#মধুবালা,০২,০৩
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২
মেসের শক্ত কাঠের চৌকিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আশরাফি। বন্ধুরা বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করলো কিন্তু কোন সাড়া দিলো না। কাল রাত থেকে কারো সাথে কথাবার্তা বলছে না। রাতের খাবার, সকালের নাশতা সব টেবিলের ওপর পড়ে আছে। দুপুরের খাবার সময়ও হয়ে গেছে কিন্তু আশরাফির কোন নড়চড় নেই। মরার মত শুয়ে আছে।
এবার বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে গেলো। মেহেরের সঙ্গে ঝামেলার কথা সব তাদের খুলে না বললেও বিয়ের কথা ওদের জানিয়েছে আশরাফি। কিন্তু কবে সেটা জানায় নি। সোহাগ আশরাফির কাছে গিয়ে নরম গলায় ডাক দিলো,’ওঠ দোস্ত। দুইটা বাজে। আর কতক্ষন ঘুমাবি?’
-‘তুই যা!’ গম্ভীর, আড়ষ্ট জবাব আশরাফির।
সোহাগ পুনরায় ডাক দিলো কিন্তু সাড়া দিলো না আশরাফি। এবার নাঈমও এগিয়ে এলো। বিষন্ন বন্ধুর পিঠে হাত আলতো করে কয়েকবার চাপড় মেরে বললো,’ওঠ, দোস্ত। ওই মেয়ের জন্য আর মন খারাপ করিস না। অই একটা চিটার, বাটপার।’
-‘তোরা তোদের কাজে যা।’
তাঁর কথায় গা করলো না কেউ। টানাটানি শুরু করে দিলো। সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পর একটা মানুষের মেজাজ কখনোই ভালো থাকার কথা নয়। আশরাফির মেজাজও চূড়ান্ত খারাপ। কাল সারারাতএকফোঁটাও ঘুমায় নি সে। ঘুমের ভান ধরে পড়ে ছিলো কেবল। কিন্তু বন্ধুদের ডাকাডাকিতে ক্ষেপে গেলো। এমনিতে কপালের শিরাগুলো চিনচিন করছে। প্রচন্ড মানসিক চাপে শিরা ছেড়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে। তারওপর বন্ধুদের ক্রমাগত ডাকাডাকি। লাফ দিয়ে উঠে বসলো সে। দুই বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বিচ্ছিরি একটা গালি দিয়ে বললো,’দরদ দেখাতে কে বলেছে তোদের? যা ভাগ আমার সামনে থেকে!’ কথা শেষ করে আবার গালি দিলো সে।
সোহাগ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’ওই নষ্ট মেয়ের জন্য তুই আমাদের গালি দিয়েছিস?’
এমনিতেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে আশরাফির। তারওপর সোহাগের কথাটা শুনে শরীরের রক্ত সব ফুটতে শুরু করলো তাঁর। রাগে দিশেহারা হতে সোহাগের কলার চেপে ধরলো সে। মুখ দিয়ে আবারো বেরোলো কুরুচিপূর্ণ গালি। সোহাগের গালে সজোরে ঘুষি মেরে বললো,’হারামির বাচ্চা নিষেধ করেছিলাম না! কথা কানে যায় না? কে বলেছে তোকে কথা বলতে? বেশি দরদ দেখাইতে আসছিস না?’
নাঈম হতভম্ভ! অবাক হলো সোহাগও! বেশকিছুক্ষন হাঁ করে বন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো তাঁরা। ধীরেধীরে ব্যপারটা ক্লিয়ার হলো। একরাতেই বিধ্বস্ত অবস্থা আশরাফির। মুখের দিকে তাকানোর জো নেই। বোধকরি এবার বন্ধুর মনের অবস্থা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে তারা। কতটা মানসিক যন্ত্রণায় থাকলে একটা মানুষ এমন পাগলের মত আচরণ করতে পারে এবার আর বুঝতে অসুবিধে হলো না তাদের। প্রিয়তম বন্ধুর দুঃখে ব্যথিত হলো দুজনেই। অনেক কষ্টে আশরাফির হাত থেকে সোহাগের কলার ছাড়ালো নাঈম। বন্ধুকে শান্ত করার চেষ্টায় বিষন্ন কন্ঠে বললো,’ওর ওপর রাগ দেখিয়ে কোন লাভ আছে? তুই যার জন্যে মরছিস সে তো ঠিকই আরেকজনকে বিয়ে করে নিচ্ছে।’
এদিকে মার খেয়েও প্রতিবাদ করলো না সোহাগ। ঘুরেফিরে আবার আশরাফি পাশেই বসলো সে। তাঁর পিঠে একটা হাত রেখে নাঈমের কথায় সমর্থণ করে বললো,’নাঈম ঠিকই বলেছে দোস্ত। তুই ওই মেয়েকে নিয়ে ভাবা বন্ধ কর। একদিনেই তোর চেহারার কি হাল হয়েছে তুই দেখেছিস? মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।’
জবাবে আশরাফি ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সোহাগের দিকে। তারপর হাত দুটো চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো। ফুঁপিয়ে উঠে বললো,’আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে দোস্ত! ওকে তোরা বুঝা! আমি মরে যাবো। ও ছাড়া আমার আর কেউ নাই!’
