মধুচন্দ্রিমা পর্ব ৯,১০

0
733

মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ৯,১০
তানিয়া রহমান
০৯

মেহবুব নিজের রুমে শিফ্ট করেছে আজ চার- পাঁচ দিন। কারো সঙ্গে কারো দেখা নেই এমন কি কথাও না।দুজনের মধ্যে চলছে এক অলিখিত ধর্মঘট।
দুজনেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে দরজার দিকে তাকিয়ে, মেহবুব ভাবছে এই বুঝি ইরিন আসবে তাকে ডাকতে আর ইরিন দরজা খুলে রেখেছে যদি মেহবুব আসে।
অপু কিছুটা আঁচ করতে পারছে কিন্তু নিজেকে জড়াতে চাচ্ছে না।তার বুঝতে অসুবিধা হয় না ইরিনকে এরানোর জন্যই মেহবুব ভোরে বেরিয়ে গভীর রাতে ফেরে।ইরিনের প্রতি মেহবুবের এমন উদাসীনতা অপুকে কষ্ট দেয়।

অফিসে নিজের রুমে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকে মেহবুব “প্রেমের বুঝি সত্যি কোন বয়স নেই, সে সব বয়সেই ভীষণ দূরন্ত, চপলা,বাঁধাহীন।এই ষাটের কাছাকাছি এসেও মেহবুব তার ভিতর খুঁজে পাচ্ছে একুশের বাঁধভাঙা জোয়ার। কোন কাজে মন দিতে পারছে না,ঘুমোও বিদায় নিয়েছে। ভিতরের আকুলতা বেরে গিয়ে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে মর্মে মর্মে বিষময় যন্ত্রণা।

অনিদ্রা আর অনিয়মে মেহবুবের শরীর খারাপ লাগছে। হাফ বেলা অফিস করে বাসায় চলে এল। আম্বিয়া দরজা খুলে দিলে মেহবুব ইরিনের রুমে ছুটে যায়, কাউকে দেখতে না পেয়ে আম্বিয়াকে জিজ্ঞেস করে – অপুর আন্টি কোথায়
– হাসপাতাল গেছে
– হসপিটাল কেন, উদ্দিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল মেহবুব
– খালাম্মার জ্বর তাই আপা নিয়া গেছে
মেহবুবের ভিতর অপরাধবোধ জেগে উঠলো। তার ঘড়ের মানুষ অসুস্থ অথচ সেই জানে না!দ্রুত অপুর নাম্বারে ডায়াল করলো, বন্ধ বলছে। একবার, দুইবার বারবার, প্রতিবারই বন্ধ। মেহবুবের ভিতর অস্থিরতা বারতে লাগলো। আম্বিয়াকে ডেকে বলল- কোন হসপিটাল বলতে পারেন
– জ্বে না
ইরিনের নাম্বারে ট্রাই করলো ওটাও বন্ধ।
একরাশ অস্থিরতা নিয়ে ফিরে এল ইরিনের রুমে। ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে পরলো, বালিশ বুকে জরিয়ে প্রান ভরে শ্বাস নিয়ে পেতে চাইলো ইরিনের গায়ের ঘ্রাণ।একসময় চোখে নেমে এল শান্তির ঘুম। চার-পাঁচদিনের অভুক্ত ঘুম ভাঙলো অপুর ডাকে
– বাবা!বাবা!
মেহবুব চোখ খুলে দেখলো অপু দাঁড়িয়ে
– কখন এসেছো,ফোন বন্ধ রেখেছো কেন, কিছুটা রাগ নিয়ে বলল মেয়েকে
– অনেকক্ষন এসেছি
– তোমার আন্টি কই
-আন্টির বাসায় দিয়ে এসেছি
মেহবুব শোয়া থেকে উঠে বসলো, উত্তেজিত হয়ে বলল- ওখানে কেন
– তুমি ভোরে বেরিয়ে যাও রাতে ফিরছো আমিও বাসায় থাকি না,আম্বিয়া আপা কদিকে সামলাবে
– আমার সঙ্গে ডিসকাস করতে পারতে
-স্যরি বাবা
– ডাক্তার কি বলল
– ভাইরাল ফিবার
মেহবুব ওয়ালেট আর মোবাইল প্যান্টের পকেটে গুঁজে বলল- আমি আসছি
– কোথায় যাচ্ছ
– ওকে নিয়ে আসতে
অপুর মনে শস্তি ফিরে এল।মনে মনে বলল”ঔষধে কাজ হয়েছে”

