#মধুবালা,১২,১৩
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২
বৃদ্ধ দারোয়ান আনিসুলের হাতে পায়ে ধরে অনেক কষ্টে তাঁকে রাজি করিয়েছে মধু। কিন্তু সমস্যা হলো আনিসুল শর্ত দিয়েছে দুঘণ্টার ভেতরে ফিরতে হবে। কারণ আরমান যদি কোনভাবে জানতে পারে মধু তাকে না জানিয়ে আশরাফিকে দেখতে গেছে ভয়ানক খেপে যাবে সে। তাছাড়া এখানকার কোন মেয়েরই আরমানের অনুমতি ছাড়া বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই। সেই ভয়ে আনিসুল প্রথমে যেতে দিতে রাজি হচ্ছিলো না মধুকে। কিন্তু অনেকদিন যাবত মধুর সঙ্গে চেনাজানা আছে তাই শেষমেশ একপ্রকার বাধ্য হয়েই রাজি হতে হলো তাঁকে। মধুও অনুনয় বিনয়ের আর কোন কসুর রাখে নি!
আনিসুল রাজি হওয়ার ওপর আর একমুহূর্তও দেরী করলো না মধু। আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢেকে সঙ্গে সঙ্গেই হস্পিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো সে। যাওয়ার সময় আনিসুলকে বুদ্ধি দিয়ে গেলো যদি কোনভাবে তাঁর ফেরার আগে আরমান চলে আসে তবে আনিসুল যেন অবশ্যই একটা ফোন করে খবর দেয় মধুকে। আনিসুলও মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
★
হস্পিটালে যেতে যেতেই প্রায় একঘণ্টার মত লেগে গেলো মধুর। এমনিতেই জ্বরে কাহিল দুর্বল শরীর তাঁর। তারওপর লাগাতর ক্রন্দনে শরীরের সব শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। চোখ কোটরে নেমে গেছে। হাসপাতালের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে মনে হলো এক্ষুনি বুঝি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে সে। বহু কষ্টে একটা একটা করে মোট চারতলার সিঁড়িগুলো সব পার করলো। শরীরের কোন বাঁধাই মানলো না।
হাঁপাতে হাঁপাতে ইমার্জেন্সির দিকে এগোতেই দেখলো সোহাগ এবং নাঈম দুজনেই বাইরে বসে অপেক্ষা করছে।কাছে গিয়ে বোরখার নেকাব তুলে দিলো মধু। সারা গা ঘামে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেছে তাঁর। বেশকয়েকবার জোরে জোরে দম নিয়ে সোহাগকে উদ্দেশ্য করে রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে মুখে বললো,’এখনো জ্ঞান ফেরেনি?’
সোহাগ হতবাক চোখে চেয়ে রইলো মধুর বিধ্বস্ত মুখখানার দিকে। একি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার? ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য, চোখের নিচে কালি, শীর্ণ দেহ! সবমিলিয়ে অনেক বেশি রোগা আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে মধুকে। প্রথম দিনের মধু আর এই মধুর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। একদম আলাদা! চেয়ার ছেড়ে উঠে মধুকে বসার জায়গা করে দিলো সে। মধুর কথার জবাবে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,’পানি খাবে?’
দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো মধু। শ্বাসকষ্টের রোগীর মত থেমে থেমে শ্বাস নিয়ে বললো,’ডাক্তার কি বলেছে?’
-‘জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।চব্বিশঘণ্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে।’
আপনাআপনি গড়িয়ে পড়লো মধুর চোখের পানি। সেটা লুকানোর জন্যই মাথা নিচু করে ফেললো সে। চেয়ারের হাতল চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু এতকিছুর পরে কি আর অশ্রু বাঁধ মানে? সুযোগ পেয়ে হতভাগা অশ্রু যেন দুচোখের নদীতে ভরাডুবি লাগিয়ে দিলো! কান্নার দমকে ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠলো মধুর রোগা ছিপছিপে ক্লান্ত দেহখানা!
