মধুবালা,০৮,০৯

0
502

#মধুবালা,০৮,০৯
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮

নিজের জন্য নির্ধারিত রুমে বসে ডিপার্টমেন্টের অফিসিয়াল কিছু কাজ করছিলো আশরাফি। এই আওয়ারে তাঁর ক্লাস নেই। সেই ফাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জরুরি কাজগুলো গুছিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিলো সে। দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে জামা, ওড়না ঠিক করে নিলো নীলা। থাই গ্লাসের আয়নায় চুলটা একবার দেখে নিয়ে রুমের দরজায় উঁকি দিলো সে। সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’স্যার আসবো?’

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা ছিলো আশরাফি। দরজার কাছে আওয়াজ পেয়ে সোজা হয়ে বসলো। সামনে খুলে রাখা ল্যাপটপে স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে হাত দিয়ে ভেতরে ঢোকার ইশারা করলো নীলাকে। গতকালকের কথা মনে পড়তেই অনুতপ্ত কন্ঠে বললো,’আমি খুবই দুঃখিত নীলা, কালকে তোমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে পারি নি। আসলে হঠাৎ করেই একটা জরুরী কাজ পড়ে গিয়েছিলো। ফোনটাও সাইলেন্ট করা ছিলো তাই কল রিসিভ করতে পারি নি। তুমি কিছু মনে করো নি তো?’ নীলা জোরপূর্বক হাসলো। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকে বললো,’ ইটস ওকে স্যার।’

-‘বসো।’

মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলো নীলা। তাঁর চোখমুখে উদ্বিগ্নতা, ভয়। ম্লান কন্ঠে বললো,’একটা কথা বলার ছিলো স্যার।’

পুনরায় হেলান দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারে বসলো আশরাফি। হাতের কলমটা ঘোরাতে ঘোরাতে নীলার মুখের দিকে একপলক চাইলো সে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনকিছু নিয়ে ভীষণ মন খারাপ মেয়েটার! সচরাচর নীলাকে হাসিমুখেই কথা বলতে দেখেছে সে। তাই আজকে হঠাৎ ওকে আপসেট দেখে একটু অবাকই হলো। তথাপি নীলার কথার জবাবে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো সে,’বলো, কি বলবে।’

নীলার বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে! কথাটা আশরাফিকে জিজ্ঞেস করা ঠিক কতটুকু শোভন হবে বুঝতে পারছে না সে। কিন্তু জিজ্ঞেস না করেও উপায় নেই। নিজের সহপাঠীর কাছ থেকে স্যারের সম্পর্কে এমন জঘন্য একটা কথা শোনার পর চুপ করে বসে থাকাটা মোটেও সমীচীন মনে করলো না সে। বিষয়টা আশরাফির সম্মানের ব্যপার। তাই চুপ থাকতে পারলো না সে। একরকম বাধ্য হয়েই আশরাফির কাছে এসেছে।

ঘটনাটা হচ্ছে ইউনিভার্সিটি আসার পর থেকেই নীলা আশরাফিকে নিয়ে কানাঘুষা শুনছে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই সবাই চুপ হয়ে যায়। শেষমেশ খুব কাছের এক বান্ধবীর কাছ থেকে ঘটনাটা জানতে পারে সে।

গতকাল রাতে আশরাফি যখন মধুদের ওখানে গিয়েছিলো ঘটনাচক্রে সেখানকার একটা কাছাকাছি এলাকাতেই বেড়াতে গিয়েছিলো নীলাদের এক সহপাঠী ছেলেবন্ধু। এলাকাটা তাঁর নানার বাড়ি। রাতের বেলা তাঁর মামার সাথে হাঁটতে বেরিয়েছিলো সে। এদিকে ব্রোথেলের চিপা গলিতে গাড়ি না ঢোকায় বেশ খানিকটা পথ হেঁটেই যেতে হয়েছিলো আশরাফিকে। যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি বাসায় পাঠিয়ে দেয় সে। এবং তখনই দূর থেকে তাঁকে দেখতে পায় ছেলেটা। কিন্তু মিনিটখানেক জন্য সে নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না লোকটা আশরাফি। ভালোভাবে সিউর হওয়ার জন্য আশরাফির পিছু নিলো সে। তারপর যখন দেখলো মানুষটা সত্যিই আশরাফি ছবি তোলার জন্য ফোনও বের করেছিলো। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো আশরাফি।

