ভৌতিকপ্রেম,পর্বঃ৭,৮
Mahfuza_Monira
পর্বঃ৭
বিকেলের দিকে মিলি আর বিধান তোহার রুমে আসে। বেলকনিতে পাতা সোফায় আরাম করে বসে তারা। লিমন ও তোহা পাশা পাশি বসে।
সবার উদ্দেশ্যে তোহা বলে –
– আমি আর লিমন ঠিক করেছি যে আমরা সরকারের কাছে এই অপরাধীদের ফন্দি ফাঁস করবো কিন্তু তার জন্য দরকার প্রমান। আর তাই কাল সকালে আমরা বিছানাকান্দিতে আবার যাবো। সেই পানির অতলে যাবো। একটা না একটা প্রমান তো নিশ্চয়ই পাবো।
মিলি আৎকে উঠে বলে-
– পানির গভীরে যাবো??
তোহা মুচকি হেসে বলে –
– হ্যা।
বিধান পালটা প্রশ্ন করে,
– কিন্তু যাবো কিভাবে?
লিমন তুরি বাজিয়ে বলে-
আমি থাকতে টেনশন কেন নিচ্ছো তোমরা? জলপরী কিভাবে সাতার কাটে জানো তো? সেটুকু জানলেই হবে। বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দাও।
বিধান আর মিলি বাহির থেকে ভয় ভয় দেখালেও ভিতরে ভিতরে তারা অনেক এক্সাইটেড। যাক,কাল তাহলে নতুন একটা এডভেঞ্চার হবে,নতুন কিছুর স্বাদ গ্রহণ করা যাবে।
.
.
রাত ৮ টা।
করিডোড়ে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিল মিলি। সেখানে রিনি এসে নিজে থেকেই বলে-
– তোহা কেমন আছে? ঠিক আছে ও?
মিলি আরেক চুমুক খেয়ে বলে-
– এত যখন চিন্তা নিজে গিয়ে প্রশ্ন করলেই পারো।
– কেন কথা বলবো ওর সাথে আমি? সামান্য কয়েকদিনের একটা ভূত কে ভালোবেসে আমাকে ভুলে গিয়েছে! সেই ছোট থেকে ওর সুখ দুঃখে আমিই তো ছিলাম আর আজ ঐ ভূতের বাচ্চা ওর কাছে আমার থেকেও বড়!! কোনো কথা বলবো না ওর সাথে কোনো কথা না।
মিলি বাকি টুকু কফিও এক চুমুকে শেষ করে ঘুরে দাঁড়ায় রিনির দিকে। তারপর বলে-
– ভালোবেসেছো কাউকে? যেদিন বাসবে সেদিন বুঝবে যে ভালোবাসা কী হয়। ভালোবাসা না মানে ধর্ম,না জাত। হুট করে কিভাবে একটা মানুষের প্রতি ভালবাসা জন্মে যায়,সেটা স্বয়ং সেই বলতে পারেনা! তবে লিমনের ব্যাপার টা বাদ দিলাম।কালকে আমরা বিছানাকান্দি কে বাঁচানোর প্রথম মিশনে যাচ্ছি। সেখানে তোমাদের ও যাওয়া উচিত ছিল। দেশ টা আমাদের সবারই। সেখানে পারসোনাল রিলেশন টেনে আনাটা কি ঠিক? হয়তো ঠিক! তাইতো এমন করছো তুমি। সাথে নেই আমাদের। যাইহোক,ঘুমাতে গেলাম আমি। সকালে ৬ টায় একটু ডেকে দিও কষ্ট করে। আমার আবার ঘুম ভাংতে চায় না সহজে! গুড নাইট।
মিলি চলে গেলে রিনি একা একাই দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে পড়ছে তাদের ছোট বেলার কথা।
টিভির রিমোটের জন্য কত মারামারি, একে অন্যের চুলের ক্লিপ ভেঙে ফেলা,লুকিয়ে অন্যের লিপস্টিক, মেকাপ ব্যবহার করা কত স্মৃতি তাদের। অথচ আজ কত দূরে দূরে লাগছে দুজনকে!!
রিনির ভীষণ কান্না পায়। দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠে সে।
.
