মধুবালা,পর্বঃ১

0
1396

#মধুবালা,পর্বঃ১
অরিত্রিকা আহানা

চৌধুরী বাড়ির বড় মেয়ে মেহেরুন্নেসার বিয়ে! সারাবাড়িতে উৎসবমুখোর পরিবেশ বিরাজ করছে। এর মাঝেই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বোরখায় মুখ ঢেকে আশরাফি সাথে দেখা করতে বেরিয়েছে মেহের। উদ্দেশ্য শেষবারের মত বিদায় নেওয়া ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে। তাদের বিগত চারবছরের সম্পর্কের ইতি হতে যাচ্ছে আজকে। বিয়ে আবশ্য আজ নয়। কাল গায়ে হলুদ, পরশু বিয়ে! মেহেরের বাবা ইরতিয়াজ চৌধুরীর পছন্দের পাত্রের সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে মেহেরের। বাবার মতের বাইরে গিয়ে কিছু করার সাধ্য কিংবা সাহস কোনটাই নেই তাঁর! ভয়ানক মানুষ ইরতিয়াজ চৌধুরী। তিনি কিছুতেই আশরাফির মত অনাথ একটা ছেলেকে চৌধুরী বংশের জামাতা হিসেবে মেনে নেবেন না। তাই বাধ্য হয়েই বিয়েতে রাজী হতে হয়েছে মেহেরকে।

দশবছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে আশরাফি। মা স্কুলের টিচার ছিলেন। ছাত্র পড়িয়ে মানুষ করেছেন ছেলেকে। কিন্তু গতবছর অ্যাক্সিডেন্টে মা-ও চলে গেলেন। তারপর থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে চালাচ্ছে আশরাফি। গ্রামে অবশ্য তাদের কিছু জমিজমা আছে। কিন্তু চাচারা সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে তাঁকে। আশরাফি মা বেঁচে থাকতেও এসব সম্পত্তি নিয়ে কোন আপত্তি করেন নি। ছেলেকে মানুষ করাই ছিলো তাঁর একমাত্র লক্ষ্য!

ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে পরিচয় হয়েছিলো দুজনার। পরিচয় থেকেই আস্তে আস্তে মন বিনিময়। কখনো যে একে অপরের অপরিহার্য হয়ে উঠলো নিজেরাও টের পেলো না। যখন টের পেলো তখন আর কিছু করার রইলো না মেহেরের। ততদিনে আশরাফির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলো সে। যদিও বেশিরভাগ সময়ই বাবার ভয়ে দিন কাটতো তাঁর। তবুও, মনের ভেতর কিঞ্চিৎ আশা ছিলো, যদি বাবা কোনভাবে রাজি হয়? যদি কোনভাবে তাঁদের সম্পর্কটা মেনে নেয়? কত আশ্চর্যজনক কিছুই তো ঘটে পৃথিবীতে! তাদের ক্ষেত্রেও যদি ঘটে? এতগুলো দিন এমন অবাস্তব, মিথ্যে সান্ত্বনায় নিজেকে বুঝ দিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এইমুহূর্তে এসে, বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারছে, কতটা ভুল আর ছেলেমানুষিতে ভরা ছিলো তার আশা আকাঙ্ক্ষা গুলো। যার কপাল মন্দ তাঁর ক্ষেত্রে যে কখনোই আশ্চর্য জনক কিছু ঘটে না! এইজন্যই হয়ত গুণীজনেরা বলে গেছেন,”ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।” কিন্তু মেহের যে জেনেশুনেই বিষ পান করেছে। সেই বিষের জ্বালা যে তাঁকে সইতেই হবে!

আশরাফি করুণ মুখ করে চেয়ে আছে তাঁর প্রিয়তমার দিকে। তাঁর দুঃসময়ে মেহেরও তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে? বাস্তবতা কেন সবসময় এত নিষ্ঠুর হয়? কেন সবসময় মানুষের আবেগ, অনুভূতি নিয়ে এমন নিষ্ঠুরভাবে খেলা করে? মেহের অশ্রুসজল কন্ঠে বললো,’আমি তাহলে আসি?’

-‘আরেকটু বসে যাও না? এইতো শেষ দেখা।’ করুণ, মর্মস্পর্শী আকুতি! টুক করে চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো মেহেরের। কম তো নয়? চারটা বছরের সম্পর্ক দুজনার! কত ভালোবাসা আর খুনসুটিতে মেতে ছিলো দুজনে। কত স্বপ্ন, কত আশা ছিলো! আজকে সব বেকার, বিফল! চোখ মুছে বোরকার নেকাব ফেলে দিলো মেহের। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’আসছি।’

আশরাফির ভেতরটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে। মেহেরকে সে কোনভাবেই পালিয়ে যাওয়ার জন্য কনভিন্স করতে পারে নি। মেহেরের এক কথা, দরকার হলে আত্মহত্যা করবে কিন্তু পালাবে না। তবুও শেষবারের মত অনুনয় করলো আশরাফি। ব্যাকুল কন্ঠে বললো,’চলো না পালিয়ে যাই? একবার বিয়ে করে নিলে দেখবেন তোমার বাবা ঠিক মেনে নেবেন!’