অতঃপর আজকে ক্লাসে এসে সত্যমিথ্যে মিলিয়ে সে-ই নানারকম গুজব ছড়াচ্ছে আশরাফি নামে। আশরাফি স্যারের মতন মানুষও ব্রোথেলে যায়। বন্ধুদের সাথে আলোচনার জন্য এই চাইতে রোমাঞ্চকর বিষয়বস্তু আর কি হতে পারে না? অতএব যতরকম মশলাপাতি আছে সব মিক্স করে বিষয়টাকে আরো ইন্টারেস্টিং, আরো থ্রিলিং করার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু সমস্যা হলো ক্লাসের কেউই বিশ্বাস করলো না তাঁর কথাটা। নীলা তো না-ই, কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস আর যাই হোক, আশরাফি স্যার এমন খারাপ জায়গায় যেতেই পারেন না। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের অন্য মেয়েরাও খেপে গেলো। তাঁদের প্রিয় আশরাফি স্যারকে নিয়ে এসব বাজে কথা ছড়ানো হচ্ছে সহ্য করতে পারছিলো না কেউ। উল্টো ছেলেটাকেই কথা শুনিয়ে দিলো তাঁরা। আর শুধু মেয়েরা কেন? ক্লাসের বেশিরভাগ ছেলেই বর্ননাকারীর সমস্ত কথা নিতান্তই না শোনার ভান করে অবজ্ঞাভরে ঝেড়ে ফেলে দিলো। সবার এক কথা, তাঁর হয়ত দেখার ভুল হয়েছে কিংবা এর মাঝে অন্য কোন ঘটনা আছে। কিন্তু আশরাফি স্যার যাবেন ব্রোথেলে? এমনটা হতেই পারে না! যদিও বর্ণনাকারী গ্যারান্টি দিয়ে বলছে সে শতভাগ নিশ্চিত লোকটা আশরাফিই ছিলো। তথাপি কেউ বিশ্বাস করলো না তাঁর কথা। নীলার তো চড়িয়ে গাল লাল করে দিতে মন চাইছিলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো সে। তাই ক্লাসের ফাঁকে, আসলে কি ঘটেছিলো সেটা জানার জন্যই আশরাফির কাছে এসেছে সে। কিন্তু এখন লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারছে না। এমন একটা কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা তো সহজ নয়! যে কারোরই লজ্জা, হওয়ার কথা। কিন্তু কিছুক্ষণ বসে থাকার পর অনুভব করলো সে, লজ্জার চেয়ে বেশি যেটা হচ্ছে সেটা হলো ভয়। অত্যাধিক ভয়ে হলা শুকিয়ে আছে তাঁর। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো।

আশরাফি স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে বললো,’এনিথিং রং?’

জবাবে অসহায় দৃষ্টিতে চাইলো নীলা। নিজের অজান্তেই এতক্ষণ বাম হাত দিয়ে টেবিল খুঁটছিল সে। আশরাফির শান্ত চাহনীতে সচেতন হয়ে হাত গুটিয়ে নিলো। সেদিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো আশরাফি,’কোন সমস্যা?’

-‘একটা প্রশ্ন ছিলো স্যার।’, অবশেষে মুখ খুললো নীলা।

-‘বলো না।’

এবারে শুকনো ঢোক গিললো নীলা। হার্টবিট অসম্ভব দ্রুত উঠানামা করছে তাঁর। আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,’আপনি মাইন্ড করবেন না তো স্যার?

প্রশ্নটার জবাব সাথে সাথেই দিলো না আশরাফি। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবলো সে। ভাবা শেষ হলে বললো,’কথাটা কি মাইন্ড করার মতন?’