মেহবুব যখন ইরিনের বাসায় পৌঁছালো তখন রাত দশটা।রুনা মেহবুবকে দেখে বলল- এতদিনে মনে পরলো
– সময় করতে পারি না ভাবী
– আজ সময় করলেন কিভাবে
মেহবুব লাজুক হেসে মাথা চুলকে বলল- ওর কি অবস্থা এখন
– ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন
মেহবুব বিয়ের পর দ্বিতীয়বার এল ইরিনদের বাসায়, রুমে এসে ড্রিম লাইটের আলোয় দেখলো ইরিন শ্বেতশুভ্র বিছানায় দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ব্লাংকেটের উপর দিয়েও বোঝা যাচ্ছে ইরিন কাঁপছে। দ্বিতীয়বার ভাবলো না মেহবুব। পাশে শুয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো ইরিনকে।চেনা গায়ের গন্ধে ইরিন বুঝতে পারলো মেহবুব এসেছে। বিচলিত না হয়ে চুপ করে রইল। ইরিনের চুলে নাক ডুবিয়ে বলল- স্যরি
– ইরিন নিশ্চুপ
– কতদিন ঘুম হয় না, নিজেদের ঘড়ে চল জরিয়ে ধরে ঘুমাব
ইরিন মনে মনে বলল – স্বার্থপর
মেহবুব ইরিনের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল – তুমি যদি চাও তবে আমি তোমার সমস্ত উত্তাপ নিয়ে নিতে পারি
ইরিন এবারও মনে মনে বলল – কি অসভ্য, অথচ দেখে মনে হয় সাধু
মেহবুব হঠাৎ ইরিনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ইরিনের ঠোঁটজোরা নিজের দখলে নিয়ে নিল।এমন বিহেভিয়ারের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না ইরিন।আবার নিজেকে ছাড়িয়েও নিল না।কি অদ্ভুত ভালবাসায় দুটি মন ভেসে গেল।ভিজে গেল মধ্যবয়সী প্রেম,যতটুকু দূরত্ব ছিল তাও আজ ঘুচে গেল।
চলবে

মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ১০
তানিয়া রহমান

ভালবাসার রং বদলে যায়, কারণে কিম্বা অকারণে বদলায়। উদভ্রান্ত প্রেমিকের সবকিছু অগোছালো হয় প্রেমিকার চোখের রঙের ভাষায়। প্রেম বুঝি এমনই!
ইরিনের অসুখকে মেহবুবের মনে হলো আশীর্বাদ। এত কাছাকাছি আসার জন্য এরকম কিছুর দরকার ছিল। দু’হাতের উপর মুখ রেখে মেহবুব
ইরিনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করতে পারছে তার ভিতরের কাঁচ কাটা হিরার জলপ্রপাত। এলোমেলো রঙহীন জীবনে ইরিন নামের সুনামি তাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে।ক্ষয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়ের কূল।মেহবুবের ভাবনায় কাঁটা বসালো মোবাইলের রিংটোন।

বিরস মুখে দ্রুত মনিরের ফোন রিসিভ করল পাছে ইরিনের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
– তুই কই দোস্ত
মেহবুব বারান্দায় এসে গলার স্বর নামিয়ে বলল- শ্বশুরালয়
– ওখানে কি করছিস
– জামাই আদর নিচ্ছি
– অপু বলল ইরির নাকি জ্বর
– হুম
– এখন কি অবস্থা
– ভোর থেকে কিছুটা কম
– দোস্ত ওকে দিবি কথা বলতাম কাতর কন্ঠে বলল মনির
– ঘুমুচ্ছে
– খুব দেখতে ইচ্ছে করছে
– আমার বোউকে তোর কেন দেখতে ইচ্ছে করবে
– তোর বোউ মানে
– কেন সন্দেহ আছে
– অধিকার দেখাচ্ছিস
– অধিকার নেই বলছিস
মনিরের ভিতরটা জ্বলে উঠলো, কল কেটে দিয়ে সেলফোনটা আছাড় দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল।মনিরের ইচ্ছে করছে মেহবুবকে কষে কয়েকটা লাগিয়ে ইরিনকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে।

গা থেকে কম্বল সরিয়ে দিল ইরিন। ঘেমে ভিজে গিয়েছে, রাতের কথা মনে হতে পাশে তাকালো। মেহবুব নেই, ইরিন মনে মনে বলল ” ওতো কখনো আগে উঠে না তবে কি আসেনি”মন খারাপ নিয়ে উঠে বসলো। নিজেকে আয়নায় দেখে তর্জনী দিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল,জ্বরের ঘোরে সবকিছু এত বাস্তব ছিল! ইরিনের কান্না পেল।অস্ফুট ভাবে বলল”এত নিষ্ঠুর!”