অদূরে দাঁড়িয়ে সমস্ত ঘটনাই পর্যবেক্ষণ করছিলো নাঈম। যদিও মধু এলেই তাঁকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো কিন্তু অসহায়, বিধ্বস্ত মধুর কান্নারত করুণ মুখখানা দেখে তার ভেতরে মনুষত্ববোধ কিছুতেই নিজেকে সায় দিলো না মধুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্য। সোহাগের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে।
চোখ মুছে ক্ষীণ পায়ে ইমার্জেন্সির বাইরে ছোট কাচের জানালার দিকে এগিয়ে গেলো মধু। সমস্ত শরীর অবস হয়ে আসছে তাঁর! হাতে পায়ে জোর নেই! বহু কষ্টে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেলো সে! অনুতপ্ত চোখে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখলো বেডের ওপর অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে আশরাফির নিথর দেহখানা। বুকের ওপর অসংখ্য যন্ত্র বসানো। হাতে ক্যানুলা ফিট করা। কান্নায় মধুর সারা শরীর ভেঙ্গে আসতে চাইলো মধুর। অসহায় চাতকের মত দেওয়াল ধরে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। সমস্ত দায়ভার আপন মাথায় তুলে নিয়ে শতকোটিবার অভিসম্পাত করলো নিজেকে। অসংখ্যবার মৃত্যু কামনা করলো নিজের। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,’কেন তুমি আমাকে মেরে ফেললে না। কেন নিজের এত বড় সর্বনাশ করলে? কত দুঃখে যে তোমাকে ছেড়েছি কেন তুমি সেই কথাটা একবারও বোঝার চেষ্টা করলে না?..কেন?’ দূরে দাঁড়ানো সোহাগ এবং নাঈম চকিত চোখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কান্না দেখে গেলো কেবল!
★
ঘণ্টাখানেক বাদে ইমার্জেন্সি থেকে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে এলেন মাঝবয়সী একজন ডিউটি ডাক্তার। মধু, সোহাগ, নাঈম তিনজনেই ছুটে গেলো তাঁর দিকে। অভিজ্ঞ ডাক্তার সপ্রতিভ হেসে বললেন,’আপনাদের রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। হি ইজ নাউ অ্যাবসলিউটলি আউট অফ ডেইঞ্জার। আর কোন ভয় নেই! আমরা খুব শীঘ্রই উনাকে কেবিনে শিফট করার ব্যবস্থা করছি।’
সস্তির নিশ্বাস ফেললো একসঙ্গে উন্মুখ হয়ে থাকা তিনটে মুখ। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো তিনজনেই।
সোহাগ উৎসাহিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’আমরা কি একটু দেখা করতে পারি ওর সঙ্গে?’
-‘জি অবশ্যই পারবেন। কিন্তু এখন না। আগে পেশেন্টিকে কেবিনে শিফট করা হোক। তারপর আপনারা সবাই দেখা করতে পারবেন।’, কথা শেষ করে প্রস্থান করলেন ডাক্তার।
★
ইমার্জেন্সির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো সবাই। স্ট্রেচারে করে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আশরাফিকে। এনেস্থিসিয়ার প্রভাবে তখনো ঘুমাচ্ছে সে। ঘুমের জন্য চোখ খুলতে পারছিলো না।
সবার প্রথমে দেখা করলো নাঈম। মধুকে সবার আগে ঢুকতে দিতে রাজি হলো না সে। কি জানি আশরাফি কেমন রিয়েক্ট করে! তাই সবার প্রথমে সেই গেলো। মধুর মুখটা মলিন হয়ে গেলো! ফ্যালফ্যাল করে নাঈমের মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। এবং স্পষ্ট বুঝতে পারলো সুস্থ আশরাফির ওপর সমস্ত অধিকার তাঁর থাকলেও এই অসুস্থ আশরাফিটার ওপর তাঁর বন্ধুদের অধিকারই বেশি।চোখভর্তি পানি নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে।
