মধুবালা,০৪,০৫

0
645

#মধুবালা,০৪,০৫
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৪

শেষ প্রশ্নের উত্তর একেবারে গুলিয়ে ফেলেছে নীলা। ফেলবেই না কেন? তার পাশেই যে দাঁড়িয়ে আছেন আশরাফি স্যার। মানুষটাকে দেখলেই বুকের ভেতর দুপদাপ শুরু হয়ে যায় নীলার। আর চোখ ফেরাতে পারে না সে। কি সুন্দর মুখ! কি সুন্দর হাসি! কি সুন্দর চেহারা!
নীলার ভাষ্যমতে, একেবারে হলিউডের হিরো!
আজকেও বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো সে। দারুণ ড্যাশিং লাগছে। ইন করা সাদা শার্টের সাথে ব্ল্যাক জিন্স! শার্টের হাতা সামান্য গুটিয়ে রেখেছে। রোজকার মত মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি আর মাথাভর্তি একরাশ ঝাঁকড়া চুল। চোখে পাওয়ারি চশমা। উফ! তবুও যেন চোখ ফেরানো দায়! কথাবার্তায়ও তো মারাত্মক কিলার টাইপ অ্যাটিটিউড! আপন মনেই হেসে ফেললো নীলা।
পরোক্ষনেই আবার মনটা খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। মানুষটা দেখতে যতটা হ্যান্ডসাম তার চেয়ে বেশি রিজার্ভ! একেবারে মেপে মেপে কথা বলা টাইপ মানুষ। কলিগের সাথে অবশ্য মাঝে মাঝে হাসাহাসি করতে দেখা যায় তাঁকে কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের সাথে? ক্ষেত্র বিশেষে দারুণ মুডি। বিশেষ করে ছাত্রীদের সাথে। ছাত্রদের সাথে কখনো কখনো সামান্য ফ্রি হলেও ছাত্রীদের সাথে সবসময় শিক্ষকসুলভ ডিসটেন্স মেইনটেইন করেই চলেন। বস্তুত সেইজন্যই তাঁকে এত পছন্দ করে নীলা! এত হ্যান্ডসাম মানুষের একটুখানি ভাব না থাকলে হয়?

পরীক্ষার হলে গার্ড হিসেবে দায়িত্ব পড়েছে আশরাফির। অভ্যাসবশতই হাঁটতে হাঁটতে ক্লাসের মাঝ বরাবর একজায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিলো সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই একজায়গাটাই পড়লো নীলার ঠিক পাশে। ব্যস! শুরু হলো বেচারীর হাটু কাঁপাকাঁপি! বুকের ভেতর দুরুদুরু। পারা প্রশ্নের উত্তর গুলিয়ে গেলো! কলম মুখে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো সে।
তাঁকে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো আশরাফি। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কি সমস্যা?’ আশরাফির সরাসরি চাহনীতে হৃদকম্পন আরো বেড়ে গেলো নীলার। সেটা সামলানোর জন্য দ্রুত দুদিকে মাথা নাড়ালো। এর মানে কোন সমস্যা নেই। এবার আশরাফি তার খাতার দিকে ইশারা করে বললো,’তাহলে লিখছো না কেন? প্রশ্ন বুঝতে কোন অসুবিধে আছে?’ এবারেও না-সূচক মাথা নাড়ালো নীলা। আশরাফিও আর কিছু না বললো না। হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে গেলো সে। এবং আবারো শুরু হলো তাঁর পায়চারি। নীলাও লিখায় মনোযোগ দিলো।

পনেরো বিশমিনিট বাদেই টুং করে বেল বাজার আওয়াজ হলো। হাত ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়েই দ্রুত সবার খাতা কালেক্ট করতে শুরু করে দিলো আশরাফি। নীলা শেষবারের মত খাতাটা একবার দেখে নিলো। তার জমা দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো।

বেরোতেই দেখলো বন্ধুরা সব জটলা পাকিয়ে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করছে। কাছে এগিয়ে গেলো সে। কার কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলো। সবারই একই জবাব! ‘মোটামুটি ভালো হয়েছে।’ তাঁর কথা জিজ্ঞেস করতেই মুখখানা লাজুক বানিয়ে দুষ্টু একটা হাসি দিলো নীলা। ইঙ্গিতটা বুঝতে কারো অসুবিধে হলো না। হো!হো! করে হেসে উঠলো সবাই।
ক্লাসে নীলার অধিকাংশ বন্ধুবান্ধবই জানে আশরাফি স্যার তাঁর ক্রাশ। শুধু নীলার কেন? আরো অনেকেরই ক্রাশ! কিন্তু সাহস করে কেএ বলতে পারে নি! একমাত্র নীলাই সাহস করে সবার কাছে তাঁর ক্রাশের কথা বলে বেড়াচ্ছে।

খাতা গোনা শেষে হলরুম থেকে বেরিয়ে এলো আশরাফি। ছাত্রছাত্রীরা তখনো করিডোরে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছিলো। তাঁদেরকে দেখে হাঁটার ওপরেই জিজ্ঞেস করলো সে,’পরীক্ষা কেমন হয়েছে তোমাদের?’