চোখের পানি টলমল করছে দুই বন্ধুরও। সাময়িক মন দেওয়া নেওয়ার ঘটনা হলে হয়ত এইমুহূর্তে আশরাফিকে নিয়ে হাসি তামাসা করতো দুজনে। কিন্তু ব্যপারটা সিরিয়াস! আশরাফি পাগলের মত ভালোবাসে মেহেরকে! তাই সান্ত্বনা দেওয়ার মত কোন ভাষা খুঁজে পেলো না তারা। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুজনে। খুব অসহায় লাগছে নিজেদেরকে! মেহেরকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে ঠিক কি কারণে তাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধুটিকে এতটা দুঃখ দিয়েছে মেহের? কেন তাকে এতটা কষ্টের মাঝে ফেলে দিয়ে গেলো সে?’
★
পার্লারের লোকেরা হলুদের জন্য সাজাচ্ছে মেহেরকে। পাশেই তার ফোন অনবরত বেজে চলেছে। দুবার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ করলো মেহের। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত একটা কন্ঠস্বর বলে উঠলো,’মেহের বলছো?’
-‘জি! আপনি কে?’
-‘আমি সোহাগ। আশরাফির বন্ধু!
নামটা শুনতেই বুকের ভেতর খামচি মেরে উঠলো মেহেরের। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো বুকটা। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে,’ও ঠিক আছে ভাইয়া?’
মেহেরের কাছ থেকে প্রথমেই এই ধরণের প্রশ্ন আশা করে নি সোহাগ। সে ধরেই নিয়েছিলো মেহের যেহেতু বিয়ে করছে তারমানে এইমুহূর্তে আশরাফিকে না চেনার ভান করবে সে। কিংবা ফোনও কেটে দিতে পারে। সেই মোতাবেক কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলো সে। তাই মেহেরের প্রশ্নের উত্তরটা সাথে সাথেই দিতে পারলো না। থমকে গেলো। তার নিরব থাকা মেহেরের ভয়ের মাত্রাটাকে আরো বেশি করে বাড়িয়ে দিলো। নিমিষেই চোখে পানি চলে এলো তাঁর। অধৈর্য কন্ঠে বারবার ‘হ্যালো ভাইয়া, হ্যালো! শুনতে পাচ্ছেন আপনি? কথা বলছেন না কেন?’ বলে গেলো সে। এদিকে পার্লারের মহিলা খেঁকিয়ে উঠে বললো,’কাঁদবেন না প্লিজ! মেকাপ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
চোখের পানি মুছে নিলো মেহের। ওপাশ থেকে সোহাগ তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম গলায় বললো,’রাফি ঠিক আছে। কিন্তু তুমি এমন কেন করলে বোন?’
