –
– কি ভাবছো?
লিমন সম্বিত ফিরে পায়। তোহার হাত তার গাল থেকে সরিয়ে বলে-
– একটা কথা বলবো তোহা? বলো রাখবে।

তোহা কপাল কুঁচকায়।

– কি কথা?
– বলো রাখবে।প্রমিস মি।
– আগে তো বলো…
– উঁহু না। আগে প্রমিস করো যে তুমি তা রাখবেই।

তোহা ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। কি এমন কথা যেটা আগে প্রতিজ্ঞা করতে হবে! এরপর শুনতে হবে!

তোহা সাতপাঁচ ভেবে বলে-
– আচ্ছা,প্রমিস। বলো।

লিমন তোহার থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে বলে-
– নির্জন কেই বিয়ে করো তোহা। আমার জন্য হলেও করো। মানা করো না প্লিজ।

তোহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পায়ের তলার মাটি সরে যায়। কি বলছে এসব লিমন! মাথা ঠিক আছে তো ওর!!

তোহা রাগী গলায় বলে –
– আর ইউ কিডিং উইথ মি??

লিমন শান্ত গলায় বলে –
– নো,আই এম নট। আমি ভেবেই বলছি। নির্জন কেই বিয়ে টা করে নাও।
– কিন্তু কেন? হোয়াই?
– কারন আমি তোমায় সব দিক থেকে সুখী করতে পারবো না। একটা সুন্দর পরিবার সৃষ্টি করতে যেমন একজন স্বামী এবং স্ত্রীর প্রয়োজন তেমনই একটা সন্তানের প্রয়োজন। যা আমি তোমাকে কোনোভাবেই দিতে পারবো না। কোনো ম্যাজিক করেও না।

লিমনের গলা কাঁপছে। তার চোখ ছলছল করছে। সে ভেতরে ভেতরে ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছে।
তোহা লিমনের মনের অবস্থা টা বুঝতে পারে।

আচমকাই লিমন কে জড়িয়ে ধরে। লিমনের বুকে মাথা রেখে বলে-
– এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে সন্তান নেই কোনো। অনেক মহিলা আছে যারা সন্তান জন্মদানে অক্ষম। তাদের কে নিয়েও অনেকে সুখের সংসার করে যাচ্ছে। সংসার করতে সন্তানের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় দুটো মানুষের ভালোবাসার। যা আমাদের ভিতর যথেষ্ট আছে। বুঝেছো বকুরাম? আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না। কোথাও না। কারো কাছে না।

তোহা শক্ত করে লিমন কে জড়িয়ে ধরে। লিমনের চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। আচ্ছা,এত সুখ তাদের কপালে সইবে তো!?

.
.
নির্জনের সাথে কফিশপে বসে আছে তোহা ও মিলি। তোহা মিলিকে সবটা জানাতে মিলিই বলে নির্জনকে ডাকতে। সে কথা বলবে।

মিলি আপাদমস্তক দেখে যাচ্ছে নির্জনের। বেশ হ্যান্ডু আছে ছেলেটা!তোহার জায়গায় সে থাকলে একপায়ে খাড়া হয়ে যেতো একে বিয়ে করতে। কিন্তু… তোহা তো জীবনেও একে বিয়ে করবে না।

মিলি গম্ভীর গলায় বলে –
– আপনার মা যে কি কান্ড ঘটিয়েছে,জানেন নাকি?

নির্জন ও গম্ভীর ভাবেই বলে-
– জানি। আসলে মা যে কখন তোহাকে দেখেছে! কে জানে। আমাকে না বলেই সে তোহার বাবাকে খুঁজে বের করে এসব বলেছে। আমি পরে জানতে পেরেছি।
– তাহলে আপনার এবার করণীয় কী?
– আসলে আমার নিজের কোনো চয়েজ নেই। যদি তোহা ম্যাম ও রাজী থাকে,তাহলে আমার আপত্তি নেই।আর সে রাজী না থাকলেও সমস্যা নেই। আমি মাকে বলে দিবো।

তোহা ফট করে বলে ফেলে-
– আমি রাজী না। আই হ্যাভ মাই লাভ।

নির্জন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না!
মিলি নির্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে-
– তোহা তো বলেই দিলো। এবার যান,আপনার মাকে বলুন। এবং এই বিয়ে ক্যান্সেল করুন।

নির্জন কিছুক্ষণ ভেবে বলে-
– আমি ভাবছি অন্যকথা। মাকে তো বলবো কিন্তু মা যে কি করবে! আগে থেকেই দু চারজন হুজুর এবং কিছু ফকির মিসকিন রেডি রাখতে হবে।উফফ! কি যন্ত্রণা…

মিলি উৎসুক চোখে বলে-
– হুজুর,ফকির মিসকিন!! হোয়াই?
– না না। ওসব কিছুনা।
– উঁহু না বলুন। শুনতে চাই।

নির্জন আশে পাশে তাকিয়ে নিচু গলায় বলে –
– আমার মা ভীষণ জ্বিনে বিশ্বাসী। তিনি ভাবেন পৃথিবীতে যাই হয় উলটা পালটা সব জ্বিনের কাজ কর্ম। আমি যদি যেয়ে বলি আমি বিয়ে করবো না বা তোহা রাজী না,সে ভাব্বে এতেও জ্বিনের কিছু মতলব আছে। তারপর ডাকবে হুজুর আর কিছু ফকির মিসকিন। খাওয়াবে তাদের! যাতে জ্বিনের নজর উতরে যায়।

মিলি হোহো করে হেসে বলে –
– ইন্টারেস্টিং তো!
আপনার মার সাথে আমি দেখা করবো। আর আমিই বলবো তোহার সাথে আপনার বিয়েটা হচ্ছে না। কিন্তু একটু অন্যরকম ভাবে….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here