প্রতিউত্তরে সবাই হাসিমুখেই জবাব দিলো,’ভালো হয়েছে স্যার।’ আশরাফিও চলে যাচ্ছিলো তখনই জটলার মাঝখান থেকে দুষ্টুটাইপ একটা ছাত্র বলে উঠলো,’খাতা একটু ছাড় দিয়ে কাটবেন প্লিজ। নইলে ইউনিভার্সিটি থেকে আর বেরোতে পারবো না।’

আশরাফি মুচকি হাসলো। হাঁটা থামিয়ে পিছন ফিরে ছাত্রছাত্রীদের দিকে একঝলক চাইলো সে। তারপর কৃত্রিম ভয় দেখিয়ে বললো,’কোন ছাড় নেই। ভালো না লিখলে সবাই ফেল।’

এবার একযোগে সবাই ‘না স্যার’ বলে প্রতিবাদ করে উঠলো। ততক্ষনে আশরাফি আর দাঁড়ালো না। দ্রুত প্রস্থান করলো। যাওয়ার সময় ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বিদায় জানিয়ে বললো,’ঠিক আছে, ভালো থাকবে সবাই। নেক্সট সেমিস্টারে আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।’ সে চলে গেলেই পূর্বের আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই। কিন্তু নীলার জমলো না। ইউনিভার্সিটি একসপ্তাহের জন্য বন্ধ। আচমকাই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তাঁর!


ইউনিভার্সিটির এরিয়া থেকে বেরোতে না বেরোতেই সোহাগের ফোন। আশরাফি ফোন রিসিভ করে বললো,’হ্যাঁ! দোস্ত আমি বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কিছু লাগবে?’

-‘না। মিটিং এর কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছি। তুই তো আবার ভুলে যাবি।’

আশরাফি হাসলো। বললো,’মনে আছে আমার। আজকে আরমান সাহেবের সাথে দেখা করার কথা! আমি বাসার নিচে, তুই ফোন রাখ।’

ফোন কেটে দিলো সোহাগ। ইউনিভার্সিটি লাইফ থেকে এখনো একসাথেই আছে তিনবন্ধু। তিনজনের কেউই এখনো বিয়ে করে নি। সোহাগ অবশ্য রিলেশনে আছে, নাঈমের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে। বাকি আছে আশরাফি! সে আদৌ বিয়ে করবে কি না তাও সিউর না বন্ধুরা। তাঁদের ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর যেহেতু সবাইকে আলাদা থাকতে হবে তাই তাঁরা যাওয়ার আগেই আশরাফিকে একটা বিয়ে করিয়ে দিয়ে যেতে। কিন্তু আশরাফি কোনমতেই রাজি নয়। তাঁকে বিয়ের কথা বলে বলে বিরক্ত হয়ে গেছে বাকি দুই বন্ধু। তাই এখন আর বলে না।

ব্যাংকে আশরাফির মায়ের রেখে যাওয়া কিছু টাকা আর সামান্য ধার দেনা করে প্রায় সাড়ে তেরো’শ স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট কিস্তিতে কিনেছে আশরাফি। নিজের জমানো কিছু টাকাও ছিলো। সব মিলিয়ে শুরুতেই ফ্ল্যাটের টাকার তিনভাগের একভাগ শোধ করে ফেলেছে সে। এরপর ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয়েছে। এখন আর অল্প কিছু বাকী আছে। তাঁর কেনা ফ্ল্যাটেই একসাথে আছে তিনবন্ধু।

সোহাগ, নাঈম দুজনেই চাকরী করছে। তবে চাকরীর পাশাপাশি গতবছরই তিন বন্ধু মিলে নতুন একটা ব্যবসা শুরু করেছিলো। তারপর অল্প কয়েকদিনেই ব্যবসা অবস্থা মোটামুটি ভালোই দাঁড়িয়ে যায়। ইতোমধ্যেই বিদেশ থেকে ডিলাররা যোগাযোগ করতে শুরু করেছে। করবেই বা না কেন? চাকরী বাইরে পুরোটা সময় যে ব্যবসার কাজেই লাগাচ্ছে তিন বন্ধু। প্রথমে আশরাফির তেমন কোন আগ্রহ ছিলো না। জোর করে তাকে পার্টনারশিপে ঢুকিয়েছে সোহাগ এবং নাঈম। মেহেরের সাথে সম্পর্ক ভাঙ্গার পর থেকে জোঁকের মত সারাক্ষণ আশরাফির পাশে লেগেছিলো তাঁরা। কোনভাবেই বিগড়ে যেতে দেয় নি তাঁকে। আপন ভাইয়ের মত আগলে রেখেছে। আসলে একটা কথা আছে, যার কেউ নেই তাঁর আল্লাহ আছেন। বস্তুত তিনি মানুষকে তাঁর দুঃখ থেকে পরিত্রাণের একটা না একটা উপায় ঠিক বের করে দেন। নতুবা কোন মানুষই এত তাড়াতাড়ি নিজেদের সামলাতে পারতো না।

সোহাগ এবং আশরাফি দুজনেই ঠিক সাড়ে চারটার দিকে নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখলো তাদের আগেই রেস্টুরেন্টে এসে বসে আছে আরমান। ওদেরকে দেখে সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলো সে। সালাম দিয়ে বললো,’আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম স্যার।’

আশরাফি এবং সোহাগ দুজনেই সালামের উত্তর নিয়ে সরাসরি কাজের কথায় ঢুকে পড়লো। এই লোকটার সাথে যত তাড়াতাড়ি ঝামেলা চুকানো যায় ততই মঙ্গল। এসব লোকের বিশ্বাস নেই! কখন কোন ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দেয় কে জানে। তাই আরমানকে বাড়তি কোন কথার সুযোগ দিলো না তাঁরা।

কথাবার্তার এক পর্যায়ে আরমান তাদেরকে আর্জি জানিয়ে বললো,’আপনারা চাইলে মেয়েগুলোর সাথে কথা বলে নিতে পারেন স্যার। পছন্দ না হলে নতুন জোগাড় করে দিবো।’

-‘কিন্তু হাতে তো সময় বেশি নেই। আপনি নতুন মেয়ে পাবেন কোথায়?’