এমনিতেই ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে নীলার। তাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা নিয়ে অত্যাধিক আতংকে আছে সে। তারওপর আশরাফি গম্ভীর চেহারা দেখে আরো বেশি করে ঘাবড়ে গেলো। যদিও আশরাফিকে দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একইভাবে নীলার দিকে চেয়ে আছে সে। বাস্তবিকই তাঁর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই নীলার কথাগুলো শুনে সম্ভাব্য ঠিক কি ধরনের রিয়েকশন হতে পারে তাঁর। নীলা কাচুমাচু করে বললো,’জি স্যার।’

আশরাফি সপ্রতিভ হাসলো। অবাক হলো নীলা। আশরাফি এবারে টেবিলে আলতো করে একটা চাপড় দিয়ে বললো,’ঠিক আছে করলাম নাহয় একটু মাইন্ড। ক্ষতি কি? তুমি বরং বলেই ফেলো।’

আশরাফির হাসিতে নীলার ভয় পুরোপুরি না গেলেও কিছু কমলো। বুকে সাহস সঞ্চয় করে নিলো সে। গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,’কথাটা কার কাছ থেকে শুনেছি আমি নাম বলবো না স্যার। কিন্তু যার কাছ থেকেই শুনি না কেন সে শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলছে তাঁর কোন ভুল হয় নি।’

-‘একটু ক্লিয়ার করে বলো নীলা। আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলে কোন লাভ নেই। বলতে যখন হবে তখন সরাসরি জিজ্ঞেস করাই ভালো। এবার সোজাসুজিই জিজ্ঞেস করলো নীলা,’আমার পরিচিত একজন বন্ধু বলছিলো সে নাকি গতকাল রাতে আপনাকে ঢাকার বাইরে খুব একটা খারাপ জায়গায় দেখেছে। আনুমানিক আটটা কিংবা নয়টা বাজে তখন। জায়গাটার নাম আমি উল্লেখ করতে চাইছি না স্যার। কিন্তু কথাটা কি সত্যি?’

সাহস করে প্রশ্নটা করে ফেললেও আতংকে অসাঢ় হয়ে গেলো নীলা। এই বুঝি আশরাফি স্যার সজোরে তাঁকে ধমক দিয়ে উঠবেন, এই বুঝি অপমান করে রুম থেকে বের করে দেবেন তাঁকে। অবশ্যম্ভাবী ঝড় থেকে বাঁচার জন্য মনে মনে আল্লাহ,আল্লাহ করছিলো সে।

কিন্তু না! তেমন কিছুই হলো না। আশরাফি যেমনি বসে ছিলো ঠায় বসে রইলো। তবে মুখখানা আগের চেয়ে অনেক বেশি গম্ভীর হয়ে গেলো তাঁর। হাস্যজ্জ্বল মুখে নেমে এলো গাঢ় অমাবস্যার ন্যায় অন্ধকার। ডান হাত মুঠো পাকিয়ে থুতনিতে চেপে ধরলো সে। নীলা সরু চোখে চেয়ে রইলো। স্যার কি এবার কিছু বলবেন? আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অধৈর্য হয়ে উঠলো সে। স্যার কেন চুপ করে আছেন না? কেন তিনি প্রতিবাদ করছেন না? বলাবাহুল্য, এতক্ষণ আশরাফি কাছে থেকে যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থণা করছিলো সে এবার মনে মনে সেই বিরূপ প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশা করলো! সোজাসুজি বলতে গেলে, আশরাফি তাঁকে ধমক না দেওয়ায় বেশ হতাশ হয়েছে সে। কোনভাবেই আশরাফি নিরবতা মেনে নিতে পারছিলো না। কারণ এই নিরবতার প্রকৃত অর্থ ছেলেটার কথাই সত্যি! মনে প্রাণে প্রার্থণা করলো সে,’ইয়া আল্লাহ, না বলুক স্যার। প্লিজ! না বলুক। ঝাড়ি দিক, অপমান করুক তাঁকে।’

কিন্তু না! আশরাফি তাঁকে অবাক করে দিয়ে বলল,’হ্যা সত্যি। গতকাল ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম আমি।’

