মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ৭,০৮
তানিয়া রহমান
০৭
ইরিন রুমে এসে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পরলো। না চাইতেও অবাধ্য চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। মেহবুব রুমে এসে ইরিনকে এলোমেলো হয়ে কাঁদতে দেখে তার ভিতরে ঝড় বয়ে গেল। পাশে বসে আবেগ নিয়ে বলল – স্যরি,সকাল থেকে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য সত্যি দুঃখিত।
ইরিন মেহবুবকে জরিয়ে ধরে কান্নার বেগ কমিয়ে বলল- ইটস ওকে
সেতু রুমে এসে এই দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারলো না। তার আপার সংসারে অন্য কারো আধিপত্য মানতে কষ্ট হচ্ছে। ক্ষোভ নিয়ে বলল – দোষ যখন আমার সরিটাও আমাকে বলতে দিন দুলাভাই
সেতুকে দেখে ইরিন মেহবুবকে ছেড়ে সরে বসলো আর মেহবুবও অপ্রস্তুত হয়ে গেল, উঠে দাঁড়িয়ে বলল- কারো রুমে ঢোকার আগে যে নক করতে হয় সেই বোধটাও গিলে খেয়েছো
– দরজা খোলা রেখে ঐ রাস্তার মেয়ের সাথে
মেহবুব কথা শেষ করতে দিল না সেতুকে,ক্রোধে ফেটে পরে বলল- হোয়াট ডু ইউ মিন বাই রাস্তার মেয়ে? তুমি আমার বাসায় দাঁড়িয়ে আমার সামনে আমার ওয়াইফকে অপমান করছো! হাউ ডেয়ার!
জাস্ট গেট লস্ট
বাবার চিৎকার শুনে অপু দৌড়ে এল,মনে মনে বলল” সকাল থেকে কি যে হচ্ছে বাসায় ”
ইরিন লাগেজ থেকে কামিজ বের করে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিল মেহবুব ইরিনের হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বেডে ছুড়ে ফেলে ইরিনকে বলল- আমার বউকে আমি যে পোশাকে চাইবো সেই পোশাক পরবে অন্য কারো ইচ্ছেতে কস্টিউমস চেঞ্জ হবে না।
মেহবুব ঘড় থেকে বেরিয়ে গেল তার পিছনে পিছনে অপুও বের হলো যেভাবেই হোক বাবাকে শান্ত করতে হবে।
সেতু একবার ইরিনের দিকে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করলো।
বাসায় এখন মোটামুটি শান্তি বিরাজ করছে। অপু,মেহবুব আর ইরিন ডিনার করছে। ইরিন প্লেটের ভাত নেড়ে চেড়ে যাচ্ছে কিন্তু মুখে দিচ্ছে না। অপু ইরিনকে খেয়াল করে বলল – খাচ্ছ না কেন আন্টি সারাদিনতো না খেয়েই কাটালে
মেহবুব আর চোখে ইরিনকে দেখে বলল- আম্বিয়া খালা
– জ্বে খালুজান
– এক বাটি চিকেন স্টু বানিয়ে ফেলুন
চিকেন স্টুর বাটি নিয়ে ঘড়ে এসে দেখলো ইরিন ভাবলেশহীন ভাবে সোফায় বসে আছে। মেহবুবকে দেখে ইরিন বলল- হাতে কি
– চিকেন স্টু,নিন ঝটপট খেয়ে নিন
– খেতে ইচ্ছে করছে না
মেহবুব ইরিনের পাশে বসে বলল – হা করুন আমি খাইয়ে দিচ্ছি
– আমকে দিন আমি খাচ্ছি
– উঁ হুঁ, আমি যখন বলেছি আমি খাইয়ে দিব তখন আমিই খাইয়ে দিব
ইরিনের খাওয়া শেষ হলে মেহবুব বলল- এবার আপনি ঘুমিয়ে পরুন আমি আমার রুমে যাচ্ছি
ইরিন দরজা আগলে বলল- সবার অপমান সহ্য করতে পারবো কিন্তু আপনার অপমান নয়,ঠিকঠাক মতো বেডে যান
মেহবুব এ মেয়ের মতিগতি ঠিক বুঝতে পারছে না, তীক্ষ্ণ চোখে ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন বলল- বেডে যাবেন নাকি অপুকে ডাকব
– অপুকে কেন
– বারে আপনার গার্ডিয়ানতো অপুই