আরমান সলজ্জ হেসে বললো,’কি যে বলেন স্যার। আমাদের তো পেশাই এটা। আপনি খালি বলুন কয়টা লাগবে?’

শেষ প্রশ্নটা খুব উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করছিলো আরমান। জবাবে সোহাগ তাকে নিরুৎসাহিত করে দিয়ে বললো,’মেয়েগুলো কি পড়াশুনা জানে?’

প্রশ্নটা শুনে দমে গেলো আরমান। মনে মনে সোহাগের ওপর বিরক্ত হলো সে। সে কি স্কুল খুলে বসেছে যে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবে? ঐসব জায়গায় লেখাপড়ার কি কাজ? কথাটা মুখের ওপরেই বলতো কিন্তু পঁচিশ হাজার টাকার মায়া তাঁকে আটকে দিলো! পাছে ডিলটা ক্যান্সেল হয়ে যায় তাই গলায় যথেষ্ঠ মোলায়েম ভাব বজায় রেখে বললো,’এইটা তো আগে বলেন নি স্যার?’

তাঁর ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে আশরাফি সান্ত্বনার সুরে বললো,’না মানে, জানতেই হবে তেমন কোন কথা নেই। কিন্তু জানলে ভালো হতো আরকি। আসলে,বিদেশি ক্লায়েন্ট তো। টুকটাক কথা চালানোর মতও যদি নাহয় তাহলে তো বুঝতেই পারছেন? তাই টুকটাক কথা চালানোর মতও যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে সমস্যা নেই বাকিটুকু শিখিয়ে দেওয়া যাবে।’

চট করে মধুর কথাটা মাথায় এলো আরমানের। হেসে উঠে বললো,’কোন সমস্যা নেই স্যার আমার ওয়াইফ পড়ালেখা জানে তিনি শিখিয়ে দিতে পারবেন। আপনারা বরং তাঁর সাথে একবার দেখা করে তাঁকেই সবকিছু বুঝিয়ে বলুন।’

আশরাফি দ্রুত একবার সোহাগের মুখের দিকে চাইলো। ঐ জায়গায় যাওয়া মানে মানসম্মান সব শেষ! কেউ দেখতে পেলে বিরাট কেলেঙ্কারি। এদিকে কাজটা জরুরী! তথাপি সোহাগ বন্ধুর মনের কথা বুঝতে পেরে মাথা নাড়িয়ে বললো,’দুঃখিত আমরা যেতে পরবো না।আপনিই বরং উনাকে বুঝিয়ে বলবেন!’

আরমান বাধা দিয়ে বললো,’বুঝেছি স্যার। আপনারা ভদ্রলোক! ঐসব জায়গায় যেতে মানসম্মানের ভয় করেন। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, কোন সমস্যা হবে না। রাতে যাবেন। রাতের বেলা এদিকে মানুষজন তেমন থাকে না। কেউ চিনবে না আপনাদের। কথাবার্তা শেষ করে আবার চলে আসবেন!’

মুখে যতই সাধু সাজার চেষ্টা করুক না কেন আরমানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনভাবে সোহাগ এবং আশরাফিকে সেখানে নিয়ে যাওয়া। ব্যাচেলর ছেলে একবার নিয়ে গিয়ে মেয়েমানুষের চক্করে ফেলে দিতে পারলেই বেশ ভালো টাকা আয় করা যাবে।

এরপরেও কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো দুই বন্ধু। আশরাফি বারণ করে দিয়ে বললো,’আমাদেরকে দেখানোর দরকার নেই। মিটিংয়ের দিন আপনি সময়মত উনাকে নিয়ে হাজির হলেই চলবে।’

আরমান নাছোড় বান্দা, বিটকেল মার্কা একটা হাসি দিয়ে বললো,’এতগুলো টাকা দিয়েছেন। আপনাদেরও ব্যবসার ব্যপার আমারও ব্যবসার ব্যপার। তাই বলি কি, একবার যদি আপনারা আমার ওয়াইফকে সব কিছু বুঝিয়ে বলতেন আমার জন্যেও সুবিধা হতো। তিনি আপনাদের মনমত করে তৈরী করে দিতে পারতেন মেয়েগুলোকে। তার হাতের কাজ খুবই পাঁকা!’

এবারে সোহাগ ফিসফিস করে বললো,’কি বলিস যাবি নাকি?’

আশরাফি বিরক্তমুখে বললো,’তুই যা।’

অতঃপর সোহাগ আরমানকে উদ্দেশ্য করে বললো,’ঠিক আছে আমরা যাবো। এখন তাহলে আসি। কখন যেতে পারবো আপনাকে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হবে।’

দুইবন্ধু রাত সাড়ে দশটার দিকে সময় দিলো আরমানকে। কিন্তু সাড়ে দশটায় বললেও তাঁরা হাজির হলো রাত সাড়ে বারোটায়। রাত গভীর হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো দুজনে। আরো দেরী করতো কিন্তু আরমানের ফোনের জ্বালায় টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাড়াতাড়ি আসতে হয়েছে। কিছুক্ষন কথাবার্তার পর আরমান মধুকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালো।