-‘না!’, দৃঢ় জবাব মেহেরের। কারণ পালিয়ে যাওয়ার ফলাফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা জানে। মেহের হয়ত পালিয়ে গিয়ে বেঁচে যাবে ঠিকই কিন্তু তাঁর মাকে বাঁচতে দেবে ইরতিয়াজ চৌধুরী। এই সমাজে এখনো মেয়ের দোষের বোঝা মাকেই টানতে হয়! তাছাড়া ইরতিয়াজ সাহেব খুবই বদরাগী মানুষ। দুনিয়া উল্টে এদিক ওদিক হয়ে গেলেও তাঁর কথার বাইরে কেউ যেতে পারবে না! যে যাবে সে কেবল একা ভুক্তভোগী হবে না পরিবারের সবাইকে এর ফল ভোগ করতে হবে। আর সবচেয়ে ভয়ানক পরিনতি হবে মেহেরের মায়ের। তাই তিনি আগেই নিজের মাথায় হাত রেখে মেয়ের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছেন। মায়ের মাথা হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে মেহের, বাবার কথার বাইরে যাবে না সে। শুধু মায়ের নয় তাঁর দশবছরের ছোট বোন নিগারের মাথাও হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন তাঁর মা জাহানারা বেগম। ইরতিয়াজ চৌধুরীকে জমের মতন ভয় পান তিনি। এই লোকটার অবাধ্য হওয়ার কথা ভুলেও কখনো মাথায় আসে নি তাঁর! অতএব নিরুপায় মেহের!

তবুও হাল ছাড়লো না আশরাফি। পুনরায় অনুনয় বিনয় করলো। কিন্তু মেহের কিছুতেই পালিয়ে যেতে রাজি নয়। উল্টো আশরাফিকে পরামর্শ দিলো সব ভুলে নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস করার জন্য! এইসব সান্ত্বনামূলক কথাবার্তা শুনে রাগে জ্বলজ্বল করে উঠলো আশরাফিত চোখজোড়া। সজোরে টেবিলে বাড়ি মেরে বললো,’আমি সব বুঝি। আসলে তোমার বাবার কোন দোষ নেই। তুমিই আমাকে বিয়ে করতে রাজি নও। এসব তোমার বাহানা! বড়লোক পাত্র পেয়ে আমাকে ভুলে গিয়েছো।’

মেহের জবাব দিলো না। নিরুত্তরমুখে বসে রইলো। সে জানে আশরাফি অতিরিক্ত রাগ থেকেই কথাগুলো বলছে। এইমুহূর্তে একটা মানুষের জন্য নিজেকে সামলে রাখা কতটা কষ্টকর তা মেহের বুঝতে পারে। আশরাফি ফের টেবিলে বাড়ি মেরে বললো,’চুপ করে আছো কেন তুমি? হোয়াই ডোন্ট ইউ আনসার মি? কেউ তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছো না?’

রেস্টুরেন্টে উপস্থিত আশেপাশের কয়েকজোড়া কাপল অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে তাদের দুজনার দিকে। মেহের উঠে দাঁড়ালো। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তাঁর পথ আটকালো আশরাফি। দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না। আমার জীবন নিয়ে তামাসা করার কোন অধিকার তোমার নেই। তুমি এইমুহূর্তে আমার সঙ্গে কাজি অফিসে যাবে। বিয়ে করবো আমরা!’

জবাবে মেহের সম্পূর্ণ অবিচল কন্ঠে বললো,’পথ ছাড়ো। সবাই দেখছে।’

-‘বললাম তো এখন তুমি কোথাও যেতে পারবে না।’ তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুকে আসতে বললো আশরাফি। এবার মেহেরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। বাইরে থেকে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে বুক কাঁপছে তাঁর। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,’তোমার সাথে দেখা করতে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।’

-‘ভুল যখন করেই ফেলেছো তখন তো এর খেসারত তোমাকে দিতেই হবে? কিছু করার নেই!’