.
.
রাতের আকাশ আজ নিকষ কালো। চাঁদ নেই, তারা নেই। অন্ধকারেও মেঘের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে। তোহা বেলকনি দিয়ে মেঘ ভেসে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে।
লিমন রাতের খাবার নিয়ে এসেছে আজ। সেটা টেবিলের উপর রেখে তোহার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশের পানে তাকিয়ে বলে
– ওদের কে সব টা বলা উচিত হয়নি হয়তো। কেইবা মেনে নিবে একজন ভূত কে! ভূতের তো ভালোবাসতে নেই!! কিন্তু আমি যে বেসে ফেলেছি সেটাই আমার অপরাধ। আমার জন্য তোমাকেও কষ্ট পেতে হচ্ছে তোহা। আই এম সরি।
তোহা ঘুরে লিমনের দিকে তাকায়। দুহাতে লিমন কে আঁকড়ে ধরে বলে –
– ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি। তোমায় বড্ড ভালোবাসি। তাই বলে দিয়েছি ওদের। সময় দাও সবাইকে। আমার বিশ্বাস ওরা মেনে নিবে সবটা৷ দেখে নিও।
লিমন তোহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে-
– তাই যেন হয় তোহা। তাই যেন হয়।
.
.
সকাল ৬ টা।
বিধান মিলি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর লিমন আর তোহাও আসে সেখানে। এখন লিমন কে তোহা ছাড়াও বিধান আর মিলিও দেখতে পায়। ওরা আসতেই বিধান বলে-
– কাপলদের ঘুম সহজে ভাংতেই চায়না! শালা আমার কপাল!!! ভূত হয়েও ভাই কত্ত ভালো প্রেম করছো আর আমি মানুষ হয়েও একটা জুটাতে পারলাম না।
তারপর একটু ঝুকে গিয়ে লিমন কে ফিসফিস করে বলে –
– ভাই,ভূতরাজ্যে তোমার জানা শোনা কেউ আছে? আই মিন মেয়ে! আমার নাম্বার টা তাকে দিও! একটা প্রেম করার ভীষণ ইচ্ছা।
বিধান ফিসফিস করে বললেও তোহা আর মিলি সবটা শুনতে পায়। তারা দুজনেই একসাথে চেঁচিয়ে বলে-
– রুমি…….
বিধান রুমির নাম শুনতেই চুপ হয়ে যায়।তা দেখে লিমন বলে
– রুমি কে?
– আর কে? গত ৪ বছর ধরে এই জনাবার পেছনে ঘুরঘুর করে আমাদের লিমন বাবা। কিন্তু ফলাফল শূন্য… (তোহা)
লিমন চিল্লিয়ে বলে-
– তোকে এতো পাকনামি করতে হবে না। উঠ,গাড়িতে উঠে বস।
.
তোহারা সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই যখনি বিধান গাড়ি স্টার্ট দিবে ঠিক তখনি রিনি আর শীষ আসে সেখানে। মিলি কে বলে-
– আমাদের নিয়ে যাবে না নাকি?
মিলির উত্তরের অপেক্ষা না করে ওরা দুজনেই উঠে বসে গাড়িতে। তা দেখে সবাই অবাক হয়। বেশি অবাক হয় তোহা। সাথে খুশিও হয়। তার মানে ওরাও কি মেনে নিয়েছে সবটা?
তোহা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই রিনি বলে-
– আমি কারো ভালোবাসা মেনে নেইনি। শুধু এই কাজ টা আমাদের দেশের ভালোর জন্য,তাই সাথে যাচ্ছি। যা করছি দেশের জন্য করছি। অন্য কারো জন্য নয়।
কথাটা শুনে তোহা গম্ভীর গলায় বিধান কে বলে-
– গাড়ি স্টার্ট দে।
.
.