মেহবুব হেসে বলল – তাও ভাল আমিতো ভেবেছিলাম — যাকগে
– কি ভেবেছিলেন
– আপনার মাথার তারতো আবার ছেড়া কি থেকে কি বলেন
– কি ছেড়া
– কিছু না ঘুমাতে আসুন
ইরিন মেহবুবের দিকে পাশ ফিরে শুলো আর মেহবুব ইরিনের সঙ্গে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে চিৎ হয়ে শুলো
ইরিন বলল- আপনি নাকি খুব সুন্দর গান জানেন
মনির বলেছে
– মনির আর আমাকে বন্ধুরা ঢুলি গায়েন বলে ডাকতো,মনির খুব ভাল তবলা বাজায় জানেনতো
– একটা গান শোনান সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে
– অনেক দিন গাওয়া হয় না
– তবুও
– হাসবেন না কিন্তু
– হাসবো কেন
মেহবুব দরদ দিয়ে গাইতে শুরু করলো
শেষ করোনা শুরুতে খেলা
না ভেঙ্গো না
দ্বীপ জ্বেলে নিভে দিও না
মন যদি নাহি দাও
মন তবে নিও না —–
– গানটা কি আমার জন্য
মেহবুব ইরিনের দিকে ফিরে বলল- আপনার কি মনে হয়
– আমাকেতো আপনি ওয়াইফ মানতে চাচ্ছেন না তবে রিং পরালেন যে
– হারিয়ে গেলেও যেন স্মৃতি রয়ে যায়
– হারিয়ে যাবেন মানে? ডিভোর্স করবেন
– ঐ জঘন্য কাজটি আমি কখনো করব না, মনিরকে আমি আগেই বলেছি।আপনাকে করতে হবে
– আমিও করবো না, এখন কি হবে
– প্রেমে পরেছেন
– বলতে পারেন
– আমার কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছে না
– কি মনে হচ্ছে
– রিভেঞ্জ নিতে চাইছেন
ইরিন দেয়ালের দিকে মুখ ফিরে বলল- রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পরুন
মেহবুব ইরিনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল- বলির পাঠা আমি কেন হব
– স্বেচ্ছায় এসেছেন
– আমি কিন্তু হিপনোটাইজ করতে জানি
– কাকে
– ঐ যে ছুরি কাচি নিয়ে যে আছে আমাকে বলি দিতে
– ভালোইতো রিভেঞ্জ নিতে সহজ হবে
– আপনি কমিটমেন্ট নষ্ট করছেন
– আমি কি কোন ডিল করেছি আপনার সঙ্গে
– না–
– যে করেছে তার সাথে বুঝুন, তাছাড়া সেই কমিটমেন্ট নষ্ট করছিল থার্ড রিলেশন শুরু করে
– আপনিও কিন্তু তাই করছেন
– মোটেই না,তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই, তার চেয়েও বড় কথা আমরা হাসবেন্ড – ওয়াইফ
– খেলা খেলা সম্পর্কে অভ্যস্থ হতে চাচ্ছেন
– আপনার কাছে খেলা হতে পারে আমার কাছে জীবন
– আমাকে আপনি কতটুকু চেনেন
– যতটা আপনি আমাকে
– অন্ধকারের আমি কিন্তু ভীষণ খারাপ
– আলো জ্বেলে রাখবো
– নিভাতেও জানি
– বেশতো নিভিয়ে আসুন
– রনে ভঙ্গ দিচ্ছেন যে
– সুযোগ করে দিচ্ছি
– মেহবুব কখনো সুযোগ নেয় না অর্জন করে
– আলো জ্বেলে অর্জন করবেন
মেহবুব পাশ ফিরে বলল- সময় হলে দেখতে পাবেন।
চলবে
মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ৮
তানিয়া রহমান
মেহবুব ঘুম ভেঙ্গে দেখলো ইরিন পাশে নেই।এ একমাসে ইরিন তার অভ্যেসে পরিনত হয়েছে, বন্ধুত্ব বেড়েছে তাদের কিন্তু দূরত্ব কমেনি।
মেহবুব ওয়াসরুমে না ঢুকে বেড়িয়ে এল ইরিনের খোঁজে। অদূরে দাঁড়িয়ে দেখলো ইরিন কোমড়ে আঁচল গুঁজে রান্না করছে। ঘেমে পিঠের কাছের ব্লাউজ লেগে গিয়েছে গায়ের সঙ্গে। চুলগুলো পনি টেইল করায় ঘাড় থেকে পিঠ অনেকটা উন্মুক্ত। ঘাম জমে কোথাও আবার মুক্তোর দানার মতো চিকচিক করছে।