মেহবুব বারান্দার স্লাইড ডোর সরিয়ে রুমে এসে দেখলো ইরিন কাঁদছে, দ্রুত কাছে এসে বলল- কি হয়েছে, শরীর বেশী খারাপ লাগছে
ইরিন বুঝতে পারছে না সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি আবার জ্বর বারছে।গালে কপালে হাত ঠেকিয়ে আবার তাকালো মেহবুবের দিকে।
মেহবুব পাশে বসে হাতের উল্টো পিঠ ইরিনের কপালে রেখে জ্বরের আঁচ বুঝতে চেষ্টা করলো।
গভীর দৃষ্টি নিয়ে বলল- জ্বর নেইতো, চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আবার বলল – কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল আমাকে
ইরিনের মাথাটা কেমন ঝিমিয়ে যাচ্ছে, বিড়বিড় করে বলল – আপনি সত্যি এসেছেন
মেহবুব ইরিনকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এল
– এই মেয়ে!কি হয়েছে তোমার, সারা রাত আদর খেয়ে এখন বলছো সত্যি এসেছি কিনা
– কোথায় ছিলেন এত সময়, কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ইরিন
– বারান্দায়, একদম ঘেমে ভিজে গিয়েছো, হট শাওয়ার নিয়ে নাও ভালো লাগবে।
ইরিন মেহবুবের বুকে মুখ গুজে দিল
– আমি কি সপ্ন দেখছি
– আমরা দুজনেই সপ্ন দেখছি ইরা,খুব সুন্দর স্বপ্ন, সারাজীবন এমন স্বপ্ন দেখতে চাই তোমাকে পাশে নিয়ে
– সত্যি বলছেন
– তিন সত্যি

মেহবুব অফিসে এসে দেখলো মনির রুমে বসে আছে।
– কি খবর
– খবরতো তোর কাছে
– আমি আবার কবে থেকে নিউজ চ্যানেল হলাম
– ঠাট্টা রাখ,ইরিতো আমাকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিয়েছে
মেহবুব সরু চোখে তাকিয়ে বলল – বুঝলাম না
– ইরির সঙ্গে তোর কথা হয় না
– হবে না কেন, কিন্তু তোর প্রসঙ্গে হয় না
– অনেক দিনতো হলো এবার
মেহবুব মনিরের কথা কেড়ে নিয়ে বলল – আমিতো তোকে আগেই বলেছি জঘন্য কাজটা আমি কখনো করব না তবে ইরা যদি করতে চায় আমি বাঁধা দিব না
– তুই ওকে ইরা বলিস
– হুম
– তোদের মধ্যে কি কিছু চলছে
– কিছু হলে তুই কি আর ওকে নিবি না
– যা ইচ্ছে তাই চলুক, মেহবুবের হাত ধরে বলল- আমি ইরিকে ফেরৎ চাই দোস্ত
– এতই যখন ভালবাসিস তবে ডিভোর্স করলি কেন
– মতিভ্রম দোস্ত মতিভ্রম, ভুলের শাস্তি প্রতি মুহূর্তে পাচ্ছি
– ও একবার কথায় কথায় বলেছিল তুই নাকি থার্ড রিলেশন শুরু করেছিলি
– হুম ঠিকই বলেছে ওর বান্ধবী শোভার প্রেমে পরেছিলাম, প্রথম প্রথম আড়াল ছিল কিন্তু যখন ধরা পরে গেলাম তখন আর আড়াল রইল না,ওর সামনেই ঘটতে লাগলো অনেক অপ্রিতিকর ঘটনা, ইরির গায়েও হাত তুলতে দ্বিধা করিনি,অমানুষ হয়ে গিয়েছিলাম।
– যার জন্য এতকিছু করলি তাকে বিয়ে করলি না কেন
– ইরিকে ডিভোর্স করার বছর খানেকের মাথায় বুঝতে পারলাম এরা গার্লফ্রেন্ড হতে পারে বাট বৌ না
মেহবুবের দিকে তাকিয়ে করুন স্বরে আবার বলল মনির – এখন বুঝতে পারছি তখন ওর ভিতর কি ঝড় বইতো,সেদিন ইরিকে দেখলাম তোকে খাইয়ে দিচ্ছে আমার ভিতরটা ভেঙ্গে গুরিয়ে গেল।তোরা এক বাসায় একই রুমে থাকছিস এসব ভাবলে আমার পাগল পাগল লাগে, কিযে অসহ্য রকম যন্ত্রণা তোকে বোঝাতে পারব না
– তোরা কথা বল, তাছাড়া আমিও এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই
– কিভাবে কথা বলবো
– ওর সঙ্গে কথা বলে আমি তোকে জানাব

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here