খুব দ্রুতই চলে আসে ওরা বিছানাকান্দি তে। আশপাশ টা প্রায় জনমানব শূন্য। তোহা সবাইকে বেস্ট অফ লাক জানায়। তারপর লাফিয়ে পড়ে বিছানাকান্দির পানিতে। পার ধরে ধরে হেটে যায় সেই পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। তার দেখাদেখি বাকিরাও তাই করে। শুধু বারবার শরীর কেঁপে উঠে মিলির। মনে মনে ভাবে “না জানি দেশকে বাঁচানোর চক্করে নিজেই না শহীদ হয়ে যাই। আগে এই ঠান্ডা বরফ পানি থেকে উদ্ধার করি নিজেকে বাকিটা পরে দেখা যাবে!”
.
.
পাহাড়ের কাছে যেতেই স্রোত বেড়ে যায়। পানির গভীরতা বেড়ে যায়। সবাই আর উপায় না পেয়ে সাতার কাটা শুরু করে। একদম পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটু শুকনো জমি। সেখানেই উঠে দাঁড়ায় সকলে।
লিমন সবার উদ্দেশ্যে বলে-
– আগে আমি তোহাকে মৎস্যকন্যা বানাচ্ছি। ওর দেখাদেখি বাকিরাও তাই করবে।
.
তোহা হাসি হাসি মুখ করে চোখ বন্ধ করে। ইশ! আরেকবার মৎস্যকন্যা হবে। ভাবতেই কি যে আনন্দ হচ্ছে তার!
২ মিনিট অতিক্রম হয়। একটা ঘন ধোয়া তোহাকে ঘিরে ধরে আর সবার চোখের সামনেই তোহা মৎস্যকন্যায় রূপান্তরিত হয়। তোহা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। সেই জমির উপর থেকেই ধাপ করে লাফিয়ে পড়ে পানিতে।
ওর দেখাদেখি বাকিরাও তৈরি হয়ে নেয় মৎস্যকন্যা হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।
লিমন একে একে সবাইকে মৎস্যকন্যা বানিয়ে দেয়। একে একে সবাই লাফিয়ে পড়ে পানিতে। লিমন ও পানির গভীরে চলে যায় ওদের সাথে।
প্রথমে সবাই বেশ ভয় পেলেও এখন ভয়টা কেটে গেছে। মৎস্যকন্যা হয়ে সাতার কাটার মজাই আলাদা। যেটা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
বিধান বলে-
– হে আল্লাহ, একটা মৎস্যকন্যা দিয়ে দিও লাইফে। আর কোনো মেয়ে লাগবে না। এখানেই সংসার করে আজীবন রয়ে যাবো।
বিধানের কথা শুনে মিলি অবাক হয়ে বলে-
– আমরা পানির নিচে কি সুন্দর কথা বলতে পারছি!
শীষ ও তার কথায় সায় দিয়ে বলে-
– শ্বাস ও নিতে পারছি!!
তাদের কৌতূহল দেখে তোহা বলে-
– আমরা মানুষ নই এখন।বাহির ভেতর সব দিক থেকেই আমরা জলপরী। সো জলপরীরা যা যা পারে আমরাও তাই তাই পারবো। এবার কথা না বলে সবাই গভীরে যেতে থাকো। ফলো মি।
তোহা আর কিছু না বলে গভীরে হারিয়ে যেতে থাকে। তাকে উদ্দেশ্য করে বাকি সবাইও যায়।
প্রায় ১৫ মিনিট ক্ষিপ্র গতিতে সাতার কাটার পর তারা একদম মাটির কাছাকাছি পৌঁছে। কিন্তু সেখানে কিছুই নেই।
তোহা বলে
– এখানেই ছিল সাবমেরিন টা,মানুষ গুলা। আমি এখানেই দেখেছি তাদের।
লিমন সবাইকে আশেপাশে খুঁজার নির্দেশ দিতেই সবাই আশেপাশে খুঁজতে শুরু করে। হঠাৎ শীষ চাঁপা গলায় বলে-
– ইউরিকা,ইউরিকা। পেয়েছি আমি কিছু পেয়েছি।
সবাই জলদি শীষের কাছে যায়। তারা দেখে মাটির উপরে একটা দরজা। লিমন সেই দরজা ধরে টান দিতেই সেটার মুখ হা হয়ে যায়। সবাই একে অপরের হাত ধরে সেটার ভেতর ঢুকতে শুরু করে।
(চলবে)
ভৌতিকপ্রেম
পর্বঃ৮
লেখা – Mahfuza_Monira
দরজার ভেতর টা ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যায়না। তোহার শরীর টা বারবার কেঁপে উঠছে ভয়ে। সে লিমনের শার্টের কোণা খামচে ধরে বলে –
– লিমন লাইটের ব্যবস্থা করো। নয়তো আর এক পাও আগাবো না আমি। আমার অন্ধকার ফোবিয়া আছে। আমি অন্ধকার সইতে পারিনা।
লিমন “কিছু করছি” বলেই নিজের ডান হাত টা উচু তে নেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে কিছু বিরবির করে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে লিমনের হাতে খুব পাওয়ারফুল একটা টর্চলাইট এসে হাজির হয়। এতটাই পাওয়ার তার যে এত গভীরেও প্রায় কয়েকশো গজ দূরের জিনিসও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার সাহায্যে।
তোহার মুখের কোণে হাসির রেখা দেখা যায়। সে লিমন কে ধাক্কা মেরে বলে-
– আসলেই ভূত বয়ফ্রেন্ড থাকা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। যেটা সব্বার থাকে না…
.
