মধুবালা,১৪,১৫

0
428

#মধুবালা,১৪,১৫
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৪

পাশাপাশি বসে আছে নাঈম এবং সোহাগ। গতকাল নীলা চলে যাওয়ার পর সারারাত আশরাফিকে বুঝিয়েছে দুই বন্ধু। যেহেতু আড়াল থেকে নীলা এবং আশরাফির কথোপকথন খানিকটা শুনেছে তাঁরা তাই নীলা কি চায় সেটা বেশ বুঝতে পারলো। মেয়েটাকে তাদেরও ভালোই পছন্দ হয়েছে। তাই ওর সঙ্গে কোনভাবে আশরাফি একটা গতি করে দিতে চাইছে দুজনে!

বিয়ে করতে হলে সবসময় ভালোবাসা থাকা জরুরি নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমেও একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। নীলা এবং আশরাফির মাঝে সেই শ্রদ্ধাবোধ আছে! তাই আশরাফির উচিৎ নিজেকে একটা সুযোগ দেওয়া। এভাবে সঙ্গী ছাড়া কারো জীবন চলতে পারে না। জীবনে দুঃখ,দুর্দশা, হতাশা, গ্লানি আসতেই পারে কিন্তু তাই বলে নিজেকে একজায়গায় থামিয়ে রাখার মধ্যে কোনপ্রকার স্বার্থকতা নেই। সময় থাকতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সবটাই শুনলো আশরাফি। কিন্তু হ্যাঁ না হ্যাঁ না কিছুই জবাব দিলো না। উদ্ভান্তের মত চেয়ে ছিলো কেবল!


অনেকক্ষণ যাবত টানা বেজে চলে মধুর ছোট বাটন ফোনখানা। রিসিভ করছে না সে। মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে। সমস্ত দিন বিছানায় শুয়ে শুয়েই কাটিয়েছে। নাওয়া খাওয়া কিছুই হয় নি। সবেমাত্র ভাতের থালা নিয়ে বসেছিলো ঠিক তখনি ফোনটা বেজে উঠলো।
বিরক্ত হয়ে প্রথমে গা করলো না মধু। কিন্তু লাগাতর বেজেই চললো। অগত্যা খাবারের থালাটা কোলে নিয়েই ফোন রিসিভ করলো সে। নাম্বারটা অপরিচিত, কিন্তু কন্ঠটা নয়। ওপাশের মানুষটা ‘হ্যালো’ বলতেই মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল রক্তের একটা স্পন্দন বসে গেলো। কতদিন পর আবার মানুষটার গলা শুনলো! আবেগে গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে এলো তাঁর। সারাদিনে বিষন্নতা নিমিষেই উবে গেলো। পাছে তার আনন্দটুকু আশরাফির কাছে ধরা পড়ে যায় সেই ভয়ে ফোন কানে দিয়েই নিঃশব্দে বসে রইলো। ওপাশ থেকে আশরাফি কোন জবাব না পেয়ে নরম গলায় বললো,’কেমন আছো মেহের?’

-‘ভালো আছি। কেন ফোন করেছো?’

-‘আমি কেমন আছি সেটা জিজ্ঞেস করবে না?’

আশরাফির ভারী, বিষণ্ণ কন্ঠস্বর শুনে মধুর ভেতরে লুকিয়ে থাকা চাপা কষ্টটাকে পুনরায় জাগিয়ে দিলো। তথাপি নিজেকে সংযত করে নিলো সে। পূর্ববৎ দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’কেমন আছো?’

-‘জানার বোধহয় খুব একটা আগ্রহ নেই তোমার।’

মনে মনে দুঃখ পেলো মধু। কিন্তু জবাব দিলো না। আশরাফি পুনরায় মলিন গলায় বললো,’ঠিক আছে। আমি কেমন আছি সেটা নাহয় জানতে চাও না কিন্তু একটু স্বাভাবিকভাবে তো কথা বলতে পারো?’