বিস্ফোরিত নয়নে, চোখ বড়বফ করে আশরাফি মুখের দিকে চেয়ে রইলো নীলা। এই উত্তরটা আশরাফি কাছ থেকে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো তাঁর। তীরের ফলার মতন একেবারে তীক্ষ্ণভাবে বুকে গিয়ে বিঁধলো। ফলাফলস্বরূপ, আচম্বিতে সমগ্র পুরুষজাতির ওপর তীব্র ক্ষোভ গিয়ে পড়লো তাঁর। ঘৃণায় সারাশরীর ছেয়ে এলো। ছিহঃ পুরুষ মানুষ এত খারাপ? এই তাদের আসল চেহারা? মানব চরিত্রের গূঢ় দিকটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না সে। এইমুহূর্তে ইংরেজি একটা কথা খুব মনে পড়ছে তাঁর,’অল ম্যান আর অ্যালাইক। দ্যা অ্যাপ্রোচ ইজ ডিফারেন্ট;বাট দ্যা রেজাল্ট ইজ অলওয়েজ দ্যা সেইম।’ এর বাংলা ভাবার্থ হলো, ‘সকল পুরুষ একই রকম। তাদের পন্থা হয়ত ভিন্ন কিন্তু তাদের কাছ থেকে ফলাফল সবসময় একইরকম পাবে তুমি।’ নিদারুণ যন্ত্রনায়, রাগে, ক্ষোভে উঠে দাঁড়ালো নীল। অনেক কষ্টে অবরুদ্ধ কান্নাটাকে ঠেকিয়ে নিস্তেজ গলায় বললো,’আমি আসি স্যার!’

-‘এসো।’

ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো নীলা। আশরাফি কেন গিয়েছিলো, কি কারণে গিয়েছিলো কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলো না। আশরাফিও আগ বাড়িয়ে কিছু বললো না। তবে ব্যপারটা কিঞ্চিৎ আহত করলো তাঁকে। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে উঠলো মধুর পরিহাসরত মুখখানা! গতকাল আশরাফিকে বাগে আনতে পেরে খুব হাসছিলো সে। তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে ফেললো আশরাফি। আর এইমুখ মনে করতে চায় না সে। যত নষ্টের গোড়া এইমুখ! মায়াভরা, বিষাক্ত, জ্বালাময়ী মুখ! যতবার মনে পড়ে, কিছুতেই স্থির থাকতে দেয় না আশরাফিকে। বুকের ভেতর দমকা হাওয়ার মত তান্ডব শুরু করে দেয়!
.
.
.
চলবে

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৯

ফরেইনারদের সাথে মিটিংটা একদম মনমতো হয়েছে আশরাফিদের। মধুকে ঠিক যেভাবে বলেছিলো ঠিক সেইভাবেই মেয়েগুলোকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে সে। কোনরকম গরমিল হয় নি। পার্টির সাথে ডিলও ফাইনাল। মিটিং শেষ হতেই তিনবন্ধ কোলাকুলি করলো একে অপরের সাথে। এই মিটিংটা তাদের কম্পানীর জন্য সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এখন আর কোন চিন্তা নেই। এবার নিশ্চিন্তে কাজ করা যাবে।

বকেয়া টাকার জন্য মিটিং রুমের বাইরে বসে ছিলো আরমান। সোহাগকে দিয়ে টাকাটা পাঠিয়ে দিলো আশরাফি। টাকা পেয়ে খুশিতে চোখমুখ চকচক করে উঠলো আরমানের। আর একমুহূর্তও দেরী করলো না সে। সঙ্গেই সঙ্গেই বিদায় জানিয়ে মেয়েগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।সেদিকে একবার তাকিয়ে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো আশরাফি। অথচ বাস্তবিক যাকে ঘৃণা করার কথা তাঁকে একফোঁটা ঘৃণা করতে পারলো না সে। উল্টো তাঁকে না পাওয়ার যন্ত্রনায় বোকার মত আরমানের সঙ্গে নিজের তুলনা খুঁজে বেড়ালো। বস্তুত মেহের কেন এমন নীচ, জঘন্য, নারী লোভী একটা জানোয়ারের সঙ্গে নিজেকে জড়ালো বুঝতে পারছিলো না সে।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের চেয়ারে দুম ধরে বসে রইলো আশরাফি। সোহাগ এবং নাঈম দুজনেই বেশ অবাক হলো। এতবড় একটা খুশির খবরের তিনবন্ধু মিলে সেলিব্রেট করবে ভেবেছিলো তাঁরা। কিন্তু আশরাফিকে দেখে মনে হচ্ছে সেই আশা বৃথা। সোহাগ ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কি হয়েছে?’