বিধান লিমন কে প্রশ্ন করে।
– আচ্ছা ভাই, আপনি কি জীবিত থাকতে জাদুকর ছিলেন? না মানে,এত জাদু কোথা থেকে করেন বুঝে আসে না!
লিমন অস্ফুট হেসে বলে –
– মৃত্যুর পর কম বেশি সবার কাছেই কিছু না কিছু প্রকৃতিগত শক্তি চলে আসে। মানে জাদু চলে আসে। এই যেমন, গায়েব হয়ে যাওয়া,হাওয়ায় উড়তে পারা এমন। কিন্তু সবার কাছে আমার মতো এত জাদু থাকে না। মানুষের মধ্যে যেমন কেউ অধিক সম্পদশালী থাকে আবার কেউ গরীব থাকে ঠিক তেমন মৃত্যুর পরেও কারো কারো কাছে স্পেশাল পাওয়ার থাকে। যেমন টা আমার কাছে আছে।
সবটা শুনে বিধান এমন ভাবে মাথা নাড়ায় যে হ্যাঁ সে সব বুঝেছে।
.
.
লাইট চারিদিকে ছুড়ে মেরে দেখে তারা একটা লম্বা করিডোরে দাঁড়িয়ে। তোহা করিডোর ধরে আগানোরই সিদ্ধান্ত নেয়৷ আবারো সবাই একে অপরের হাত ধরে। যদিও এবার লাইট আছে,তাও সাবধানতার জন্য সবাই একে অপরকে ধরে ধরেই সামনে আগায়।
.
.
প্রায় ৭ মিনিট যাওয়ার পর হঠাৎ রিনরিনে স্বরে কারো কথা শোনার আওয়াজ পাওয়া যায়। সবাই একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে। রিনি হাত দিয়ে ইশারা করে যে আওয়াজ টা করিডোরের একদম শেষ মাথা থেকে আসছে। এবার আগের থেকে আরো স্লো স্লো চলে তারা। চোখ কান খুলে রেখেই সামনের দিকে এগোয় তারা।
২ মিনিট যেতেই করিডোরের মাথায় একসাথে ৭ টা দরজা পায়। ৪ নাম্বার দরজার ভেতর থেকে সেই রিনরিনে গলার আওয়াজ টা আসছে। লিমন কান পাতে। ওপাশে কী হচ্ছে তাই শোনার জন্য।
ভেতর থেকে কেউ চাঁপা গলায় বলছে-
এখনো আসছে না কেন ওরা! কখন আসবে! আর এতই বা দেড়ি করছে কেন! উফফ,আর তর সয় না। কবে যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পানির নিচে গুপ্ত পথ করতে পারবো কে জানে! চট্টগ্রাম দিয়ে তো আসাই যায়না এখন৷ তবে এই জায়গায় যদি একটা গুপ্ত পথ বের করতে পারি,তবে আর চোরাই মাল নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবেনা আর ড্রাগস গুলোও খুব সহজেই বাংলাদেশের ভেতর নিয়ে আসা যাবে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে।
এতটুকু শুনতে পারে লিমন। হঠাৎই কারো আসার শব্দ পায় তারা। একজন না,প্রায় দলবল বেধে অনেকজন। কথা বলতে বলতে আসছে।
তোহার মনে প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা তারা কি করে কথা বলছে? তাহলে কি তারাও আমাদের মতো মারমেইড! সত্যিকারের মারমেইড!?