আর্দ্র হয়ে এলো মধুর কন্ঠস্বর। অনুতপ্ত কণ্ঠে বললো,’আমি স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছি।’

-‘বলছো না। তুমি আমার সঙ্গে খুব খারাপ ভাবে কথা বলছো।’

-‘তোমার যদি তেমন মনে হয় তবে আমার কিছুই করার নেই।’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশরাফি। মধুর কথার জবাবে কোনরকম প্রতিবাদ না করে বললো,’তোমাকে একটা কথা জানানোর ফোন করেছি।’

-‘কি?’

-‘আমি বিয়ে করছি!’

বোধকরি, কথাটা অসম্ভব ভেবেই বিশেষ গুরুত্ব দিলো না মধু। উদাসীন কন্ঠে বললো,’কবে?’

-‘এখনো কিছু ঠিক হয় নি। কিন্তু পাত্রী স্থির!’

তখনো কথাটা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারলো না মধু। কিন্তু আচমকাই বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেলো। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’তাই নাকি?’

-‘হ্যাঁ। আমার ছাত্রী নীলা।’

প্রবল ধাক্কা খেলো মধু! ইতোপূর্বে যেই ভয়ের কথা ক্ষণকালের জন্যেও মস্তিষ্কের কোন ক্ষুদ্রতম পরিসরে উদয় হয় নি আজ হঠাৎ করেই সেই ভয় একমুহূর্তই তাঁর সমস্ত ত্যাগ,সংযম, আত্মবিশ্বাসের পাহাড়টাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলো। মুহূর্তকালের জন্য কোন কথা বলতে পারলো না। থমকে গেলো! গোটা পৃথিবীটাকে মিথ্যে মনে হলো!

আশরাফি তার জবাবের অপেক্ষায় অধীরভাবে অপেক্ষা করেছিলো। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অধৈর্য কন্ঠে বললো,’কি হলো মেহের? কথা বলছো না কেন?’

বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে আত্মসংবরণ করে নিলো মধু। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,’ভালোই তো। বিয়ে করছো এ তো খুশির খবর। তা হঠাৎ এই সুমতির কারণ?’

-‘হাঁপিয়ে গেছি মেহের। ভীষণ হাঁপিয়ে গেছি। আর পারছি না।’

তাচ্ছিল্যসের সুরে হাসলো মধু। কই সে তো হাঁপায় নি? সেতো আজও মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসে মানুষটাকে। হাঁপিয়ে যাওয়া? এসব মিথ্যে বাহানা! নিজের ভেতরের সমস্ত হতাশা, রাগ, অভিমান গিয়ে আশরাফির ওপর জমা হলো। বিদ্রুপের সুরে বললো,’কিসে হাঁপিয়েছো শুনি?’

প্রশ্নটার জবাব সাথে সাথেই দিলো না আশরাফি। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,’কিসে যে হাঁপিয়েছি সেটা তো তুমি খুব ভালো করেই জানো মেহের!’

-‘না জানি না। জানার জন্যই প্রশ্নটা করেছি।’

-‘বেশ! তাহলে শোনো, তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে হাঁপিয়ে গেছি আমি। এই যন্ত্রণা আমার ভেতরটাকে প্রতিটা মুহূর্তে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে! আমি আর নিতে পারছি না! মাঝে মাঝে মনে হয় এবার বোধহয় সত্যিই চোখ বন্ধ করে কারো কাধে মাথাটা এলিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো! আর কিছু না হোক অন্তত একটুখানি সান্ত্বনা যদি পাওয়া যেত।’

-‘মিথ্যে কথা। কেবলমাত্র সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ানোর জন্য কেউ বিয়ে করে না।’

আশরাফি হাসলো। তাঁর হাসিতে জোর নেই! কন্ঠে তেজ নেই। ভীষণ পরিশ্রান্ত, নিস্তেজ কন্ঠস্বর। ক্লান্ত নিশ্বাস ছেড়ে বললো,’তুমি কি রাগ করেছো মেহের?

থতমত খেয়ে গেলো মধুর। বিব্রত কন্ঠে বললো,’রাগ? রাগ করতে যাবো কেন? তুমি সত্যিটা স্বীকার করতে চাইছো না তাই বললাম।’

-‘তুমি ভালো করেই জানো তোমার কাছে মিথ্যে বলার মত ক্ষমতা আমার নেই।’

-‘বিয়েটা তাহলে সত্যিই করছো?’