লোক পাঠানোর মিনিট পাঁচেক বাদেই উপরতলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা গেলো মধুকে। তার পরণে গাড় নীল রংয়ের কাতান শাড়ি। ফুলহাতা ব্লাউজের সাথে বাঙালী ধাঁচে একপ্যাঁচি করে পরেছে শাড়িখানা। শাড়ির আঁচলে একগোছা চাবি বাঁধানো। পোশাক আশাক, চলুনভঙ্গী, সাজগোজ দেখে যে কেউ ভাববে আগেকার দিনের কোন জমিদার ঘরের বউ সে।
মধুর দিকে চোখ পড়তেই সোহাগ হতভম্ভ। বন্ধুর ফোনে মেহেরের ছবি অনেকবার দেখেছে সে। অতএব সন্দেহের কোন অবকাশ নেক এই মেয়েটাই মেহের! অবাক হয়ে আশরাফির দিকে চাইলো সে। আশরাফি নির্বাক! ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে তাঁর সমস্ত পৃথিবী! একনিমিষেই সরে গেছে পায়ের তলার মাটি! কেউ যেন আচমকাই তাকে ধাক্কা মেরে কোন এক অন্ধকার গুহায় ফেলে দিয়েছে। চোখেমুখে একরাশ বিস্ময়,হতাশা, গ্লানি নিয়ে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলো সে,’মেহের!’ আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়াতে শুরু করলো তাঁর কথাটা!
চমকে উঠলো মধু! কতদিন বাদে আবার নিজের নামটা শুনেছে সে। কিন্তু তবুও কোন আনন্দ, উচ্ছ্বাস কিছুই প্রকাশ করতে পারলো না! উল্টো বুকের ভেতর শুরু হলো তীব্র মাত্রার কম্পন! পলকহীনভাবে চেয়ে রইলো সামনের মানুষটার দিকে! তথাপি সামনে এগোতে পারলো না! কেউ যেন তাঁর হঠাৎ করেই চলৎশক্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে। মাথা ঘুরেই পড়ে যাচ্ছিলো, সিঁড়ি হাতল ধরে কোনমতে সামলে নিলো। কিন্তু তখনো নিজেকে সামলাতে পারে নি আশরাফি। সে হতবাক, বিমূঢ়, বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো সামনের মানুষটার দিকে!
.
.
.
চলবে

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৫

পালংকের ওপর মূর্তির ন্যায় বসে ছিলো মধু। তার ভেতরে কি চলছে তা কেবল সেই জানে। পরনের শাড়ি আলুথালু, মাথার চুল এলোমেলো। একরাতেই কোটরে বসে গেছে চোখ। কপালে ব্যান্ডেজ বাধানো। কালরাতের পর থেকে আজ সারাদিন নাওয়া খাওয়া কিছুই হয় নি তাঁর। উদ্ভ্রান্তের মত খোলা জানালার দিকে চেয়ে আছে। আরমান ভেতরে ঢুকে গলা খাঁকারি দিলো। সচকিত হলো মধু। নড়েচড়ে বসলো সে। তার মলিন মুখের দিকে আরমান মৃদু কোমল স্বরে বললো,’আশরাফি সাহেবদের কি তুমি আগে থেকেই চিনতে?’ আরমানের কথার জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মধু। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,’ইনিই সেই! যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।’

একসময় আশরাফিকে নিয়ে সবার সাথে প্রচুর গল্প করতো মধু। তাঁর উদ্দেশ্যহীন জীবনের একমাত্র আনন্দ ছিলো আশরাফিকে নিয়ে গল্প করার সময়টুকুতেই। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই গল্পটাও পুরোনো হয়ে গেলো। এখন আর কেউ শুনতে চায় না সেই গল্প। মধুও বলে না। কিন্তু আশরাফি দেখার পর থেকেই পুরোনো সেই স্মৃতিগুলো আবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। রঙিন, আনন্দঘন স্মৃতি! তার পরপরই আবার আশরাফির তীব্র ঘৃণাযুক্ত রাগত চেহারা!

আরমান মধুর মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,’তারমানে ইনিই তোমার সেই পুরাতন প্রেমিক?’

জবাবে মলিন হাসলো মধু। প্রেমিক আবার পুরাতন হয় নাকি? প্রেমিক তো প্রেমিকই! কিন্তু এসব কথা আরমান বুঝবে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, চুপ করে রইলো সে।
এদিকে কালরাতের পর থেক চিন্তায় আছে আরমান। মধুর রিয়েকশন দেখেই সে বুঝে নিয়েছিলো লোকগুলোর সঙ্গে পুরোনো কোন সংযোগ তাঁর আছে। তাই মনের ভেতর ভয় ঢুকে গিয়েছে তাঁর। সেধে সেধে লোকগুলোকে এখানে ডাকা মোটেই উচিৎ হয় নি। এখন যদি তাঁরা মধুকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চায়? মধু চলে ফেলে আরমানের কি হবে? কে তাঁকে যত্ন করে ভাত বেড়ে খাওয়াবে? কে তাঁকে শাসন করবে? কে তাঁকে সৎপরামর্শ দেবে? কার মুখখানা ভেবে ঘরে ফিরবে আরমান?
নাহ! আর ভাবতে পারলো না সে। মধু চলে গেলে একমুহূর্তও শান্তিতে থাকতে পারবে না আরমান। অতএব যে করেই হোক মধুকে তাঁর চাই। দরকার হলে ডিলটা ক্যান্সেল করে দেবে কিন্তু তবুও মধুকে ছাড়বে না। তাঁর শঙ্কিত মুখের দিকে চেয়ে মধু ম্লান হেসে বললো,’তোমার ভয় নেই! সে আর এখন আমাকে চাইবে না। জেনেশুনে কেউ এমন মেয়েকে ঘরে তুলবে না।’

কথাটাআরমানের পছন্দ হলো। তবুও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলো না সে। সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,’যদি চায়?’