পরমুহূর্তেই আবার ভয় জাগে৷ এখন তো ধরা খেয়ে যাবো। আমাদের দেখে ফেলবে তারা। তারপর যদি মেরে ফেলে আমাদের! ইশ কি যে হবে!?
সবাই একসাথে একে অপরের কে ধরে ওভাবেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের চোখ সামনের দিকে। এখনো সামনে থেকে কথার শব্দ আসছে। কিন্তু তারা এসে এখনো পৌঁছায় নি।
হঠাৎ…
কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই অপর একটা দরজা খুলে যায়৷ কেউ বের হয়ে তোহার হাত ধরে হ্যাচকা টান মারে। তোহার আরেকহাত লিমন ধরে ছিল বিধায় লিমন ও টান খায়। লিমনের সাথে বিধান,বিধানের সাথে মিলি, মিলির সাথে রিনি, আর রিনির সাথে শীষ,একে একে সবাই টান খেয়ে সেই দরজার ভেতরের রুমে ঢুকে পড়ে। আর সাথে সাথেই দরজা টা আটকে যায়।
ভেতর টা একদম অন্ধকার। তোহা ভয়ে প্রায় আধমরা হয়ে গেছে। তোহা অস্ফুটস্বরে লিমন কে ডাক দিতে নিলেই কেউ ফিসফিস করে বলে –
– হুউউউউউশ… কথা বলো না। চুপ করে থাকো কিছুক্ষন।
তোহা চুপ হয়ে যায়৷ বাকি সবাই ও অন্ধকারের ভেতর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সবাই অপেক্ষা করতে থাকে এই অন্ধকার শেষ হয়ে নতুন আলো দেখার। সবাই দোয়া করতে থাকে যেন এখানেই চিরজীবন আটকে না যায়। যেন আরেকবার পৃথিবীর নতুন সূর্য দেখার সুযোগ পায়।
.
দরজার বাহিরে সেই দলবলের আওয়াজ স্পষ্ট। তারা কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে করতে লিমন যেই দরজায় কান পেতেছিল সেই দরজায় ঢুকে দরজা আটকে দেয়। তোহা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
তখনি কেউ টর্চ জ্বালায়। সবাই দেখে একজোড়া বাদামী চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ডুবুরির স্যুট পড়া লোকটা।
সে সবাকে উদ্দেশ্য করে বলে-
– মাথা খারাপ তোমাদের? এখানে মরতে এসেছো? জানো এই লোকেরা কত ডেঞ্জারাস? বড় বড় পুলিশ অফিসার রা পর্যন্ত এদের এড়িয়ে চলে। একবার যদি তোমাদের ব্যাপারে জানতে পারেনা,তাহলে রেহাই পাবে না একজনও। এই পানিতেই তোমাদের মাংস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে চারিদিকে।
কথাটা শুনতেই রিনির গা শিরশিরেই উঠে। সে এখন মনে মনে ভীষণ কড়া ভাবে গালিগালাজ করছে নিজেকে। কেন যে এসেছিল এইখানে মরতে কে জানে!!
মরলে তোহা মরুক লিমনের জন্য,কিন্তু সে কেন মরবে!!
রিনির আপন চিন্তার ঘোর কাটে বিধানের করা প্রশ্নে।
বিধান লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে-
– আপনি কে?
লোকটি এবার সবার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে –
– আমি আবিদ। সিলেট শহরের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। অনেকদিন যাবত শুনছিলাম এই পানির নিচে কিছু তো আছে। তাই আজ খোঁজ করতে আসলাম। আর তোমাদের পেয়ে গেলাম এখানে। কিন্তু তোমরা তো মানুষ! এভাবে জলপরী সেজেছো কিভাবে? অহ! বুঝেছি। এগুলো জলপরীদের মতো জামা কাপড় তাইনা? বাহ বাহ বেশ তো! সাইন্স কোথা থেকে কোথায় গিয়েছে! কতকিছুই না আবিষ্কার হচ্ছে!