-‘পালানোর মত যদি কোন পথ খুঁজে না পাই তবে হ্যাঁ!’

-‘ও!’ নিচের ঠোঁটটা সজোরে কামড়ে ধরলো মধু। টলমল করতে থাকা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো ভাতের থালায় ওপর। দাঁতের চাপে রক্তজমা হলো ঠোঁটে কিন্তু ‘উহ’ পর্যন্ত করলো না। তাঁর ভেতরে যেই যন্ত্রণার আগুন জ্বলছে তার তুলনায় এই সামান্য ব্যথা সত্যিই নগন্য! এর চেয়ে হাজারগুন বেশি ব্যথা হৃদয় নামক বস্তুটাকে হচ্ছে! কিন্তু মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারছে না।

ক্ষণকাল চুপ থেকে আশরাফি বললো,’তোমাকে দ্বিতীয়বার দেখার পর ভেবেছিলাম এই জীবনে আমার আর বিয়ে করা হবে না। কিন্তু পরে ভাবলাম একবার চেষ্টা করে দেখি। শুনেছি, পুরুষমানুষ চাইলে পারে না এমন কিছু নেই!’

-‘ঠিকই বলেছো। পুরুষ মানুষ চাইলেই সব পারে। আসলে মেয়েমানুষের জাতটাই বড্ড বিশ্রী, বেহায়া! একবার ভালোবেসেছে তো জন্মের মত ডুবেছে।’

তাচ্ছিল্যভরে হাসলো আশরাফি। পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ শান্ত কন্ঠে বললো,’হাসালে মেহের! আমাকে ভালোবেসে তুমি ডুবেছো? কবে, কখন,কোথায়?’ জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো মেহের। চাইলেও উত্তরটা দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। নির্মম বাস্তবতার কাছে আরো একবার নিষ্ঠুর ভাবে পরাজিত হলো তার বুকভর্তি ভালোবাসা !
আশরাফি ফের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষণ্ণ মলিন কন্ঠে বললো,’সত্যিই যদি কেউ ডুবে থাকে সে আমি ডুবেছি মেহের। তুমি নও। কারণ আমার মতো যন্ত্রণা তোমাকে ভোগ করতে হয় নি। হ্যাঁ, একথা হয়ত ঠিক যে আমি বিয়ে না করলে তোমার হয়ত কিছুটা আত্মতৃপ্তি হতো। স্বামীকে গর্ব করে বলতে পারবে কেউ একজন সারাজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলো। কিন্তু আমি? আমার তো কোনদিকেই শান্তি নেই। আমি তো বিয়ে করলেও তোমাকে পাবো না, না করলেও পাবো না। তবে তুমি কি করে ডুবলে মেহের? একূলওকূল দুকূলেই তো আমি হতভাগা ডুবলাম!’

-‘তুমি বিয়ে করলেও আমার কোন ক্ষতি নেই, না করলেও আমার কোন আত্মতৃপ্তি নেই। সুতরাং এসব অর্থহীন কথা বলার কোন মানে হয় না। আমি জাস্ট কথার কথা বলেছি। নিজের কথা নয়।’

ফের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো। ফোন কানে দিয়ে চুপ করে রইলো আশরাফি। মধুর ভেতরটা তখন নিদারুণ যন্ত্রণায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো। হতাশায় বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেলো। নারীসুলভ ঈর্ষায় বিষাক্ত হয়ে গেলো সমস্ত শরীরটা। আশরাফি চুপ থাকাটা সেই জ্বালাটাকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো। শীতল কন্ঠে বললো,’রাখছি আমি।’

-‘তোমার কষ্ট হচ্ছে মেহের। আমি বিয়ে করবো শুনে সহ্য করতে পারছো না তুমি।’

করুণমুখে হাসলো মেহের! এতক্ষণে তবে তাঁর কষ্টে খবর মিলেছে! চাপা অভিমানে বুক ভার হয়ে এলো তাঁর! নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,’মোটেও না। আমার কষ্ট হতে যাবে কেন?’