আরমানের চোখেমুখে উৎকন্ঠা, ভয়! মধু স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফের হেসে ফেললো। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো,’চাইবে না। তবুও যদি চায়, আমি যাবো না।’

ভরসা পেলো আরমান। মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাঁর! কৃতজ্ঞ হাসি! মধু যখন নিজমুখে স্বীকার করেছে তাঁরমানে আর কোন ভয় নেই। কোথাও যাবে না সে। অবশ্য খামোখাই ভয় পাচ্ছিলো আরমান! মধু যতই রূপসী হোক না কেন, যতই তাদের মধ্যে ভালোবাসা থাকুক না কেন, কোন ছেলেই বা এমন একটা মেয়েকে নিজের ঘরের বউ করতে চাইবে না। আরমানের সামাজিক কোন বাধা নেই তাই সে চাইলেই মধুকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু আশরাফি? তাঁর পক্ষে তো সমাজের বিপক্ষে গিয়ে মধুকে বিয়ে করাটা সম্ভব নয়। সমাজের চোখে মধু একজন প্রস্টিটিউট! এর চেয়ে ভালো কোন সামাজিক মর্যাদা তাঁর নেই!
অতএব মাথা থেকে চিন্তাটা সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া মধু নিজমুখেই বলেছে আশরাফি তাকে চায় না। সুতরাং এসব নিয়ে আর বেশি চিন্তা না করাই ভালো। যত বেশি চিন্তা করবে সমস্যা ততই বাড়বে।

মধুর বিষন্ন মুখের দিকে চেয়ে সান্ত্বনার সুরে বললো,’পুরোনো কথা মনে করে লাভ কি মধু? তাতে কি দুঃখ কমবে? মোটেও কমবে না উলটে আরো বাড়ে। তারচেয়ে বরং এসব চিন্তা বাদ দিয়ে যাও গোসল সেরে এসো। আজকে দুজন একসঙ্গে খাবো! তারপর তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো একজায়গায়।’

ছেলেমানুষি কথাবার্তা! হাসলো মধু! চারবছরে এই প্রথম আরমান তাকে নিয়ে বাইরে বেরোনোর কথা বলেছে। নতুবা এখানে যারা আসে তাদের জন্য বাইরের পৃথিবীর নিষিদ্ধ! চাইলেও বেরোনোর ক্ষমতা নেই তাদের। ঠাট্টার সুরে বললো,’আজকে হঠাৎ এত খাতির?’

আরমান সলজ্জ হাসলো। মাথা নিচু করে বললো,’না মানে। তোমার মন ভালো নেই তাই বলছিলাম। তবে তোমার যদি কোন অসুবিধে থাকে তাহলে থাক।’

মধুর মুখের হাসি গুটিয়ে নিলো। এখন আর বাইরে যেতে মন চায় না তাঁর! নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখতেই ভালো লাগে। আরমানের কথার জবাবে হ্যাঁ বা না কিছুই উত্তর দিলো না সে। ভেতরে ভেতরে ব্যথিত হলো আরমান। মধুকে সে কিসের অভাব দিয়েছে? সম্মান, শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা কোনকিছুতেই তো কোন কমতি রাখে নি! তবে এতগুলো বছরেও কেন মধু তাকে ভালোবাসতে পারলো না? মৌনমুখে বললো,’তোমার বোধহয় যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাই না?

-‘না।’

-‘কিন্তু কেন? এতদিন বাদে তোমাকে নিয়ে বাইরে বেরোতে যাবো বললাম অথচ তোমার কোন আগ্রহই নেই? কেন মধুবালা?’

-‘কারণ এখন আর আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। সব ইচ্ছে মরে গেছে।’ আরমান শেষ চেষ্টাস্বরূপ আরেকবার জোর করতে চাইছিলো মধু বারণ করে দিয়ে বললো,’কুয়োর ব্যাঙ কুয়োতেই ঠিক আছে। আলোর ঝলকানি তাঁকে দেখিয়ো না। সইবে না।’
দমে গেলো আরমান। আর কথা বাড়ালো না সে। চুপচাপ বেরিয়ে গেলো।


কম্পিউটার টেবিলের সামনে দুম ধরে বসে আছে আশরাফি। বুকের ভেতরটা জ্বালাপোড়া করছে তাঁর। কিন্তু এতকিছুর পরেও মধুকে ঘৃণা করতে পারছে না সে। নিজের জ্বালা মেটাতেই কালরাতে মধুকে তীব্রভাবে অপমান করে এসেছে সে। কিন্তু সেই জ্বালা এখন বিষের মতন তাঁকেই দংশন করছে। মধুকে আঘাতের যন্ত্রণা শূল হয়ে প্রতিটা মুহূর্তে তাঁর বুকেই এসে বিঁধছে। যন্ত্রণায় সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারে নি। চাপা মষ্টে বুকের ভেতরটা ভেঙে, গুড়িয়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে তাঁর, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। নিজেকে বড় অসহায়, নিরর্থক মনে হচ্ছে। কাউকে ভালোবাসার যন্ত্রনায় সত্যিই অদ্ভুত। এর জন্যেই।বোধহয় কবি বলে ছিলেন,
তুমি লহ নাই ভালোবাসিবার দায়।
দুহাতে শুধুই কুড়িয়েছো ঝরা ফুল।
কৃষ্ণচূড়ার তলে আমি বসে একা
বুনিয়াছি প্রেম, ঘৃণা বুনিবার ছলে।
যতবার করে আশরাফি নিজেকে বোঝাতে চাইছে, সে মধুকে ঘৃণা করে ততবারই ভেতর থেকে কেউ একজন যেন বলে উঠছে,’তুমি এখনো তাঁকে পাগলের মত ভালোবাসো আশরাফি। সমস্ত পৃথিবীর চাইতেও বেশি!
অথচ কালরাতে মেহেরকে জঘন্যভাবে অপমান করে এসেছে সে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করে এসেছে তাঁর। তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এসেছে তাঁর দিকে। কিন্তু তএতকিছুর পরেও কেবল সেই জানে কতখানি গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে ছিলো সেই ঘৃণার আড়ালে।