নাঈম ভেতরে যাওয়ার পর এক ফাঁকে দারোয়ানের নাম্বারে ফোন করে নিলো মধু। উদ্দেশ্য আরমান ফিরেছে কিনা সেই খবর জানা। কিন্তু ভাগ্য ভালো তাঁর। আরমান এখনো ফেরে নি। দুপুরের আগে ফেরার আর কোন সম্ভাবনা নেই তাঁর। দুশ্চিন্তা মুক্ত হলো মধু। আরমান যদি একবার জানতে পারে তাহলে দারোয়ানের তো খবর আছেই সেই সাথে ওখানকার বাকি মেয়েগুলো বিপদে পড়তে পারে।
নাঈম বেরিয়ে আসার পর ভেতরে ঢুকলো সোহাগ। অস্থির লাগছিলো মধু! ক্রমেই ভেতরে ঢোকার ছটফটানি বেড়ে গেলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না! অসহায় চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নি সে! নাঈমের কথা অনুযায়ী সোহাগ বেরোলে তারপর ভেতরে যেতে দেওয়া হবে তাঁকে। ডাক্তারের নিষেধ আছে একসঙ্গে বেশি লোক ভেতরে যাওয়া যাবে না। যাই যতক্ষণ না সোহাগ বেরোয় ততক্ষন বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে মধুকে।
সোহাগ ভেতরে ঢুকে দরজাটা হালকা করে ভেজিয়ে দিলো। হাতে পায়ে প্লাস্টার করা আশরাফির।গলায় কলার কাপ বাধা। ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না সে। একটুখানি সজাগ হয়ে ফের চোখ বন্ধ করে ফেলছে। সোহাগ বেশকিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে শেষে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’আর কত ঘুমাবি? এবার ওঠ। মেহের এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য।’
কথাগুলো অস্পষ্ট শোনানো আশরাফির কানে। তথাপি মেহেরের নামটা কানে যেতেই জোরপূর্বক সচেতন হওয়ার চেষ্টা করলো সে। বহুকষ্টে একবার চোখ মেলে আবার বন্ধ করে ফেললো। সোহাগ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আশরাফিকে সত্যিই অবাক লাগে তাঁর! কি করে কেউ কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে?
বাইরে মধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন সোহাগ বেরোবে আর কখন ভেতরে ঢুলতে পারবে সে। সেই কথা মনে পড়তেই ঘুমন্ত বন্ধুর মুখের দিকে আরেকবার ভালো করে চেয়ে উঠে দাঁড়ালো সোহাগ।
দরজায় বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো মধু। সোহাগ বেরোতেই কালক্ষেপণ না করে দ্রুত ঢুকে পড়লো। পাছে নাঈম ভেতরে ঢুকতে বারণ করে দেয় তাই এই তাড়াহুড়ো! সোহাগ চট করে একবার নাঈমের মুখের দিকে চাইলো। নাঈম হাড়ির মত মুখ করে বসে আছে। মধুর চরিত্রটা বুঝে উঠতে পারছে না সে। মেয়েটার মুখ দিকে তাকালে কিছুতেই বিশ্বাস করতে মন চায় না এই মেয়েটাই এত কষ্ট দিয়েছে আশরাফিকে। সোহাগ বন্ধুর চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো!
ভীরু পায়ে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকলো মধু। ভেতরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে আশরাফি! মধু বেডের কাছে গিয়ে অনিমেষ চোখে চেয়ে রইলো তন্দ্রাচ্ছন্ন, রুগ্ন মানুষটার নিষ্পাপ মুখের দিকে। বিরূপ পৃথিবীর নিষ্ঠুর জ্বালাযন্ত্রণা সইতে না পেরে জাগতিক সমস্ত কিছুর দায়ভার থেকে বিমুখ হয়ে যেন একান্ত অভিমানে গাল ফুলিয়ে রেখেছে মানুষটা!