মেহবুব কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল
– এখানে কি
আম্বিয়া মেহবুবকে দেখে তটস্থ হয়ে বলল- আমি মানা করছি খালাম্মা শুনে না
মেহবুব ইরিনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল – ঘেমে গিয়েছেন,চেঞ্জ করবেন আসুন
– হাতের কাজ শেষ করে আসছি
মেহবুব আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আম্বিয়া বিদায় নিয়েছে, ইরিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল – আমার আগে কখনো ঘুম থেকে উঠবেন না আমার পছন্দ নয়
– কেন
মেহবুবের বলতে ইচ্ছে করলো তোমায় দেখে আমার দিন শুরু করতে চাই কিন্তু সেটা সে বলল না, সে বলল – আমার ইচ্ছে তাই
– আপনি কিন্তু ভীষণ একরোখা
– আমার বউ হতে হলে আমার মতই চলতে হবে
– ইশ! পারবো না
মেহবুব ইরিনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল,ইরিনের কপালে, নাকে ঘাম জমেছে, গলার কাছটা ভিজা,এ জেন এক নিকটিনের নেশা।এ নেশা কাটানোর উপায় একটাই আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে হৃদয় ক্ষত করা।
– কি দেখছেন
– দেখছি না ভাবছি
– কি
– ঐ যে সবসময় যা ভাবি
– সবসময় কি ভাবা হয়
– লোকে শেষে না আমায় বউ চোর বলে
ইরিন হেসে দিল
অপু কিচেনে এসে মেহবুব আর ইরিনকে দেখে বলল- আম্বিয়া আপা কই
– আমাকে বল (ইরিন)
– টেবিলে ব্রেকফাস্ট দেখছি না আন্টি
– দিচ্ছি বোস,আজ আমি ব্রেকফাস্ট বানিয়েছি
– সত্যি
– হুম, অপুর গাল ছুঁয়ে বলল”আমার মেয়ের জন্য ”
– আর কখনো কিচেনে আসা যাবে না, ঘেমে ঠান্ডা লেগে যাবে (মেহবুব)
অপু ইরিনকে জরিয়ে ধরলো
– একদম ঠিক বলেছে বাবা
মেহবুব অফিসে যাবার জন্য রেডি হয়ে ডাইনিঙে এসে দেখলো ইরিন অপুকে খাইয়ে দিচ্ছে।অপুর মাথার চুল হালকা করে টেনে দিয়ে বলল- নিজে হাতে খাচ্ছ না কেন
– আন্টির আদর নিচ্ছি
– আমি কেন বাদ যাব
– আমার শেষ আন্টি বাবাকে খাইয়ে দাও
মেহবুব ইরিনের পাশে বসে পরলো
– সব্জি দিয়ে দিন
ইরিন মেহবুবকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল – এমন লজ্জায় কেন ফেললেন
মেহবুব আশেপাশে তাকিয়ে বলে – কাউকেতো দেখছি না কাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছেন
কথার ছেদ ঘটিয়ে বেল বেজে উঠলো।মেহবুব বলল- কোন বেরসিক আবার এল
আম্বিয়া দরজা খুলে দিলে মনির ঢুকলো,লিভিং আর ডাইনিং ওপেন হওয়ায় মনিরের চোখ চলে গেল ডাইনিঙে।
ইরিন মেহবুবকে খাইয়ে দিচ্ছে।মনিরের ভিতরটা নড়ে উঠলো এরকম কতশত সুন্দর মুহূর্ত তাদের জীবনে আছে অথচ সে নিজে পিষে নষ্ট করেছে সে ভালবাসা।
মনিরকে দেখে মেহবুব অপ্রস্তত হলো
– তুই! এখানে
– কেন ডিস্টার্ব করলাম
– বোস্
ইরিনের দিকে তাকিয়ে মেহবুবকে উদ্দেশ্য করে বলল মনির – জমিয়ে প্রেম করছিস মনে হয়
অনুরোধের স্বরে মেহবুব বলল- প্লিজ! অপু আছে
– মনির ভাই ব্রেকফাস্ট করুন(ইরিন)
মনির তীর্যক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ইরিনের দিকে, ক্রোধ নিয়ে বলল – আমি ভাই
– হাসবেন্ডের বন্ধুকে তাহলে কি বলবো
পরিস্থিতি সামাল দিতে মেহবুব বলে উঠলো – ইরিন আমার ওয়ালেট আর ফোন এনে দিবেন প্লিজ!