-‘কারণ তুমি এখনো আমাকেই ভালোবাসো।’

-‘এককথা বারবার বলতে ভালো লাগে না। রাখছি আমি।’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশরাফি। হতাশ কন্ঠে বললো,’ঠিক আছে রাখো। কিন্তু তার আগে আমি কি করবো সেটা বলে দাও? সোহাগ, নাঈম দুজনেই আমাকে হুমকি দিয়েছে আমি বিয়ে না করলে বাড়ি ছাড়বে ওরা। আর কোন সম্পর্ক রাখবে না আমার সাথে! আমি নাকি পরস্ত্রীলোভী! অন্যের বউকে নাকি জোর করে নিজের কাছে আটকে রাখতে চাইছি। ওরা তোমাকে আমার পর ভাবছে মেহের..!’ শেষের কথাগুলো বলার সময় ধরে এলো আশরাফির গলা। কথা শেষ করতে পারলো না সে চাপা কষ্টে কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো। ওপাশ থেকে মেহের তখন শক্ত কণ্ঠে বললো,’তো করো না বিয়ে! আমি কি আটকে রেখেছি? নাকি আমার বলার ওপর কি কিছু নির্ভর করে আছে?’

-‘এতদিনেও সেটা বুঝতে পারো নি?’

অভিমানে, যন্ত্রণায় মধুর চোখের পানি টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো। জ্বালাভরা কন্ঠে বললো,’না পারি নি। এতদিন যা জেনে এসেছি সব ভুল। আজকে সমস্তটা একেবারে জলের মতন পরিষ্কার!’

-‘আমি বিয়ে করবো বলেছি বলেই আজ সব ভুল হয়ে গেলো?’

আশরাফি যুক্তির বিপরীতে পাল্টা যুক্তি খুঁজে পেলো না মধু। মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। না পারছে সহ্য করতে না পারছে কিছু বলতে! হতাশা তাঁকে মতিচ্ছন্ন করে দিলো। রাগত কণ্ঠে বললো,’তোমার যা ইচ্ছে ভাবো। আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমি ফোন রাখছি। একটুপর আরমান খেতে আসবে। ওর খাবার রেডি করবো।’

কথা শেষ করে ফোন কেটে দিলো মধু। সম্মুখের ভাতের থালাটাকে ঠেলে সরিয়ে দিলো সে। খাবার আর মুখ রচলো না। হাত ধুয়ে উঠে গেলো। বলা বাহুল্য, শেষে আরমানের কথাটা সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই আশরাফিকে আঘাত করার জন্য বলেছে। তাঁর নিজের মধ্যে যেই ঈর্ষার আগুন জ্বলছিলো সেই আগুনের তাপ আশরাফি মধ্যেও ব্যাপ্ত করবার বৃথা প্রয়াস বলা চলে। কিন্তু প্রতিউত্তরে আশরাফি নির্বিকার মনোভাব সেই আগুনের শিখাকে দাবানলের মত তাঁর-ই সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে দিলো। বেদনার মত বুকের মধ্যে বাজতে শুরু করলো সমস্তটা। বাঁধভাঙা,উদ্বেলিত ক্রন্দনে ভেঙ্গে পড়লো সে। আশরাফি অন্য কারো হয়ে যাবে ভাবতেই বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করলো!
অথচ এতদিন যাবত সে নিজেই তাই চেয়ে এসেছে! মনেপ্রাণে প্রার্থণা করে এসেছে আশরাফি যেন তাঁকে ভুলতে পারে, নিজের মত করে বাঁচতে শিখে, হৃদয়ের শূন্যস্থান পূরণের জন্য কে যেন নতুন কাউকে বেছে নেয় কিন্তু আজ যখন সেটা সত্যিই ঘটতে চলছে তখন আর সহ্য করতে পারলো আত্মবঞ্চনাকারী, নির্বোধ নারী হৃদয়। প্রবল অধিকারবোধ জেগে উঠলো বুকের ভেতর। সবকিছু ভেঙ্গেগুড়িয়ে তছনছ করে দিতে মন চাইলো।
নারী হৃদয়ের নিগূঢ় তাৎপর্য বাস্তবিকই বড় দুর্বোধ্য। অধিকার ছেড়ে দেওয়ার মধ্যেও একধরনের প্রচ্ছন্ন অধিকার বোধ কাজ করে এদের। নতুবা স্বেচ্ছায় যেই অধিকার মধু ছেড়ে দিয়েছিলো সেই অধিকার অন্য কারো হয়ে যাবে শুনে এত কষ্ট কেন হচ্ছে তাঁর? কেন যন্ত্রণায় সমস্ত হৃদয় জ্বলছে?
তার কারণ এই যন্ত্রণার পুরোটাই তাঁর একান্ত আপন, একান্ত নিজের মানুষটার প্রতি তীব্র ভালোবাসা এবং অধিকারবোধের বহিঃপ্রকাশ! চাইলেও আজ আর এই সত্যটা অস্বীকার করতে পারলো না মধু।
.
.
.
চলবে