কিন্তু আমাকে এটা বোঝাও তোমরা কোনো অক্সিজেন না নিয়েও কিভাবে শ্বাস নিচ্ছো?
বিধান হয়তো সত্যিটাই বলতে যাচ্ছিল আবিদ কে। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে তোহা বলে-
– ঐ যে বিজ্ঞানের অবদান। ভেবে নিন এটাও বিজ্ঞানের কারিশমা। বিজ্ঞানের মাধ্যমেই একটা ঔষধ পেয়েছি যেটা সেবন করলে পানির নিচেও শ্বাস নেওয়া যায়।
আবিদ অবাক হয় কথাটা শুনে। পরমুহূর্তেই স্বীকার করে বিজ্ঞান আসলেই জীবনটাকে একদম জাদুর জীবন করে তুলেছে।
এরপর তারা সবাই টুকটাক কথা বলে একসাথেই বেরিয়ে আসে সেই করিডোর ধরে।
পানির উপরে সেই পাহাড়ের পাশে থাকা শুকনো জমিতে গিয়ে উঠে সবাই। বিধান ওখানেই শুয়ে পড়ে। শরীর আর চলেই না তার।
উপরে উঠে আবিদ তার ডাইভিং স্যুট খুলে ফেলে। একটু জিরিয়ে বলে-
– তোমরা তোমাদের পোশাক খুলছো না কেন?
মিলি বলে-
– হ্যাঁ খুলবো খানিকবাদে।
আবিদ সবার সাথে পরিচিত হয়। শুধু লিমন ছাড়া। লিমনও এগিয়ে যায় না নিজ থেকে পরিচিত হতে। কেননা সে ভাবে আবিদ তাকে দেখতে পারছে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আবিদ লিমনের দিকে হাত উঁচিয়ে বলে-
– তোমার নাম তো বললে না!
লিমন তোহা দুজনেই থ!
তোহা আমতা আমতা করে বলে-
– তুমি ওকে দেখতে পারছো?
– হ্যাঁ কেন পারবো না! আমার চোখ কি নষ্ট নাকি!
এবার আরো অবাক হয় তোহা। লিমন নিজ থেকে কাউকে দেখা না দিলে কেউ তাকে দেখতে পারবেনা। তাহলে আবিদ দেখছে কিভাবে!!
লিমন এগিয়ে এসে শুকনো হাসি হেসে বলে-
– হাই আমি লিমন।
– হাই আমি আবিদ! আগেই জেনেছো।
বলেই আবিদ তার হাত বাড়িয়ে দেয়।।লিমন ও হ্যান্ডশেক করে। আবিদের হাতে নিজের হাত রাখতেই লিমন কিছু অনুভব করতে পারে। সে ভ্রু কুঁচকে আবিদের দিকে তাকিয়ে দেখে আবিদের ঠোঁটের কোণায় রহস্যময় হাসি।
.
.
পরেরদিন…
কাল তো ছিলাম ভালো
আজ আমার কি হলো
সে কথা কইতে পারিনা
একলা রইতে পারিনা……
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একা একাই মনের সুখে গান গেয়ে যাচ্ছে রিনি।
চোখ বন্ধ করে আবিদকে ভেবে চলেছে সে।
লম্বা,ফর্সা,চুল গুলো বাদামী লালচে, চোখ দুটো একদম হলুদ বাদামী। এতটাই ফর্সা যে শরীরের ভেতর বয়ে চলা রক্তও উপর থেকে দেখা যায়। চামড়া এতটাই পাতলা যেন একটু ধরলেই ফেটে যাবে।
রিনি চোখ দুটো খুলে ফেলে। আপনমনেই বলে –
– এ কি হলো আমার! এভাবে কারো জন্য কখনো হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়নি। কাউকে শয়নে স্বপনে দেখিনি। কারো কথা ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়নি। তাহলে এটাই কী প্রেম? এটাই কী ভালোবাসা?
(চলবে)