জবাব দিলো না আশরাফি। না-সূচক মাথা দোলালো দুদিকে। নাঈম বিরক্ত কন্ঠে বললো,’আবার ঐ মেয়েটার কথা ভাবছিস তুই তাইনা?’

সোহাগের যদিও মেহেরের প্রতি যৎসামান্য সফট কর্ণার ছিলো কিন্তু নাঈম বরাবরই সহ্য করতে পারে না মেহেরকে। তাঁর ধারণা, শুধুমাত্র মেহেরের জন্যই তাঁর প্রাণ প্রিয় বন্ধুর এই দুর্গতি। অসভ্য মেয়েটা ভালোবাসার অভিনয় করে তাঁর বন্ধুকে ফাঁসিয়ে শেষমেশ বাপের কথায় নাচতে নাচতে অন্য ছেলেকে বিয়ে করে নিলো! বিয়ে করেছে ভালো কথা! তাও শান্তি নেই। এখন আবার আশরাফিকে বাগে আনার জন্য নতুন গল্প ফেঁদেছে। যে যাই বলুক না কেন নাঈম ভালো করেই জানে মেয়েটা মেহেরের মত মেয়েরা কতটা লোভী, স্বার্থ হতে পারে। টাকাই এদের কাছে সব। নতুবা কোনো মেয়েই নিজের ইচ্ছেতে প্রস্টিটিউশন এর মত জঘন্য একটা কাজে নিজেকে জড়াবে না। যদি কেউ দুর্ভাগ্যক্রমে জড়িয়ে যায় সেটা আবার বুক ফুলিয়ে কারো সামনে বলার মত সাহস অন্তত কোন মেয়ের হবে না। কিন্তু মেহের তো দিব্যি বলে বেড়াচ্ছে সে নিজের ইচ্ছেতে আরমানকে বিয়ে করেছে। স্বেচ্ছায় এই পেশায় নেমেছে। এর পরেও কি করে আশরাফির রুচি হয় ঐ মেয়ের কাছে যেতে সেটাই বুঝতে পারে না নাঈম। অন্যকেউ হলে আরো আগেই ঐ মেয়ের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিতো। কিন্তু আফসোস হাজার চেষ্টা করেও কথাগুলো আশরাফিকে ফেরাতে পারে নি নাঈম। ঘুরেফিরে ঐ মেয়েটার পিছনেই পড়ে আছে সে। কি যে পেয়েছে ঐ মেয়েটার মাঝে আল্লাহই জানে।

আশরাফি নিরবে একবার নাঈমের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকটা নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত করেই বললো,’না রে। ওর কথা এখন আর ভাবি না আমি।’