এবার আর অবরুদ্ধ ক্রন্দন ঠেকিয়ে রাখতে পারলো না মেহের। সোহাগের নরম গলা শুনে ডুঁকরে কেঁদে উঠলো সে। কান্নারত কন্ঠেই বললো,’উপায় নেই ভাইয়া। আমি নিরুপায়! বিশ্বাস করুন আমাকে বাধ্য করা হয়েছে! কিন্তু আপনাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমি জানি আপনারা ওর খেয়াল রাখবেন কিন্তু তবুও বলছি এইমুহূর্তে ওর খুব প্রয়োজন আপনাদেরকে! আপনারা ছাড়া ওকে দেখে রাখার মতন আর কেউ নেই।’
ইতোপূর্বে খেঁকিয়ে উঠা পার্লারের সেই মহিলা এবার বুঝতে পারলেন হৃদয়ঘটিত কোন সমস্যা চলছে বউয়ের। তাই আর কিছু বললেন না। টিস্যু দিয়ে আলতো করে মেহেরের চোখের পানি মুছে দিয়ে পুনরায় মেকাপে মনোযোগ দিলেন তিনি।
সোহাগ ম্লান কণ্ঠে বললো,’আজকে সারাদিন না খেয়ে আছে। কাল রাত থেকেই সবার সাথে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে। দুপুরে আমরা ডাকতে যাওয়ায় আমাদের সাথেও উল্টো রাগারাগি করেছে। কি যে করবো বুঝতে পারছি না।’
মেহের নিরবে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। সাহসে কুলাচ্ছে না নতুবা এই মুহূর্তে নিজেকে শেষ করে ফেলতো সে। নিজেকে ভীষণ অসহায়, নিরুপায় লাগছে। তাঁর ভালোবাসার মানুষটাকে নিদারুণ যন্ত্রণার মাঝে ছেড়ে দিয়ে এসেছে সে। এতটা যন্ত্রণা কোন শত্রুও বোধহয় তাঁর শত্রুকে দেয় না! আঁচড়ে, কামড়ে, খামচে শেষ করে দিতে মন চাইছে নিজেকে! কিন্তু আফসোস সেটুকুও করার ক্ষমতাও তার নেই। কাঁদতে কাঁদতেই জিজ্ঞেস করলো সে,’ও এখন কোথায়?’
-‘মেসেই আছে। চুপচাপ বসে আছে। বললাম না কালরাত থেকেই চুপচাপ।’
কথাগুলো শোনার পর থেকে মেহেরের বুক আরো বেশি করে কেঁপে উঠলো। আশরাফি কোন অঘটন ঘটাবে না তো? চিৎকার চেঁচামেচি তবুও ভালো। কিন্তু মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখা তো ভালো লক্ষণ নয়? এর পরিণাম ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হতাশভাবে কান্না চাপলো সে। চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে একটাই প্রার্থণা করলো সে,আশরাফির যেন কোন ক্ষতি না হয়!’
এদিকে মেহেরের কাছ থেকে কোন জবাব না পেয়ে ফোন রেখে দিলো সোহাগ। বড় রাগ লাগছে তাঁর! পৃথিবীটা এমন কেন? কেন এখানে সত্যিকারের ভালোবাসাগুলোর মিলন হয় না?
মেহেরের সাথে তাঁর পুরো কথোপকথন নাঈমের সাথে আলোচনা করলো সে। সব শুনে নাঈম বিরক্ত মুখে বললো,’নাটক করছে ঐ মেয়ে! নাটক! এদের চেনা বড় মুশকিল। আসল কথা হলো বড়লোক ছেলে দেখে রাফিকে ভুলে গেছে। এখন মিথ্যে নাটক করছে! তুই বুঝবি না এসব।’
অসন্তোষে মাথা নাড়ালো সোহাগ। মেহেরের কান্নারত,উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর না শুনলে সে-ও হয়ত পূর্বের মত নাঈমের সঙ্গে একমত হতে পারতো কিন্তু এইমুহূর্তে পারছে না। চোখে না দেখলেও মেহেরের কান্নার মাঝে লুকিয়ে থাকা ভয়ানক কষ্টের আভাস উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। পেরেছে বলেই নাঈমের মত ঘৃণা করতে পারছে না মেহেরকে। তবে হ্যাঁ! রাগ লাগছে মেহেরের ওপর! সে যদি আগেই জানতো তাঁর বাবা আশরাফিকে মেনে নেবে না তবে কেন সে আশরাফির সাথে এমন করলো? এর উত্তরটা এখনো পরিষ্কার নয় সোহাগের কাছে। মেহের কি সত্যিই নিরুপায়? নাকি নাঈমই ঠিক বলছে?
.
.
চলবে
#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৩
আরমানের পাতে মাছের ঝোলটা ঢেলে দিলো মধু। মাংসের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বললো,’আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?’