শেক্সপিয়ার বলেছিলেন,’লাভ মি অর হেইট মি, বোথ আর ইন মাই ফেভার। ইফ ইউ লাভ মি, আই উইল অলওয়েজ বি ইন ইউর হার্ট। ইফ ইউ হেইট মি, আই উইল অলওয়েজ বি ইন ইউর মাইন্ড!’ অর্থাৎ আমাকে ভালোবাসো কিংবা ঘৃণা করো দুটোই আমার পক্ষে। যদি তুমি আমাকে ভালোবাসো তবে আমি সর্বদা তোমার হৃদয়ে থাকবো আর যদি ঘৃণা করো তবে আমি থাকবো তোমার মনে।’ তাই এতকিছুর পরেও আশরাফির মন মস্তিষ্ক দুটোকেই দখল করে বসে আছে মধু। শত চেষ্টা করেও মন থেকে মধুর মুখটা মুছে ফেলতে পারছে না আশরাফি। রাগ করে মধুর পুরোনো সব ছবি ডিলিট করে দিয়েছে সে। কিন্তু তাতে কোনা লাভ হলো না। মধুর যেই জ্যান্ত ছবিখানা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সেটা কিছুতেই মুছতে পারলো না। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সেই জ্বালাময়ী মুখ!
আর যতবারই মধুর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ততবার মাথায় আগুন জ্বলছে আশরাফির। নিজেকে কোনভাবেই শান্ত রাখতে পারছে না সে। শান্ত রাখবেই বা কি করে? তাঁর মেহের! তাঁর ভালোবাসার মানুষ! টাকার জন্য অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গী বানিয়েছে নিজকে! এই দুঃখ কি আদৌ মিটবে আশরাফির! আকস্মিক চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো তাঁর। অশ্রমাখা কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো,’তুমি মরে গেলেও বোধহয় এতটা কষ্ট হতো না মেহের, যতটা কষ্ট এখন হচ্ছে। আমার বড় দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছো তুমি। তুমি যে আমার ছিলে কি তা তুমি নিজেও জানো না! কিন্তু আজকে তুমি সব শেষ করে দিলে।’

সোহাগ ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর বসলো। আশরাফির বিধ্বস্ত মুখের দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত গলায় বললো,’তুই এখনো এসব নিয়ে ভাবছিস? তোকে কতবার বারণ করেছি এসব আর ভাবিস না তবুও বারবার কেন ঘুরেফিরে ঐ মেয়েটার কথাই ভাবিস তুই? কি আছে ওর মাঝে? ঐ মেয়ে ছাড়া কি পৃথিবীতে আর কোন মেয়ে নেই? নিজের চোখেই তো দেখলি টাকার জন্য নিজেকে কতটা নিচে নামিয়েছে সে। তবুও কেন ওকে নিয়েই পড়ে আছিস তুই আমি বুঝি না। এতদিন নাহয় চোখে দেখিস নি তাই অন্ধের মত ভালোবেসে গেছিস কিন্তু এবার তো নিজের চোখেই দেখেছিস তাঁর কর্মকাণ্ড! এতকিছুর পরেও যদি তোর শিক্ষা নাহয় তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই তোকে। তোর যা মন চায় তুই কর।’

আশরাফি একফোঁটাও জবাব দিলো না। পূর্বের ন্যায় থম মেরে রইলো সে। গা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে তাঁর! চোখ জ্বালাপোড়া করছে। সবকিছু ভেঙ্গে,গুড়িয়ে তছনছ করে দিতে মন চাইছে।

গতকাল রাতে মেহেরকে দেখার পর সোহাগ ওয়াশরুমে যাবার বাহানায় তাঁর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলো আশরাফিকে। কিন্তু মেহেরের বুক ফাটলো তবু মুখ ফাটলো না। নিজের সমস্ত,দুঃখ, কষ্ট, বেদনা সব নিজের মাঝেই রেখে দিলো সে। আশরাফি যখন সীমাহীন বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলো তখন আশরাফিকে করা তার প্রথম প্রশ্নটা ছিলো ,’বিয়ে করেছো?’

আশরাফির জবাবহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু তাঁর সকরুণ চোখের মনি সার্চলাইটের মত প্রদক্ষিণ করছিলো মধুর সমগ্র মুখে। বোধকরি, মধুর হাসিমুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বেদনার রহস্য খুঁজে বের করতে চাইছিলো সে। কিন্তু ধরা দিলো না। হতাশ হয়ে আশরাফি ধরে আসা কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো,’সেটা জেনে তোমার লাভ কি মেহের?’
ভেবেছিলো সত্যিটা বলবে মধু। কিন্তু জবাবে হাসলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসিমুখেই বললো,’ভয় নেই। তোমার ঘাড়ে চেপে বসবো না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম!’