-‘তাই নাকি?’ তিরস্কারসূচক চাহনী নাঈমের।

-‘হ্যাঁ। ভেবে লাভ কি বল? ও তো ভালোই আছে। বিয়ে করে সুখে সংসার করছে। আরমান নাকি ভালোবাসা দিয়ে একেবারে ভরিয়ে দিয়ে রেখেছে ওকে। দিনরাত আমাকে সেই কথাই শুনাচ্ছে। তাই আমি ঠিক করে এখন ওর কথা আর ভাববো না।’ কথাগুলো বলার সময় অনেক বেশি মলিন শোনালো আশরাফির কণ্ঠস্বর। তার এই না-এর মাঝে কতটা হ্যাঁ লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে নাঈম কিংবা সোহাগ দুজনের কারোরই তেমন কোন অসুবিধে হলো না। আশরাফির মনটা যে এখনো মেহেরেই আটকে আছে বেশ বুঝতে পারলো দুজনে। নিরবে একে অপরের মুখের দিকে চাইলো দুইবন্ধু। নাঈম অত্যাধিক নরম গলায় বললো,’একদম ঠিক ভেবেছিস। আমি তো সেই কবে থেকেই ঐ মেয়ের চিন্তা ছেড়ে দিতে বলেছি তোকে। তুই-ই তো কানে নিলি না। যাইহোক, যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। ঐ মেয়ের স্বভাব তো নিজের চোখেই দেখলি? বাজে, জঘন্য একটা মেয়ে। গোল্ড ডিগার। টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। যেই দেখলো আরমানের কাছে টাকা কাছে অমনি ঝুলে পড়লো তাঁর গোলায়। কেন প্রথম স্বামী মরে গিয়েছে তো কি হয়েছে বাপের বাড়িতে তো যেতে পারতো? নাহ! আরমানকেই বিয়ে করতে হয়েছে তাঁকে? কিন্তু তুই দেখিস, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ঐমেয়ে আরমানেও সঙ্গেও টিকবে না বেশিদিন। এসব মেয়েরা কোনদিন ভালো হয় না। হঠাৎ করে একদিন দেখবি আরমানের সাথেও ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তখন না আবার তোর গলায় ঝুলে পড়ে আমি সেই চিন্তায়তেই আছি। তাই বলছি, সময় থাকতে নিজের কথা ভাব দোস্ত। বারবার তোকে বোকা বানানোর সুযোগ ঐ মেয়েটাকে আর দিস না। ওর মিষ্টি কথা শুনে বর্তে যাওয়ার স্বভাবটা একটু বদলা।’

আশরাফি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তাঁর। বন্ধুরা যতই তাঁকে বোঝাক না কেন কিন্তু মনের ওপর তো কারো জোর চলে না! মেহের ছাড়া অন্যকাউকে নিজের জীবনে কল্পনাই করতে পারে না সে। কি করে পারবে? মেহের যে তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, সমস্ত সত্ত্বায় একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে। চোখবন্ধ করলেই এখনো মেহেরের মুখটাই ভেসে উঠে সবার আগে! কি করে তাঁকে ভুলবে আশরাফি?

মাঝে মাঝে নিজের ওপর রাগ হয় আশরাফির। আত্মসম্মানহীন, কাপুরুষ মনে হয় নিজেকে।নতুবা যেই মেয়েটা তাঁকে এত কষ্ট দিলো, আঘাতের পর আঘাত জর্জরিত করে দিলো তাঁর হৃদয়টাকে, তাঁর পাহাড়সম ভালোবাসাকে ছোট করে শুধুমাত্র টাকার জন্য অন্য একটা লোকের সাথে ঘর বাঁধলো সেই মেয়েটাকেই কেন মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসে আশরাফি! কেন? কেন এখনো আশরাফির প্রতিটা সকাল শুরু হয় মেহেরকে নামক যন্ত্রনাকে কাছে পাওয়ার প্রতিক্ষায়? কেন এখনো তাঁর প্রতিটা রাত কাটে মেহেরকে না পাওয়ার যন্ত্রণায়? এই কেনটার জবাব নিজেও জানে না আশরাফি! কিন্তু মেহেরকে ভালো না বেসে থাকতে পারে না সে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যিই যে এতকিছুর পরেও খনো মেহেরকে পাগলের মত ভালোবাসে সে।

কিন্তু মেহের তো এখন পরস্ত্রী! আরমান যতই খারাপ হোক না কেন সে যে মেহেরের স্বামী এই কথাটা তো কোনদিন অস্বীকার করতে পারবে না আশরাফি! প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক নাহয় অস্বীকার করা যায়! কিন্তু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক? এই সম্পর্ক কখনো অস্বীকার করা যায় না। এই সম্পর্কে স্বামী স্ত্রী দুজনেই সারাজীবনের জন্য অটুট এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় পরস্পরের সাথে। চাইলেই তখন আর এই বন্ধন ছিন্ন করে বেরয়ে আসতে পারে না কেউ। মেহেরও পারবে না।

চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলো আশরাফি। কেন তাঁর জীবনটা এমন হলো? কেন মেহের তাঁর হলো না? কেন এতভালোবাসার পরেও মেহেরকে নিজের করে পেলো না সে। আরমান সত্যিই মেহেরকে ভালোবাসে কি না আশরাফি জানে না। কিন্তু মেহেরকে ফিরে পাওয়ার আর কোন পথ নেই! মেহের সারাজীবনের জন্য হারিয়ে গেছে আশরাফির জীবন থেকে। এই কথাটা যতবার মনে পড়ে ততবার হাহাকার করে উঠে তাঁর বুকের ভেতরটা। বিভীষিকাময় লাগে পুরো পৃথিবী।

দুদিন পরের ঘটনা। রাত নয়টা কিংবা দশটা বাজে তখন। রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু ফাইল রেডি করছিলো আশরাফি। হঠাৎ করে ফোনটা বেজে উঠলো তাঁর। আকস্মিক মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো সে। ভ্রু জোড়া অটোমেটিক কুচকে গেলো।

অনিচ্ছাসত্ত্বে রিসিভ করতে গিয়ে দেখলো মেহেরের নাম্বার। মিনিটখানেকের জন্য থমকে গেলো সে। বলাবাহুল্য, এইমুহূর্তে মেহেরের ফোন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত তাঁর জন্য। তথাপি রিসিভ করতে গিয়েও করলো না সে। কেটে দিলো।

নাহ! আর কোনভাবেই নিজেকে মেহেরের সঙ্গে জড়াতে চায় না আশরাফি! অনেক হয়েছে ঘাত, প্রতিঘাতের দ্বন্দ্ব! এবার নিজের মত করে বাঁচা উচিৎ! নিজেকে সময় দেওয়া উচিৎ। মেহেরকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিৎ, তাঁর প্রতিক্ষায় থেমে নেই আশরাফি জীবন। নিজের মত করে আশরাফিও ভালো থাকতে জানে!
ফোন হাতে নিয়ে এসবই ভাবছিলো সে। এদিকে ফোন কেটে গিয়ে আবার রিং হলো। পুনরায় কেটে দিতে গিয়ে থেমে গেলো আশরাফি। নাহ! রিসিভ করে কথাগুলো মেহেরকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। আর ছাড় দেওয়া যাবে না তাঁকে। এবার থেকে ইটের জবাব পাটকেলে দেবে আশরাফি।ফোন রিসিভ করে যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় হ্যালো বললো সে।

সঙ্গে সঙ্গেই ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে বারো তেরো বছর বয়সী একটা কিশোরী মেয়ের ক্রন্দনরত কন্ঠস্বর শোনা গেলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,’মধুমা খুব অসুস্থ স্যার। আজকে দুদিন যাবত বিছানায় পড়ে আছে। খাওয়াদাওয়াও ঠিক মতন করছে না। জ্বরের ঘরে কেবল আপনার নাম করছে। আপনি একবার আসুন না স্যার। আপনি এলে মধুমা ঠিক ভালো হয়ে যাবে।আমরা সবাই খুব চিন্তায় আছি।’

মেহের অসুস্থ! ব্যস! খবরটা শুনার সাথে সাথেই ফের দিশেহারা হয়ে পড়লো আশরাফি। একটু আগের করা প্রতিজ্ঞাটা বেমালুম ভুলে গেলো সে। ব্যকুল বিগলিত চিত্তে, তড়িঘড়ি করে বলল,’কি হয়েছে মেহেরের? ও ঠিক আছে তো।’

জবাবে মেয়েটার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। ফুঁপিয়ে উঠে বললো,’কি হয়েছে আমি জানি না। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে গেছেন তবুও সারছে না। খুব কষ্ট পাচ্ছে মধুমা। আপনি আসবেন তো মাকে দেখতে?’

-‘তুমি ফোন রাখো। আমি এক্ষুনি আসছি!’

-‘ঠিক আছে।’
মেয়েটা ফোন রাখতেই আর দেরী করলো না আশরাফি। ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে। টেবিলের ওপর থেকে ওয়ালেট আর গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মেহেরের উদ্দেশ্যে। ভুলে গেলো সে সমস্ত মান, অভিমান।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here