-‘তোমার মুখটা মনে পড়লো আর কিছুতেই থাকতে পারলাম না। সব কাজ ফেলে ছুটে চলে এলাম। এসে তোমার মুখটা দেখেছি এবার শান্তি।’, হাসিমুখে মধুর প্রশ্নের জবাব দিলো আরমান। মধুও হাসলো। নিষ্প্রভ, নিষ্প্রাণ হাসি। এই হাসিতে কোন জৌলুশ নেই, কোন আনন্দ কিংবা উচ্ছ্বাস কিছুই নেই। আছে কেবল একরাশ লুকোনো বেদনা। মর্মাহত হলো আরমান। মধুর সঙ্গে এইধরনের কথাবার্তা কখনোই ভালোভাবে জমাতে পারে নি সে। মধুই এড়িয়ে যায়। আরমান প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে নিলো। পাতের ভাতে ঝোল মাখাতে মাখাতে বললো,’মালদার একটা পার্টি পেয়েছি মধু। গুনে গুনে পঁচিশ হাজার দেবে বলেছে!’
অবাক হলো মধু। এখানে যারা আসে তাঁরা এরাতের জন্য সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় হাজার টাকা দিতে রাজী হয়। খুব বেশি হলে দুইহাজার। কিন্তু আজ হঠাৎ এত টাকার কথা শুনে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলো সে। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,’পঁচিশ হাজার? কিন্তু কাজটা কি?’
-‘কাজ তেমন কিছু না। সুন্দর আর নাচজানা দুইতিনটা মেয়ে চাইছে তারা। তাও মাত্র দুইঘন্টার জন্য!’
আরমানের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না মধু। তাঁর পরের বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় চুপ করে রইলো সে। আরমান ভাতের লোকমা মুখে পুরে দিয়ে সেটা চিবোতে চিবোতে বললো,’নতুন কম্পানী। আগামীকাল বিদেশ থেকে তাদের বায়ারদের সাথে জরুরী একটা মিটিং আছে। তাই পার্টিকে খুশি করার জন্য পুরোনো ধাঁচের জলসার আয়োজন করতে চাইছে তাঁরা। নামীদামী শিল্পীদের ভাড়া করতে গেলে তো মোটা টাকা খরচ করতে হবে সেইজন্যই আমাকে ধরেছে দুই তিনটা মেয়ে জোগাড় করে দিতে।’
-‘কিন্তু এখানে তো কেউ নাচ জানে না।’
-‘না জানলে টুকটাক শিখিয়ে দেবে।’
-‘আমি? তোমাকে কে বললো আমি নাচ জানি?’
-‘সে কি তুমি নাচ জানো না? কিন্তু তুমি যে বললে তুমি খুব বড় ঘরের মেয়ে?’
-‘বড় ঘরের মেয়েরা নাচ জানে এই কথা তোমাকে কে বলেছে?’
-‘বেশ! তাহলে আমি দেখি সস্তার ভেতর কোন নাচের গুরু জোগাড় করতে পারি কি না। অবশ্য তাঁর প্রয়োজন হবে কি না কে জানে। যতই তাঁরা নাচের কথা বলুক আসল উদ্দেশ্য কি সেটাতো তুমিও জানো আমিও জানি!’
এই কথার জবাবে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেললো মধু। ইতোপূর্বে এইধরনের কোন প্রস্তাব পায় নি আরমান। এইবারই প্রথম। তাই মধুর ভাষ্যমতে কাজটা তাঁর ভালোভাবে করা উচিৎ। হতে পারে সত্যিই কম্পানীর লোকজন জলসার আয়োজন করতে চাইছে? তারপর সেখানে গিয়ে যদি দেখা যায় মেয়েরা নাচতে পারলো না তবে তো প্রথমেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলো। মুখে না বললেও প্রস্তাবটা মধুর পছন্দ হয়েছে। প্রথমবারে ভালোমত কাজটা করতে পারলে পরে হয়ত এই ধরণের সুযোগ আরো আসতে পারে। তাতে করে মেয়েগুলোর অন্তত একটা গতি হবে। নরপশুদের অত্যাচারের হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। তাই আরমানের গাফলতি পছন্দ হলো না তাঁর! গম্ভীর গলায় বললো,’তুমি বরং ভালো দেখে একজন নাচের গুরু জোগাড় করো।’
-‘তাতে তো খরচা বেশি হবে?’
-‘হোক। হতে পারে কম্পানীর পছন্দ হলে এই ধরণের সুযোগ তাঁরা আরো জোগাড় করে দেবে।’
মধুর কথার বিপরীতে হাসলো আরমান। প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুতে ধুতে বললো,’বাহ্! বেশ ব্যবসা শিখে গেছো দেখছি তুমি?’