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৫

খাটের ওপর হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আশরাফি। একটু আগেই নীলার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথাবার্তা সব ফাইনাল করে এসেছে সোহাগ এবং নাঈম। তীব্র অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না আশরাফির। বন্ধুদের বাস্তবসম্মত যুক্তির বিপরীতে পালটা জবাব দেওয়ার মতন কোন যুক্তি ছিলো না তাঁর কাছে। তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছে।
মোটামুটি এখন ভালোই সুস্থ সে। হাঁটাচলাও করতে পারে। যদিও গতকালই প্লাস্টার খোলা হয়েছে তবে ডাক্তার বলেছে আর কোন ভয় নেই। আগের মত চলাফেরা করতে পারবে সে। তাই বন্ধুরা যততাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চাইছে। আর নীলা তো এক পায়ে খাড়া! মেয়েটাকে আশরাফি কিছুতেই বোঝাতে পারে নি এই বিয়েটা তাদের দুজনের জন্যই মস্তবড় ভুল সিদ্ধান্ত।


দুদিন আগের ঘটনা, ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মোটামুটি প্রস্তুত সোহাগ এবং নাঈম। বিয়ের জন্য কোনভাবেই আশরাফিকে রাজি করতে না পেরে শেষে এই পন্থা অবলম্বন করেছে দুই বন্ধু। এবার যদি কাজ হয়!

আশরাফি তখন বাসায় ছিলো না। ফিরে এসে ড্রয়িংরুমে একগাদা ব্যাগপত্র গোছানো দেখে মনে মনে ঝড়ের পূর্বাভাষ আন্দাজ করে নিলো সে। তথাপি দেখেও না দেখার ভান করে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলো। বই পড়ার অজুহাত দিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ। ঘন্টাখানেক বাদেই সোহাগ এবং নাঈম দুজনেই একসঙ্গে ঘরে ঢুকলো তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য। আশরাফি রাগে ফিরেও তাকালো না। পুনরায় বিদায় জানালো দুই বন্ধু।
এবারে হাতের বইটা সজোরে বন্ধ করলো আশরাফি। চেঁচিয়ে উঠে বললো,’হ্যাঁ! তো যা না। এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার বাসা থেকে। আমি কি বাধা দিয়েছি? আমি তো খারাপ। আমার মত খারাপ মানুষের সঙ্গে কেন থাকবি তোরা? তোরা তো একেকটা ন্যায়ের দেবতা! দুধে ধোয়া তুলসী পাতা। জীবনে কোন অন্যায় করিস নি! তোদের দরকার নেই আমার সঙ্গে থাকার। যা বেরিয়ে যা!’

সোহাগ প্রতিউত্তরে কিছু বলতে চাইছিলো ইশারায় বাধা দিলো নাঈম। আশরাফির কথাগুলোকে পুরোপুরি ইগ্নোর করলো সে। কোনরকম এক্সপ্লেনেশন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো আশরাফির। রাগে টেবিল বরাবর লাথি মেরে বললো,’ন্যায় অন্যায় শেখাতে এসেছে আমাকে। আমি কি তোদের চাকর? তোদের কথামত উঠবো বসবো? আমার লাইফের ডিসিশন আমি নিজেই নিতে পারি। আমার যা ভালো মনে হবে আমি তাই করবো।’