নাহ! এসব মধুর কল্পনাপ্রসূত চিন্তাভাবনা! নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আশরাফি! তেমনি শান্ত, স্নিগ্ধ,স্থির, কোমল মুখ। নিঃশব্দে তাঁর পাশে চেয়ার টেনে বসলো মধু।
নিজের ক্লান্ত মাথাটা আলতো করে আশরাফির বুকে এলিয়ে দিয়ে অসহায়ের মত ফুঁপিয়ে উঠলো সে। এই পৃথিবীকে আশরাফি ছাড়া তাঁকে বোঝার মত কেউ নেই! সবাই তাঁকে ঘৃণা করে! সবাই স্বার্থপর ভাবে! কিন্তু এই মানুষটাই মধুর সম্পূর্ণ নিজের! হাজার অভিমানেও কখনো মুখ ফিরিয়ে নেয় নি মধুর দিক থেকে! দুহাত ভরে ভালোবাসা বিলিয়ে গেছে মধুর প্রতি!
সে চলে গেলে কার কাছে নিজের যন্ত্রণার নিরাময় খুঁজবে মধু? দিনের পর দিন যেই অসহ্য অন্তরযন্ত্রণা সে ভোগ করে চলেছে কে দেবে তাঁকে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি?
নিঃস্ব, সহায়সম্বলহীনের মত একটু আশ্রয় পাওয়ার আশায় শক্ত করে আশরাফিকে আঁকড়ে ধরলো সে। আশরাফির পরনের হস্পিটালের দেওয়া ঢোলা টি-শার্টটা দুহাতে খামচে ধরে অশ্রুসিক্ত, অভিমানী কণ্ঠে বললো,’কেন তুমি আমার এত বড় সর্বনাশ করতে গিয়েছিলে? কেন তুমি নিজের ক্ষতি করার আগে একবারও আমার কথাটা ভাবলে না? তোমার কিছু হলে আমার কি হতো?’ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে। বেশ কিছুক্ষন এভাবেই পড়ে থেকে অশ্রু বিসর্জন করলো।
আশরাফি তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে বলতেই পারবে না এতকালযাবত যেই ছলানাময়ী, কঠিনহৃদয়া নারীকে সে মনেপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে এসেছে সেই দুঃখিনী, সমাজ পরিত্যক্তা, সর্বশান্ত রমনী আজও তাঁরই আছে! আজও তাঁর জন্যই সমস্ত ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে, সবার সমস্ত অপমান মুখ বুঝে সহ্য করে দিশেহারা, উন্মাদের মত বুকভর্তি ভালোবাসা নিয়ে হস্পিটালে ছুটে এসেছে! শুধুমাত্র তাঁর জন্যই সমস্ত রজনী নির্ঘুম কাটিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে।
আফসোস আকাঙ্ক্ষিত এই সত্যটা জানার সৌভাগ্য হলো না আশরাফির। এতসুখ তাঁর কপালে নেই বলেই বোধহয় জানার সুযোগ হলো না তাঁর! নতুবা মধুর বাঁধভাঙ্গা ক্রন্দনের পরেও কি করে সে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকতে পারে?
আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না! ঘড়িতে অলরেডি দেড়টা বেজে গেছে! চোখ মুছে উঠে দাড়ালো মধু! শেষবারের ওপর প্রাণভরে একবার দেখে নিয়ে ব্যান্ডেজের ওপর দিয়েই আশরাফির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে ফের চোখের পানি বিসর্জন করলো নিরবে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো সে।
.
.
.