মধুও জবাব না দিয়ে হাসলো। আরমান আর কথা বাড়ালো না। হাত ধোয়া শেষে তোয়ালেতে হাত মুছে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এঁটো বাসন পত্র নিয়ে চুপচাপ তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মধু
উপরোক্ত কথোপকথন গুলো চলছিলো ঢাকার অদূরবর্তী একটা নিষিদ্ধপল্লির দুই বাসিন্দার মধ্যে। পুরুষ বক্তাটি মানে আরমান এই হাউজের পিম্প! বাংলায় যাকে বলে দালাল। যদিও এখানকার মালিক সে তবে মেয়ে জোগাড় করাই তাঁর প্রধান কাজ। আর মেয়ে বক্তাটি এখানকার হবু মালকিন। বর্তমানে এই হাউজের মোট একুশজন মেয়ের দেখাশোনার করাই তাঁর প্রধাণ কাজ।ইতোপূর্বে তাঁর নাম ছিলো মেহেরুন্নেসা চৌধুরী। যাকে ঘিরেই মধুবালা গল্পের যত কাহিনী!
অতএব বলা বাহুল্য তাঁর আগের নাম বদলে নতুন নাম রাখা হয়েছে মধুবালা। সবার পরিচিত মধুমা সে! বাকি মেয়েরা সবাই মধু-মা বলেই ডাকে তাঁকে। তাঁর মেহেরুন্নেসা থেকে মধুবালা হওয়ার ইতিহাসও এখানকার কারো অজানা নয়। প্রায় প্রতিটা মেয়েই শুনেছে তাঁর করুণ ইতিহাস। শুনে কেউ বা খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে বিষয়টা আবার কেউ কেউ ডুঁকরে কেঁদে উঠেছে। এদের মধ্যে অনেকেই আবার নিরবে অশ্রু বিসর্জন করেছে তাঁর দুঃখে।
★
মধুর দুঃখের ইতিহাসের বর্ণণা যদি অতি সংক্ষেপে দেওয়া হয় তবে এরজন্য মূলত দায়ী তাঁর বাবা। বাবা মা কখনোই সন্তানের খারাপ চায় না! কিন্তু কথায় আছে অতিরিক্ত চালাক মানুষের কপালে দুঃখ বেশি। তাঁরাই বেশি ঠকে। মধুর বাবার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। পরিবারের সবার অমতে একক সিদ্ধান্তে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কিন্তু সুখ দিতে পারেন নি মেয়েকে। একদিনও টিকলো মধুর সংসার। তার স্বামী মৃত ইশতিয়াক ছিলো একজন এপিলেপটিক পেশেন্ট। বাংলায় যাকে বলে মৃগীরোগী। কিন্তু মধুর বাবার কাছে তাঁর অসুখের খবরটা গোপন করে যায় ইশতিয়াকের পরিবার।
কিন্তু গোপনটা সত্যিটা একদিনও গোপন থাকলো না মধুর কাছে। বিয়ের দিন রাতেই ফাঁস হয়ে গেলো।
সেদিন রাতে ইশতিয়াক ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে যখন একঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বেরোলো না তখন বাধ্য হয়ে দরজায় নক করলো মধু। সেইমুহূর্তে তাঁর নিজের মাথাও ঠিক ছিলো না। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতেও কাঁদছিলো সে। আশরাফির জন্য ভেতরে ভেতরে চিন্তা অনুভব করছিলো। তবুও ভেতরের মানুষটার জন্য কিঞ্চিৎ উৎকন্ঠা বোধ করছিল সে। কিন্তু বেশ কয়েকবার দরজায় নক করার পরেও ভেতর থেকে কোন জবাব এলো না। শঙ্কিত মধু উপায়ান্তর না পেয়ে তাঁর ননদ কে ডেকে আনলো। ননদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির বাকিরাও একে একে সবাই হাজির হলো। শেষমেশ দরজা ভেঙ্গে বের করা হলো ইশতিয়াককে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ওয়াশরুমেই কনভালসিভ অ্যাটাক হয়েছিলো তাঁর। অর্থাৎ খিঁচুনি শুরু হয়েছিলো। আচমকা অ্যাটাক শুরু হওয়ায় শরীরের ব্যালেন্স রাখতে পারে নি সে। বেকায়দায় ওয়াশরুমের পিচ্ছিল মেঝেতে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলে। হস্পিটালে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ডাক্তাররা জানান মস্তিষের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের (হেমোরেজিক স্ট্রোক) কারণে অনেক আগেই মারা গেছে সে।
মধুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চারদিকে মধুর নামে গুজব ছড়ানো শুরু করলো। মধুর সাথে থাকা জ্বীনের আছরেই নাকি মারা গেছে ইশতিয়াক।
আধুনিক যুগে যদিও এসব বিশ্বাস্যযোগ্য নয় কিন্তু তবুও এই সমাজে সবকিছুর দায়ভার মেয়েদের ওপরেরই চাপানো হয়। তাই ইশতিয়াকের মৃত্যুর জন্যেও ঘুরেফিরে মধুকে-ই দায়ী করা হলো। এরপর স্বামী মারা যাওয়ার অযুহাত দিয়ে চল্লিশদিন পর্যন্ত শ্বশুরবাড়িতে তাঁকে একঘরে আটকে রাখা হলো। সেইসময় টুকুকে তার ওপর করা অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা আজও ভুলতে পারে নি মধু। পরে তাঁর এক ননদের সহযোগীতায় শ্বশুরবাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই সেখান থেকে পালায় সে। কিন্তু সেখানেও তাঁর কপাল মন্দ। মাঝ পথেই দালালের খপ্পরে পড়ে গেলো অভাগিনী। তারপর থেকেই এখানকার বাসিন্দা।
কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও এই কথা সত্যি যে, আরমান তাঁর কোন ক্ষতি করে নি। কোনদিন তাঁকে কোনরকম অসম্মান করে নি কিন্তু এখান থেকে যেতেও দেয় নি। মধুকে প্রথম দেখাতে ভালো লেগে গিয়েছিলো তাঁর। তাঁর রেশ ধরেই পরবর্তীতে মধুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো সে! কিন্তু মধু রাজী নয়। বিয়ের সাধ মিটে গেছে তাঁর!
তবুও আরমানের বিশ্বাস খুবই শীঘ্রই রাজি হবে মধু। কারণ এখন আর নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কোন পথ খোলা নেই তাঁর আছে। এই নোংরা জায়গাতেই কেটে গেছে তাঁর জীবনের দীর্ঘ চারটা বছর। অতএব মুক্তির আর কোন পথ নেই।
ব্যবসাটা আরমানের পূর্বপুরুষের আমলের। তাঁর দাদা, পরদাদা, এমনকি তাঁর বাবাও এই ব্যবসা করে গেছে। আরমান লেখাপড়া বেশিদূর করে নি। ছোটবেলাতেই তাঁর বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাঁর মা সফুরা বানু আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে আরমানকে দেখার মত কেউ ছিলো না। বাবার সাথে এখানেই বড় হয়েছে! বর্তমানে চৌত্রিশ বছরের বলিষ্ঠ যুবা পুরুষ সে। বাবার মৃত্যুর পর এই কল-হাউজের দায়িত্ব এখন তাঁর!
মধুকে ভালোবাসে বিধায় এই ব্যবসায় কখনো জড়ায় নি। সে চায় মধুকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার গড়ে তুলতে। যেখানে ফুটফুটে সুন্দর দেখতে কয়েকটা ছেলেমেয়ে হবে তাঁদের।
কিন্তু মেয়েমানুষের লোভ যে তাঁর নেই তেমন নয় তথাপি কোন এক অজ্ঞাত কারণে মধুকে শ্রদ্ধা করে সে। মধুর কথার ওপরে কোন কথা বলতে পারে না।
অবশ্য মধু আছে বলে এখানকার মেয়েগুলোরও রক্ষে। নতুবা ছোট ছোট মেয়েগুলোকেও রোজ নরপশুদের অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হতো। কিন্তু মধু আসার পর থেকে পারতপক্ষে কমবয়সী মেয়েদের খদ্দেরের কাছে পাঠায় না সে। কারো শরীর খারাপ হলে কিংবা বয়স একটু কম হলে যতটুক সম্ভব আগলে রাখার চেষ্টা করে। আরমান অবশ্য মনে মনে এই নিয়ে একটু নাখুশ হলেও মধুর সম্মুখে কোনদিন কিছু বলে নি। বলার সাহসই পায় নি। একরত্তি মেয়ের মাঝে কি যেন একটা আছে। একে দেখলেই ভয়ে তাঁর বুকের ভেতরটা কেমন যেন সেঁধিয়ে আসে। কেন এমন হয় আরমান নিজেও জানে না। কিন্তু হবেই বা না কেন? ওপাশ থেকে যে কেউ একজন এখনো মনে মনে মধুর প্রত্যাশাতেই বসে আছে!
.
.
.
চলবে