ইরিনের চলে যাবার দিকে মনির তাকিয়ে রইল কিছুসময়
– ওর সমস্যা কি
– আমি নিজেই বুঝতে পারছি না তোকে কি বলবো
– প্রেমে পরেছে তোর
– আমাকে দেখে মনে হয় প্রেমে পরার মত কিছু আছে
– মেয়েরা অদ্ভুত যার মধ্যে কিছু নাই দেখা যায় তার প্রেমেই হাবুডুবু খাচ্ছে
মেহবুব হাসতে হাসতে বলল- কলস ধরিয়ে দিয়ে যা যেন ডুবে না মরে
আকাশে চাঁদ উঠে এসেছে মধ্য গগনে।মিনমিনে আলোয় নদীর জলে পরেছে তার ছায়া, ইরিন নৌকার মাঝামাঝি বসে আছে ছইয়ের কাছ ঘেঁষে আর মেহবুব শুয়ে আছে পাটাতনে দুহাত মাথার নিচে গুঁজে। চাঁদের যে রাঙ্গা আলো নদীর জলে পরে ঢেউ খেলছে তার মাঝ থেকে অঞ্জলি ভরে পানি তুলে মেহবুবের দিকে ছুড়ে দিল ইরিন
মেহবুব চমকিয়ে উঠলো
– এটা কি হলো
– চাঁদের আলোয় ভিজিয়ে দিলাম
মেহবুব উঠে এসে ইরিনের কাছ ঘেঁষে বলল- এ আলোয় ভিজে মন ভরবে না আমার চাই পূর্নিমা
– শুধু চাই,ছুঁয়ে দিতে মন চায় না
– খুউব
– তবে কেন এত আড়াল
– বেড়িয়ে আসুন
– সমুখেই আছি কেবল হাত বারিয়ে দিন
হঠাৎ আকাশের রং বদলে গেল, শরতেও শুরু হলো ঝড়ো হাওয়া, নদীতে ঢেউ বেড়ে গিয়ে নৌকা দুলতে লাগলো।বড় বড় ফোটায় শুরু হলো বৃষ্টি তার সঙ্গে গর্জন।
ইরিনকে নিয়ে ছইয়ের ভিতর চলে এল মেহবুব। বাজের বিকট শব্দে ইরিন মেহবুবের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে- আমি কিন্তু সুইমিং জানিনা
দুহাতে আগলে ধরে ফিসফিস করে বলল মেহবুব – ভয় কি, আমি আছিতো
কোলের মধ্যে টেনে নিল ইরিনকে।পাগল করা আদরে ভরিয়ে দিতে লগলো।
ঘোর লাগা কন্ঠে ইরিন বলল- কি করছেন
– ভালবাসছি
– এখন নয় প্লিজ!
মেহবুবের ঘোর কেটে গেল।তীক্ষ্ণ চোখে ইরিনের দিকে চেয়ে বলল- বাইরে দেখেছেন কেমন ঝড় হচ্ছে, আমার ভিতরেও বইছে,সো এত কাছে আসবেন না আমি বেসামাল হয়ে যাই
– আমিও হতে চাই
– তবে বাঁধা দিচ্ছ যে
ইরিন এ কথার জবাব খুঁজে পেল না
ঝড়ের বেগ কমে এসেছে কিন্তু ইরিনের ভিতর চলছে গঙ্গা যমুনার উথাল পাথাল, তারই ঝাপটা এসে পরলো ইরিনের চোখে। জল টলমল চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো দু ফোটা শিশির। মেহবুব কি বুঝলো কে জানে, চোখের জল না মুছিয়ে কঠিন স্বরে বলল – আমার কাছে আসতে হলে আমার হয়েই আসতে হবে।
চলবে