জবাবে নাঈম শান্ত গলায় বললো,’চিৎকার করে বলার কোন দরকার নেই। এমনিতেও আমরা আর তোর কোন ব্যপারে থাকবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছি। অতএব নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস তুই। হ্যাঁ! চোখের সামনে থাকলে হয়ত সহ্য করতে পারবো না। সে জন্যই তো আলাদা বাসা নিয়েছি। তোর আর কোন অসুবিধে হবে না। যা মন চায় করতে পারবি। একটা কেন একশোটা পতিতা মেয়ে নিয়ে সংসার করার চিন্তাভাবনা করলেও এখন আর কেউ বাধা দেবে না তোকে।’

রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো আশরাফির। তেড়ে গেলো সে। সোহাগও বিরক্ত হলো। ইতোপূর্বে সে এই বিষয়ে অনেকবারই বারণ করেছে নাঈমকে। তাদের কাছে মধু যতই খারাপ হোক না কেন আশরাফি মেয়েটাকে ভালোবাসে। তার সম্পর্কে খারাপ কথা বললে আশরাফির খারাপ লাগবে। কিন্তু এই সামান্য বিষয়টা কেন নাঈমের মাথায় ঢুকলো না সেটাই বুঝতে পারছিলো না সে। আশরাফি রাগে দাঁতমুখ খিঁচে নাঈমের কলার ধরে,’ওকে নিয়ে এত জ্বালা কেন তোর? কি ক্ষতি করেছে ও তোর? যা করেছে আমার সঙ্গে করেছে, তুই বলার কে? কোন সাহসে ওকে নিয়ে বাজে কথা বললি তুই?’

নাঈমও খেপে গেলো। আশরাফির এসব পাগলামি অনেক সহ্য করেছে। আর না। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। যা করেছে তোর সঙ্গে করেছে। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি সে কেন এসব করেছে। আসলে তোর মত একটা বদরাগী, মাথাখারাপ মানুষের সাথে একসঙ্গে থাকাটা যে কোন সুস্থ মানুষের পক্ষেই অসম্ভব। আর তোর শুধু মাথাখারাপই নয় ভীষণ স্বার্থপরও তুই। সেইজন্যই আমাদের বেরিয়ে যেতে বলতে পারলি!’

অবাক হলো আশরাফি! তাঁর অভিমানের কথাগুলো সত্যিই সত্যি ধরে নিলো বন্ধুরা? এতদিনেও আশরাফিকে চিনতে পারলো না? রাগে দুঃখে সেও আর কোন কিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করলো না। চেঁচিয়ে উঠে বললো,’হ্যাঁ আমি স্বার্থপর! এবার খুশি হয়েছিস তুই? যেখানে যাচ্ছিস যা। কাউকে ধরে রাখার কোন দায় পড়ে নি আমার।’

মনে মনে দুঃখ পেলো দুইবন্ধু। অথচ তারা নিজেরাও জানে এই কথাগুলো আশরাফির মনের কথা নয়। কিন্তু এইমুহূর্তে তাদের এই পাগলাটে, খেপা, সরলমনা বন্ধুটির মনের কথার কথার চাইতেও মুখের কথাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো তাদের কাছে। অবশ্য তাদের দোষ দিয়েও বা লাভ কি? আশরাফিকে বোঝাতে বোঝাতে হাঁপিয়ে গেছে দুজনে। বন্ধুত্বের মর্যাদা তো আশরাফিরও রাখা চাই? এত করে বোঝানোর পরেও সে ঘুরেফিরে মধুর কাছে ছুটে যায়। সব জেনেশুনে আবারো তাঁকে একই ভুলটা তো করতে দেওয়া যায় না। তাছাড়া ঘটনাটা যদি একবার কোনরকমস জানাজানি হয়ে যায় লোকে থুতু দেবে মুখে। নতুবা বন্ধুকে ছেড়ে যেতে কি তাদের কষ্ট হচ্ছে না? কিন্তু এছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তাদের? আশরাফির ভালোর জন্যই এই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে। তাই আশরাফির রাগের পাত্তা না দিয়ে বললো,’আসছি আমরা।’