ঢোক গিললো মেহের। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে পুনরায় কিছু বলতে যাচ্ছিলো আশরাফি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,’কোন লাভ হবে না। আমি আমার ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি। এক্ষুনি বিয়ে করবো আমরা!’
আকস্মিক কেঁদে ফেললো মেহের। কাঁদতে কাঁদতেই বসে পড়লো সে। আশরাফির একটা হাত চেপে ধরে অসহায় কন্ঠে বললো,’দোহাই তোমার। তুমি ওদের আসতে বারণ করে দাও। বাবা আমার মাকে মেরে ফেলবেন। প্লিজ মায়ের কথাটা একবার ভাবো।’

থমকে গেলো আশরাফি! মেহের কি তবে এইজন্য বিয়েতে রাজি হয়েছে? মায়ের জন্য? হ্যাঁ! তা নয়ত কি? আশরাফি জানে মেহের তাঁকে কতটা ভালোবাসে! কিন্তু মা! যেখানে অন্য সকল শব্দ, সম্পর্ক, ভালোবাসা থেমে যায়! এই কথার জবাবে কি বলবে আশরাফি! সে কি বলবে তোমার মায়ের কথা বাদ দিয়ে আমার কথা ভাবো? না! আশরাফি কখনোই এই কথাটা বলতে পারবে না। তবুও হতাশা, আত্মগ্লানি, রাগ, ক্ষোভ সব গিয়ে পড়লো মেহেরের ওপর। নিরুপায় হয়ে হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিলো মেহেরকে। দুহাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো। চোখমুছে উঠে দাঁড়ালো মেহের। সে জানে এবার আর আশরাফি তাঁকে আটকাবে না। চোখ বন্ধ করে বড়বড় একটা দম নিলো আশরাফি। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললো,’আমি তোমাকে কখনো মাফ করবো না মেহের! তুমি জীবনেও সুখি হতে পারবে না।’

মেহের ফুঁপিয়ে উঠলো। তাকে রেখেই বেরিয়ে গেলো আশরাফি। মাথা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে তাঁর। মেহের কেবল নিজের মায়ের কথাই ভাবলো? আশরাফি কথাটা একবারও ভাবলো না? আশরাফি কি করে থাকবে মেহেরকে ছাড়া? বন্ধুর বাইক নিয়ে এসেছিলো সে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে গতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিলো। মনে মনে প্রার্থণা করলো এই মুহূর্তেই যেন অ্যাক্সিডেন্ট করে মরে যায়। মেহেরকে যেন সারাজীবন আফসোস করতে হয় তাঁর জন্য!


রাত দুটো! নিজের ঘরে বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে মেহের। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে তাঁর! মনটা কু ডাকছে। আশরাফির জন্য ছটফট করছে। সে ঠিক আছে তো? আশরাফির করুণ মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাঁর! ফোন করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘চলো পালিয়ে যাই!’ কিন্তু আফসোস কিছুই করার নেই তাঁর!
দুহাতে মুখ চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে গুঙিয়ে উঠলো সে। চোখ জ্বালা করছে। এই কয়দিনে এত কেঁদেছে যে এখন চোখে পানি এলেই চোখ জ্বালা করে। ফোন বের করে আশরাফির নাম্বারে ডায়াল করলো। দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো আশরাফি। সে ‘হ্যালো’ বলতেই মেহের বুক থেকে পাথর নেমে গেলো। আশরাফি ঠিক আছে! চোখের পানি মুছে গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,’ঘুমাও নি?’

-‘না।’

-‘এত রাত জেগে কি করছো।’

-‘প্ল্যান করছি।’

-‘কিসের প্ল্যান?’

-‘তোমাকে খুন করার। তুমি আমার সাথে যা করেছো এরপরে তোমাকে ছেড়ে দিলে আমার ভালোবাসার অপমান হবে।’

এত কষ্টের মাঝেও হাসি পেয়ে গেলো মেহেরের। মেহের তো এমনিতেই মরে গেছে! তাঁকে আর কি মারবে আশরাফি? দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। অথচ সে জানে না আশরাফি তখন আঘাতে আঘাতে কতটা বিকৃতমনষ্ক! বাস্তবিকই তাঁকে খুন করার প্ল্যান করছিলো আশরাফি! হ্যাঁ! মেহেরকে খুন করে তারপর নিজে মরবে সে! রাতের অন্ধকার, তীব্র হতাশায় নানারকম উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা মাথায় আসছে তাঁর।

তীব যন্ত্রণায় জর্জরিত মেহের! কিঞ্চিৎ ঠাট্টার সুরে বললো,’সত্যিই মারতে চাও?’

থমকে গেলো আশরাফি! নিমিষেই চুপসে গেলো এতক্ষনের ফুলতে থাকা প্রতিশোধের বেলুনটা! মেহের! যাকের সে নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসে! তাঁকে আঘাত করার কথা কেবল কল্পনাতেই ভাবা যায়! বাস্তবে নয়। হতাশা, ক্ষোভ, তীব্র যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা আবারো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো। মেহেরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাগে ফোন কেটে দিলো সে। এইমুহূর্তে সমস্ত পৃথিবী ওলটপালট করে দিতে ইচ্ছে করছে তাঁর। ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে মন চাইছে সব কিছু।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here