চলবে
#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৩
সপ্তাহ খানেক বাদে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হলো আশরাফিকে। হাতে পায়ের প্লাস্টার যদিও খোলা হয় নি কিন্তু এখন হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে পারে সে। ডাক্তারের নিষেধ ফ্র্যাকচার সম্পূর্ণ সেরে না উঠার আগ পর্যন্ত প্লাস্টার খোলা যাবে না। সময় মত হস্পিটালে গিয়ে খুলিয়ে আসতে হবে। এর মাঝে অবশ্য বেশ কয়েকবার চেকাপসহ, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সব প্রেসক্রিপশনে লিখে দেওয়া হয়েছে।
জ্ঞান ফেরার পর হস্পিটালে যতদিন ছিলো প্রায়ই প্রতিদিনই অধীর আগ্রহে মধুর অপেক্ষা করে বসে থাকতো আশরাফি। কিন্তু একদিনও গেলো না মধু! মাঝখানে একদিন সোহাগের কাছ থেকে ফোন করে খবর নিলো কেবল। তারপর আর কোন যোগাযোগ হয় নি।
সোহাগ অবশ্য ফোনটা আশরাফিকেই দিতে চেয়েছিলো কিন্তু অভিমানে কথা বললো না আশরাফি! মধুও জোরাজুরি করে নি। যাবতীয় কথাবার্তা সোহাগের সাথেই সেরে ফোন রেখে দিয়েছিলো সে। রাগ করে আশরাফিও জানার চেষ্টা করলো না। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই সমস্ত রাগ উধাও! ফের অস্থির হয়ে পড়লো সে। রোজ একবার করে মেহেরের খবর জানতে চাইতো সোহাগের কাছে। আর প্রতিদিনই সোহাগ হতাশমুখে না-সূচক উত্তর দিতো। অভিমানের পাহাড় জমতে জমতে পর্বত হয়ে গেলো আশরাফির কিন্তু মধুর খোঁজ জানা গেলো না!
★
বাসায় ফেরার দুদিনের মাথায়-ই নীলা তাঁর বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে দেখা করতে এলো আশরাফির সঙ্গে। অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে হস্পিটালেও গিয়েছিলো সে কিন্তু আশরাফির সাথে কথা বলার সুযোগ হয় নি। কড়া ঘুমের ইঞ্জেকশনের দেওয়ার ফলে সেদিন বেঘোরে ঘুমিয়ে ছিলো আশরাফি ।
সোহাগ এবং নাঈম দুজনে বাসায় ছিলো। দরজা খুলে নীলাকে দেখে প্রথমে অবাক হলো সোহাগ। চিনতে পারলো না। নীলার কাছ থেকে পরিচয় জানার পর হাসিমুখেই ভেতরে আসার আহ্বান জানালো তাদেরকে।
সবার প্রথমে ভেতরে ঢুকলো নীলা। ভেতরে ঢুকেই সালাম দিলো সে। তারপর একে একে সবাই ভেতরে ঢুকলো।
আশরাফি তখন খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলো। ওদেরকে দেখে হাসিমুখে সালামের উত্তর দিয়ে বললো,’আরে তোমরা? কেমন আছো সবাই?’
একসঙ্গে সম্মতিসূচক জবাব দিলো সবাই,’ভালো আছি স্যার।’ কেবল নীলাই চুপ করে রইলো। বিষন্ন মুখে আশরাফির দিকে চেয়ে রইলো সে। আশরাফি চোখে চোখে পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলো। আশরাফি বসতে ইশারা করলো সবাইকে। খাটের পাশে ছোট সোফায় বসতে বসতে একটা ছাত্র জিজ্ঞেস করলো,’অ্যাক্সিডেন্ট হলো কি করে স্যার?’
আশরাফি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসলো। ছেলেটার প্রশ্নের জবাবে বললো,’অ্যাক্সিডেন্টলি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। সেসব বাদ দাও। তোমাদের কি খবর? পড়াশোনা ঠিকমত চলছে তো?’
তারপর বেশ কিছুক্ষণ গল্প গুজবে হলো! তারপর ছাত্রছাত্রীদের বাসায় ফেরার পালা। একে একে সবাই বেরিয়ে গেলো। নীলা গেলো না। সবার বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করলো সে। সবাই বেরিয়ে গেলে খানিকটা তড়িঘড়ি করে বললো,’একটা কথা জিজ্ঞেস করবো স্যার?’
অবাক হলো আশরাফি। এতক্ষণ বোবার মত চুপচাপ বসে ছিলো নীলা। হঠাৎ সবাইকে লুকিয়ে কি জিজ্ঞেস করতে চায় সে? আশরাফি বিস্মিত কন্ঠে বললো,’কি কথা?’