জবাব দিলো না আশরাফি। আড়চোখে একবার চাইলো কেবল। সত্যিই সত্যিই বেরিয়ে যাচ্ছে সোহাগ এবং নাঈম! চোখে পানি চলে এলো তাঁর। সামান্য একটা কারণে এতদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে ওরা? আশরাফির কষ্টটা একবারও বোঝার চেষ্টা করলো না? এতটা খারাপ হয়ে গেছে ওদের চোখে আশরাফি? কিন্তু মুখে স্বীকার না করলেও ভেতরে ভেতরে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো তাঁর! ওরা এভাবে রাগ করে বেরিয়ে গেলে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে পারবে না সে। একা বাসায় দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে! আত্মাভিমানের ঠেলায় সেকথা আর মুখ ফুটে বলতে পারলো না। নিজের অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে রাগে,অভিমানে বাসার ভেতর ভাংচুর শুরু করে দিলো সে।

সিঁড়ি কাছে যেতে না যেতেই ভাঙচুরের বিকট আওয়াজে চমকে উঠে একে ওপরের দিকে চাইলো সোহাগ এবং নাঈম। তাদেরকে বাধা দিতে না পেরেই খেপে গেছে আশরাফি। বেশ বুঝতে পারলো যাওয়াটা আর হবে না। ভেতরে ভেতরে খুব খুশিই হলো দুইবন্ধু। কিন্তু প্রকাশ করলো না।
সোহাগ বিরক্ত গলায় বললো,’পাগল খেপেছে!’
নাঈমও কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো,’ভেবেছে এসব ছেলেমানুষি করলে ফিরে যাবো আমরা।’

-‘যাবি না?’ অবাক হয়ে উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে তাঁর মুখের দিকে রইলো সোহাগ। ভ্রু জোড়া অটোমেটিক কুঁচকে গেছে তাঁর। নাঈম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হতাশভাবে মাথা দুলিয়ে আবারো ভেতরে ঢুকলো দুই বন্ধু। দুই মিনিটেই বাসার অবস্থা কাহিল করে ফেলেছে আশরাফি। ওদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেখে ফের রাগে ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’ফিরে এলি কেন? যা বেরো! বেরো বলছি! নইলে এক্ষুনি বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবো। বেরো আমার বাসা থেকে।’

-‘ভাংচুর করে কি প্রমাণ করতে চাইছিস তুই?’

-‘কিচ্ছু প্রমাণ করতে চাইছি না। তোরা যা, বেরো আমার বাসা থেকে। অনেক করেছিস আমার জন্য আর লাগবে না।’

বন্ধুর বাধা দেওয়ার পদ্ধতি দেখে হেসে ফেললো নাঈম! ভাঙবে তবু মচকাবে না! তাকে হাসতে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আশরাফি! হাসির কারনটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না।

বাস্তবিকই বন্ধুদের সম্পর্কগুলো বড় অদ্ভুত। কখনো কখনো সম্পর্কের দায়ভার অনেক বেশি জেনেও সম্পর্কটাকে উপেক্ষা করতে পারে না কিছু মানুষ। সোহাগ এবং নাঈম তাদেরই অন্তর্ভূক্ত।
এবং মুখে যতই রাগ দেখাক না কেন মনে মনে আশরাফি নিজেও জানে তাঁর বন্ধুদুটি ঠিক কতটা ভালোবাসে তাঁকে। তার ভাঙাচোরা, উদ্দেশ্যহীন জীবনে এই বন্ধুদুটি অবদান কখনোই অস্বীকার করতে পারবে না সে। নিজের আপন মানুষের চাইতে অনেক বেশি করেছে ওরা তাঁর জন্য। সুখে দুঃখে বিপদে আপদে সবার আগে ছুটে গিয়েছে। তাঁর অসুখে রাত জেগে মেয়েদের মত সেবা করেছে। মেহের চলে যাওয়ার পর তাঁরাই ওকে সামলেছে। তাই আজ ওরা যখন ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো রাগে দুঃখে মাথা ঠিক রাখতে পারে নি সে। কিন্তু এতকিছু পরেও নিজের জেদ বজায় রেখে গম্ভীর গলায় বললো,’আমি কাউকে ফিরে আসতে বলি নি।’