তখনো নিজেকে পুরোপুরি সামলাতে পারে নি আশরাফি। সে বিশ্বাসই করতে পারছিলো না মধুই সত্যিই তাঁর সামনে! সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। যাকে এতগুলো বছর ধরে সযত্নে নিজের হৃদয়ে লালন করে এসেছে তাঁর দেখা এমন জঘন্য জায়গায় মিলবে! মধুর ঠাট্টায় যোগ না দিয়ে বিস্ময়াবিষ্ট, সকরুণ কণ্ঠে বললো,’এই অবস্থা কেমন করে হলো মেহের?’

-‘মেহের বলে এখানে কেউ আমাকে ডাকে না। মধুবালা বললেই বেশি খুশি হবো।’

-‘এড়িয়ে যাচ্ছো?’

যদিও আশরাফির প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পেরেছিলো মধু। তথাপি না বোঝার ভান করে বললো,’এড়িয়ে যাবো কেন? বলো কি জানতে চাও?’

-‘তুমি এখানে কেন?’ আবারো করুণ কন্ঠস্বর আশরাফির।

-‘আমি তো এখানেই থাকি।’

-‘কিন্তু কেন? ঐ লোকটা কেন বলছে তুমি তাঁর স্ত্রী?’

সবার কাছে মধুকে নিজের বউ বলেই পরিচয় দেয় আরমান। মধুও অবশ্য এই নিয়ে কোন দিন কোন প্রতিবাদ করে নি। করে লাভই বা কি? এইখানে যারা আসে তাদের বিয়ে হলেও কি, না হলেও কি? তাঁদের জীবন এমনিতেই নিরর্থক! সম্মান পাবার কোন অধিকার তাদের নেই। তাদের কেবল একটাই কাজ। টাকার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। এর বাইরে আর কোন কাজ নেই তাদের।
হ্যাঁ! মধুকে হয়ত অন্যন্য মেয়েদের মত লোভী পুরুষদের শয্যাসঙ্গিনী হতে হয় নি কিন্তু তবুও চারবছর যাবত এখানে আছে সে। এখন আর নিজেকে আলাদা বলেই মনে হয় না। মনে হয় যেন, এদেরই একজন সে। তাই বিয়ে নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যথা ছিলো না। কেউ জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখেই আরমানের কথা সমর্থণ করে নিতো সে। কিন্তু আজকে পারলো না। বুকের ভেতর কোথাও গিয়ে যেন লাগলো আশরাফির প্রশ্নটা! জবাবে খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,’ভুলে বলেছে ও। আমি কারো বউ নই।’ কিন্তু পারলো না। মনের কথা মনেই চাপা দিয়ে জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে এনে বললো,’হ্যাঁ। ঠিকই তো বলেছে। আমি ওর বউ। বিয়ে হয়েছে আমাদের দুজনের।’

একের পর এক আঘাতে জর্জরিত আশরাফি। মধুর নিজমুখে স্বীকার করার পরেও তাঁর কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,’বিয়ে হয়েছে? নাকি ঐ লোকটা নিশ্চয়ই জোর করে তোমাকে এখানে ধরে এনেছে?’

-‘দেখে কি তাই মনে হচ্ছে?’

-‘মানে?’

-‘মানে আমাকে দেখে কি কোনভাবেই মনে হচ্ছে যে জোর করে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে? কিংবা খুব কষ্টে আছি আমি?’

এবার জ্বলজ্বল করে উঠলো আশরাফি চোখজোড়া। চোয়ালের পেশিগুলো কঠিন হয়ে এলো তাঁর। ধারালো কণ্ঠে বললো,’কি বলতে চাইছো তুমি? এখানে খুব সুখে আছো?’

-‘আমি কিছুই বলতে চাইছি না। আমি শুধু তোমার ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দিতে চাইছি। এখানকার মালকিন আমি। আমার কথাতে সব কিছু হয় এখানে। সুতরাং আমাকে জোর করার মত প্রশ্নই উঠে না।’

-‘আমার প্রশ্নের সরাসরি জবাব চাই। হ্যাঁ অথবা না?’

-‘না। আমি নিজের ইচ্ছেতেই এখানে এসেছি।’

-‘মিথ্যেকথা। নিজের ইচ্ছেই কেউ কখনো এখানে আসে না।’

-‘কিন্তু আমি এসেছি। আমার টাকার দরকার ছিলো। প্রচুর টাকার।’

-‘টাকা?’

-‘হ্যাঁ টাকা। আমার প্রথম স্বামী ইশতিয়াক মারা যাওয়ার পর তাঁর বাড়ির লোকজন আমাকে জোর করে আটকে রেখেছিলো তাঁদের কাছে। বন্দী অবস্থায় আমার ওপর অনেক অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে ছিলো তাঁরা। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম আমি। নিজের খরচ চালানোর মত তখন একটা কানাকড়িও ছিলো না আমার কাছে। ঠিক সেইমুহূর্তেই আরমানের সাথে দেখা হলো। সে আমাকে বিয়ে করে এখানে নিয়ে এসেছে।’

-‘ওর ব্যবসার কথা তুমি জানতে?’

-‘হ্যাঁ। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগলেও এখন সয়ে গেছে। তাছাড়া আমাকে অনেক ভালোবাসে সে।’

মেহেরের এমন নিখুঁত মিথ্যে বর্ণনার পরেও আশরাফির সন্দেহ গেলো না। অবিশ্বাস্য কন্ঠে রাগত মুখে বললো,’ক্রমাগত মিথ্যে বলে যাচ্ছো তুমি। আমি জানি, ঐ লোকটা তোমাকে জোর করে এখানে ধরে নিয়ে এসেছে। নতুবা তোমার বাবা কোথায়?’