নীলা সময় নষ্ট করলো না। দ্বিধা সংকোচ ভুলে এতদিনের চেপে রাখা প্রশ্নটা করেই ফেললো সে,’আপনি ব্রোথেলে কেন গিয়েছিলেন স্যার? আমি জানি কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে যাওয়ার মত লোক আপনি নন। কিন্তু কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছিলাম না, তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে জিজ্ঞেস করতে হলো।’
আশরাফি চুপচাপ শুনছিলো নীলার কথা। তার বলা শেষ হলে মুচকি হেসে বললো,’সব কথা কি সবাইকে বলা যায় নীলা? আমরা সবাই কি সবার ভেতরের কথা জানি ‘
মুখটা ছোট হয়ে গেলো নীলার। এই প্রশ্নটার জবাব না পেলে যে কিছুতেই শান্তি হবে তাঁর! হাজার চেষ্টা করেও আশরাফির ব্রোথেলে যাওয়ার ঘটনাটা মাথা থেকে সরাতে পারে নি সে। কিন্তু আশরাফি কথা শুনে বেশ বুঝতে পারলো জবাবটা নীলার কাছ থেকে এড়িয়ে যেতে চাইছে সে! চোখে পানি চলে এলো নীলার।দুচোখ ঝাপিয়ে আকস্মিক কান্না পেয়ে গেলো তাঁর! কিন্তু কেন পেলো সে বুঝতে পারলো না। বোঝার চেষ্টাও করলো না। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো সে। মৌনমুখে বললো,’ঠিক আছে। আমি তাহলে আসি স্যার!’
তার অশ্রুসজল চোখদুটো নজরে এড়ালো না আশরাফির। পুনরায় ডাক দিলো সে,’নীলা শোনো?’
পিছু ফিরলো নীলা। ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করলো,’জি?’
-‘বসো। তোমার প্রশ্নের জবাব দেবো।’
হঠাৎ আশরাফির ডিসিশন চেইঞ্জের কারণ বুঝতে পারলো না নীলা। বোকার মতন চেয়ে থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। আশরাফি মুচকি হেসে বললো,’ভেবেছিলাম বলবো না। কিন্তু পরে ভাবলাম কথাগুলো না বোঝার মতন ছোট তুমি নও। যদি কথাগুলো আমার পার্সনাল কিন্তু তোমাকে বলা যায়।’
নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,’বাইরে সবাইকে অপেক্ষা করছে। ওদেরকে বলে আসি?’
-‘এসো।’
সবাইকে অপেক্ষা করতে বলে তাড়াতাড়ি ফিরে এলো নীলা। আশরাফির মুখ থেকে কারণটা শোনার জন্য তর সইছিলো না তাঁর। ভেতরে ঢুকেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,’জি বলুন স্যার!’
তার আগ্রহ দেখে ভেতরে ভেতরে অবাক হলেও চেপে গেলো আশরাফি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’আমার ব্রোথেলে যাওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ হলো এক কাণ্ডজ্ঞানহীন, মূর্খ, মূঢ়চিত্ত, নিষ্ঠুর মেয়ের ভালোবাসা!’ কথার শেষ করে নীলার রিয়েকশন দেখার জন্য তাঁর মুখের দিকে চাইলো সে। নীলার চোখে একসাথে বিস্ময়, কৌতুহল এবং হতাশার সংমিশ্রণ! চোখ সরিয়ে নিলো আশরাফি। পূর্বের কথার রেশ ধরে বললো,’ওর নাম মেহের! ভার্সিটি লাইফের প্রেম আমাদের। তারপর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায় মেহেরের। মেহের অবশ্য রাজি ছিলো না কিন্তু নিরুপায় হয়ে বিয়েটা করতে হয়েছিলো ওকে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বিয়েরদিন রাতেই ওর প্রথম স্বামী মারা যায়। মৃগী রোগ ছিলো। বিষয়টা তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন গোপন করে গেছিলো তাঁর বাবা কাছে। তারপর আবার বিয়ে হয় মেহেরের। আমি যেই ব্রোথেলে গিয়েছিলাম সেখানকার মালিক ওর দ্বিতীয় স্বামী।’ কথাশেষ করে পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশরাফি। নীলা হতবাক, বিমূঢ়, বাকরুদ্ধ! সহজ কথাগুলোর ভেতরে লুকিয়ে অসংখ্য রহস্যের গন্ধ পেলো সে! আরো কিছু শোনার অপেক্ষায় আশরাফির মুখের দিকে চেয়ে রইলো। আশরাফি তাঁর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির বিপরীতে মুচকি হেসে বললো,’শেষ! এইটুকুই কাহিনী!’