নিজেকে সামলে নিলো নাঈম। নরম হলেই আশরাফি বেঁকে বসবে। তাই গম্ভীর গলায় পুনরায় বাসা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে বললো, ‘কথা ঘুরিয়ে কোন লাভ নেই রাফি। তুই ভালো করেই জানিস তোর সঙ্গে আমাদের কি সম্পর্ক? আমরা দুজন তোকে কতটা ভালোবাসি! সবসময় তিনভাইয়ের মত চলেছি তিনজন একসঙ্গে!
এতকিছুর পরেও যখন ঐ মেয়েটাই তোর কাছে সব হয়ে গেলো তখন আমাদের আর কিছু বলার নেই। ব্রোথেলের একটা বাজে মেয়ের জন্য তুই নিজের জীবন বরবাদ করতে চাইছিস কর। কিন্তু দয়া করে আমাদেরকে মুক্তি দে। এসব কথা লোক জানাজানি হলে লজ্জায় কাউকে মুখও দেখাতে পারবো না।’

জবাবে আশরাফি রাগত চেহায়ার তীব্র ব্যথার ছাপ দেখা দিলো। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। অসহায়ের কন্ঠে বললো,’আমি ওকে ভালোবাসি।’

-‘ভালোবাসিস ভালো কথা। তোকে তো কেউ ভালোবাসতে বারণ করে নি। কিন্তু এইকথাটাও তো ভুলে গেলে চলবে না সে এখন অন্য একজনের স্ত্রী? তাঁকে তাঁর নিজের মত লাইফ লিড করতে দেওয়া উচিৎ!’

সোহাগও সম্মতিসূচক মাথা দুলিয়ে বললো,’নাঈম ঠিকই বলেছে দোস্ত। মেহেরকে ওর নিজের মত থাকতে দেওয়া উচিৎ। একটা বিবাহিত মেয়ের পেছনে ঘুরে শুধুশুধু নিজের সময় নষ্ট করছিস তুই। ভালো করে একবার ভেবে দেখলে তুই নিজেই বুঝতে পারবি ঠিক করছিস না ভুল করছিস।’

এরপর অনেক বাকবিতণ্ডা, কথা কাটাকাটি হলো! কিন্তু বন্ধুরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড়। হয় আশরাফিকে মধুর চিন্তা বাদ দিতে হবে নয়ত তাদেরকে ছাড়তে হবে। শেষমেশ তাদের সিদ্ধান্তেই রাজী হতে হলো আশরাফিকে। বাধা দেওয়ার মত অবশ্য কোন পথ খোলা ছিলো না তাঁর কাছে। অনেক আগেই সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে মধু। কিন্তু এতকিছুর পরেও সে যদি শুধু একবার মুখ ফুটে আশরাফিকে বিয়ের জন্য বারণ করতো স্বেচ্ছায় সমস্ত জীবনটা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে পার করে দিতো আশরাফি! পৃথিবী আর কারো কথার শোনার কোন প্রয়োজন মনে করতো না। কারণ সে এখনো মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাঁর ওপর সমস্ত অধিকার কেবল মধুর! মধু ছাড়া অন্যকাউকে নিজের জীবনে কল্পনাও করতে পারে না সে।’ কিন্তু যার জন্য সে ভালোবাসার পাহাড় জমিয়ে ব্যাকুল হয়ে আছে সে তো মনে মনে আশরাফির জীবন নিয়ে কোনরকম মাথা না ঘামানোর পণ করে বসে আছে। নিজেকে নিষ্ঠুর, স্বার্থপর প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে সে।’

বন্ধুদের সাথে কথা শেষ করে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো আশরাফি। বন্ধুরা এই নিয়ে তেমন মাথা ঘামালো না। বরঞ্চ এতসহজে সে আশরাফিকে রাজি হবে ভাবতেও পারে নি তাঁরা। খুশিতে চোখ চকচক করে উঠলো দুজনের। একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো! রাগ করে বলুক আর যেভাবেই বলুক আশরাফি যে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তাতেই অনেক। কোনমতে একবার বিয়েটা হয়ে গেলে ঠিকই মাথা থেকে মধুর ভুত নামবে তাঁর।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here