অন্য যে কেউই হলে আশরাফির রাগত চেহারা দেখে ঘাবড়ে যেত। কিন্তু মধু ঘাবড়ালো না। এবারেও মসৃণ মিথ্যে বর্ণণা করে গেলো সে। আশরাফির প্রশ্নের জবাবে শব্দ করে হেসে উঠে বললো,’তোমার ধারণা তুমি তোমার কাছেই রাখো না। ওসব আমি ভাবি না। আমি বাবার কাছে যাইনি তার কারণ বাবার ওপর রাগ ছিলো আমার। গেলেও বিশেষ কোন লাভ হতো কিনা জানি না। কারণ ইশতিয়াকের মৃত্যুর পর তিনিই আমাকে ওদের বাড়িতে রেখে এসেছিলেন। যাইহোক, সেসব কথা এখন থাক। কিন্তু নিজের মত করে এসব কেন ভাবছো আমি বুঝতে পারছি না? একটা কথা বলি তোমাকে, এতে হয়ত তোমার সন্দেহ কিছুটা হলেও দূর হবে, আরমান যতই খারাপ হোক না কেন আমাকে ও খুব ভালোবাসে। সুতরাং ভুল ভাবার কোন কারণ নেই। যথেষ্ট সুখে আছি আমরা। বেশ ভালো আছি। কোন কিছুর অভাব নেই। বলার আগেই সব হাজির রাখে আরমান।’

আশরাফি রাগে বাক্যহারা হয়ে গেলো। মুখের কথা মিলিয়ে গেলো তাঁর। এ কোন মেহেরকে দেখছে সে? টাকা মানুষকে এতটা পরিবর্তন করে দিতে পারে? তীব্র ঘৃণা মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। তীরস্কারের সুরে বললো,’তারমানে নিশ্চয়ই টাকা রোজগারের জনে সে তোমাকেও এই ব্যবসায় নামিয়েছে?’

-‘আমাকে কারো নামানোর দরকার নেই। আমি নিজের ইচ্ছেতেই নেমেছি!’

মধুর কথা শেষ হতে না হতেই ঠাস করে চড় পড়লো তাঁর গালে। রাগ লাল হয়ে গেছে আশরাফির গৌরবর্ণ মুখখানা। মধুর মুখ থেকে এমন জঘন্য কথাবার্তা শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারে নি সে। সপাটে চড় বসিয়ে দিয়েছে মধুর গালে। চড় মেরেও রাগ কমলো না। ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললো ,’মরে গেলে না কেন তুমি? এখনো কেন বেঁচে আছো? এবার আমি তোমাকে খুন করবো।’

কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছিলো আশরাফির। সর্বাঙ্গে জ্বালা করছিলো! এমনিতেই এখানে আসার পর থেকেই গা ঘিনঘিন করছিলো তাঁর। প্রথমেই মেয়েগুলোকে দেখে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো সে। তারপর যখন মধুকে দেখলো হৃদপিন্ডটা পাঁজর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো! এত আঘাতের পর আবার মধুর এসব কথাবার্তা। সহ্যের তো একটা সীমা আছে মানুষের? এর পরেও একটা মানুষ কি করে নিজেকে শান্ত রাখতে পারে?
এদিকে চড় খেয়ে হাসছে মধু। হাসতে হাসতেই বললো,’তুমি এখনো বোকার মত আমাকে ভালোবাসো নাকি বিয়ে করেছো? কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে না?’

আশরাফি মুখ দেখে মনে হলো পারলে এখনই মধুকে খুনই করে ফেলে সে। কিন্তু মধু বিন্দুমাত্রেও ঘাবড়ালো না। আশরাফি রাগকে ক্রমাগত বাড়িয়ে দিয়ে নির্লজ্জের মত হাসছে সে। আশরাফি রাগে দিশেহারা হয়ে সজোরে তাঁর বাহু চেপে ধরে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’এরপরেও হাসি আসছে তোমার? নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়েমানুষ একটা! লজ্জা করে না তোমার? তোমার মুখ দেখাও পাপ।’ কথা শেষ করে সজোরে মধুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো সে। ছিটকে পড়ে গেলো মধু। বেকায়দা পড়ে কপাল ফেটে গেলো তাঁর কিন্তু ফিরেও তাকালো না আশরাফি। গটগট করে বেরিয়ে গেলো। ততক্ষনে সোহাগকে নিয়ে ফিরে এসেছে আরমান। মধু মেঝেতে বসে দেখে অবাক হলো সে। রক্ত চোখে পড়তেই উদ্বিগ্ন কন্ঠ বললো,’একি মধু? তোমার এই অবস্থা কেন? রাফি সাহেব কোথায়?’

চোখে কোনে জল চিকচিক করছিলো মধুর। সোহাগ হতভম্ভ! চোখ বড়বড় করে চেয়ে ছিলো মধুর দিকে। আরমানের কথার জবাবে মধু মুচকি হেসে বললো,’উনি চলে গেছেন!’.

-‘কিছু বলে যায় নি?’

-‘না।’

আরমানের সন্দেহ হলো! সোহাগের হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে যেতে চাওয়া, ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাওয়া, কাউকে কিছু না বলে আশরাফির বেরিয়ে যাওয়া, মধুর কপালে রক্ত, সবমিলিয়ে একটা না একটা ঘাপলা তো নিশ্চয়ই আছে। তথাপি কথা বাড়ালো না সে।সোহাগের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মধুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। মধু ছলছল চোখে একবার সোহাগের মুখের দিকে চেয়ে ধীরেধীরে ভেতরে ঢুকে গেলো তাঁর সঙ্গে।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here