মানসিক প্রশান্তি হলো না নীলার। আরো অনেক কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে তাঁর! কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হলো। তথাপি একটা কথা জিজ্ঞেস না করে পারলো না। সেটা হচ্ছে আশরাফি এখনো নীলাকে ভালোবাসে কি না।’
জবাবে আশরাফি নিঃসংকোচে বললো,’বাসি!’
-‘কিন্তু এটা তো অন্যায়। তাঁর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে। আপনার সরে আসা উচিৎ।’
আশরাফি মুচকি হেসে বললো,’ন্যায় অন্যায় বোঝার মত জ্ঞান আমার আছে নীলা! আমি কখনোই তাঁকে অসম্মান করি নি! বারবারই সরে আসতে চেয়েছি। কিন্তু মাথার ভেতর একগাদা প্রশ্ন কিলবিল করছে। সেগুলোর উত্তর জানতেই বারবার তাঁর কাছে ছুটে যাই।’
নীলা থতমত খেয়ে গেলো। কিঞ্চিৎ লজ্জায়, বিব্রত কন্ঠে বললো,’আমার মনে হলো আপনি ভুল করছেন তাই বললাম। অন্যকিছু মিন করে বলি নি।’
আশরাফি ফের হাসলো। বললো,’বুঝতে পেরেছি আমি। তোমার মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে তোমার কাছে!’
-‘প্রশ্ন?’
-‘হ্যাঁ প্রশ্ন। আমার কাছে মেহেরের সম্পর্কে জানার পর আর কি কিছু জানতে ইচ্ছে করছে তোমার? যেমন ধরো, মেহের দ্বিতীয় বিয়েটা কেন করলো? কেন সে আমার কাছে ফিরে এলো না? একটা ব্রোথেলের ওনারকেই কেন বিয়ে করতে হলো তাঁর? এসব কিছু। তারপর ধরো, সে আমাকে এখনো ভালোবাসে কি না কিংবা আমার কাছে ফিরে আসতে চায় কি না।’
জবাবে নীলা যা বললো তাতে ইতোপূর্বে তাঁকে নিয়ে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমস্ত সংশয় দূর হয়ে গেলো আশরাফির। নীলার জন্য দুঃখবোধ করলো সে। ভুল করেছে মেয়েটা! মারাত্মক ভুল! সে এমন একজনকে ভালোবেসে বসে আছে যে কোনদিন তাঁকে ভালোবাসতেই পারবে না, নিজের সমস্ত ভালোবাসা অপাত্রে দান করে দেউলিয়া হয়ে গেছে সে! আর কাউকে ভালোবাসার ক্ষমতা তাঁর নেই!
আশরাফিকে করা নীলার প্রশ্নটা ছিলো মেহের আশরাফিকে ফিরে পেতে চায় কি না? প্রশ্নটা করার সময় নীলার চোখেমুখের অস্থিরতাই সবকিছু পরিষ্কার করে দিলো আশরাফির কাছে। তাঁর বুঝতে বাকি রইলো না কেন নীলা সবকিছু বাদদিয়ে ঠিক এই প্রশ্নটাই বেছে নিয়েছে?
তথাপি সিউর হওয়ার জন্য নীলার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলো সে,’ডু ইউ লাভ সামওয়ান? ইজ ইট মি?’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো নীলার হৃদপিন্ডটা! আতংকে, ভয়ে, ফ্যাকাশে হয়ে গেলো তাঁর ফর্সা মুখটা। হাতের মুঠোয় আঙ্গুল প্যাচিয়ে কাচুমাচু করলো সে। আশরাফি সেদিকে একবার তাকিয়ে খুব সহজ গলাতেই বললো,’ভালোবাসাটা কোন অন্যায় কিছু নয় নীলা। কিন্তু তুমি যাকে ভালোবেসেছো সে তোমার জন্য রাইট চয়েস নয়। অ্যাম অ্যাবসলিউটলি আ রং পার্সন ফর ইউ!’
নীলা মাথা হেট করে বসে রইলো। এভাবে আশরাফির কাছে ধরা পড়ে যাবে সে ভাবতেই পারে নি। লজ্জায়,গ্লানিতে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আশরাফি তাঁর আনত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,’সহজ হও নীলা। আমি খুব ফ্র্যাংকলি তোমার সঙ্গে বিষয়টা আলোচনা করতে চাইছি। তোমার যদি কিছু বলার থাকে তুমি বলতে পারো।’
তারপরেও বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইলো না। ধীরে ধীরে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলো সে। মুখ তুলে তাকালো। বিষন্ন কন্ঠে বললো,সবাই কি সঠিক মানুষকে ভালোবাসতে পারে? আপনিও তো ভুল মানুষকে ভালোবেসেছেন।’
-‘আমার পরিণতিটা কি খুব ভালো মনে হচ্ছে তোমার কাছে?’
-‘সবার পরিনতি তো আর একরকম হয় না।’
-‘সেটা অবশ্য ঠিক। কিন্তু একতরফা ভালোবাসার পরিনতি সবসময়ই অসম্পূর্ণ। সমস্তটাই যন্ত্রণা!’
এই কথার জবাবে নীলা তাঁকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে বললো,’কিন্তু আমি সেই যন্ত্রণা ভোগ করতে চাই। আপনার আমাকে ভালোবাসতে হবে না। আপনি শুধু আমাকে ভালোবাসার সুযোগ করে দিলেই হবে। কি জানি হয়ত আমাদের দুজনের এই যন্ত্রণায় ধরণটাই একদিন কাছে নিয়ে আসবে আমাদের। আর যদি না আনে তাতেও আপত্তি নেই আমার। আমি আপনাকে কোনকিছু নিয়ে জোর করবো না।’
-‘কেন শুধুশুধু কষ্ট বাড়াতে চাইছো নীলা? এখনো সময় আছে নিজেকে শোধরাও। একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসে সারাজীবন কষ্ট পাওয়ার চেয়ে সময় থাকতে তাঁকে ভুলে যাওয়া উচিৎ।’
-‘একই কথাটা যদি আমি আপনাকে বলি?”
-‘আমার কথা আলাদা। সেই সুযোগ আমার আর নেই! অনেক আগেই ফতুর হয়ে গেছি আমি! কিন্তু তুমি চাইলেই নিজেকে বদলাতে পারো।’
নীলা হাসলো। বললো,’কে বলেছে আমি চাইলেই নিজেকে বদলাতে পারি? মোটেই পারবো না। আপনি একজনকে কেন হাজার জনকে ভালোবাসলেও আমি কেবল আপনাকেই ভালোবাসবো। আমাদের দুজনের যন্ত্রণার ধরণ যেমন একই তেমনি ভালোবাসার ধরণটাও ঠিক একরকম!’ জবাবে আশরাফি নিরুত্তরভাবে চেয়ে রইলো নীলার মুখের দিকে। প্রতিউত্তরে কিছু বলার মতন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলো না সে। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেলো নীলা। চোখ বন্ধ করে ক্লান্ত নিশ্বাস ছাড়লো আশরাফি। বড্ড আফসোস হচ্ছে তাঁর! কি! অদ্ভুত পৃথিবী! চারদিকে ভালোবাসার ছড়াছড়ি অথচ হাত বাড়িয়ে গ্রহন করার ক্ষমতা কারো নেই!
.
.
.
চলবে